স্মরণ-উপমহাদেশের সাংবাদিকতা জগতের পথিকৃৎ by শেখ আবদুস সালাম
বাঙালিকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন মানিক মিয়া। সাংবাদিকতা চর্চায়, তার লেখায় এই ভালোবাসা নানাভাবে প্রতিমূর্ত হয়ে উঠেছিল। সময় ও সমাজ বদলের মোক্ষম হাতিয়াররূপে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা পেশাকে। সুদূরপ্রসারী মিশন ও ভিশন নিয়ে একজন সুদক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে তিনি তার পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল পাঠকগোষ্ঠী
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া উপমহাদেশের সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম পথিকৃৎ কলমসৈনিক। ডাক নাম মানিক মিয়া। ছদ্মনাম মুসাফির। গতানুগতিক কলমজীবী না হয়ে আদর্শ রাজনীতি ও সমাজচেতনার কালপুরুষরূপে তিনি এ দেশের সাংবাদিকতায় এক কালজয়ী অবদান রেখে গেছেন। কলমসৈনিক ও রাজনীতিবিদ মানিক মিয়ার কর্মকাণ্ড ছিল বিশাল অবয়বে পরিব্যাপ্ত। জাতীয় রাজনীতির অতন্দ্র প্রহরী মানিক মিয়া তার আদর্শ ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে বাঙালির ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় স্থান করে নিয়েছেন।
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম দিকপাল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ অনুসারী। সহকর্মী ও সহমর্মী হিসেবে এ দেশের রাজনীতির সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্ক বা যোগসূত্রেরই কার্যকর প্রতিফলন ঘটে তার 'রাজনৈতিক মঞ্চ' কলামের মধ্য দিয়ে। রাজনীতি ও সমাজ সচেতনতায় তার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণে সে সময় তার কলামটি হয়ে ওঠে দেশবাসীর জন্য রাজনীতির এক দূরশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানস্বরূপ। রাজনীতি ছাড়াও তার কলামে স্থান পেয়েছে অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ জীবনঘনিষ্ঠ নানা প্রসঙ্গ। বস্তুত তার বহুল পঠিত ও আলোচিত কলামের মাধ্যমে তার জীবদ্দশায় তিনি হয়ে ওঠেন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও পথিকৃৎ জাতীয় ব্যক্তিত্বরূপে।
১৯৪৬ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা থেকে 'ইত্তেহাদ' নামের একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আবুল মনসুর আহমেদকে 'দৈনিক ইত্তেহাদে'র সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। মানিক মিয়া এ সময় মুসলিম লীগ অফিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে 'ইত্তেহাদে'র পরিচালনা বিভাগে সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা দিয়ে এ সময় তিনি সবাইকে মুগ্ধ করেন। সাংবাদিকতায় মানিক মিয়ার প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে এই পত্রিকার মাধ্যমেই। আর এ সময় থেকেই তার রাজনৈতিক রচনার হাতেখড়ি। এক বছরের কিছু বেশি সময় তিনি এই পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকাটি সে সময় সব দিক দিয়েই একটি প্রথম শ্রেণীর বাংলা দৈনিক ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর রাজনৈতিক কারণে এ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে মানিক মিয়া ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগের বিরোধী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটলে সে বছরই এই নতুন দলের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর ১৯৫১-এর ১৪ আগস্ট থেকে এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিকরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ইত্তেফাক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মানিক মিয়া ধীরে ধীরে পত্রিকাটিকে মুসলিম লীগবিরোধী ও পূর্ব বাংলার বঞ্চিত জনগণের মুখপত্র হিসেবে গড়ে তোলেন। ইত্তেফাক অল্পদিনেই সাধারণ পাঠক তথা গণমানুষের পত্রিকা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির পেছনে দৈনিক ইত্তেফাক সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। আর এ ক্ষেত্রে 'মুসাফিরে'র 'রাজনৈতিক মঞ্চ' কলামটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।
মানিক মিয়া মুসাফির ছদ্মনামে 'রাজনৈতিক মঞ্চ' কলামটিতে অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়, অন্তরঙ্গ অথচ তীক্ষষ্টভাবে মুসলিম লীগ সরকারের নানা বৈষম্য, অবিচার, অত্যাচার ও বঞ্চনার কাহিনী তুলে ধরতেন। পাঠকরা পরম আগ্রহভরে এই কলামটি পড়ার জন্য অপেক্ষা করত এবং পত্রিকাটি হাতে পেলে যেন গোগ্রাসে তা পড়ে ফেলত।
১৯৫৪ সালের পর পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে যে ভাঙা-গড়ার সূত্রপাত হয়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার ওপর যে বৈষম্য, অবিচার আর বঞ্চনা চাপিয়ে দেয় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তার তীব্র বিরোধিতা করেন। আগুন ঝরা লেখনীর মাধ্যমে স্বৈরশাসনের মুখোশ উন্মোচন করেন। আর তাই স্বর্থান্বেষী কেন্দ্রীয় শাসকচক্র তার লেখা সহ্য করতে পারেনি। তাকে বারবার রাজরোষে পড়তে হয়েছে। কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে বহুবার। তার পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইনের চোখে তাকে কখনোই দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি।
১৯৫৫ সালে ইত্তেফাকের প্রকাশনা কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৫৯ সালে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে সামরিক আইন লঙ্ঘনের মিথ্যা অজুহাতে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করলে পূর্ব বাংলায় যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল, তা দমনের জন্য অন্য অনেক নেতার সঙ্গে মানিক মিয়াকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের ডাকে পূর্ব বাংলায় যে হরতাল পালিত হয়, সে সময়ও মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয় এবং সে সঙ্গে 'নিউ নেশন প্রেস' বাজেয়াপ্ত করা হয়। ফলে ইত্তেফাক বন্ধ হয়ে যায়। পরে অবশ্য প্রেস বাজেয়াপ্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রায়ে তিনি জয়লাভ করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার অর্ডিন্যান্স সংশোধন করে দ্বিতীয়বার এ প্রেস বাজেয়াপ্ত করে। এ সময় মানিক মিয়া দীর্ঘ ১০ মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের ফলে আইয়ুব সরকার পুনরায় ইত্তেফাক প্রকাশের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। নৈতিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৬৯
সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক পুনঃপ্রকাশিত হয়।
ইত্তেফাকের সাংগঠনিক কাজে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ১৯৬৯ সালের ২৬ মে রাওয়ালপিন্ডি গমন করেন এবং
১ জুন সেখানকার এক হোটেলে
তিনি আকস্মিকভাবে মৃত্যুমুখে
পতিত হন।
বাঙালিকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন মানিক মিয়া। সাংবাদিকতা চর্চায়, তার লেখায় এই ভালোবাসা নানাভাবে প্রতিমূর্ত হয়ে উঠেছিল। সময় ও সমাজ বদলের মোক্ষম হাতিয়াররূপে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা পেশাকে। সুদূরপ্রসারী মিশন ও ভিশন নিয়ে একজন সুদক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে তিনি তার পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল পাঠকগোষ্ঠী।
সমাজসেবার ক্ষেত্রেও মানিক মিয়ার ভূমিকা ছিল অনন্য। পিরোজপুর জেলার বহু স্থানে বিশেষ করে জন্মস্থান ভাণ্ডারিয়া এলাকায় তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ড. শেখ আবদুস সালাম :অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম দিকপাল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ অনুসারী। সহকর্মী ও সহমর্মী হিসেবে এ দেশের রাজনীতির সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্ক বা যোগসূত্রেরই কার্যকর প্রতিফলন ঘটে তার 'রাজনৈতিক মঞ্চ' কলামের মধ্য দিয়ে। রাজনীতি ও সমাজ সচেতনতায় তার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কারণে সে সময় তার কলামটি হয়ে ওঠে দেশবাসীর জন্য রাজনীতির এক দূরশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানস্বরূপ। রাজনীতি ছাড়াও তার কলামে স্থান পেয়েছে অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ জীবনঘনিষ্ঠ নানা প্রসঙ্গ। বস্তুত তার বহুল পঠিত ও আলোচিত কলামের মাধ্যমে তার জীবদ্দশায় তিনি হয়ে ওঠেন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও পথিকৃৎ জাতীয় ব্যক্তিত্বরূপে।
১৯৪৬ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা থেকে 'ইত্তেহাদ' নামের একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আবুল মনসুর আহমেদকে 'দৈনিক ইত্তেহাদে'র সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। মানিক মিয়া এ সময় মুসলিম লীগ অফিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে 'ইত্তেহাদে'র পরিচালনা বিভাগে সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা দিয়ে এ সময় তিনি সবাইকে মুগ্ধ করেন। সাংবাদিকতায় মানিক মিয়ার প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে এই পত্রিকার মাধ্যমেই। আর এ সময় থেকেই তার রাজনৈতিক রচনার হাতেখড়ি। এক বছরের কিছু বেশি সময় তিনি এই পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকাটি সে সময় সব দিক দিয়েই একটি প্রথম শ্রেণীর বাংলা দৈনিক ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর রাজনৈতিক কারণে এ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে মানিক মিয়া ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগের বিরোধী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটলে সে বছরই এই নতুন দলের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক। আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর ১৯৫১-এর ১৪ আগস্ট থেকে এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিকরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ইত্তেফাক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মানিক মিয়া ধীরে ধীরে পত্রিকাটিকে মুসলিম লীগবিরোধী ও পূর্ব বাংলার বঞ্চিত জনগণের মুখপত্র হিসেবে গড়ে তোলেন। ইত্তেফাক অল্পদিনেই সাধারণ পাঠক তথা গণমানুষের পত্রিকা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির পেছনে দৈনিক ইত্তেফাক সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। আর এ ক্ষেত্রে 'মুসাফিরে'র 'রাজনৈতিক মঞ্চ' কলামটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।
মানিক মিয়া মুসাফির ছদ্মনামে 'রাজনৈতিক মঞ্চ' কলামটিতে অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়, অন্তরঙ্গ অথচ তীক্ষষ্টভাবে মুসলিম লীগ সরকারের নানা বৈষম্য, অবিচার, অত্যাচার ও বঞ্চনার কাহিনী তুলে ধরতেন। পাঠকরা পরম আগ্রহভরে এই কলামটি পড়ার জন্য অপেক্ষা করত এবং পত্রিকাটি হাতে পেলে যেন গোগ্রাসে তা পড়ে ফেলত।
১৯৫৪ সালের পর পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে যে ভাঙা-গড়ার সূত্রপাত হয়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার ওপর যে বৈষম্য, অবিচার আর বঞ্চনা চাপিয়ে দেয় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তার তীব্র বিরোধিতা করেন। আগুন ঝরা লেখনীর মাধ্যমে স্বৈরশাসনের মুখোশ উন্মোচন করেন। আর তাই স্বর্থান্বেষী কেন্দ্রীয় শাসকচক্র তার লেখা সহ্য করতে পারেনি। তাকে বারবার রাজরোষে পড়তে হয়েছে। কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে বহুবার। তার পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইনের চোখে তাকে কখনোই দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি।
১৯৫৫ সালে ইত্তেফাকের প্রকাশনা কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৫৯ সালে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে সামরিক আইন লঙ্ঘনের মিথ্যা অজুহাতে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করলে পূর্ব বাংলায় যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল, তা দমনের জন্য অন্য অনেক নেতার সঙ্গে মানিক মিয়াকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের ডাকে পূর্ব বাংলায় যে হরতাল পালিত হয়, সে সময়ও মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয় এবং সে সঙ্গে 'নিউ নেশন প্রেস' বাজেয়াপ্ত করা হয়। ফলে ইত্তেফাক বন্ধ হয়ে যায়। পরে অবশ্য প্রেস বাজেয়াপ্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রায়ে তিনি জয়লাভ করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার অর্ডিন্যান্স সংশোধন করে দ্বিতীয়বার এ প্রেস বাজেয়াপ্ত করে। এ সময় মানিক মিয়া দীর্ঘ ১০ মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের ফলে আইয়ুব সরকার পুনরায় ইত্তেফাক প্রকাশের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। নৈতিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৬৯
সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক পুনঃপ্রকাশিত হয়।
ইত্তেফাকের সাংগঠনিক কাজে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ১৯৬৯ সালের ২৬ মে রাওয়ালপিন্ডি গমন করেন এবং
১ জুন সেখানকার এক হোটেলে
তিনি আকস্মিকভাবে মৃত্যুমুখে
পতিত হন।
বাঙালিকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন মানিক মিয়া। সাংবাদিকতা চর্চায়, তার লেখায় এই ভালোবাসা নানাভাবে প্রতিমূর্ত হয়ে উঠেছিল। সময় ও সমাজ বদলের মোক্ষম হাতিয়াররূপে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা পেশাকে। সুদূরপ্রসারী মিশন ও ভিশন নিয়ে একজন সুদক্ষ ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে তিনি তার পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল পাঠকগোষ্ঠী।
সমাজসেবার ক্ষেত্রেও মানিক মিয়ার ভূমিকা ছিল অনন্য। পিরোজপুর জেলার বহু স্থানে বিশেষ করে জন্মস্থান ভাণ্ডারিয়া এলাকায় তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ড. শেখ আবদুস সালাম :অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments