খোলা চোখে-আফগানিস্তানে শান্তির জন্য চাই ভারত-পাকিস্তান মৈত্রী by হাসান ফেরদৌস
একটা কাণ্ডই করে ফেলেছেন পাকিস্তান ও ভারতের দুই টেনিস তারকা, আসিমুল ও রোহান। উইম্বলডন টেনিস প্রতিযোগিতায় এই দুই তারকা একসঙ্গে জুটি বেঁধে পুরুষদের দ্বৈত ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। শুধু খেলছেন না, দারুণ খেলছেন। ইতিমধ্যেই তাঁরা কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে গেছেন।
শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টের শিরোপা তাঁরা পাবেন কি না জানি না, কিন্তু যতটুকু খেলেছেন, তাতেই এই দুজন ইতিহাস গড়ে ফেলেছেন।
ভারত-পাকিস্তান মানেই লাঠালাঠি, মারামারি, যুদ্ধ। একজনকে দেখলে আরেকজনের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। অথচ সেই দুই দেশের খেলোয়াড় হয়ে আসিমুল ও রোহান শুধু একসঙ্গে খেলছেনই না, দুজনেই বলেছেন, যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই, আর সে জন্য লড়াই-ফড়াই বাদ দিয়ে আসুন একসঙ্গে টেনিস খেলি। তাঁরা ভারত-পাকিস্তানের ওয়াগাহ সীমান্ত চৌকিতে গিয়ে টেনিস খেলার এক প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়ে বসেছেন।
এমন একটা প্রস্তাবকে স্বাগত না জানিয়ে উপায় নেই। ভারত-পাকিস্তানকে যদি শান্তি ও সহযোগিতার পথে আসতে হয়, তাহলে সবার আগে যেতে হবে সাধারণ নাগরিকদের কাছে। তারা যদি শান্তি ও সহযোগিতার দাবি না তোলে, রাজনীতিবিদেরা ভুলেও সে পথ মাড়াবেন না। একে অপরের দেশকে জুজুবুড়ি বানিয়ে তাঁরা রাজনীতির লাঠিখেলা এ পর্যন্ত তো ভালোই চালিয়ে আসছেন। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা সুষম ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নানা কারণে জরুরি। অন্য সব কারণ ছাপিয়ে যে জন্য শুধু সহাবস্থান নয়, তাদের মধ্যে সহযোগিতা চাই, তা হলো ইসলামি মৌলবাদের আগ্রাসী উত্থান।
ভারত-পাকিস্তানের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে এই অঞ্চলের যে দেশটি সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মুখে পড়েছে, সেটি হলো আফগানিস্তান। যুদ্ধে যুদ্ধে দেশটির এমনিতেই শুকনো চিঁড়ের দশা। একদিকে আল-কায়েদা ও তালেবান, অন্য দিকে মার্কিন নেতৃত্বে বিদেশি সেনা দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, তাও প্রায় এক দশক হয়ে গেল। এই যুদ্ধ এখন এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছে যে শুধু বোমা ফেলে বা কামান দেগে তালেবানদের কাবু করা যাবে না এ কথাটা ওয়াশিংটন বুঝতে পেরেছে। তারা এও বুঝেছে, অনন্তকাল এই দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা তাদের পক্ষে অসম্ভব। যেকোনো একটা ফর্মুলায় নিজেদের জয় ঘোষণা করে, আফগানদের হাতে দেশের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে মানে মানে কেটে পড়তে পারলেই তারা বাঁচে। কিন্তু তেমন একটা সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করতে হলে দুটো ঘটনা ঘটতে হবে: এক. তালেবানদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তি ও আফগানিস্তান প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তানের ঐকমত্য।
তালেবানদের হটানো খুব সহজ নয়। আফগানিস্তান দেশটি তাদের, এর অলিগলি সব তাদের চেনা। মাটি কামড়ে হলেও এখানে পড়ে থাকা সম্ভব। আর বোমাবাজির ফলে যদি থাকা অসম্ভব হয়েই ওঠে, তাহলে পাশের বাড়ির পাকিস্তান তো রয়েছেই। সেখানে তাদের মিত্র পাকিস্তানি তালেবান আছে, খোদ পাকিস্তান সরকারও তাদের জন্য ছাতা খুলে তৈরি। আমেরিকার জন্য পাকিস্তানের এ ব্যবহারটা একদম অসহ্য হয়ে উঠেছে। কাগজ-কলমে সে আমেরিকার মিত্র, কোটি কোটি ডলার তাদের নামে পাঠানো হচ্ছে। অথচ তার পরও তারা সেই তালেবানের দোসর, যারা আফগানিস্তানে মার্কিনি ও ন্যাটো বাহিনীর সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। শুধু এই জুন মাসে তাদের হাতে মারা গেছে ১০০-র ওপরে মার্কিন ও ন্যাটো সেনা। আমেরিকার হাতে এমন প্রমাণ রয়েছে যে তালেবানদের এই আক্রমণের পেছনে অস্ত্র ও বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করছে খোদ পাকিস্তান। পাকিস্তানের সেনা-নিয়ন্ত্রিত একদল ‘পাকিস্তানি তালেবান’ রয়েছে। তার বাইরেও আছে একাধিক পাঞ্জাবি তালেবান বাহিনী, যেমন জইশে মুহাম্মদ, সিপাহি সাহাবা ও হুজি। এরাও কমবেশি পাকিস্তানি সেনা সদর দপ্তরের পৃষ্ঠপোষকতা ভোগ করে আসছে। পাকিস্তান এদের পুষছে দুটো কারণে: ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধে এরা হবে অগ্রবর্তী বাহিনী এবং আফগানিস্তান থেকে আমেরিকানরা হটলেই এদের কাঁধে বন্দুক রেখে কাবুলে আসন গেড়ে বসবে ইসলামাবাদ।
পাকিস্তান যে তালেবানদের সঙ্গে আঁতাত বজায় রেখে চলেছে, সম্প্রতি তা একদম ফর্সা হয়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, আফগানিস্তানে আমেরিকার সামরিক অভিযান তালগোল পাকাচ্ছে দেখে পাকিস্তান নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে এক রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা চেষ্টা চালাচ্ছে আফগান তালেবানদের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে দেশের পশতু রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে এক ধরনের আপসরফা করতে। আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে তারা বোঝাতে চাইছে, আমেরিকা আজ হোক, কাল হোক এ দেশ ছাড়বেই। তখন অতি উগ্র তালেবানদের খপ্পরে দেশটি পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় তার নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকার সবচেয়ে ভালো পথ হলো তালেবানদের মধ্যে তেমন উগ্র নয় এমন একটি অংশের সঙ্গে রাজনৈতিক রফা সেরে ফেলা। পাকিস্তান জানিয়েছে, এ কাজে তারা সিরাজুদ্দিন হাক্কানির নিয়ন্ত্রিত তালেবান গোষ্ঠীকে আলোচনা ও সমাঝোতার পথে আনতে সক্ষম হবে। এই দলটি তাদের প্রভাবাধীন। শুধু টাকা ও অস্ত্রই নয়, আমেরিকান আক্রমণের মুখে তাদের রক্ষার কাজও করে থাকে পাকিস্তান। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, হাক্কানি গ্রুপের সঙ্গে আপস করার প্রস্তাবটি নিয়ে শলা-পরামর্শে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল কায়ানি ও সেনা গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধান জেনারেল সুজা। গত দুই মাসে তাঁদের প্রতিনিধি দল দফায় দফায় কাবুল সফর করে গেছে, কারজাই ও তাঁর পরামর্শদাতাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক সেরেছে। তাঁরা দুজনও বারকয়েক কারজাইয়ের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠক করেছেন। আমেরিকা সে কথা জানতে পেরে ব্যাপার কী, তা জানতে চেয়েছে। কায়ানি বা সুজা কেউই তার কোনো সদুত্তর দেননি।
কারজাইয়ের নিজের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভালো নয়। তাঁর প্রশাসন দুর্নীতিবাজ, এ কথা খোদ প্রেসিডেন্ট ওবামা একবার নয়, হাজারবার বলেছেন। চলতি আফগান সরকারকে তারা বিশ্বাস করে না, আল-কায়েদা ও তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা এই সরকারের পক্ষে অসম্ভব সে কথাও মার্কিন নেতৃত্ব রাখঢাক ছাড়াই বলেছে। অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য নেতা পাওয়া গেলে কারজাইকে অনেক আগেই হটিয়ে দেওয়া হতো। এ কথা কারজাই নিজে বোঝেন, তাঁর সহকর্মীদের সে কথা বলেছেনও। এসব কারণে আমেরিকানদের ব্যাপারে কারজাই এতটাই ত্যক্ত-বিরক্ত যে কিছুদিন আগে তিনি মুখ ফসকে বলেই বসেন, অবস্থা না বদলালে তিনি নিজেই হয়তো তালেবানে যোগ দেবেন।
এ অবস্থায় পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে যদি যেনতেন প্রকারের একটি রাজনৈতিক সমাধান অর্জন সম্ভব হয়, বিশেষত তাঁর নিজের গদি অক্ষত রেখে, তাহলে কারজাই তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বলাই বাহুল্য, আমেরিকা ব্যাপারটা মোটেই ভালো চোখে দেখছে না। তালেবানের সঙ্গে বিশেষত কম উগ্র এমন তালেবানের সঙ্গে চুক্তিতে আমেরিকার আপত্তি নেই। কিন্তু ওয়াশিংটনকে না জানিয়ে, তাকে একদম বাদ দিয়ে গোপনে এমন এক চুক্তি হোক, আমেরিকা স্বাভাবিকভাবেই তা চাইবে না। আফগানিস্তানে আমেরিকার প্রধান কৌশলগত লক্ষ্য হলো সেখানে যাতে আল-কায়েদার ঘাঁটি ফের না গড়ে ওঠে তার নিশ্চয়তা। কিন্তু হাক্কানি-জাতীয় খুনে তালেবানের সঙ্গে আঁতাতের ফলে তেমন নিশ্চয়তা পাওয়া অসম্ভব। হাক্কানিরা পশতু, ফলে পশতু গোত্রভুক্ত কারজাই ও তাঁর দলবল এই আঁতাতে আশ্বস্ত হতে পারেন কিন্তু আফগানিস্তানের অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে উজবেক ও হাজারা, এই আঁতাত মেনে নেবে না। তালেবান আমলে তাদের হাতে এই দুই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছিল। তা ছাড়া হাক্কানি নিয়ন্ত্রিত তালেবান কট্টর মৌলবাদী বলে পরিচিত। তাদের সঙ্গে আল-কায়েদার মতো জেহাদি গ্রুপের সখ্য থাকবে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এ ধরনের যেকোনো আঁতাতের বিরোধিতা আসবে ভারতের দিক থেকেও। এ কথা প্রমাণিত যে আফগানিস্তানের ভেতর এ পর্যন্ত ভারতীয় লক্ষ্যস্থলের ওপর যে কয়টি হামলা হয়েছে, তার অধিকাংশই হাক্কানি গ্রুপের হাতে। মার্কিন মহল থেকে বলা হয়েছে যে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসের ওপর যে রক্তাক্ত হামলা চলে, তাতে হাক্কানি গ্রুপের সদস্যরা জড়িত। এমন কথাও বলা হয়েছে, পুরো হামলার পরিকল্পনা ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিল পাকিস্তান। কয়েক মাস আগে বাগরামের বিমান ঘাঁটিতে যে আত্মঘাতী হামলা হয়, তার পেছনেও ছিল হাক্কানি গ্রুপ। আফগানিস্তানে নতুন মার্কিন কমান্ডার জেনারেল পেট্রায়াস নিজে কংগ্রেসের সামনে এক শুনানিতে এ কথা জানান। জেনারেল কায়ানিকে সে কথা বলা হয়েছে বলেও তিনি সে সময় জানিয়েছিলেন।
আফগানিস্তান নিয়ে পাকিস্তানের এই খেলা কয়েক দশক ধরেই চলছে। দুর্বল ও গরিব দেশ, ফলে তার ওপর বন্দুক চালানো সহজ। ভারতও চায় দেশটির ওপর নিজের প্রভাব বজায় রাখতে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ তো রয়েছেই, কিন্তু আসল কারণ সামরিক কৌশলগত। পাকিস্তানি সেনা কৌশলবিদেরা বরাবর যুক্তি দেখিয়েছেন, ব্যাসে যথেষ্ট না হওয়ায় পাকিস্তানের ‘কৌশলগত গভীরতা’ নেই। ভারত আক্রমণ করে বসলে পিছু হটার জন্য দরকার এই ‘স্ট্রাটেজিক ডেপথ’ বা কৌশলগত গভীরতা। তা অর্জন একমাত্র সম্ভব যদি আফগানিস্তানে পাকিস্তানের পা ফেলার মতো জায়গা থাকে। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো গোপন আঁতাতে ভারতের ভয় তাই একদম অযৌক্তিক নয়।
অথচ আফগানিস্তান একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ। তাকে নিয়ে এই যে ফুটবল খেলা চলছে, তার ফলে শুধু আফগানিস্তানই যে অস্থিতিশীল হয়ে থাকছে তা-ই নয়, পুরো অঞ্চলের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও অব্যাহত হুমকির মুখে পড়ে থাকছে। এ অবস্থা বদলাতে হলে আগে দরকার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বই ইঙ্গিত দিয়েছেন পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলাপে তাঁরা আগ্রহী। মধ্য পর্যায়ের শলা-পরামর্শ ইতিমধ্যে শুরুও হয়েছে। এমন শুরু অবশ্য এর আগেও বারকয়েক হয়েছে। কিন্তু আলোচনা কয়েক কদম এগোলেই তা ভণ্ডুল করতে উঠেপড়ে লেগে বসে কোনো কোনো দল। দুই দেশেই রাজনৈতিক দলের কমতি নেই, যারা ভারত-পাকিস্তান প্রতিদ্বন্দ্বিতা জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটতে চায়। পাকিস্তানের সেনা নেতৃত্ব যে নিজেদের সে দেশের ‘সার্বভৌমত্বের একমাত্র গ্যারান্টার’ বলে দাবি করে আসছে, তাও সম্ভব হয়েছে ওই ভারত-জুজুর কথা বলে।
এ অবস্থা বদলাতে হলে দাবিটা উঠতে হবে দুই দেশের মানুষের কাছ থেকে। শান্তি না থাকলে একমাত্র লাভ সেনাকর্তাদের ও জেহাদিদের। আর শান্তি হলে লাভ সাধারণ মানুষের। এ কথাটা যত দিন না উভয় দেশের মানুষ বিশ্বাস করা শুরু করে, তত দিন অবস্থা বদলাবে না। আসিমুল ও রোহানকে একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে খেলতে দেখে মনে হয়েছে এমন পরিবর্তন একদম অসম্ভব নয়।
২৯ জুন ২০১০, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
ভারত-পাকিস্তান মানেই লাঠালাঠি, মারামারি, যুদ্ধ। একজনকে দেখলে আরেকজনের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। অথচ সেই দুই দেশের খেলোয়াড় হয়ে আসিমুল ও রোহান শুধু একসঙ্গে খেলছেনই না, দুজনেই বলেছেন, যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই, আর সে জন্য লড়াই-ফড়াই বাদ দিয়ে আসুন একসঙ্গে টেনিস খেলি। তাঁরা ভারত-পাকিস্তানের ওয়াগাহ সীমান্ত চৌকিতে গিয়ে টেনিস খেলার এক প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়ে বসেছেন।
এমন একটা প্রস্তাবকে স্বাগত না জানিয়ে উপায় নেই। ভারত-পাকিস্তানকে যদি শান্তি ও সহযোগিতার পথে আসতে হয়, তাহলে সবার আগে যেতে হবে সাধারণ নাগরিকদের কাছে। তারা যদি শান্তি ও সহযোগিতার দাবি না তোলে, রাজনীতিবিদেরা ভুলেও সে পথ মাড়াবেন না। একে অপরের দেশকে জুজুবুড়ি বানিয়ে তাঁরা রাজনীতির লাঠিখেলা এ পর্যন্ত তো ভালোই চালিয়ে আসছেন। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা সুষম ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নানা কারণে জরুরি। অন্য সব কারণ ছাপিয়ে যে জন্য শুধু সহাবস্থান নয়, তাদের মধ্যে সহযোগিতা চাই, তা হলো ইসলামি মৌলবাদের আগ্রাসী উত্থান।
ভারত-পাকিস্তানের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে এই অঞ্চলের যে দেশটি সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মুখে পড়েছে, সেটি হলো আফগানিস্তান। যুদ্ধে যুদ্ধে দেশটির এমনিতেই শুকনো চিঁড়ের দশা। একদিকে আল-কায়েদা ও তালেবান, অন্য দিকে মার্কিন নেতৃত্বে বিদেশি সেনা দলের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, তাও প্রায় এক দশক হয়ে গেল। এই যুদ্ধ এখন এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছে যে শুধু বোমা ফেলে বা কামান দেগে তালেবানদের কাবু করা যাবে না এ কথাটা ওয়াশিংটন বুঝতে পেরেছে। তারা এও বুঝেছে, অনন্তকাল এই দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা তাদের পক্ষে অসম্ভব। যেকোনো একটা ফর্মুলায় নিজেদের জয় ঘোষণা করে, আফগানদের হাতে দেশের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে মানে মানে কেটে পড়তে পারলেই তারা বাঁচে। কিন্তু তেমন একটা সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করতে হলে দুটো ঘটনা ঘটতে হবে: এক. তালেবানদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্তি ও আফগানিস্তান প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তানের ঐকমত্য।
তালেবানদের হটানো খুব সহজ নয়। আফগানিস্তান দেশটি তাদের, এর অলিগলি সব তাদের চেনা। মাটি কামড়ে হলেও এখানে পড়ে থাকা সম্ভব। আর বোমাবাজির ফলে যদি থাকা অসম্ভব হয়েই ওঠে, তাহলে পাশের বাড়ির পাকিস্তান তো রয়েছেই। সেখানে তাদের মিত্র পাকিস্তানি তালেবান আছে, খোদ পাকিস্তান সরকারও তাদের জন্য ছাতা খুলে তৈরি। আমেরিকার জন্য পাকিস্তানের এ ব্যবহারটা একদম অসহ্য হয়ে উঠেছে। কাগজ-কলমে সে আমেরিকার মিত্র, কোটি কোটি ডলার তাদের নামে পাঠানো হচ্ছে। অথচ তার পরও তারা সেই তালেবানের দোসর, যারা আফগানিস্তানে মার্কিনি ও ন্যাটো বাহিনীর সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। শুধু এই জুন মাসে তাদের হাতে মারা গেছে ১০০-র ওপরে মার্কিন ও ন্যাটো সেনা। আমেরিকার হাতে এমন প্রমাণ রয়েছে যে তালেবানদের এই আক্রমণের পেছনে অস্ত্র ও বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করছে খোদ পাকিস্তান। পাকিস্তানের সেনা-নিয়ন্ত্রিত একদল ‘পাকিস্তানি তালেবান’ রয়েছে। তার বাইরেও আছে একাধিক পাঞ্জাবি তালেবান বাহিনী, যেমন জইশে মুহাম্মদ, সিপাহি সাহাবা ও হুজি। এরাও কমবেশি পাকিস্তানি সেনা সদর দপ্তরের পৃষ্ঠপোষকতা ভোগ করে আসছে। পাকিস্তান এদের পুষছে দুটো কারণে: ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধে এরা হবে অগ্রবর্তী বাহিনী এবং আফগানিস্তান থেকে আমেরিকানরা হটলেই এদের কাঁধে বন্দুক রেখে কাবুলে আসন গেড়ে বসবে ইসলামাবাদ।
পাকিস্তান যে তালেবানদের সঙ্গে আঁতাত বজায় রেখে চলেছে, সম্প্রতি তা একদম ফর্সা হয়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, আফগানিস্তানে আমেরিকার সামরিক অভিযান তালগোল পাকাচ্ছে দেখে পাকিস্তান নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে এক রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা চেষ্টা চালাচ্ছে আফগান তালেবানদের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে দেশের পশতু রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে এক ধরনের আপসরফা করতে। আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে তারা বোঝাতে চাইছে, আমেরিকা আজ হোক, কাল হোক এ দেশ ছাড়বেই। তখন অতি উগ্র তালেবানদের খপ্পরে দেশটি পড়বে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় তার নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকার সবচেয়ে ভালো পথ হলো তালেবানদের মধ্যে তেমন উগ্র নয় এমন একটি অংশের সঙ্গে রাজনৈতিক রফা সেরে ফেলা। পাকিস্তান জানিয়েছে, এ কাজে তারা সিরাজুদ্দিন হাক্কানির নিয়ন্ত্রিত তালেবান গোষ্ঠীকে আলোচনা ও সমাঝোতার পথে আনতে সক্ষম হবে। এই দলটি তাদের প্রভাবাধীন। শুধু টাকা ও অস্ত্রই নয়, আমেরিকান আক্রমণের মুখে তাদের রক্ষার কাজও করে থাকে পাকিস্তান। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, হাক্কানি গ্রুপের সঙ্গে আপস করার প্রস্তাবটি নিয়ে শলা-পরামর্শে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল কায়ানি ও সেনা গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধান জেনারেল সুজা। গত দুই মাসে তাঁদের প্রতিনিধি দল দফায় দফায় কাবুল সফর করে গেছে, কারজাই ও তাঁর পরামর্শদাতাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক সেরেছে। তাঁরা দুজনও বারকয়েক কারজাইয়ের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠক করেছেন। আমেরিকা সে কথা জানতে পেরে ব্যাপার কী, তা জানতে চেয়েছে। কায়ানি বা সুজা কেউই তার কোনো সদুত্তর দেননি।
কারজাইয়ের নিজের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভালো নয়। তাঁর প্রশাসন দুর্নীতিবাজ, এ কথা খোদ প্রেসিডেন্ট ওবামা একবার নয়, হাজারবার বলেছেন। চলতি আফগান সরকারকে তারা বিশ্বাস করে না, আল-কায়েদা ও তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতা এই সরকারের পক্ষে অসম্ভব সে কথাও মার্কিন নেতৃত্ব রাখঢাক ছাড়াই বলেছে। অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য নেতা পাওয়া গেলে কারজাইকে অনেক আগেই হটিয়ে দেওয়া হতো। এ কথা কারজাই নিজে বোঝেন, তাঁর সহকর্মীদের সে কথা বলেছেনও। এসব কারণে আমেরিকানদের ব্যাপারে কারজাই এতটাই ত্যক্ত-বিরক্ত যে কিছুদিন আগে তিনি মুখ ফসকে বলেই বসেন, অবস্থা না বদলালে তিনি নিজেই হয়তো তালেবানে যোগ দেবেন।
এ অবস্থায় পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে যদি যেনতেন প্রকারের একটি রাজনৈতিক সমাধান অর্জন সম্ভব হয়, বিশেষত তাঁর নিজের গদি অক্ষত রেখে, তাহলে কারজাই তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বলাই বাহুল্য, আমেরিকা ব্যাপারটা মোটেই ভালো চোখে দেখছে না। তালেবানের সঙ্গে বিশেষত কম উগ্র এমন তালেবানের সঙ্গে চুক্তিতে আমেরিকার আপত্তি নেই। কিন্তু ওয়াশিংটনকে না জানিয়ে, তাকে একদম বাদ দিয়ে গোপনে এমন এক চুক্তি হোক, আমেরিকা স্বাভাবিকভাবেই তা চাইবে না। আফগানিস্তানে আমেরিকার প্রধান কৌশলগত লক্ষ্য হলো সেখানে যাতে আল-কায়েদার ঘাঁটি ফের না গড়ে ওঠে তার নিশ্চয়তা। কিন্তু হাক্কানি-জাতীয় খুনে তালেবানের সঙ্গে আঁতাতের ফলে তেমন নিশ্চয়তা পাওয়া অসম্ভব। হাক্কানিরা পশতু, ফলে পশতু গোত্রভুক্ত কারজাই ও তাঁর দলবল এই আঁতাতে আশ্বস্ত হতে পারেন কিন্তু আফগানিস্তানের অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলো, বিশেষ করে উজবেক ও হাজারা, এই আঁতাত মেনে নেবে না। তালেবান আমলে তাদের হাতে এই দুই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছিল। তা ছাড়া হাক্কানি নিয়ন্ত্রিত তালেবান কট্টর মৌলবাদী বলে পরিচিত। তাদের সঙ্গে আল-কায়েদার মতো জেহাদি গ্রুপের সখ্য থাকবে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এ ধরনের যেকোনো আঁতাতের বিরোধিতা আসবে ভারতের দিক থেকেও। এ কথা প্রমাণিত যে আফগানিস্তানের ভেতর এ পর্যন্ত ভারতীয় লক্ষ্যস্থলের ওপর যে কয়টি হামলা হয়েছে, তার অধিকাংশই হাক্কানি গ্রুপের হাতে। মার্কিন মহল থেকে বলা হয়েছে যে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসের ওপর যে রক্তাক্ত হামলা চলে, তাতে হাক্কানি গ্রুপের সদস্যরা জড়িত। এমন কথাও বলা হয়েছে, পুরো হামলার পরিকল্পনা ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিল পাকিস্তান। কয়েক মাস আগে বাগরামের বিমান ঘাঁটিতে যে আত্মঘাতী হামলা হয়, তার পেছনেও ছিল হাক্কানি গ্রুপ। আফগানিস্তানে নতুন মার্কিন কমান্ডার জেনারেল পেট্রায়াস নিজে কংগ্রেসের সামনে এক শুনানিতে এ কথা জানান। জেনারেল কায়ানিকে সে কথা বলা হয়েছে বলেও তিনি সে সময় জানিয়েছিলেন।
আফগানিস্তান নিয়ে পাকিস্তানের এই খেলা কয়েক দশক ধরেই চলছে। দুর্বল ও গরিব দেশ, ফলে তার ওপর বন্দুক চালানো সহজ। ভারতও চায় দেশটির ওপর নিজের প্রভাব বজায় রাখতে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ তো রয়েছেই, কিন্তু আসল কারণ সামরিক কৌশলগত। পাকিস্তানি সেনা কৌশলবিদেরা বরাবর যুক্তি দেখিয়েছেন, ব্যাসে যথেষ্ট না হওয়ায় পাকিস্তানের ‘কৌশলগত গভীরতা’ নেই। ভারত আক্রমণ করে বসলে পিছু হটার জন্য দরকার এই ‘স্ট্রাটেজিক ডেপথ’ বা কৌশলগত গভীরতা। তা অর্জন একমাত্র সম্ভব যদি আফগানিস্তানে পাকিস্তানের পা ফেলার মতো জায়গা থাকে। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো গোপন আঁতাতে ভারতের ভয় তাই একদম অযৌক্তিক নয়।
অথচ আফগানিস্তান একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ। তাকে নিয়ে এই যে ফুটবল খেলা চলছে, তার ফলে শুধু আফগানিস্তানই যে অস্থিতিশীল হয়ে থাকছে তা-ই নয়, পুরো অঞ্চলের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও অব্যাহত হুমকির মুখে পড়ে থাকছে। এ অবস্থা বদলাতে হলে আগে দরকার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বই ইঙ্গিত দিয়েছেন পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলাপে তাঁরা আগ্রহী। মধ্য পর্যায়ের শলা-পরামর্শ ইতিমধ্যে শুরুও হয়েছে। এমন শুরু অবশ্য এর আগেও বারকয়েক হয়েছে। কিন্তু আলোচনা কয়েক কদম এগোলেই তা ভণ্ডুল করতে উঠেপড়ে লেগে বসে কোনো কোনো দল। দুই দেশেই রাজনৈতিক দলের কমতি নেই, যারা ভারত-পাকিস্তান প্রতিদ্বন্দ্বিতা জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটতে চায়। পাকিস্তানের সেনা নেতৃত্ব যে নিজেদের সে দেশের ‘সার্বভৌমত্বের একমাত্র গ্যারান্টার’ বলে দাবি করে আসছে, তাও সম্ভব হয়েছে ওই ভারত-জুজুর কথা বলে।
এ অবস্থা বদলাতে হলে দাবিটা উঠতে হবে দুই দেশের মানুষের কাছ থেকে। শান্তি না থাকলে একমাত্র লাভ সেনাকর্তাদের ও জেহাদিদের। আর শান্তি হলে লাভ সাধারণ মানুষের। এ কথাটা যত দিন না উভয় দেশের মানুষ বিশ্বাস করা শুরু করে, তত দিন অবস্থা বদলাবে না। আসিমুল ও রোহানকে একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে খেলতে দেখে মনে হয়েছে এমন পরিবর্তন একদম অসম্ভব নয়।
২৯ জুন ২০১০, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments