গণমাধ্যম-জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সামনে কী? by মশিউল আলম
উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, পরিপূর্ণ স্বচ্ছতার পক্ষে লড়াকু সাইবার-যোদ্ধা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে যাঁরা ভালোবাসেন, গত মঙ্গলবার ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনে তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবছেন, অ্যাসাঞ্জের এখন কী হবে?
আর যাঁরা এই ‘হ্যাকার’কে মনে করেন ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস ম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, তাঁকে আল-কায়েদার জঙ্গিদের মতো
আর যাঁরা এই ‘হ্যাকার’কে মনে করেন ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস ম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’, তাঁকে আল-কায়েদার জঙ্গিদের মতো
গুলি করে মারতে চান, গুয়ানতানামো কারাগারে পাঠাতে চান, গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত আইনের আওতায় বিচার করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে চান, তাঁরা উৎফুল্লমনে ভাবছেন, এই তো বেটাকে বাগে পাওয়া গেছে!
গত মঙ্গলবার সকালে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ আদালতের সাতজন বিচারকের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রায় দিয়েছে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ইউরোপীয় প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় যুক্তরাজ্য থেকে সুইডেনে প্রত্যর্পণে কোনো আইনি বাধা নেই। তাই এখন মনে করা হচ্ছে, সুইডিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের আঠারো মাসের দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের একটি পর্যায় শেষ হতে চলেছে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এখন তাঁকে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের হাতে প্রত্যর্পণ করবে। সুইডেনে অ্যাসাঞ্জকে লড়তে হবে দুই নারীর বিরুদ্ধে; যাঁরা তাঁর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। কিন্তু অ্যাসাঞ্জের দুর্ভাগ্য, তাঁরাই তাঁর বিরুদ্ধে যৌন অসদাচরণের অভিযোগ তুলে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। অবশ্য তাঁদের অভিযোগের সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করা ব্রিটেনের সুপ্রিম কোর্টের কাজ ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের বিচার্য ছিল, অ্যাসাঞ্জকে সুইডেনে পাঠানোয় কোনো আইনি বাধা আছে কি না।
দুই সাবেক ভক্ত তরুণীর দায়ের করা মামলায় সুইডিশ প্রসিকিউটর অফিস ২০১০ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। অ্যাসাঞ্জ তখন লন্ডনে, ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অ্যাসাঞ্জ লুকিয়ে থাকতে বেশ পারঙ্গম। শেষে ইন্টারপোলের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়ান্টেড লিস্টে’ প্রচার করা হয় তাঁর নাম: আন্তর্জাতিক হুলিয়া। অ্যাসাঞ্জ তখনো পলাতক। কারণ, তাঁর বিশ্বাস, যৌন অসদাচরণের অভিযোগ আসলে অজুহাত। সুইডিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পেতে চায় আমেরিকার হাতে তুলে দিতে। কারণ, আমেরিকানদের কাছে তিনি তত দিনে হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি। ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে মার্কিন সেনাদের বর্বরতার প্রত্যক্ষ বিবরণ-সংবলিত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঠানো ‘ফিল্ড রিপোর্ট’ আর সারা বিশ্বের মার্কিন দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনগুলোর গোপন তারবার্তা—সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ গোপন নথিপত্র—উইকিলিকসের মাধ্যমে ইন্টারনেটে ফাঁস করে দিয়ে অ্যাসাঞ্জ পরিণত হয়েছেন আমেরিকার এক নম্বর শত্রুতে। তাই, তাঁর ধারণা, আমেরিকা সুইডেনকে দিয়ে তাঁকে পাকড়াও করে নিয়ে যাবে; মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত আইনের আওতায় বিচার করবে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
তাই লন্ডনে অ্যাসাঞ্জ আত্মগোপনে চলে যান। একপর্যায়ে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীদের বলে, অ্যাসাঞ্জ যেন সুইডিশ মামলাটির বিষয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে তাদের সঙ্গে দেখা করেন। ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর অ্যাসাঞ্জ তাঁর আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের এক থানায় যান পুলিশের প্রশ্নের জবাব দিতে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে এক ওয়েস্টমিনস্টার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে। অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা তাঁর জামিনের আবেদন করেন, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট নামঞ্জুর করেন। তার পরের ১০ দিন অ্যাসাঞ্জকে কাটাতে হয় দাগি কয়েদির পোশাক পরে লন্ডনের ওয়ান্ডসওয়ার্থ কারাগারে। ১৭ ডিসেম্বর তাঁকে এমন শর্তে জামিন দেওয়া হয়, তিনি লন্ডনের আশপাশেই থাকবেন, প্রতিদিন নিকটস্থ থানায় সশরীরে গিয়ে খাতায় সই করে আসবেন। তাঁর পায়ের গোড়ালিতে সব সময় বাঁধা থাকবে একটা ইলেকট্রনিক ট্যাগ। সেই থেকে আজ প্রায় ১৮ মাস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এক অদ্ভুত গৃহবন্দী, যাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়নি।
ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অ্যাসাঞ্জকে জামিন দেয়নি। অ্যাসাঞ্জ আপিল করেছেন হাইকোর্টে। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছে। অ্যাসাঞ্জ তারপর গেছেন সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পর পর দুই দিন শুনানি হলো গত ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু রায় সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হলো না। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে বলা হলো, বিচারপতিরা সময় নেবেন। কত সময়? সপ্তাহ চারেক। কিন্তু চার সপ্তাহ নয়, চার মাস পেরোনোর পর রায় এল। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সাত বিচারপতির মধ্যে পাঁচজন ভোট দিয়েছেন প্রত্যর্পণের পক্ষে, দুজন বিপক্ষে। বিচারপতিদের সভাপতি নিকোলাস ফিলিপস রায় ঘোষণা করার পর সাংবাদিকদের বলেছেন, অ্যাসাঞ্জের বিষয়টা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা মোটেও সহজ ছিল না।
আসলে, এই আঠারো মাস ধরে আইনি বিতর্ক চলেছে মূলত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। অ্যাসাঞ্জের যৌনতা-বিষয়ক অভিযোগের সঙ্গে সেটার কোনো সম্পর্কই নেই। বিষয়টা হলো, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন সুইডেনের পাবলিক প্রসিকিউটর। অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাজ্য থেকে সুইডেনে প্রত্যর্পণের আবেদনও করেছেন তিনিই। প্রশ্ন হলো, একজন প্রসিকিউটরের কি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা এবং আসামি প্রত্যর্পণের দাবি জানানোর এখতিয়ার আছে? ইউরোপীয় প্রত্যর্পণ চুক্তির একটি ধারা বলে, প্রত্যর্পণ মামলা দায়ের করতে পারবেন শুধু ‘কমপিটেন্ট জুডিশিয়াল অথরিটি’ বা যথাযথ বিচারিক কর্তৃপক্ষ। সুইডিশ পাবলিক প্রসিকিউটর এই ক্ষেত্রে যথাযথ বিচারিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন কি না—এই প্রশ্নেরই সুরাহা হচ্ছিল না এতটা সময় ধরে। অ্যাসাঞ্জের পক্ষের আইনজীবীরা বরাবর বলার চেষ্টা করেছেন, সুইডিশ পাবলিক প্রসিকিউটর যথাযথ বিচারিক কর্তৃপক্ষ হতে পারেন না; কারণ তিনি অভিযোগকারীদের পক্ষ নিয়ে বিচার করার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দণ্ড দিতে চান, তিনি বিচারকের ভূমিকা পালন করতে পারেন না। অর্থাৎ, আইন প্রয়োগকারী ও বিচারক একই কর্তৃপক্ষ হতে পারে না।
অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীদের এ যুক্তি ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টে শেষ পর্যন্ত টিকল না। তবে অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টকে চ্যালেঞ্জ করবেন বলে অ্যাসাঞ্জের প্রত্যর্পণ দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত রাখার আর্জিসহ একটি ‘জরুরি আবেদন’ জানালে সুপ্রিম কোর্ট সেটা মঞ্জুর করেছে। অর্থাৎ, অ্যাসাঞ্জকে এখনই সুইডেনে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। সামনে আরও দুই সপ্তাহ সময় আছে। এর মধ্যে অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আরও কিছু যুক্তিতর্ক, বক্তব্য তুলে ধরবেন। সেসবও যদি ধোপে না টেকে, তাহলে অ্যাসাঞ্জের সামনে থাকবে আরও একটা ধাপ: তিনি আপিল করবেন ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে। ইউরোপীয় আদালত ১৪ দিনের মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে। অর্থাৎ, মোট আরও এক মাস অ্যাসাঞ্জ লন্ডনেই থাকছেন।
কিন্তু তারপর? অ্যাসাঞ্জকে তো শেষ পর্যন্ত সুইডেনে যেতেই হবে। সেখানে তাঁকে মুখোমুখি হতে হবে তাঁর সাবেক ভক্ত দুই তরুণীর তোলা সেই সব অপ্রীতিকর অভিযোগের। তার চেয়েও গুরুতর বিষয় হলো, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যখন তাঁকে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবে, তখন সুইডিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে কারাগারে। যে মামলার তদন্ত এখনো শুরুই হয়নি, কবে সেই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে, কত দিন ধরে তার শুনানি চলবে, কে জানে। আর এই পুরোটা সময় অ্যাসাঞ্জকে কাটাতে হবে সুইডেনের কারাগারে; ব্রিটেনের মতো গৃহবন্দী হিসেবে নয়, পুরোপুরি কারাবন্দী হিসেবে। আর, নিউইয়র্ক টাইমস-এর দুই প্রতিবেদক জন এফ বার্নস ও রবি সোমাইয়া, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকস নিয়ে রিপোর্ট করছেন, তাঁরা যে রকম আভাস দিচ্ছেন, তাতে শঙ্কা হচ্ছে, অ্যাসাঞ্জের সামনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। স্ট্র্যাটফোর নামের এক মার্কিন বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যভান্ডার থেকে উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপন ই-মেইল থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, অ্যাসাঞ্জকে সুইডেন থেকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভেতরে ভেতরে কী কী তৎপরতা চলছে। মঙ্গলবার ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার পর উইকিলিকস তাদের ওয়েবসাইটে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে একযোগে তৎপর হয়ে উঠেছে ব্রিটেন, সুইডেন ও আমেরিকা। এমনকি তাঁর স্বদেশ অস্ট্রেলিয়ার সরকারও ওই তিনটি দেশের সরকারের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com
গত মঙ্গলবার সকালে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ আদালতের সাতজন বিচারকের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রায় দিয়েছে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ইউরোপীয় প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় যুক্তরাজ্য থেকে সুইডেনে প্রত্যর্পণে কোনো আইনি বাধা নেই। তাই এখন মনে করা হচ্ছে, সুইডিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের আঠারো মাসের দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের একটি পর্যায় শেষ হতে চলেছে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এখন তাঁকে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের হাতে প্রত্যর্পণ করবে। সুইডেনে অ্যাসাঞ্জকে লড়তে হবে দুই নারীর বিরুদ্ধে; যাঁরা তাঁর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। কিন্তু অ্যাসাঞ্জের দুর্ভাগ্য, তাঁরাই তাঁর বিরুদ্ধে যৌন অসদাচরণের অভিযোগ তুলে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। অবশ্য তাঁদের অভিযোগের সত্য-মিথ্যা নির্ধারণ করা ব্রিটেনের সুপ্রিম কোর্টের কাজ ছিল না। সুপ্রিম কোর্টের বিচার্য ছিল, অ্যাসাঞ্জকে সুইডেনে পাঠানোয় কোনো আইনি বাধা আছে কি না।
দুই সাবেক ভক্ত তরুণীর দায়ের করা মামলায় সুইডিশ প্রসিকিউটর অফিস ২০১০ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। অ্যাসাঞ্জ তখন লন্ডনে, ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অ্যাসাঞ্জ লুকিয়ে থাকতে বেশ পারঙ্গম। শেষে ইন্টারপোলের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়ান্টেড লিস্টে’ প্রচার করা হয় তাঁর নাম: আন্তর্জাতিক হুলিয়া। অ্যাসাঞ্জ তখনো পলাতক। কারণ, তাঁর বিশ্বাস, যৌন অসদাচরণের অভিযোগ আসলে অজুহাত। সুইডিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পেতে চায় আমেরিকার হাতে তুলে দিতে। কারণ, আমেরিকানদের কাছে তিনি তত দিনে হয়ে উঠেছেন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি। ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে মার্কিন সেনাদের বর্বরতার প্রত্যক্ষ বিবরণ-সংবলিত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঠানো ‘ফিল্ড রিপোর্ট’ আর সারা বিশ্বের মার্কিন দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনগুলোর গোপন তারবার্তা—সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ গোপন নথিপত্র—উইকিলিকসের মাধ্যমে ইন্টারনেটে ফাঁস করে দিয়ে অ্যাসাঞ্জ পরিণত হয়েছেন আমেরিকার এক নম্বর শত্রুতে। তাই, তাঁর ধারণা, আমেরিকা সুইডেনকে দিয়ে তাঁকে পাকড়াও করে নিয়ে যাবে; মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তি-সংক্রান্ত আইনের আওতায় বিচার করবে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
তাই লন্ডনে অ্যাসাঞ্জ আত্মগোপনে চলে যান। একপর্যায়ে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীদের বলে, অ্যাসাঞ্জ যেন সুইডিশ মামলাটির বিষয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে তাদের সঙ্গে দেখা করেন। ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর অ্যাসাঞ্জ তাঁর আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের এক থানায় যান পুলিশের প্রশ্নের জবাব দিতে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে এক ওয়েস্টমিনস্টার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে। অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা তাঁর জামিনের আবেদন করেন, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট নামঞ্জুর করেন। তার পরের ১০ দিন অ্যাসাঞ্জকে কাটাতে হয় দাগি কয়েদির পোশাক পরে লন্ডনের ওয়ান্ডসওয়ার্থ কারাগারে। ১৭ ডিসেম্বর তাঁকে এমন শর্তে জামিন দেওয়া হয়, তিনি লন্ডনের আশপাশেই থাকবেন, প্রতিদিন নিকটস্থ থানায় সশরীরে গিয়ে খাতায় সই করে আসবেন। তাঁর পায়ের গোড়ালিতে সব সময় বাঁধা থাকবে একটা ইলেকট্রনিক ট্যাগ। সেই থেকে আজ প্রায় ১৮ মাস জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এক অদ্ভুত গৃহবন্দী, যাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়নি।
ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অ্যাসাঞ্জকে জামিন দেয়নি। অ্যাসাঞ্জ আপিল করেছেন হাইকোর্টে। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছে। অ্যাসাঞ্জ তারপর গেছেন সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পর পর দুই দিন শুনানি হলো গত ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু রায় সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হলো না। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে বলা হলো, বিচারপতিরা সময় নেবেন। কত সময়? সপ্তাহ চারেক। কিন্তু চার সপ্তাহ নয়, চার মাস পেরোনোর পর রায় এল। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সাত বিচারপতির মধ্যে পাঁচজন ভোট দিয়েছেন প্রত্যর্পণের পক্ষে, দুজন বিপক্ষে। বিচারপতিদের সভাপতি নিকোলাস ফিলিপস রায় ঘোষণা করার পর সাংবাদিকদের বলেছেন, অ্যাসাঞ্জের বিষয়টা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা মোটেও সহজ ছিল না।
আসলে, এই আঠারো মাস ধরে আইনি বিতর্ক চলেছে মূলত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। অ্যাসাঞ্জের যৌনতা-বিষয়ক অভিযোগের সঙ্গে সেটার কোনো সম্পর্কই নেই। বিষয়টা হলো, অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন সুইডেনের পাবলিক প্রসিকিউটর। অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাজ্য থেকে সুইডেনে প্রত্যর্পণের আবেদনও করেছেন তিনিই। প্রশ্ন হলো, একজন প্রসিকিউটরের কি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা এবং আসামি প্রত্যর্পণের দাবি জানানোর এখতিয়ার আছে? ইউরোপীয় প্রত্যর্পণ চুক্তির একটি ধারা বলে, প্রত্যর্পণ মামলা দায়ের করতে পারবেন শুধু ‘কমপিটেন্ট জুডিশিয়াল অথরিটি’ বা যথাযথ বিচারিক কর্তৃপক্ষ। সুইডিশ পাবলিক প্রসিকিউটর এই ক্ষেত্রে যথাযথ বিচারিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন কি না—এই প্রশ্নেরই সুরাহা হচ্ছিল না এতটা সময় ধরে। অ্যাসাঞ্জের পক্ষের আইনজীবীরা বরাবর বলার চেষ্টা করেছেন, সুইডিশ পাবলিক প্রসিকিউটর যথাযথ বিচারিক কর্তৃপক্ষ হতে পারেন না; কারণ তিনি অভিযোগকারীদের পক্ষ নিয়ে বিচার করার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দণ্ড দিতে চান, তিনি বিচারকের ভূমিকা পালন করতে পারেন না। অর্থাৎ, আইন প্রয়োগকারী ও বিচারক একই কর্তৃপক্ষ হতে পারে না।
অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীদের এ যুক্তি ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টে শেষ পর্যন্ত টিকল না। তবে অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টকে চ্যালেঞ্জ করবেন বলে অ্যাসাঞ্জের প্রত্যর্পণ দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত রাখার আর্জিসহ একটি ‘জরুরি আবেদন’ জানালে সুপ্রিম কোর্ট সেটা মঞ্জুর করেছে। অর্থাৎ, অ্যাসাঞ্জকে এখনই সুইডেনে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। সামনে আরও দুই সপ্তাহ সময় আছে। এর মধ্যে অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আরও কিছু যুক্তিতর্ক, বক্তব্য তুলে ধরবেন। সেসবও যদি ধোপে না টেকে, তাহলে অ্যাসাঞ্জের সামনে থাকবে আরও একটা ধাপ: তিনি আপিল করবেন ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে। ইউরোপীয় আদালত ১৪ দিনের মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে। অর্থাৎ, মোট আরও এক মাস অ্যাসাঞ্জ লন্ডনেই থাকছেন।
কিন্তু তারপর? অ্যাসাঞ্জকে তো শেষ পর্যন্ত সুইডেনে যেতেই হবে। সেখানে তাঁকে মুখোমুখি হতে হবে তাঁর সাবেক ভক্ত দুই তরুণীর তোলা সেই সব অপ্রীতিকর অভিযোগের। তার চেয়েও গুরুতর বিষয় হলো, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ যখন তাঁকে সুইডিশ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেবে, তখন সুইডিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে কারাগারে। যে মামলার তদন্ত এখনো শুরুই হয়নি, কবে সেই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে, কত দিন ধরে তার শুনানি চলবে, কে জানে। আর এই পুরোটা সময় অ্যাসাঞ্জকে কাটাতে হবে সুইডেনের কারাগারে; ব্রিটেনের মতো গৃহবন্দী হিসেবে নয়, পুরোপুরি কারাবন্দী হিসেবে। আর, নিউইয়র্ক টাইমস-এর দুই প্রতিবেদক জন এফ বার্নস ও রবি সোমাইয়া, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকস নিয়ে রিপোর্ট করছেন, তাঁরা যে রকম আভাস দিচ্ছেন, তাতে শঙ্কা হচ্ছে, অ্যাসাঞ্জের সামনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। স্ট্র্যাটফোর নামের এক মার্কিন বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যভান্ডার থেকে উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপন ই-মেইল থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, অ্যাসাঞ্জকে সুইডেন থেকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভেতরে ভেতরে কী কী তৎপরতা চলছে। মঙ্গলবার ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার পর উইকিলিকস তাদের ওয়েবসাইটে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে একযোগে তৎপর হয়ে উঠেছে ব্রিটেন, সুইডেন ও আমেরিকা। এমনকি তাঁর স্বদেশ অস্ট্রেলিয়ার সরকারও ওই তিনটি দেশের সরকারের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com
No comments