স্মরণ-তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া by আহমেদ রিয়াজ
একবার মোনায়েম খাঁ ঘোষণা দিলেন, মানিক মিয়াকে ঢাকা শহরে খড়ম পায়ে হাঁটিয়ে ছাড়বেন। মানিক মিয়া রাগলেন না। ঘটনাটি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝির। আইয়ুব খান আর মোনায়েম খাঁ, দুজনই বেজায় নাখোশ মানিক মিয়ার ওপর। কত বড় সাহস! খান সাহেবের সমালোচনা হয় মানিক মিয়ার পত্রিকা ইত্তেফাকে? যদিও ইত্তেফাক তখনো বন্ধ।
তবু মানিক মিয়াকে ভীষণ ভয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর।
নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে কখনোই মাথা নোয়াননি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। সে যত বড়ই ক্ষমতাশালী হোক। জন্ম তাঁর পিরোজপুরের কচা নদীর তীরের গ্রাম ভাণ্ডারিয়ায় ১৯১১ সালে। বাবা মুসলেম উদ্দিন। ছোটবেলা থেকেই মা-হারা। ভাণ্ডারিয়া মডেল প্রাইমারি স্কুলে শুরু হয় লেখাপড়া। এরপর ভর্তি হন ভাণ্ডারিয়া হাই স্কুলে। এখানে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর চলে যান পিরোজপুর সরকারি হাই স্কুলে। এ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর বরিশাল বি এম কলেজ থেকে বিএ পাস করেন ১৯৩৫ সালে।
চাকরি শুরু করেন পিরোজপুর সিভিল কোর্টে। চাকরি করার সময়ই তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সানি্নধ্যে আসেন।
মানিক মিয়াকে কলকাতার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেন সোহরাওয়ার্দী। ফলে কলকাতায় গিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ভালোভাবেই জড়িয়ে পড়েন মানিক মিয়া। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারির পদ ছেড়ে দেন। যোগ দেন 'দৈনিক ইত্তেহাদ'-এর পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে।
১৯৪৯ সালে আবির্ভাব ঘটে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাক। সম্পাদক হন মানিক মিয়া। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। নির্বাচনে মুসলিম লীগের ব্যাপক ভরাডুবি হয়। এই ভরাডুবির পেছনে ছিল দৈনিক ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার 'মোসাফির' ছদ্মনামে ক্ষুরধার লেখা।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হয়। ১৯৫৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। মুক্তি পান কিছুদিন পর। ১৯৬২ সালে আবারও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মানিক মিয়া।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। মানিক মিয়াকে আবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁর 'নিউ নেশন' প্রেসও বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।
১০ মাস পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। শেষে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ইত্তেফাক পত্রিকার প্রেস মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। দুই বছর সাত মাস পর ১৯৬৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আবার ইত্তেফাকসহ তিনটি পত্রিকার পুনঃ প্রকাশ শুরু হয়। ১৯৬৯ সালের ১ জুন মানিক মিয়া মৃত্যুবরণ করেন।
আহমেদ রিয়াজ
No comments