শিল্পীর ভুবন-মেট্রোপল্লির মিহি মন্দিরা by সিলভিয়া নাজনীন

পরিযায়ী পাখির মতো তাঁর বিচরণ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। দেশ-বিদেশের শিল্প-সংস্কৃতির সব অন্ধিসন্ধির খবর নিয়ে তিনি ঋদ্ধ করেন তাঁর ভাবনাবলয়। শিল্পী কালিদাস কর্মকার বাংলার শেকড় থেকে রস আস্বাদন করে ছড়িয়ে পড়েন বিশ্বব্যাপী।


শেষ পর্যন্ত এই জলাভূমির পলিমাটি আর নদীবিধৌত কুমোরপল্লির শিল্পিত গড়নই তাঁর আরাধ্য হয়ে ওঠে। কামার-কুমোর-স্বর্ণকার-কর্মকারের শৈল্পিক দান তাঁর রক্তে বহমান সুপ্রাচীন কাল থেকে। শিল্পের সঙ্গে বসবাসকে তিনি মনে করেন তাঁর উত্তরাধিকার।
আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ ছাপচিত্রের একটি স্টুডিও রয়েছে মালিবাগের কসমস আঁতেলিয়া ’৭১-এ। শিল্পী কালিদাস কর্মকারের সঙ্গে শিল্পবিষয়ক নানা আলাপ হয়েছিল এই স্টুডিওতে। ‘আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। আমার শিক্ষাজীবনে খুব কাছ থেকে একবার দেখার সুযোগ হয় তাঁকে, চারুকলায় বসে ছাত্রছাত্রীদের তিনি একটা পেপারে মার্কার দিয়ে একটানে একটি গরুর মাথা এঁকে দেখিয়েছিলেন। খুব অল্প সময়ে তিনি তা এঁকেছিলেন, তাঁর রেখার গতি দেখে এক অদ্ভুত মন্ত্রমুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল সে সময়, আর সেটা এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।’ শিল্পী কালিদাস স্মৃতি হাতড়ে বলেন, দুরন্ত শৈশব ছিল তাঁর, কোনোভাবেই লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল না। আর শিল্পী হওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষাই ছিল না। শুধু নিরীক্ষাপ্রবণতা ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে কাজ করত। পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি আম আর বরইগাছকে ড্রাফটিং করে চেষ্টা করেছিলেন নতুন কোনো বৃক্ষের উৎপাদন। ‘তবে ছবি আঁকার জন্য যে দক্ষতা দরকার, তা আমার বরাবরই ছিল। কারণ আমরা কর্মকার পরিবার। গয়না বানানোটা বংশগত ঐতিহ্য। তাই আমরা বেড়ে উঠেছি এই দক্ষতা নিয়ে। ছবি আঁকতে কোনো কষ্ট হয়নি, এটা রক্তের মধ্যেই রয়েছে, এই ক্রিয়েটিভ সেনসিবিলিটি ইনহেরিট করেছি আমি। এখন লেখাপড়া করে, দেশের বাইরে যাওয়া-আসা সব মিলে আরও কিছু নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো তৈরি হয়েছে।’
শিল্পী কালিদাস ’৬২ সালে ঢাকায় শিল্প-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন। শিল্পীরা একটি আঙ্গিকে ছবি আঁকা রপ্ত করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেন সেই একই ছবি এঁকে। ‘আমার ছবিতে নিরীক্ষাপ্রবণতা বেশি। আমি যা আঁকি তা আবার নতুন কিছু বিনির্মাণের তাগিদ থেকে ভেঙে বদলে ফেলি। তাই নির্দিষ্ট কোনো প্রবণতা বা স্টাইল আমার নেই।’ শিল্পী কালিদাসের করণকৌশল শিল্পের অন্যান্য প্রয়োজনীয় শুদ্ধতাকে ম্লান করে দেয়। তিনি প্রথাগত চর্চাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যান নতুন সৃষ্টির পথে।
আর্য আর দ্রাবিড়দের সংমিশ্রণে বলা হয় বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্ম। ব্রাহ্মণ যাদের বলা হয়, তারাও অন্য জায়গা থেকে এসেছিল। অথচ বাঙালি হলো কৃষক-কর্মকার-সূত্রধর-জেলে-জোলা-কুমোর-কামার—যারা এখানে খেটে খাওয়া, উৎপাদনের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল। এই মানুষের জীবনযাত্রায় সময় বা শাসক তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। কারণ সমাজের যেকোনো শ্রেণীর মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে এই জনগোষ্ঠী অপরিহার্য ছিল। তাই তারা নিজেদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের চর্চায় নিয়োজিত থাকতে পেরেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
‘বিশ্বশিল্প ভুবনে বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পের পরিচিতি বা গুরুত্ব শূন্য।’ এভাবেই হতাশা ব্যক্ত করেন কালিদাস। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ছাড়া অন্য কোনো দেশেরই এখানকার শিল্প বা শিল্পী সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এ দেশে ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে শিল্প-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্মের পরই শিল্পের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়। অথচ হাজার বছর আগের কষ্টিপাথরের যে দারুণ ভাস্কর্য এ দেশের বিভিন্ন জাদুঘরে রয়েছে তা থেকে বোঝা যায়, বাংলায় প্রতিভাবান শিল্পীর অভাব ছিল না। আর সেই প্রতিভার বিকাশে সমাজ আদৌ কোনো সহযোগিতা করেনি বলেই মনে হয়। শিল্পী কালিদাস বলেন, এখনো বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পকলা দেখে বলা যায় না এটা এখানকার শিল্প। কোনো নির্দিষ্ট ধারা গড়ে ওঠেনি। কিন্তু বেশ কিছু এলিমেন্ট রয়েছে, যা হয়তো আরও চর্চায় গড়ে তুলবে এ দেশের শিল্পের এক নতুন নিজস্ব ভাষা। আবার এটাও সত্য, যেকোনো ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে সমকালীন শিল্পকে আবদ্ধ করা ঠিক নয়।
প্রকৃত অর্থে যেকোনো দেশের শিল্পচর্চায় সেখানকার ঐতিহ্য-পরিবেশ-জনগোষ্ঠী-সংস্কৃতি প্রধান ভূমিকা রাখে। সে কারণেই এই ভূমিসন্তানেরা আধুনিক যুগে হয়ে ওঠে শিল্পী শব্দের জীবন্ত প্রতিভূ। সুফলা বাংলার শ্যামল ভূমিতে শিল্পীদের পুনর্জন্ম হোক বারবার।

শিল্পী কালিদাস কর্মকার: জন্ম ১৯৪৬ সালে ফরিদপুর জেলায়। প্রিডিগ্রি ১৯৬৪ সালে বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গভর্নমেন্ট ফাইন আটর্স অ্যান্ড ক্র্যাফটস কলেজ, কলকাতা থেকে স্নাতক ১৯৬৯ সালে। দেশ-বিদেশে বহু একক এবং যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন।

No comments

Powered by Blogger.