রুশ ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট: তুরস্ক কি আমেরিকার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে? by শাকিল আনোয়ার
তুরস্কে এস ফোর হানড্রেড |
মুসলিম প্রধান তুরস্কের সাথে পাশ্চাত্যের দীর্ঘদিনের সামরিক এবং রাজনৈতিক মৈত্রী যে মাত্রায় হুমকিতে পড়েছে তা প্রায় নজিরবিহীন।
যুক্তরাষ্ট্র
এবং নেটো সামরিক জোটের বহু অনুরোধ উপরোধ এবং সবশেষে হুমকির তোয়াক্কা না
করে তুরস্ক রাশিয়ার কাছে থেকে অত্যাধুনিক এস-৪০০
ক্ষেপণাস্ত্রের চালান নিতে শুরু করেছে।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়,
যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে তুরস্ককে একশর মতো অত্যাধুনিক এফ-৩৫
যুদ্ধবিমান বিক্রির চুক্তি তারা স্থগিত করছে। একইসাথে, তারা তুরস্কের ওপর
নিষেধাজ্ঞা চাপানোর পরিকল্পনা শুরু করেছে, যদিও সেই নিষেধাজ্ঞার মাত্রা কী
হবে তা এখনও খোলাসা করা হয়নি।
তুরস্কের পাশ্চাত্য সামরিক মিত্ররা
মানতে পারছে না যে নেটোর সদস্য হয়েও তুরস্ক রাশিয়ার কাছে থেকে কৌশলগতভাবে
গুরুত্বপূর্ণ এমন ক্ষেপণাস্ত্র কিনছে।
তুরস্কের বক্তব্য যে তারা
বাধ্য হয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগেই তুরস্ক আমেরিকার কাছ থেকে তাদের
প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে চেয়েছিল। ওবামা প্রশাসন বেশ কিছুদিন
ঝুলিয়ে রেখে তুরস্ককে জানিয়ে দেয় প্যাট্রিয়ট তাদের দেয়া হবেনা।
প্রত্যাখ্যাত
হয়ে ২০১৭ সালে তুরস্ক নেটোর সদস্য হওয়া স্বত্বেও জোটের প্রধান বৈরি
শক্তি রাশিয়ার দ্বারস্থ হয়। প্রস্তাব সাথে সাথেই লুফে নেয় রাশিয়া, যদিও
এখন পর্যন্ত চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশে এখনও তারা এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র
বিক্রি করেনি।
আঙ্কারার কাছে একটি এয়ারফিল্ডে এস ফোর হানড্রেডের সরঞ্জাম নিয়ে একটি রুশ বিমান |
তখন থেকেই আমেরিকা এবং নেটো জোটের পক্ষ থেকে তুরস্ককে
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র কেনা থেকে বিরত রাখার বহু চেষ্টা হলেও প্রেসিডেন্ট
এরদোয়ানকে টলানো যায়নি।
কিন্তু তুরস্ক এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের সম্পর্কে অবিশ্বাস এতদূর গড়ালো কীভাবে?
কুয়ালালামপুরে
মালয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সমর-বিদ্যা বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দ
মাহমুদ আলী বিবিসিকে বলেন, এই দূরত্ব একদিনে তৈরি হয়নি। অনেক বছর ধরে ধীরে
ধীরে এটি বেড়েছে।
কেন তুরস্ক এই সম্পর্ককে আর আগের মতে গুরুত্ব দিচ্ছেনা - তার কিছু কারণ উল্লেখ করেন ড. আলী।
১. মুসলিম তুরস্ক
বিশ বছরেরও
বেশি সময় ধরে তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢোকার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি
এবং পারবে বলেও তারা এখন আর বিশ্বাস করেনা । অথচ একই সময়ে তুরস্ক দেখছে
যে তাদের পাশ কাটিয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে এক এক করে ইইউ জোটে নেয়া
হয়েছে। ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, "কেন তাদের নেওয়া হয়নি তার কারণ
স্পষ্ট করে বলা না হলেও তুরস্ক বিশ্বাস করে মুসলিম প্রধান দেশ বলেই তাদেরকে
অগ্রাহ্য করা হয়েছে।"
২. গুলেন ফ্যাক্টর
ড.
আলীর মতে, এরদোয়ান সরকারের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং স্পর্শকাতর বিষয়
হয়ে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তুর্কি ইসলামি রাজনীতিক ফেতুল্লা
গুলেন। দু বছর আগে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য তাকেই নাটের গুরু
হিসাবে দায়ী করেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। তাকে বিচারের জন্য তুরস্কে
পাঠানোর দাবি বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে আমেরিকা। বরঞ্চ আমেরিকার সরকারের
সহযোগিতায় মি. গুলেন আমেরিকাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিশাল
ইসলাম শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। একটি রাজনৈতিক সংগঠনও তৈরি করেছেন।
৩. কুর্দি ভীতি
কুর্দিরা
বহুদিন ধরে তুরস্কে যে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদি আন্দোলন করছে তাকে
তুরস্কের সরকার দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বিরাট একটি হুমকি হিসাবে
বিবেচনা করে। ইরাক এবং সিরিয়ায় কুর্দিদের সাথে আমেরিকার যেভাবে সখ্যতা
দিনে দিনে বেড়েছে তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে তুরস্ক।
ড. আলী বলেন,
"এরদোয়ান বারবার আমেরিকাকে বলেছেন কুর্দিরা আমাদের শত্রু। তোমরা তাদের
সমর্থন দিয়ে তাদেরকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাচ্ছো, সশস্ত্র বাহিনী গড়ে
তুলতে তাদের সাহায্য করছো। এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থ বিরোধী, এটা আমরা হতে
দেবনা।"
বিবিসির প্রতিরক্ষা বিষয়ক ভাষ্যকার জনাথন মার্কাস বলছেন,
নেটোর দাবি- হুমকি-অনুরোধ উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র
ক্রয় তুরস্কের 'সামরিক-রাজনৈতিক কৌশলে' মৌলিক একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
তিনি মনে করেন এর পেছনে তুরস্কের যে তাড়না তার মূলে রয়েছে কুর্দিদের
ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থান। "এক কথায় সেটিই মূল কারণ।"
ইরাক
এবং সিরিয়ায় আমেরিকার ভূমিকা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছে তুরস্ক।
কীভাবে কুর্দিরা শক্তিশালী হচ্ছে তা দেখছে। জনাথন মার্কাস বলছেন, "এটিই এখন
তুরস্কের এক নম্বর নিরাপত্তা উদ্বেগ।"
তুরস্ক কি পশ্চিমা বলয় ছাড়ছে ?
পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশ্ন উঠছে তুরস্ক কি পাশ্চাত্যের সামরিক বলয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে?
ড.
সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন, "তুরস্ক বেরিয়ে যেতে চায়না, কিন্তু গত ৬/৭ বছরে
তাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে তুরস্কের ভেতর সংশয় দেখা দিয়েছে যে
পাশ্চাত্য তাদের সত্যিকারের মিত্র হিসাবে দেখেনা এবং কোনো দিন হয়তো
দেখবেও না।"
শুধু এরদোয়ান সরকার নয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য বিশ্বকে নিয়ে তুরস্কের সাধারণ মানুষের ভেতরেও বৈরি মনোভাব তীব্রতর হচ্ছে।
এ
মাসের গোঁড়ায় তুরস্কের কাদির হাস ইউনিভার্সিটি ব্যাপক একটি জনমত জরিপ
করেছে। জরিপে প্রশ্ন করা হয় - আমেরিকা এবং নেটোর তীব্র আপত্তি এবং
নিষেধাজ্ঞার হুমকি উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনা
কি উচিৎ হচ্ছে? ৪৪% উত্তরদাতা বলেছেন, কেনা উচিৎ। অন্যদিকে ২৫ শতাংশের মত
বলেছেন উচিৎ নয়।
আমেরিকা এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তুরস্কের সাধারণ মানুষের মনোভাবও যে বদলে যাচ্ছে সেটাও বেরিয়ে এসেছে এই জরিপে।
প্রায়
৮১% উত্তরদাতা বলেছেন আমেরিকা তুরস্কের জন্য হুমকি। অন্যদিকে ৫৫%
উত্তরদাতা রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে ইতিবাচক বিষয় বলে মতামত দিয়েছেন।
কেন আমেরিকা ক্ষিপ্ত
কোনো নেটো জোটের সদস্য দেশের পক্ষ থেকে রাশিয়ার কাছ থেকে অত্যাধুনিক কৌশলগত অস্ত্র কেনা নজিরবিহীন।
শুধু
গ্রিসের কাছে রুশ এস থ্রি হানড্রেড ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে তবে গ্রিরীস তা
পেয়েছে পরোক্ষভাবে। সাইপ্রাস তা কিনেছিল এবং তুরস্কের তীব্র আপত্তির মুখে
সেগুলো তারা গ্রিসকে দিয়ে দেয়।
আমেরিকার প্রধান উদ্বেগ -
নিরাপত্তা। তারা ভয় পাচ্ছে, এস-৪০০ স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রশিক্ষণের
জন্য প্রচুর রুশ সামরিক প্রশিক্ষক এবং প্রকৌশলী তুরস্কে যাতায়াত করবে।
ফলে তুরস্কের আকাশে যদি এফ-৩৫ ওড়ে তখন কাছে বসে সহজে ঐ বিমান সম্পর্কে
গোয়েন্দাগিরির সুযোগ পেয়ে যাবে রাশিয়া।
ফলে কৌশলগত-ভাবে সেই সম্ভাবনাকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে আমেরিকা।
একশর
মতো এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে বহুদিন ধরেই তুরস্কের সাথে আমেরিকার
বোঝাপড়া হয়ে ছিল। এই বিমানের অনেক যন্ত্রাংশ তুরস্কে তৈরি হচ্ছে। এফ-৩৫
চালানোর প্রস্তুতি হিসাবে তুরস্কের বিমানবাহিনীর বৈমানিকরা যুক্তরাষ্ট্রে
প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন।
কিন্তু ক্ষুব্ধ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মঙ্গলবার
জানিয়ে দেন, এফ-৩৫ বিমান তুরস্কের কাছে বিক্রি করা হবেনা। তবে তিনি এই
পরিস্থিতির জন্য তার পূর্বসূরি বারাক ওবামাকে দায়ী করেছেন। তার কথা,
প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে না পেরে তুরস্ক বাধ্য হয়ে রাশিয়ার
দ্বারস্থ হয়েছে।
জানা গেছে, এফ-৩৫ চালানোর যে প্রশিক্ষণ তুর্কি বৈমানিকদের দেওয়া হচ্ছিল, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, এফ-৩৫ বিমানের যেসব যন্ত্রাংশ তুরস্কে তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর উৎপাদন অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
তবে
তুরস্ক এসব হুমকি ধামকিতে কান দিচ্ছেনা। তারা বলছে, ২০১৭ সালে করা চুক্তির
শর্ত হিসাবে এরই মধ্যে ২০০ কোটি ডলার রাশিয়াকে দেওয়া হয়ে গেছে, সুতরাং
এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রশ্ন নেই।
গত সপ্তাহে এস-৪০০ সরবরাহ
শুরু হয়েছে। রোববার পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্রের যন্ত্রাংশ নিয়ে ১২টি রুশ
সামরিক বিমান আঙ্কারার কাছে মুরতেদ সামরিক এয়ারফিল্ডে এসে নেমেছে।
লাভ-ক্ষতির হিসেব-নিকেশ
তুরস্ক
এবং পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কে এই সঙ্কটের পরিণতি কী? নেটোতে তুরস্কের
অবস্থান কি আল্গা হয়ে পড়বে? নাকি আমেরিকা তুরস্কের গুরুত্ব বুঝে আপোষ
করবে?
ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, যদি আমেরিকা নমনীয় না হয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তুরস্কের অর্থনীতির বর্তমান সঙ্কট আরো বাড়বে।
তবে
তিনি বলেন, নেটোর জন্য তুরস্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তুরস্ক
নিষ্ক্রিয় হলে ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে নেটোর প্রতিরক্ষা বলয় হুমকিতে
পড়বে।
তার মতে, এ কথা এখনই বলা যাবেনা যে তুরস্ক পাশ্চাত্য বলয়
থেকে নিশ্চিতভাবে সরে যাচ্ছে। যদিও এটা ঠিক যে তুরস্ক পাশ্চাত্যের কাছ থেকে
অনেক কিছু প্রত্যাশা করেছিল, কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশা মিটছে না। সে
কারণেই রাশিয়ার দিকে ধীরে ধীরে তারা মুখ ঘুরিয়েছে।
বিবিসির জনথান মার্কাসও মনে করছেন, তুরস্কের সাথে দিন দিন রাশিয়ার সখ্যতা বাড়বে, আর নেটোর সাথে সম্পর্ক আলগা হতে থাকবে।
"যদিও
তুরস্ক মনে করছে যদিও তাদের স্বার্থ এবং রাশিয়ার স্বার্থ এক নয়, তবু
এটাই তাদের মন্দের ভালো। তারা বুঝতে পারছে এ অঞ্চলে রাশিয়া ধীরে ধীরে বড়
মাপের ক্রীড়নক হয়ে উঠছে, ফলে রাশিয়ার সাথে তাদের একটা সম্পর্ক এখন
প্রয়োজন।।"
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাথে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে |
No comments