ইস্টার হামলার পর টার্গেট হয়েছে শ্রীলংকার মুসলিমেরা by অরিত্রী দাস
কলম্বোতে স্থানীয় আইএসআইএসের পরিচালিত ইস্টার বোমা হামলার পর শ্রীলংকার
সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় টার্গেট ও নির্যাতিত হচ্ছে। অনেক লোককে
শ্রীলংকার তদন্তকারী সংস্থাগুলো তুলে নিয়ে গেছে, অনেকেই সংখ্যাগুরু
কট্টরপন্থী সিংহলি বৌদ্ধদের টার্গেটে পরিণত হচ্ছে।
গত ২১ এপ্রিল চার্চ ও বিলাসবহুল হোটেলে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হওয়ার পর
থেকেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়ে গেছে। গত বছর কয়েকটি হামলার প্রেক্ষাপটে
আগে থেকেই এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ছিল।
ইস্টার সানডে আত্মঘাতী হামলার দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট
(আইএসআইএস)। শ্রীলংকা সরকার জানায়, স্বল্প পরিচিত ন্যাশনাল তৌহিদ জামায়াত
ওই হামলা চালায়। এতে নিহত হয় ২৫০ জন।
গত মে মাসে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিমদের মালিকানাধীন বাড়িঘর, দোকানপাট ও
মসজিদে হামলা চালানো হয়, ভাংচুর করা হয়। এক ব্যক্তি হামলাকারীদের গ্রেফতার
করার জন্য পুলিশকে চাপ দিতে গিয়ে নিহত হন। সরকারের অনুসন্ধান অভিযানে
তুলনামূলক অনেক বেশি মুসলিম গ্রেফতার হয়। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন,
মুসলিমদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার করা
হচ্ছে।
পুলিশ ৪ জুন জানায়, তারা সন্ত্রাসী হামলা ও এর পরের সহিংসতার সাথে
সম্পর্ক থাকার অভিযোগে ২,২৮৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতার করা লোকদের
মধ্যে ১,৮২০ জন মুসলিম, ৩৩০ জন সিংহলি ও ১৩৯ জন তামিল। শ্রীলংকার ২২ মিলিয়ন
জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিমরা ১০ ভাগ, সিংহলি বৌদ্ধরা প্রায় ৭০ ভাগ।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ
গত ৭ জুলাই রোববার কট্টরপন্থী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ক্যান্ডি নগরীতে প্রথম সমাবেশের
আয়োজন করে। তারা এই সমাবেশে ‘সিংহলি’ সরকার গঠনের আহ্বান জানায়। এসময়
ক্যান্ডির মুসলিমরা সহিংসতার আশঙ্কায় তাদের দোকানপাট বন্ধ রাখে। বৌদ্ধ
জাতীয়তাবাদী সংস্থা বড়ু বালা সেনার সাধারণ সম্পাদক গালাগোদা আথথে নানাসারা
থেরা সমাবেশ থেকে দেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার জন্য বৌদ্ধদের প্রতি আহ্বান
জানান।
নানাসারার বিরুদ্ধে মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষমূলক অপরাধের জন্য অভিযুক্ত
হয়েছিলেন। তাকে মে মাসে প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনার বিশেষ ক্ষমায়
মুক্তি দেয়া হয়। গত মাসে বৌদ্ধধর্মের আসগিরিয়া চ্যাপ্টারের প্রধান ধর্মনেতা
সন্ন্যাসী ওয়ারাকেগোড়া শ্রী নানারাথানা মুসলিম দোকান বয়কটের আহবান জানান।
এটি অনানুষ্ঠানিকভাবে এখনো চলছে।
তিনি এক মুসলিম চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চার হাজার বৌদ্ধ নারীকে সিজারিয়ান
করার সময় নির্বীজ করার অভিযোগ এনেছেন। এ ধরনের দাবি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের
মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়।
মানবাধিকার কর্মী ও ওম্যান্স অ্যাকশন নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য
শিরিন আবদুল সারুর এশিয়া টাইমসকে বলেন, একটি অজুহাত পেলেই বৌদ্ধ চরমপন্থীরা
মুসলিমদের টার্গেট করে হামলা চালায়।
গত ৩ জুন শ্রীলংকার সরকার থেকে ৯ মন্ত্রী ও তাদের সহকারীদের সবাই
পদত্যাগ করেন। মুসলিম সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দিতে সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ
এনে তারা পদত্যাগ করেন। এর আগে এক প্রভাবশালী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সিনিয়র
মুসলিম কর্মকর্তাদের দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে অপসারণ না করা পর্যন্ত আমরণ
অনশনে বসেছিলেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক বিরাজ পাটনায়েক
এশিয়া টাইমসকে বলেন, ইস্টার বোমা বিস্ফোরণের পর শ্রীলংকার মুসলিমদের
বিরুদ্ধে হামলা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। বরং কয়েক বছর ধরেই তা ঘটছে। আর
হামলাকারীরা আইনের ঊর্ধ্বেই থেকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আগে যারা হামলা চালাত,
তারাই এখন হামলা চালাচ্ছে, এমন সম্ভাবনা খারিজ করা যায় না। তিনি বলেন,
বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখার জন্য কাউকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না।
আইনের অপব্যবহার
হামলার সাথে সম্পর্ক থাকার অভিযোগে পুলিশ বিভিন্ন ধারায় দুই হাজারের
বেশি লোককে গ্রেফতার করেছে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে দি প্রিভেনশন অব
টেরিরিজম অ্যাক্ট (পিটিএ)। এই আইন দীর্ঘ দিন ধরে অপব্যবহার করা হচ্ছিল।
এক তরুণ ও তার বাবাকে ১১ মে থেকে আটক রাখা হয়েছে তাদের বাড়ি থেকে তাদের
ভাষায় ২৫০ গ্রাম ক্লোরিন পাওয়া যাওয়ায়। তবে সেনাবাহিনী মনে করেছিল, এই সাদা
পাওডারটি ছিল সি-৪ বিস্ফোরক।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক চাকার কাছাকাছি একটি ছবি-সংবলিত পোশাক পরায় ৪৭ বছর বয়স্কা আবদুল রাহিম মুসাহিনাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
আটক ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবী স্বস্তিকা অরুলিঙ্গম বলেন,
পুলিশ ও সেনাবাহিনী স্রেফ সন্দেহের বশে লোকজনকে গ্রেফতার করছে। কাউকে পিটিএ
আইনে গ্রেফতার করা হলে অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমতি ছাড়া মুক্তি দেয়া হয়
না। সাধারণত বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে আটক থাকতে হয়।
তিনি বলেন, এক মুসলিম কর্মীকে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে সামাজিক
মাধ্যমে তামিল ভাষাতে আইএসআইএসের পক্ষে লেখার অভিযোগ আনা হয়। বাস্তবে তিনি
লিখেছিলেন আইএসআইএসের বিরুদ্ধে। পুলিশ তামিল ভাষা না বুঝে তাকে গ্রেফতার
করে।
তিনি বলেন, ১৯৭৮ সাল থেকে পিটিএ আইনটির অপব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৯০ ও
২০০০-এর দশকে এই আইনের অপব্যবহার করা হতো তামিলদের বিরুদ্ধে। এখন করা
হচ্ছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে।
কলম্বোভিত্তিক মানবাধিকার কর্মী রুকি ফারনান্ডো বলেন, সরকারের উচিত
তদন্ত করে যারা হামলার সাথে জড়িত তাদের গ্রেফতার করা। কিন্তু গ্রেফতার করতে
হবে প্রমাণভিত্তিক। তিনি বলেন, নির্বিচারে গ্রেফতার করা উচিত নয়।
ভীতিকর পরিবেশ
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, প্রকাশ্য স্থানগুলোতে বিশেষ করে হিজাবধারী মুসলিমদের পুলিশ ক্রমবর্ধমান হারে তল্লাসি চালাচ্ছে।
অরুলিঙ্গম বলেন, বমি বমি লাগা রোধ করতে এক গর্ভবতী নারী মুখ ঢাকতেই তাকে
পুলিশ গ্রেফতার করে। জামিন দেয়ার আগে তাকে দুই সপ্তাহ কারাগারে থাকতে হয়।
তার অভিযোগ এখনো তুলে নেয়া হয়নি।
অনেক এলাকায় মুসলিমরা স্থায়ীভাবে আতঙ্কে রয়েছে।
কলম্বোর ২৮ বছর বয়স্ক আইনের ছাত্র জুল লুথফি বলেন, আমাদের কাছে মনে হয়,
আমরা বুঝি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, যাদের ওপর মৌলিক অধিকার প্রয়োগ করা হয়
না।
No comments