রাজনীতি-আওয়ামী লীগকে বদলাতে হবে আগে by মাহমুদুর রহমান মান্না
১৯৭২ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। ছাত্র ইউনিয়ন প্রায় পুরো প্যানেলে জয়লাভ করেছিল। ছাত্রলীগ থেকে আমার প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ছিলেন ঢাকা বিভাগের সাবেক কমিশনার মোবারক হোসেন।
এর আগে ভিপি প্রার্থী হয়েছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সম্প্রতি পরাজিত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী। কিন্তু জেতার সম্ভাবনা নেই দেখে ছাত্রলীগ সেই নির্বাচন বানচাল করে দিয়েছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে তখন আঞ্চলিকতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে সক্রিয়। যেকোনো প্যানেল বানানোর সময় এ জন্যই একজন স্থানীয় এবং একজন অস্থানীয়র সমন্বয় করতে হতো। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সংগঠনটি শূন্যের কোঠায় থেকে তখন গঠন করেছিলাম আমরা, যারা হলে থাকতাম এবং সে কারণে অস্থানীয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি শহর থেকে বারো মাইল দূরে হওয়ার কারণে এবং শহর থেকে যাতায়াতের জন্য ট্রেন ও বাসের ব্যবস্থা ছিল বলে স্থানীয়রা শহরেই থাকত। হলে থাকত না। এবং এই কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সংগঠনে তাদের কোনো অবদানও ছিল না। তাই বলে স্থানীয়রা নেতৃত্বে তাদের ভাগ ছাড়বে কেন? অতএব জনাব মহিউদ্দিন চাকসুর ভিপি প্রার্থী হয়েছিলেন, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে কেউ তাঁকে চিনত না। যতদুর জানি নির্বাচন করার জন্য তড়িঘড়ি তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়েছিল।
তখন একটা ছোটখাটো নৈকট্য গড়ে উঠেছিল মহিউদ্দিনের সঙ্গে। আগেই বলেছি, ওই নির্বাচনটি হয়নি। অতএব মহিউদ্দিনও আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়মুখো হননি। তাঁর সঙ্গে আর ঘনিষ্ঠতা হয়নি। চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ তখন যে সিটি ডিস্ট্রিক্ট গ্রুপিং ছিল, সেই সূত্রে তাঁর খবরাখবর পেতাম।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যেসব কথাবার্তা হচ্ছে, তার একটা উপক্রমণিকা হিসেবে এই কথাগুলো বললাম। সেই সময়ের অনেকেই এখনো চট্টগ্রামের রাজনীতিতে সক্রিয় বা দর্শক-সমর্থক হিসেবে আছেন যাঁরা, আমার সঙ্গে একমত হবেন যে তখন মহিউদ্দিন এমন কোনো নেতা ছিলেন না। ভালো ছাত্র বা মেধাবী মানুষ হিসেবে তিনি কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন না। কথাবার্তায়ও চৌকস ছিলেন না। কারণ অকারণে রাগ করতেন কিন্তু মুখে মিষ্টি হাসি ছিল সর্বদা (যা এখনো অমলিন)। মহিউদ্দিন চৌধুরী অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন। তখনো চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে গ্রুপিং ছিল। মহিউদ্দিন চৌধুরী কোনো গ্রুপের নেতাও ছিলেন না। কিন্তু পরিশ্রম করে তিনি নেতা হয়ে উঠেছিলেন। অর্থ, বিত্ত ও শক্তিশালী নেতারা মহিউদ্দিনের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ান। কিন্তু তিনি তাঁর পরিশ্রম দিয়ে কর্মী ও জনগণের মন জয় করে চট্টগ্রামের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে যান।
স্বাধীনতার পর প্রায় চার দশক ধরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতি, এর অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং তার ভেতরে জনাব মহিউদ্দিনের লড়াই ও গ্রুপিংয়ের কথা বলতে অনেক লম্বা পরিসর লাগবে। কিন্তু আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু সেটা নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি, ইনিই সেই মহিউদ্দিন, যিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে এভাবেই বেড়ে উঠেছেন। মানুষ এভাবেই তাঁকে দেখেছে, চিনেছে, জেনেছে এবং এভাবে জেনেই তাঁকে ভোট দিয়েছে। এভাবে ভোট পেয়ে এই মহিউদ্দিনই গত ১৭ বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র থেকেছেন। সেই মহিউদ্দিন এই নির্বাচনে এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করলেন। কেন?
বন্ধু ওবায়েদুল কাদের প্রায়ই বলেন, ‘সাফল্যের অনেক পিতা আছে, কিন্তু ব্যর্থতা একটি এতিম।’ মহিউদ্দিন সাহেব হেরেছেন, তাই তিনি এতিম হয়ে গেছেন। তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখনো এই পরাজয়ের কারণ মূল্যায়ন করেনি। কিন্তু দলের লোকজন কথা বলছে, পত্রিকা লেখালেখি করছে। এক পত্রিকায় দেখলাম, এক নেতা বলেছেন, এই পরাজয় মহিউদ্দিন চৌধুরীর। আওয়ামী লীগের নয়। বিষয়টি কি হাস্যকর নয়? মহিউদ্দিন চৌধুরীকে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সমর্থন করেনি? সমর্থন দেওয়ার পর চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতাদের ডেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পক্ষে কাজ করতে বলেননি? বিনোদ বিহারীকে শেখ হাসিনা মহিউদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে ফোন করেননি? দলের উপদেষ্টা, সাংসদ ও জেষ্ঠ্য নেতারা কি নির্বাচনের সময় চট্টগ্রামে কাজ করেননি?
কোনো কোনো নেতা বলেছেন, এটা তো স্থানীয় সরকারের নির্বাচন। তাহলে এতগুলো জাতীয় নেতা সেখানে গেলেন কেন? এ কথা সত্যি, প্রধান দুজন প্রার্থী সেখানকার প্রচারণায় স্থানীয় ইস্যুর ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। তার পরও চট্টগ্রাম কি এককভাবে স্থানীয় বিষয়? চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক নগর হিসেবে গড়ে তোলা কি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাজ, নাকি তা একটি জাতীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত? এক সাংবাদিক ঠিকই পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, এবারের নির্বাচনের ফলাফল যদি পরিপূর্ণভাবেই স্থানীয় বিবেচনার বিষয় হয়, তাহলে গতবার মহিউদ্দিন সাহেবের জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ কীভাবে বলেছিল যে ওই পরাজয় ছিল চারদলীয় জোটের পরাজয়।
পত্রিকায় দেখলাম, নির্বাচনের পর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেই বলেছেন, তাঁরা সবাই কাজ করেছেন বলেই মহিউদ্দিন সাহেব অতগুলো ভোট পেয়েছেন। না হলে আরও শোচনীয় পরাজয় হতো তাঁর। সত্যি নাকি? নির্বাচনের আগে নেতারা অবশ্য মহিউদ্দিন সম্পর্কে নেত্রীর কাছে অভিযোগ করেছিলেন। তাঁদের কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে তো মহিউদ্দিনকে সমর্থন করাই উচিত হয়নি মহাজোটের। অথচ মহাজোট কেবল সমর্থনই করেনি, জাতীয় পার্টি তাঁর পক্ষে প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এবং সেটি তো আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত ছাড়া হয়নি।
আমি বলছি না যে মহিউদ্দিন সাহেবের কোনো সমস্যা ছিল না, প্রার্থী হিসেবে তাঁর জুড়ি ছিল না। বরং মন্দির ভেঙে মার্কেট বানানো, নিচতলায় স্কুল রেখে ওপরে মার্কেট গড়ে তোলাসহ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে সেবামূলক হওয়ার পরিবর্তে একটি বাণিজ্যিক সংস্থায় পরিণত করা হয়েছিল বলে অনেকগুলো যুক্তিযুক্ত অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম মহানগরের যে নেতারা পরাজয়ের জন্য ব্যক্তি মহিউদ্দিনকে দায়ী করেছেন, তাঁরাও প্রণিধানযোগ্য। মহিউদ্দিন চৌধুরী মানুষকে সম্মান করে কথা বলতেন না, কথায় কথায় অন্যদের অসম্মান করতেন, গালাগালি করতেন। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক আচরণে তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগকে তিনি গণতান্ত্রিকভাবে গড়ে উঠতে দেননি, তাঁর আজ্ঞাবহ একটি পকেট সংগঠন বানিয়েছিলেন, এসব অভিযোগ তো নতুন নয় বরং অনেক দিনের পুরোনো। এটা কি হঠাৎ করে নির্বাচনের পরের দিন সবাই বুঝতে পারলেন?
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়েদুল কাদের চট্টগ্রাম নির্বাচনের ফলাফলের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এই নির্বাচন আমাদের একটি বিশাল বার্তা দিয়েছে। এই নির্বাচন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।’ আমি মনে করি, তাঁর এই কথার গুরুত্ব অনেক।
অনেক কথাই লুকিয়ে আছে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে। কিন্তু আমি ভাবছি তিনি যে কথা বললেন, তা কি বুঝতে পেরেছে তাঁর দল। নাকি তাঁরা মনে করছেন, ১৬ মাস আগে নির্বাচনের সময় যেমন ছিল, এখনো অবস্থা তেমন আছে। ভুলে যাওয়া চলবে না, চট্টগ্রামের আগে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঢাকা মহানগরের নেতা-কর্মীদের দাবির মুখে সরকার নির্বাচন কমিশনকে বলেছিল, সে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে শীতকালে অনুষ্ঠানের জন্য। কারণ, তখন গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সংকট কম অনুভূত হবে। সরকার ঢাকার নির্বাচন পেছাল, কিন্তু চট্টগ্রামের নির্বাচন পেছাতে বলল না। কেন? জবাব একটাই হতে পারে, ঢাকার মতো চট্টগ্রামের জেতা নিয়ে সংশয় ছিল না সরকারের মনে।
তারপরও চট্টগ্রামে মহাজোটের প্রার্থী হারলেন কেন? অনেকে বলেন, জলাবদ্ধতাসহ চট্টগ্রাম পৌর এলাকার অনেক সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন মহিউদ্দিন। মানুষ মনে করে, চট্টগ্রাম পৌর এলাকার সমস্যা মহিউদ্দিন একাই সমাধান করতে পারতেন। তিনি না পারলেও তার তৎকালীন ঘনিষ্ঠ সহযোগী মন্জুর সাহেব সেটা পারবেন? ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ আর ঐক্যজোটের প্রার্থী মন্জুর সমাধান করতে পারবেন চট্টগ্রামের সব সমস্যা? অতএব উদার হয়ে গেছে আমাদের গণতন্ত্র? নাকি চট্টগ্রামে সিটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
এ কথা মেনে নেওয়া উচিত যে চট্টগ্রামে মহাজোট সমর্থিত প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। সে পরাজয়ে প্রার্থীর নিজস্ব অবদান নিশ্চয় আছে। সেটা হয় তো ছোটও নয়। কিন্তু এ পরাজয় ব্যক্তির নয়। আওয়ামী লীগের বাইরে মহিউদ্দিন কেউ নন, আওয়ামী লীগকে বাদ দিলে মহিউদ্দিন কোনো বিবেচ্য প্রার্থীও নন। আমি এ কথার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত যে চট্টগ্রাম নির্বাচন আমাদের একটি মস্ত বার্তা দিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি আমরা তা বুঝতে পারব, ততই মঙ্গল।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ২৯ মে মুন্সিগঞ্জের এক সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দেশকে বদলাতে হলে আওয়ামী লীগকে বদলাতে হবে। পুরোনো ধ্যান-ধারণা বাদ দিতে হবে।’
ঠিক কথা বলেছেন তিনি। একা মহিউদ্দিনের দোষ দিয়ে লাভ কী? আমরা সবাই কি একেকজন মহিউদ্দিন নই?
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে তখন আঞ্চলিকতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে সক্রিয়। যেকোনো প্যানেল বানানোর সময় এ জন্যই একজন স্থানীয় এবং একজন অস্থানীয়র সমন্বয় করতে হতো। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সংগঠনটি শূন্যের কোঠায় থেকে তখন গঠন করেছিলাম আমরা, যারা হলে থাকতাম এবং সে কারণে অস্থানীয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি শহর থেকে বারো মাইল দূরে হওয়ার কারণে এবং শহর থেকে যাতায়াতের জন্য ট্রেন ও বাসের ব্যবস্থা ছিল বলে স্থানীয়রা শহরেই থাকত। হলে থাকত না। এবং এই কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সংগঠনে তাদের কোনো অবদানও ছিল না। তাই বলে স্থানীয়রা নেতৃত্বে তাদের ভাগ ছাড়বে কেন? অতএব জনাব মহিউদ্দিন চাকসুর ভিপি প্রার্থী হয়েছিলেন, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে কেউ তাঁকে চিনত না। যতদুর জানি নির্বাচন করার জন্য তড়িঘড়ি তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়েছিল।
তখন একটা ছোটখাটো নৈকট্য গড়ে উঠেছিল মহিউদ্দিনের সঙ্গে। আগেই বলেছি, ওই নির্বাচনটি হয়নি। অতএব মহিউদ্দিনও আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়মুখো হননি। তাঁর সঙ্গে আর ঘনিষ্ঠতা হয়নি। চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ তখন যে সিটি ডিস্ট্রিক্ট গ্রুপিং ছিল, সেই সূত্রে তাঁর খবরাখবর পেতাম।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যেসব কথাবার্তা হচ্ছে, তার একটা উপক্রমণিকা হিসেবে এই কথাগুলো বললাম। সেই সময়ের অনেকেই এখনো চট্টগ্রামের রাজনীতিতে সক্রিয় বা দর্শক-সমর্থক হিসেবে আছেন যাঁরা, আমার সঙ্গে একমত হবেন যে তখন মহিউদ্দিন এমন কোনো নেতা ছিলেন না। ভালো ছাত্র বা মেধাবী মানুষ হিসেবে তিনি কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন না। কথাবার্তায়ও চৌকস ছিলেন না। কারণ অকারণে রাগ করতেন কিন্তু মুখে মিষ্টি হাসি ছিল সর্বদা (যা এখনো অমলিন)। মহিউদ্দিন চৌধুরী অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন। তখনো চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে গ্রুপিং ছিল। মহিউদ্দিন চৌধুরী কোনো গ্রুপের নেতাও ছিলেন না। কিন্তু পরিশ্রম করে তিনি নেতা হয়ে উঠেছিলেন। অর্থ, বিত্ত ও শক্তিশালী নেতারা মহিউদ্দিনের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ান। কিন্তু তিনি তাঁর পরিশ্রম দিয়ে কর্মী ও জনগণের মন জয় করে চট্টগ্রামের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে যান।
স্বাধীনতার পর প্রায় চার দশক ধরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতি, এর অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং তার ভেতরে জনাব মহিউদ্দিনের লড়াই ও গ্রুপিংয়ের কথা বলতে অনেক লম্বা পরিসর লাগবে। কিন্তু আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু সেটা নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি, ইনিই সেই মহিউদ্দিন, যিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে এভাবেই বেড়ে উঠেছেন। মানুষ এভাবেই তাঁকে দেখেছে, চিনেছে, জেনেছে এবং এভাবে জেনেই তাঁকে ভোট দিয়েছে। এভাবে ভোট পেয়ে এই মহিউদ্দিনই গত ১৭ বছর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র থেকেছেন। সেই মহিউদ্দিন এই নির্বাচনে এমন শোচনীয় পরাজয় বরণ করলেন। কেন?
বন্ধু ওবায়েদুল কাদের প্রায়ই বলেন, ‘সাফল্যের অনেক পিতা আছে, কিন্তু ব্যর্থতা একটি এতিম।’ মহিউদ্দিন সাহেব হেরেছেন, তাই তিনি এতিম হয়ে গেছেন। তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখনো এই পরাজয়ের কারণ মূল্যায়ন করেনি। কিন্তু দলের লোকজন কথা বলছে, পত্রিকা লেখালেখি করছে। এক পত্রিকায় দেখলাম, এক নেতা বলেছেন, এই পরাজয় মহিউদ্দিন চৌধুরীর। আওয়ামী লীগের নয়। বিষয়টি কি হাস্যকর নয়? মহিউদ্দিন চৌধুরীকে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সমর্থন করেনি? সমর্থন দেওয়ার পর চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতাদের ডেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পক্ষে কাজ করতে বলেননি? বিনোদ বিহারীকে শেখ হাসিনা মহিউদ্দিন চৌধুরীর পক্ষে ফোন করেননি? দলের উপদেষ্টা, সাংসদ ও জেষ্ঠ্য নেতারা কি নির্বাচনের সময় চট্টগ্রামে কাজ করেননি?
কোনো কোনো নেতা বলেছেন, এটা তো স্থানীয় সরকারের নির্বাচন। তাহলে এতগুলো জাতীয় নেতা সেখানে গেলেন কেন? এ কথা সত্যি, প্রধান দুজন প্রার্থী সেখানকার প্রচারণায় স্থানীয় ইস্যুর ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। তার পরও চট্টগ্রাম কি এককভাবে স্থানীয় বিষয়? চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক নগর হিসেবে গড়ে তোলা কি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাজ, নাকি তা একটি জাতীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত? এক সাংবাদিক ঠিকই পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, এবারের নির্বাচনের ফলাফল যদি পরিপূর্ণভাবেই স্থানীয় বিবেচনার বিষয় হয়, তাহলে গতবার মহিউদ্দিন সাহেবের জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ কীভাবে বলেছিল যে ওই পরাজয় ছিল চারদলীয় জোটের পরাজয়।
পত্রিকায় দেখলাম, নির্বাচনের পর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেই বলেছেন, তাঁরা সবাই কাজ করেছেন বলেই মহিউদ্দিন সাহেব অতগুলো ভোট পেয়েছেন। না হলে আরও শোচনীয় পরাজয় হতো তাঁর। সত্যি নাকি? নির্বাচনের আগে নেতারা অবশ্য মহিউদ্দিন সম্পর্কে নেত্রীর কাছে অভিযোগ করেছিলেন। তাঁদের কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে তো মহিউদ্দিনকে সমর্থন করাই উচিত হয়নি মহাজোটের। অথচ মহাজোট কেবল সমর্থনই করেনি, জাতীয় পার্টি তাঁর পক্ষে প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এবং সেটি তো আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত ছাড়া হয়নি।
আমি বলছি না যে মহিউদ্দিন সাহেবের কোনো সমস্যা ছিল না, প্রার্থী হিসেবে তাঁর জুড়ি ছিল না। বরং মন্দির ভেঙে মার্কেট বানানো, নিচতলায় স্কুল রেখে ওপরে মার্কেট গড়ে তোলাসহ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে সেবামূলক হওয়ার পরিবর্তে একটি বাণিজ্যিক সংস্থায় পরিণত করা হয়েছিল বলে অনেকগুলো যুক্তিযুক্ত অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম মহানগরের যে নেতারা পরাজয়ের জন্য ব্যক্তি মহিউদ্দিনকে দায়ী করেছেন, তাঁরাও প্রণিধানযোগ্য। মহিউদ্দিন চৌধুরী মানুষকে সম্মান করে কথা বলতেন না, কথায় কথায় অন্যদের অসম্মান করতেন, গালাগালি করতেন। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক আচরণে তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগকে তিনি গণতান্ত্রিকভাবে গড়ে উঠতে দেননি, তাঁর আজ্ঞাবহ একটি পকেট সংগঠন বানিয়েছিলেন, এসব অভিযোগ তো নতুন নয় বরং অনেক দিনের পুরোনো। এটা কি হঠাৎ করে নির্বাচনের পরের দিন সবাই বুঝতে পারলেন?
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়েদুল কাদের চট্টগ্রাম নির্বাচনের ফলাফলের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘এই নির্বাচন আমাদের একটি বিশাল বার্তা দিয়েছে। এই নির্বাচন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।’ আমি মনে করি, তাঁর এই কথার গুরুত্ব অনেক।
অনেক কথাই লুকিয়ে আছে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে। কিন্তু আমি ভাবছি তিনি যে কথা বললেন, তা কি বুঝতে পেরেছে তাঁর দল। নাকি তাঁরা মনে করছেন, ১৬ মাস আগে নির্বাচনের সময় যেমন ছিল, এখনো অবস্থা তেমন আছে। ভুলে যাওয়া চলবে না, চট্টগ্রামের আগে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঢাকা মহানগরের নেতা-কর্মীদের দাবির মুখে সরকার নির্বাচন কমিশনকে বলেছিল, সে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে শীতকালে অনুষ্ঠানের জন্য। কারণ, তখন গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের সংকট কম অনুভূত হবে। সরকার ঢাকার নির্বাচন পেছাল, কিন্তু চট্টগ্রামের নির্বাচন পেছাতে বলল না। কেন? জবাব একটাই হতে পারে, ঢাকার মতো চট্টগ্রামের জেতা নিয়ে সংশয় ছিল না সরকারের মনে।
তারপরও চট্টগ্রামে মহাজোটের প্রার্থী হারলেন কেন? অনেকে বলেন, জলাবদ্ধতাসহ চট্টগ্রাম পৌর এলাকার অনেক সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন মহিউদ্দিন। মানুষ মনে করে, চট্টগ্রাম পৌর এলাকার সমস্যা মহিউদ্দিন একাই সমাধান করতে পারতেন। তিনি না পারলেও তার তৎকালীন ঘনিষ্ঠ সহযোগী মন্জুর সাহেব সেটা পারবেন? ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ আর ঐক্যজোটের প্রার্থী মন্জুর সমাধান করতে পারবেন চট্টগ্রামের সব সমস্যা? অতএব উদার হয়ে গেছে আমাদের গণতন্ত্র? নাকি চট্টগ্রামে সিটি গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
এ কথা মেনে নেওয়া উচিত যে চট্টগ্রামে মহাজোট সমর্থিত প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। সে পরাজয়ে প্রার্থীর নিজস্ব অবদান নিশ্চয় আছে। সেটা হয় তো ছোটও নয়। কিন্তু এ পরাজয় ব্যক্তির নয়। আওয়ামী লীগের বাইরে মহিউদ্দিন কেউ নন, আওয়ামী লীগকে বাদ দিলে মহিউদ্দিন কোনো বিবেচ্য প্রার্থীও নন। আমি এ কথার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত যে চট্টগ্রাম নির্বাচন আমাদের একটি মস্ত বার্তা দিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি আমরা তা বুঝতে পারব, ততই মঙ্গল।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ২৯ মে মুন্সিগঞ্জের এক সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দেশকে বদলাতে হলে আওয়ামী লীগকে বদলাতে হবে। পুরোনো ধ্যান-ধারণা বাদ দিতে হবে।’
ঠিক কথা বলেছেন তিনি। একা মহিউদ্দিনের দোষ দিয়ে লাভ কী? আমরা সবাই কি একেকজন মহিউদ্দিন নই?
মাহমুদুর রহমান মান্না: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক।
No comments