হামিদুজ্জামান খানের একক প্রদর্শনী-নীলের ভেতর শুভ্র প্রাণ by মোবাশ্বির আলম মজুমদার
নির্জন রাতের আকাশে মৃদু আলোর ঝলক এসে আছড়ে পড়েছে নদীর গায়ে। পাহাড়ের কোলে দুপুরের রোদ এসে দোল খায়। এ যেন শিল্প উদ্যাপন। শিল্পী হামিদুজ্জামান খান শিল্পের সঙ্গেই বসবাস করেন। প্রকৃতির শক্তির মাত্রাগুলো ধারণ করেন।
২৪ মে গ্যালারি কায়ায় ‘জলরং ও ভাস্কর্য’ শিরোনামে শিল্পী হামিদুজ্জামান খানের ২২তম একক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। এবারের প্রদর্শনীতে শিল্পী মোট ৭৯টি কাজ নিয়ে হাজির হয়েছেন। নয়টি ব্রোঞ্জ নির্মিত ভাস্কর্য ছাড়াও রয়েছে জলরং অ্যাক্রিলিক মাধ্যমের ৭০টি কাজ। শিল্পী হামিদুজ্জামান খান বাংলাদেশে প্রথাগত বাস্তবধর্মী ভাস্কর্য গড়ার বিপরীতে ধাতব দ্রব্যের ভাস্কর্য নির্মাণে আগ্রহী হন আশির দশকের শেষভাগে। ধাতব বস্তুর তৈরি জ্যামিতিক আদল একটির সঙ্গে আরেকটি আকৃতি জুড়ে তিনি তৈরি করেছেন নানা ভাস্কর্য। গত কয়েকটি একক প্রদর্শনীর কাজে শিল্পীর প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে। জলরং মাধ্যমে আঁকা এবারের নিসর্গচিত্রে গাঢ় নীল-কালো আবার উজ্জ্বল বর্ণের ব্যবহার লক্ষণীয়। ২২তম প্রদর্শনী প্রসঙ্গে শিল্পী বলেন, ‘প্রদর্শনীর ব্যতিক্রমী কিছু ছবি হচ্ছে প্রতিকৃতি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের মুখের গড়ন বিভিন্ন রকম। বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সুবাদে আমি সেই সব মানুষের মুখগুলো স্মৃতি থেকে জলরঙে তুলে এনেছি।’ শিল্পী পথ চলতে চলতেই ছবির বিষয় সংগ্রহ করেন। তিনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান, মানুষ দেখেন, মানুষের জীবনযাপন, সমাজকাঠামোর চালচিত্র দেখে আত্মস্থ করেন। তাঁর ছবির বিষয় হয়ে ওঠে এসব অভিজ্ঞতা। প্রকৃতি অনুধাবন নিয়ে শিল্পী ভাবেন এভাবে, প্রকৃতি দিন-রাতের ব্যবধানে কতটা বদলে যায়, ভোরের আকাশ আর সন্ধ্যার আলো একেবারেই ভিন্নরূপে আমার চোখে ধরা দেয়। একজন শিল্পী এভাবেই প্রকৃতির কাছ থেকে ছবির বিষয় খুঁজে নেন। গত দুই বছরে শিল্পী ঘুরে এসেছেন মালদ্বীপ, ভুটান, নেপাল, দিল্লি ও শান্তিনিকেতন। আর আমাদের দেশের সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবান। মালদ্বীপের সমুদ্রের জল নীল। নীল জলে রাতের সৌন্দর্য এঁকেছেন জলরঙে। ভুটানের আকাশে মেঘের দুরন্তপনা, পাহাড়ের সঙ্গে যূথবদ্ধ মেঘের আনাগোনা তুলে এনেছেন গাঢ় আর উষ্ণ রঙে। প্রদর্শনীর নয়টি ব্রোঞ্জ নির্মিত ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন অতি সরলরূপে। জ্যামিতিক আকৃতিগুলো যুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে মানবীর মুখ, পাখি, মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি। ‘ল্যান্ডস্কেপ-৩২’ ছবিতে হলুদের সঙ্গে ধূসর আকাশের কোলে নৌকায় নদী পার হয় একদল যাত্রী। ল্যান্ডস্কেপ-১৩, ৮, ৯, ১০, ১২, ১৩, ১৪, ১৫—গাঢ় কালো রঙের আকাশের সঙ্গে উঁকি দেয় উজ্জ্বল আলো আর লাল-হলুদের মিশেলে প্রকৃতির মায়াময় রূপ। রাতের আঁধারে প্রকৃতির দ্যোতনা সৃজনশীলতাকে ছাড়িয়ে যায়। হামিদুজ্জামানের এ প্রদর্শনীতে নতুন একজন শিল্পীকে চেনা যায়। প্রকৃতি অনুধাবনের শক্তির মাত্রা তিনি ধারণ করেন। একজন সহজ-সরল শিল্পীর নিরন্তর ছুটে চলা আমাদের শিল্পাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে। শিল্পীর ধাতব বস্তুর তৈরি ভাস্কর্যে কৌণিক আকৃতির উপস্থাপনায় একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাস্কর্য নির্মিত হয়। নিসর্গে কালো রঙের অতিমাত্রায় ব্যবহারকে শিল্পী দীর্ঘ সময় ভাস্কর্য নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণ হিসেবে মনে করেন। শিল্পী হামিদুজ্জামানের ২২তম একক প্রদর্শনীর প্রকৃতির মায়াময় রূপ সৃজন আমাদের প্রকৃতিকে নতুনভাবে চিনিয়ে দেয়। প্রদর্শনীটি শেষ হবে আগামী ৬ জুন।
হামিদুজ্জামান খান: জন্ম ১৯৪৬। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বিএফএ এবং ১৯৭৭ সালে ভারতের বরোদা এমএস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২-৮৩ সালে নিউইয়র্কের ইটার্ন স্কাল্পচার, স্কাল্পচার সেন্টারে অধ্যয়ন করেন। দেশে-বিদেশে ২১টি একক প্রদর্শনী ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অসংখ্য দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নেন। ২০০৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করেন। বর্তমানে তিনি স্বাধীন ভাস্কর হিসেবে ঢাকায় কাজ করছেন।
হামিদুজ্জামান খান: জন্ম ১৯৪৬। ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বিএফএ এবং ১৯৭৭ সালে ভারতের বরোদা এমএস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২-৮৩ সালে নিউইয়র্কের ইটার্ন স্কাল্পচার, স্কাল্পচার সেন্টারে অধ্যয়ন করেন। দেশে-বিদেশে ২১টি একক প্রদর্শনী ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অসংখ্য দলীয় প্রদর্শনীতে অংশ নেন। ২০০৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করেন। বর্তমানে তিনি স্বাধীন ভাস্কর হিসেবে ঢাকায় কাজ করছেন।
No comments