বাজেটে চাই মসজিদ-মাদ্রাসার জন্য আলাদা বরাদ্দ by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

প্রতি বছর জুন মাস এলেই বাজেট সংক্রান্ত নতুন ভাবনায়, নতুন চিন্তায় গোটা জাতি আলোড়িত হয়। দেশে প্রতি বছর বাজেট ঘোষিত হয়। কোনো নির্দিষ্ট আর্থিক বছরের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাবকে বাজেট বলে। প্রত্যেক আর্থিক বছরের গোড়াতে ওই বছরের বিভিন্ন উৎস থেকে কী পরিমাণ অর্থ আয় হবে এবং বিভিন্ন খাতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে তার একটি বিস্তারিত বিবরণী তৈরি করা হয়।


বিবরণটির একদিকে দেখানো হয় আয়ের হিসাব, অন্যদিকে থাকে ব্যয়ের। আগামী ৭ জুন জাতীয় সংসদে ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে। এ বছর প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করা হবে।
নতুন বাজেট ঘোষণায় সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি আসবে, না আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে; তা বলা মুশকিল। দেশের সংবিধানে সকল নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। তাই কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সেই নাগরিক অধিকারের আলোকে আসন্ন বাজেটে চাই মসজিদ-মাদ্রাসার উন্নয়নসহ এর সঙ্গে জড়িতদের জন্য আলাদা বরাদ্দ।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত বাজেট হয়েছে প্রায় সব বাজেটেই শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে এ খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, এসব বাজেটে শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হলেও ইসলামী শিক্ষা হিসেবে কওমি মাদ্রাসার জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বরাদ্দ দেওয়া হয়নি দেশের আড়াই লাখ মসজিদের নির্মাণ এবং উন্নয়নসহ ইমাম-মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের বেতন বাবদ কোনো অর্থ। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মসজিদকেন্দ্রিক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনাসহ আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকে।
সর্বশেষ মসজিদ জরিপের তথ্যানুযায়ী দেশে প্রায় আড়াই লাখের বেশি মসজিদ রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য মতে, দেশে মোট নয় হাজার ৩৭৬টি আলিয়া ও ১৫ হাজার ২৫০টি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। কওমি মাদ্রাসার ওপর সরকার ও শিক্ষা বিভাগের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি। কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি। বর্তমান সরকার কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি প্রদান এবং কওমি মাদ্রাসার স্বার্থসংশিল্গষ্ট যাবতীয় বিষয়াদির সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট স্বতন্ত্র একটি 'কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন' গঠন করেছে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী গঠিত কমিশন এ লক্ষ্যে কাজও শুরু করেছে। আমরা চাই আসন্ন বাজেটে কওমি মাদ্রাসাগুলোর জন্য আলাদা বিশেষ বরাদ্দ। যে বাজেটের আওতায় কওমি ধারার শিক্ষায় শিক্ষিতরা সমাজের সর্বস্তরে সমভাবে কাজ করার সুযোগ থাকবে। এ ছাড়া অন্যান্য শিক্ষাধারার সঙ্গে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সুযোগ, শিক্ষকদের যোগ্যতার সমতা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মাদ্রাসার অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তিসহ নানাবিধ সুযোগ নিশ্চিত করা হবে।
ধর্মীয় শিক্ষার আরেকটি ধারা হলো নূরানী মক্তব ও ফুরকানিয়া মাদ্রাসা। আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসা বাদে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েক হাজার এবতেদায়ি, ফুরকানিয়া, হাফেজিয়া, নূরানী মক্তব ও এতিমখানা বিভিন্ন নামে অসংখ্য মাদ্রাসা রয়েছে। জনগণের সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতায় পরিচালিত এসব মাদ্রাসায় কওমি বা আলিয়ার শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হলেও প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণের অভাব ও ভৌত সুবিধাদির অপ্রতুলতায় শিক্ষা ব্যবস্থা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এসব মাদ্রাসার বেশিরভাগই গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত। এ ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যও বাজেটে আলাদা বরাদ্দ থাকা বাঞ্জনীয়।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ইসলামী জ্ঞান এবং নৈতিক শিক্ষা ছাড়া সৎ, নীতিবান ও যোগ্য দেশপ্রেমিক তৈরি হয় না। ধর্মীয় জ্ঞানার্জন ছাড়া সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করাও অসম্ভব। আর এ জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় বিষয়াদি ও ধর্মীয় শিক্ষা খাতগুলোতে আলাদা আলাদা বরাদ্দ। ধর্মীয় বিষয় ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দের এ প্রবণতা ইসলামের সোনালি অতীতেও ছিল। বিশেষত ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের (রা.) আমলে শিক্ষা খাত বিশেষ গুরুত্ব ও বরাদ্দ লাভ করেছিল। ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা ও কল্যাণকর পার্থিব শিক্ষাকে প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ করেছে। এ জন্য ধর্মীয় খাতে ব্যয় বরাদ্দের ওপরও অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। মানবসমাজের কল্যাণের জন্য ইসলাম এমন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করেছে, যে শিক্ষা আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে ইতিবাচক ফল বয়ে আনে ও সত্যিকারের মনুষ্যত্ব বিকাশে সহায়ক হয়। তাই আমরা চাই, ধর্মীয় শিক্ষার জন্য আলাদা বরাদ্দ। যদিও আমাদের দেশের কওমি মাদ্রাসার পরিচালকরা সরকারি অনুদান গ্রহণের বিপক্ষে মত দিয়ে আসছেন। এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, এটা নিয়ে কওমি মাদ্রাসার পরিচালকদের আবারও ভাবা উচিত। সরকার অনুদান দেবে তার নিজের টাকা দিয়ে নয়। সরকার টাকা দেবে রাজস্ব খাত থেকে। এ খাতের টাকার মালিক দেশের আপামর জনগণ; কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষ নয়। কওমি মাদ্রাসার কর্তা ব্যক্তিদের এমন মনোভাবের পেছনে শক্তিশালী কোনো যুক্তি নেই। কারণ তারা তো দেশের সর্বস্তরের জনগণের টাকা দান-অনুদান হিসেবে নিয়েই থাকেন। এমতাবস্থায় রাজস্ব খাত থেকে টাকা নিলে অসুবিধা কোথায় তা স্পষ্ট নয়। তবে এখানে যদি সরকারি নিয়ন্ত্রণ বা কোনো ধরনের শর্ত দেওয়া হয়, তাহলে সেটা আলোচনার দাবি রাখে। শুধু শুধু সরকারের প্রতি উষ্মা প্রকাশ জাতির জন্য অথবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কল্যাণকর নয়।
অন্যদিকে দেশের প্রায় আড়াই লাখ মসজিদের সাত লাখ ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম ও অন্য কর্মীদের জন্যও বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়েও বিশেষ বরাদ্দের।
muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.