কালের পুরাণ-পাকিস্তানি নেত্রীর কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার by সোহরাব হাসান

পাকিস্তান সরকার যখন একাত্তরে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করে চলেছে, দেশের ভেতরেও মতলববাজেরা ‘পুরোনো বিষয়’ নিয়ে জাতিকে বিভক্ত না করার উপদেশ দিচ্ছে, তখন পাকিস্তানি নাগরিকসমাজের দুই প্রতিনিধির বাংলাদেশে এসে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ নিঃসন্দেহে আমাদের সাহসী করে তোলে।


তাঁদের মানবতাবোধ ও বিবেককে সালাম জানাই। অনেকের ধারণা, পাকিস্তানি মানেই খারাপ, আর বাংলাদেশের মানুষ সব ফেরেশতা। এ ধারণা যে কতখানি ভুল, তার উজ্জ্বল উদাহরণ পাকিস্তানের নারীনেত্রী নাসিম আখতার ও আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাফর মালিক। সম্প্রতি তাঁরা ঢাকায় এসেছিলেন যুদ্ধাপরাধের বিচারসংক্রান্ত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। পাকিস্তান ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন।
গত বৃহস্পতিবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সংবর্ধনা সভায় নাসিম আখতার যে বক্তব্য দেন, তা আমাদের নতুন করে ভাবায়, উজ্জীবিত করে। তিনি সেই মহীয়সী নারী, যিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী। আরও অনেকের সঙ্গে তিনি এসেছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বৈঠকে যোগ দিতে। ২৫ মার্চ রাতে ট্রাকে করে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিমানবন্দরে। নাসিম আখতার রাস্তার দুই পাশে সারি সারি লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন, বাড়িঘরে আগুন জ্বলতে দেখেছেন। তিনি যখন তাঁর মাতৃভাষায় এসব বর্ণনা করছিলেন, তখন পুরো কক্ষে ছিল পিনপতন নীরবতা। তাঁর আবেগঋদ্ধ উচ্চারণ ও বলিষ্ঠ কণ্ঠ ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিল। লাহোরে ফিরে গিয়ে নাসিম আখতার সতীর্থদের নিয়ে গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ৪০ জনের বেশি লোকের স্বাক্ষর নিতে পারেননি। তিনি জেলখানায় বাঙালি বন্দীদের জন্য খাবার নিয়ে যেতেন, তাঁদের সাহস জোগাতেন। ষোলোই ডিসেম্বর, যেদিন পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে, সেদিন নাসিম আখতার জেলখানায় বাঙালি বন্দীদের বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার খবরটি জানিয়ে তাঁদের সঙ্গে নিজেও উচ্চারণ করেছিলেন ‘জয় বাংলা’। বৃহস্পতিবারও তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনে সভাকক্ষের সবাই চমকিত হয়েছিলেন।
একাত্তরের সেই বৈরী পরিবেশে পাকিস্তানে আরও যাঁরা গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, নাসিম আখতারের স্বামী ও পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শামিম আশরাফ মালিক, শান্তি আন্দোলনের কর্মী তাহেরা মাজহার আলী ও সাংবাদিক মাজহার আলী (প্রখ্যাত ছাত্রনেতা-লেখক তারেক আলীর মা ও বাবা), তরুণ কবি আহমেদ সেলিম প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে মাজহার আলী ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং ডন-এ গণহত্যার ওপর ধারাবাহিক নিবন্ধ লিখেছিলেন। যে কারণে তাঁর চাকরি চলে যায়।
দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার ৩৯ বছরেও আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারিনি। এ জন্য কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে দায়ী করা ঠিক হবে না। এ ব্যর্থতা সবার। একাত্তরে আমরা সবাই মিলে স্বাধীনতা চেয়েছিলাম বলেই দেশ স্বাধীন হয়েছে, দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের লজ্জাজনকভাবে পরাজিত করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি নানা দল ও উপদলে ছত্রখান হয়ে যায়। যার সুযোগটি নিয়েছে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। তারা আজ যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে আস্ফাালন করার সাহস পাচ্ছে। ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে।
নব্বইয়ের দশকে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আমরা একতাবদ্ধ হয়েছিলাম। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারে তথ্যপ্রমাণও জোগাড় করা হয়েছিল। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি, যারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সহায়তায় ক্ষমতায় এসেছিল। তারা শুধু এ বিচারেরই বিরোধিতা করেনি, বিচারের উদ্যোক্তাদের দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও বিচারের বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়। দ্বিতীয় দফায় বিএনপি শুধু জামায়াতের সমর্থন নিয়ে নয়, তাকে অংশীদার করেই ক্ষমতায় এসেছিল। ২০০১—২০০৬ বিএনপির শাসনকালে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের উত্থান ঘটে, বোমাবাজি ও সন্ত্রাসের কালো ছায়ায় দেশ বিপন্ন হয়ে পড়ে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি সামনে চলে আসে। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার। প্রথমে এ নিয়ে সরকারের মধ্যে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও এখন মনে হচ্ছে, তারা যুদ্ধাপরাধের বিচারে আগ্রহী। ইতিমধ্যে বিচারের আইনগত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তদন্ত কমিটিতে আরও তিনজন কর্মকর্তা যুক্ত হয়েছেন, গঠিত হয়েছে আদালত ও আইনজীবী প্যানেল।
দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল বলে তাদের বিচার করতে হবে—এটি একমাত্র যুক্তি নয়। একাত্তরে এ দেশে গণহত্যা হয়েছে, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে, মা-বোনের ওপর অত্যাচার হয়েছে। এগুলো জঘন্য অপরাধ। এর বিচার হতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৬৫ বছর পরও যদি নাৎসি অপরাধীদের বিচার হতে পারে, তাহলে একাত্তরের ঘাতকেরা রেহাই পাবে কেন? অনেকে যুক্তি দেখাচ্ছেন, যুদ্ধাপরাধের মূল হোতা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আমরা কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারিনি। তাদের সহযোগীদের বিচার করে কী লাভ? এটি যুক্তি নয়, কুযুক্তি। তা ছাড়া পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের নিঃশর্ত ক্ষমা করা হয়নি। ১৯৭৪ সালের সিমলা চুক্তির শর্ত ছিল, পাকিস্তান সরকার তাদের বিচার করবে। তারা সেই শর্ত ভঙ্গ করেছে। এর দায় বাংলাদেশের নয়। পাকিস্তানের নাগরিক সমাজের অনেক প্রতিনিধি এখনো মনে করেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া উচিত। যদিও পাকিস্তান সরকারের মনোভাব ইতিবাচক নয়।
প্রশ্ন উঠেছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়ে। নিরপেক্ষতা শব্দটি প্রতারক। সত্য ও অসত্যের মধ্যে, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে কেউ নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। পৃথিবীর যেসব দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে, সেসব দেশ আন্তর্জাতিক নীতি ও আইন অনুসরণ করেছে। বাংলাদেশও বলেছে, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (আদালত) আইনে এর বিচার হবে। তা ছাড়া এ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা যাবে। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে অযথা হইচই ও উত্তেজনা সৃষ্টির কারণ নেই। এসব তারাই করছে, একাত্তরে যাদের ভূমিকা ছিল কালিমালিপ্ত। আবার সরকারের কোনো মন্ত্রীর বক্তব্য, সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের অতি উৎসাহও বিচারের বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পূর্ণ আইন-আদালতের বিষয়। এ নিয়ে আদালতে যুক্তিতর্ক হবে, তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে রায় হবে। মাঠে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে কাউকে অপরাধী চিহ্নিত করা কিংবা খালাস দেওয়া যাবে না।
১৯৭১ সালে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের ভূমিকা কী ছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতেই যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে। অন্য কোনো বিবেচনা এখানে আসতে পারে না। কে কোন দলের নেতা বা কর্মী, তাও নয়। ক্ষমতার শরিক বলে কাউকে রেহাই দেওয়া বা বিরোধী দলের বলে কাউকে ধরে আনার নীতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে না, বরং একটি মহৎ উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হবে, যা কারও কাম্য নয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী একটি সত্য কথা বলেছেন, শিবিরের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেওয়া উচিত নয়। যারা শিবির করে তাদের বয়স ১৮ থেকে ২৫। তারা কোনোভাবেই একাত্তরের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল না। একই কথা প্রযোজ্য জামায়াতের অনেক নেতার ক্ষেত্রেও। এ দলের সবাই গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে শরিক হয়নি। যারা স্বাধীনতার পর দলে যুক্ত হয়েছেন, তাঁরা কেন একাত্তরের অপরাধের দায় নেবেন?
অস্বীকার করার উপায় নেই, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে যেমন জনমত গঠনে নানা উদ্যোগ আছে, তেমনি একটি গোষ্ঠী তাদের বাঁচাতেও উঠেপড়ে লেগেছে। সম্প্রতি লন্ডনে জামায়াতে ইসলামীর সহায়তায় একটি সেমিনার হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। জামায়াতের নেতারা যদি একাত্তরের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত না হবেন, তাহলে বিদেশে এ অপতৎপরতা কেন?
২৭ জুনের হরতালকে সামনে রেখে সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতিতে যে উত্তাপ লক্ষ করা গিয়েছিল, হরতালের পর তা আরও বেড়েছে। রাজধানীর হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়েছে মফস্বল পর্যন্ত। কারও কারও মতে, সরকার হঠাৎই কঠোর অবস্থানে। কিন্তু বিরোধী দল তো আগে থেকেই কঠোর অবস্থানে ছিল। বিএনপি শুরু থেকেই নির্বাচনের ফল মানতে চায়নি, তারা বর্তমান সরকারকে এক-এগারোর পরবর্তী সরকারের বর্ধিত রূপ বলে দাবি করে আসছিল। এর অর্থ নির্বাচনের রায় অস্বীকার।
প্রশ্ন উঠেছে সম্প্রতি জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় তিন নেতার গ্রেপ্তার নিয়েও। তাঁদের বিরুদ্ধে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে। তবে গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্য মামলায়। সে মামলার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন আছে। একটি সমাবেশে কয়েকজন জামায়াত নেতার বক্তব্য ধরে ধর্ম অবমাননার মামলা দায়ের এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে হাতিয়ার এত দিন ধর্মবাদী জামায়াত ব্যবহার করেছে, সেই হাতিয়ার কেন সেক্যুলার সরকার ব্যবহার করবে? পরে অবশ্য তাদের হরতালের সময় সন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুর ও হত্যা মামলায়ও গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
একাত্তরে এ দেশে যে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও লুটপাট হয়েছে, সেটি প্রমাণিত সত্য। অতএব যুদ্ধাপরাধের বিচার হতেই হবে। এ থেকে পিছিয়ে আসার কোনো পথ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিতর্ক হবে, প্রশ্ন উঠবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নিয়েও নানা কথা উঠেছিল। কিন্তু আইন ও সত্যের পক্ষে সেই বিচার হয়েছিল বলে কেউ বিরোধিতা করতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধের বিচারেও সেই ন্যায় ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। কোনো অপরাধী শাস্তির বাইরে থাকবে, সেটি যেমন কাম্য নয় তেমনি কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি নাজেহাল হবে না, সেই নিশ্চয়তাও থাকতে হবে।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.