নির্বাহী বিভাগের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে-৩১ কর্মকর্তাকে হাইকোর্টে তলব
তিন মাসে ৩১ জন সরকারি কর্মকর্তার হাইকোর্টে হাজির হওয়ার ঘটনা সাধারণভাবে প্রমাণ করে যে বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জনপ্রশাসন অস্বস্তি অনুভব করছে। তাঁদের অনেকেই নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। আদালত অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে উল্লেখযোগ্য সময় দাঁড় করিয়ে রাখছেন। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য করার যে মনোভাব, তার মূল সুর আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে। স্বাধীন বিচার বিভাগের অস্তিত্ব অস্বীকার করার পরিণতি আমাদের জন্য অনেক বিপদ ডেকে আনছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে ৩১ কর্মকর্তার হাইকোর্টে হাজিরা সমস্যার গভীরতার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। অন্য বিবেচনায় যে যত বড়ই হোন, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন। আমাদের সমাজে এই বিষয়টি এখনো অনেকটা কথার কথা হিসেবে বিবেচিত। এর বড় কারণ, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে রাখার প্রবণতা দেখিয়ে চলেছেন। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে সর্বত্র। সমাজপতিরা অনেক সময় আদালতের কাছ থেকেই অন্যায্য অনুকূল আদেশ পেয়ে থাকেন।
জনপ্রশাসনে আদালতের আদেশ অমান্য করাটা একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কখনো কখনো, এমনকি অভ্যাসবশত আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য বা উপেক্ষা করা হয়। এটা যে সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্রয়ে করা হয়, তা নয়। ইদানীং মনে হচ্ছে, আমলাতন্ত্রের একটি অংশ আদালতের আদেশ অমান্য করার ক্ষেত্রে নিজেরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলটি ছিল অরাজনৈতিক। সে সময় ১৯২৬ সালের আদালত অবমাননা আইনটিকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হলে আমরা তাকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। কিন্তু অধ্যাদেশ জারির পর আমরা অন্তত একটি বিধান দেখে বিস্ময়ে হতবাক হই। যার মোদ্দা কথা ছিল, সরকারি কর্মকর্তারা আদালতের আদেশ যত দূর সম্ভব পালনের চেষ্টা করবেন। কিন্তু যদি বিদ্যমান আইন ও বিধির কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা যাবে না। বোঝাই যায়, যে মহলটি এ রকম বিধান ঢোকাতে সক্ষম হয়েছে, তারা যথারীতি শক্তিশালী রয়েছে।
অন্যদিকে আদালতের আদেশ যে আদালতের দ্বারাই অগ্রাহ্য হচ্ছে, সেই নজিরও কিন্তু কম নয়। আদালত অবমাননা একটি ফৌজদারি অপরাধ। এবং তার জন্য কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। যদিও খুবই বিরল ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা হয়। হাইকোর্টের আদেশ অধস্তন আদালত অমান্য করলে আদালত অবমাননা হয়। আবার আপিল বিভাগের আদেশ হাইকোর্ট বিভাগ অমান্য করলেও একই ধরনের অপরাধের উন্মেষ ঘটে। ফলে বিষয়টি শুধু এমন নয় যে, বিচ্যুতি শুধু জনপ্রশাসনে ঘটছে।
৩১ কর্মকর্তার আদালতে হাজিরার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম বলেন, ‘কেউ সংক্ষুব্ধ হলে আপিল বিভাগে যাবেন। তবে আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য হওয়া উচিত নয়।’ কিন্তু এখন এটা ভাবার সময় এসেছে, সরকারের ওপর জারি করা আদেশ সব ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের মাধ্যমে দ্রুত সুরাহার যে বিধিব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে, তার খোলনলচে পাল্টানো উচিত কি উচিত নয়। অনেক সময় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অলিখিত হুকুম সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মেনে চলেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে রক্ষা পান। প্রকৃত দোষী আড়ালে থাকেন। অভিযুক্ত কর্মকর্তার জন্য আদালত অবমাননার মামলা পরিচালনা করাও বিড়ম্বনার। সব মিলিয়ে এ ক্ষেত্রে যদি একটা যান্ত্রিকতা ভর করে, তাহলে তা চলতে দেওয়া সমীচীন নয়।
No comments