চারদিক-গুণতীর্থ, কাশতলায় কবির জন্মদিনে by মামুনুর রশীদ
সেই ’৬৭ কি ’৬৮ সালের কথা। নির্মলেন্দু গুণের বাড়ি গিয়েছিলাম। সম্ভবত তখন ছিল শরৎকাল। সকালবেলায় মানুষজনের কোলাহলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। শত শত মানুষ বারহাট্টা স্টেশনের দিকে ছুটছে। গুণও ছুটছে। কী ব্যাপার? গুণই এসে জানান দিল ডিজেলচালিত ট্রেন ইঞ্জিন এসেছে আজকেই। তাই মানুষের এত আনন্দ।
মানুষ পুষ্পবৃষ্টি করেছিল ইঞ্জিনের মাথায়। কয়লার ইঞ্জিনগুলো তখন চলত অবহেলিত এলাকাগুলোতে। সেই অবহেলা থেকে এই এলাকা মুক্তি পেল ডিজেল ইঞ্জিন এল বলে। এত দিন কয়লার ইঞ্জিনে ওঠা মানুষগুলো যেন একটা নতুন মর্যাদা পেল। সেই বয়সে বিষয়টা আমার কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি। কারণ, আমার এলাকায় ট্রেনই ছিল না। এখন বুঝি উন্নত প্রযুক্তিতে মানুষ নিজেকে কতটা সম্মানিত বোধ করে।
আজ ৪২ বছর পর আবার চলেছি সেই পথে। ট্রেন আজ পরিত্যক্ত পরিবহন। ছুটেছি মাইক্রোবাসে। সেদিনের সেই অখ্যাত নির্মলেন্দু গুণ এবং তার গ্রাম কাশতলা আজ সুবিখ্যাত নির্মলেন্দু গুণের গৃহ; গৃহটি আজ তীর্থে পরিণত হতে চলেছে। বহুবার অপারগতার পর কথা রাখতে ছুটেছি তীর্থে। তীর্থে যাওয়ার আনন্দ অপার। পথ দীর্ঘ, তবে সুদীর্ঘ নয়। ঢাকা থেকে ১৫০ কিলোমিটার, ময়মনসিংহ হয়ে নেত্রকোনা পেরিয়ে কাশতলা। আমার সঙ্গে তিন অনুরাগী—অনন্ত হীরা, অমিত মল্লিক ও মাসুদ। তিনজনই শিল্পের লোক। অনন্ত হীরা নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা, অমিত সংগীতশিল্পী এবং মাসুদ স্থপতি ও অভিনেতা। সূর্যালোকিত ভোরে রওনা দিলেও পথে বৃষ্টি নামল। পথিমধ্যে মনে হলো আরেকজন সঙ্গী হলে ভালোই হতো। ভালুকার গাড়োবাজার থেকে আমাদের সঙ্গী হলেন চাষি আবদুল আজিজ কোম্পানি, যিনি এবার চ্যানেল আইয়ের শ্রেষ্ঠ কৃষকের সম্মাননা ‘স্বর্ণপদক’ পেয়েছেন। তাঁর বাগানের নানা ফলফুলের উদ্ভাবনী এক নজর দেখতেই হলো। পথে আমারই এক আত্মীয়ের গড়া বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অর্কিড বাগান। বাগানে নেমে বেশ বড় একটা অর্কিডের গুচ্ছ নিলাম নির্মলেন্দু গুণের জন্য; যার আজ ৬৬তম জন্মদিন (২১ জুন)। আর এ উপলক্ষে কাশতলাবাসী প্রতিবছর জন্মদিন পালন করে থাকে বেশ সমারোহেই। পথে ভালো করেই বৃষ্টি এল। পথবিভ্রমও হলো। শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি মাথায় করে পৌঁছালাম কাশতলায়। বৃষ্টি-প্লাবিত কাশতলায় বেশ একটা সংবর্ধনার ব্যবস্থা। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সমাবেশে নারী-পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত সরল আনন্দ উৎসব। শামিয়ানার নিচে দাঁড়াতেই বৃষ্টি আমাদের বাধা দিল দু-দুবার। অগত্যা জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতাটুকু করতে হলো স্কুলের ভেতরে। চারদিকে স্কুল, পাঠাগার এবং পুকুর। কাশতলায় নতুন স্কুলঘর, হালটের পথের জায়গায় পাকা রাস্তা একেবারে স্কুল পর্যন্ত। এসব কিছুই ছিল না সেই ষাটের দশকে। নির্মলেন্দু গুণের ঠাকুরদাদা রামসুন্দর গুণ চৌধুরী ১০০ বছর আগে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেটি ছিল নেত্রকোনার দ্বিতীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৯১ সালে নির্মলেন্দু গুণ নিজেই প্রতিষ্ঠা করল কাশবন বিদ্যানিকেতন। বর্তমানে সেই হাইস্কুল এবং এ বছর এমপিওভুক্ত হওয়ায় এলাকাবাসীর আনন্দের সীমা নেই। বাবা-কাকার সম্পত্তিতে একটা পুকুরও কাটা হয়েছে শুভেন্দু-সুখেন্দু সরোবর নামে। পাঠাগার-সংগ্রহশালাও স্থাপিত হয়েছে। গুণ কি রবীন্দ্রনাথের পথে যাচ্ছে? জানলাম, ইতিমধ্যেই সেখানে নাটক হওয়া শুরু হয়েছে। স্কুলের শিক্ষক শ্যামল ও ফখরুদ্দিনের কণ্ঠেও আশাবাদ। আসলে গুণকেও এখন কাব্যচর্চার নেশা ছেড়ে জনসেবায় পেয়ে বসেছে। তার অর্জিত অর্থ সে এখানেই খরচ করছে। সেই ৪২ বছর পরে ওর ভগ্নি ঝিল্লি ও পল্টুর সঙ্গেও দেখা হলো। ওরা কত বড় হয়ে গেছে। দেখা হলো না যাদের সঙ্গে তারা এখন পরপারে অথবা ’৭১-এর পর ভারত থেকে দেশে ফেরেনি। তার বাবার সস্নেহ সম্ভাষণের বঞ্চনাও বোধ করলাম। গুণকে নিয়ে আমি একটি গানও লিখেছিলাম। গানটি এ রকম:
জন্মেই তুমি দেখেছিলে ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি
হুলিয়া নিয়ে কেটেছে তোমার যৌবন
তবু তুমি ফিরে এসেছ বারবার
কাশতলায়।
একাত্তরে তুমি ঘুরেফিরে ছুটে গেছ সীমান্তে সুদূরে।
তুমি যেন সেই ফিরে আসো সূর্যোদয়ের ভোরে।
পঁচাত্তরে মধ্যরাতের রক্তক্ষরণ
কলম তোমার থামেনি তখন
সূর্যের রশ্মিতে করলে আবিষ্কার
শেখ মুজিব—
শেখ মুজিব—
রবীন্দ্রনাথের ছায়া দেখি তোমায়
সুকান্ত-নজরুল মিশে আছে সেথায়
আছে মায়াকোভস্কি পাবলো নেরুদা—
আর চেতনায় চে-গেভারা।
অমিত গিটারে গানটি গাইল। দীর্ঘ শ্মশ্রুমণ্ডিত অবয়বে গুণের অভিব্যক্তিটি বোঝা গেল না।
২১ জুন ৭ আষাঢ় গুণের জন্মদিনে আবার ঘনিয়ে এল আষাঢ়। শাওন ওয়াহেদের মাইক্রোবাস জল-সিঞ্চিত রভসে যাত্রা করল ঢাকার পথে। ৪২ বছর পর আবার স্মৃতিতে আরেকটি দিন যুক্ত হলো সোনালি মোড়কে।
আজ ৪২ বছর পর আবার চলেছি সেই পথে। ট্রেন আজ পরিত্যক্ত পরিবহন। ছুটেছি মাইক্রোবাসে। সেদিনের সেই অখ্যাত নির্মলেন্দু গুণ এবং তার গ্রাম কাশতলা আজ সুবিখ্যাত নির্মলেন্দু গুণের গৃহ; গৃহটি আজ তীর্থে পরিণত হতে চলেছে। বহুবার অপারগতার পর কথা রাখতে ছুটেছি তীর্থে। তীর্থে যাওয়ার আনন্দ অপার। পথ দীর্ঘ, তবে সুদীর্ঘ নয়। ঢাকা থেকে ১৫০ কিলোমিটার, ময়মনসিংহ হয়ে নেত্রকোনা পেরিয়ে কাশতলা। আমার সঙ্গে তিন অনুরাগী—অনন্ত হীরা, অমিত মল্লিক ও মাসুদ। তিনজনই শিল্পের লোক। অনন্ত হীরা নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা, অমিত সংগীতশিল্পী এবং মাসুদ স্থপতি ও অভিনেতা। সূর্যালোকিত ভোরে রওনা দিলেও পথে বৃষ্টি নামল। পথিমধ্যে মনে হলো আরেকজন সঙ্গী হলে ভালোই হতো। ভালুকার গাড়োবাজার থেকে আমাদের সঙ্গী হলেন চাষি আবদুল আজিজ কোম্পানি, যিনি এবার চ্যানেল আইয়ের শ্রেষ্ঠ কৃষকের সম্মাননা ‘স্বর্ণপদক’ পেয়েছেন। তাঁর বাগানের নানা ফলফুলের উদ্ভাবনী এক নজর দেখতেই হলো। পথে আমারই এক আত্মীয়ের গড়া বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অর্কিড বাগান। বাগানে নেমে বেশ বড় একটা অর্কিডের গুচ্ছ নিলাম নির্মলেন্দু গুণের জন্য; যার আজ ৬৬তম জন্মদিন (২১ জুন)। আর এ উপলক্ষে কাশতলাবাসী প্রতিবছর জন্মদিন পালন করে থাকে বেশ সমারোহেই। পথে ভালো করেই বৃষ্টি এল। পথবিভ্রমও হলো। শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি মাথায় করে পৌঁছালাম কাশতলায়। বৃষ্টি-প্লাবিত কাশতলায় বেশ একটা সংবর্ধনার ব্যবস্থা। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সমাবেশে নারী-পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত সরল আনন্দ উৎসব। শামিয়ানার নিচে দাঁড়াতেই বৃষ্টি আমাদের বাধা দিল দু-দুবার। অগত্যা জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতাটুকু করতে হলো স্কুলের ভেতরে। চারদিকে স্কুল, পাঠাগার এবং পুকুর। কাশতলায় নতুন স্কুলঘর, হালটের পথের জায়গায় পাকা রাস্তা একেবারে স্কুল পর্যন্ত। এসব কিছুই ছিল না সেই ষাটের দশকে। নির্মলেন্দু গুণের ঠাকুরদাদা রামসুন্দর গুণ চৌধুরী ১০০ বছর আগে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেটি ছিল নেত্রকোনার দ্বিতীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৯১ সালে নির্মলেন্দু গুণ নিজেই প্রতিষ্ঠা করল কাশবন বিদ্যানিকেতন। বর্তমানে সেই হাইস্কুল এবং এ বছর এমপিওভুক্ত হওয়ায় এলাকাবাসীর আনন্দের সীমা নেই। বাবা-কাকার সম্পত্তিতে একটা পুকুরও কাটা হয়েছে শুভেন্দু-সুখেন্দু সরোবর নামে। পাঠাগার-সংগ্রহশালাও স্থাপিত হয়েছে। গুণ কি রবীন্দ্রনাথের পথে যাচ্ছে? জানলাম, ইতিমধ্যেই সেখানে নাটক হওয়া শুরু হয়েছে। স্কুলের শিক্ষক শ্যামল ও ফখরুদ্দিনের কণ্ঠেও আশাবাদ। আসলে গুণকেও এখন কাব্যচর্চার নেশা ছেড়ে জনসেবায় পেয়ে বসেছে। তার অর্জিত অর্থ সে এখানেই খরচ করছে। সেই ৪২ বছর পরে ওর ভগ্নি ঝিল্লি ও পল্টুর সঙ্গেও দেখা হলো। ওরা কত বড় হয়ে গেছে। দেখা হলো না যাদের সঙ্গে তারা এখন পরপারে অথবা ’৭১-এর পর ভারত থেকে দেশে ফেরেনি। তার বাবার সস্নেহ সম্ভাষণের বঞ্চনাও বোধ করলাম। গুণকে নিয়ে আমি একটি গানও লিখেছিলাম। গানটি এ রকম:
জন্মেই তুমি দেখেছিলে ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি
হুলিয়া নিয়ে কেটেছে তোমার যৌবন
তবু তুমি ফিরে এসেছ বারবার
কাশতলায়।
একাত্তরে তুমি ঘুরেফিরে ছুটে গেছ সীমান্তে সুদূরে।
তুমি যেন সেই ফিরে আসো সূর্যোদয়ের ভোরে।
পঁচাত্তরে মধ্যরাতের রক্তক্ষরণ
কলম তোমার থামেনি তখন
সূর্যের রশ্মিতে করলে আবিষ্কার
শেখ মুজিব—
শেখ মুজিব—
রবীন্দ্রনাথের ছায়া দেখি তোমায়
সুকান্ত-নজরুল মিশে আছে সেথায়
আছে মায়াকোভস্কি পাবলো নেরুদা—
আর চেতনায় চে-গেভারা।
অমিত গিটারে গানটি গাইল। দীর্ঘ শ্মশ্রুমণ্ডিত অবয়বে গুণের অভিব্যক্তিটি বোঝা গেল না।
২১ জুন ৭ আষাঢ় গুণের জন্মদিনে আবার ঘনিয়ে এল আষাঢ়। শাওন ওয়াহেদের মাইক্রোবাস জল-সিঞ্চিত রভসে যাত্রা করল ঢাকার পথে। ৪২ বছর পর আবার স্মৃতিতে আরেকটি দিন যুক্ত হলো সোনালি মোড়কে।
No comments