সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে by মরিয়ম চম্পা
রাশেদের
চোখে স্বপ্ন ছিল। আশা ছিল একদিন অভাবের সংসারে সুখ ফিরিয়ে আনবেন।
কামাই-রুজি করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দে দিন কাটাবেন। তাই ছুটে আসেন
রাজধানীতে। চাকরি নেন বাসের হেলপার হিসাবে। এভাবে বছর দুয়েক চলে। প্রতিদিন
যে টাকা পান তা দিয়ে সুন্দর করে সংসার চলছিল। কিন্তু একদিন তার স্বপ্ন ভেঙে
চুরমার হয়ে যায়।
সুখ একদিনেই অসুখে পরিণত হয়। যে গাড়িতে তিনি হেলপারি করতেন সে গাড়ির নিচেই তিনি চাপা পড়েন। গাড়ির চাকা তার শরীরের এক পাশ দিয়ে চলে যায়। ৫ বছর আগের এ দুর্ঘটনায় তার একটি পা কেটে বাদ দেয়া হয়। আর একটি হাত অকেজো হয়ে পড়ে। একেবারে হয়ে উঠেন কর্মহীন। সংসারের রয়েছে স্ত্রী ও দুই সন্তান। অভাব থেকে মুক্তি পেতে তিনি বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। শাহবাগ ও গুলিস্থান রুটের গাড়িতে ভিক্ষা করেন তিন। একটি দুর্ঘটনা তাকে একেবারে ভিক্ষুক বানিয়ে ছাড়ে।
রাশেদ বলেন, এই হাতে একসময় হাজার হাজার টাকা কামিয়েছি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ সেই হাত পেতে মানুষের কাছে ভিক্ষা চেয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে। প্রথম দিকে কারো চোখের দিকে তাকিয়ে ভিক্ষা চাইতে পারতাম না। খুব লজ্জা লাগতো। মনে হতো এই বুঝি কোনো পরিচিত লোকের সামনে পড়ে যাই। এখন আর লজ্জা লাগে না। রাশেদ বলেন, অন্তত ছোট একটা চায়ের দোকানা দিতে পারলেও এভাবে ভিক্ষা করতে হতো না। সরকার যদি আমাদের জন্য কোনো কর্মসংস্থান বা কাজের ব্যবস্থা করতো তাহলে হয়তো আমার মতো রাশেদের আজ ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশাকে বেছে নিতে হতো না।
বকুল বেগম রাজধানীর মিরপুরের এক বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজিরপুর। ৭ বছর আগে স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে চলে গেছে। দুই ছেলে মেয়ে আর বিধবা মাকে নিয়ে তার সংসার। বাচ্চারা নানীর সাথে গ্রামে থাকেন। ঈদের ছুটিতে বাচ্চাদের সঙ্গে ঈদ করতে ঢাকা থেকে একটি নৈশ কোচে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন। হঠাৎ চালক গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। গাড়িটি সড়কে থাকা একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে খাদে পড়ে যায়। গাড়ির সিটের নিচে বকুলের পা দুটি আটকা পরে। এতে তার ডান পা হাটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। আরেক পা দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হাটতে পারেন না। তাই ক্রাচে ভর দিয়ে মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করে বেড়ান। ভিক্ষা করতে তার ভালো লাগে না। প্রায়ই মানুষের বাজে কথা শুনতে হয়। নিজের তেমন কোনো সঞ্চিত টাকা পয়সা নেই। যে ছোট খাটো একটি পান বিড়ির দোকান করবো। শুনেছি সরকার আমাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করবে। সেই অপেক্ষায় দিন গুনছি।
বাংলাদেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় যোগ হচ্ছে আহত পঙ্গু জনসংখ্যার মিছিল। এসকল পঙ্গু বা আহত ব্যক্তিদের যথাযথ পূণর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকায় তাদের নামতে হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৫ হাজার লোক পঙ্গু হচ্ছে। এর একটা বড় অংশ হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা ২০১৭ সালে রাজধানীর গাবতলী, ফার্মগেইট, মহাখালী, সায়েদাবাদ, সদরঘাট, গুলিস্থান, পল্টন, মালিবাগ, উত্তরা, নীলক্ষেত এলাকায় ক্রাসে ভর দিয়ে, খুঁড়িয়ে পায়ে হেঁটে ও বাসে ভিক্ষাবৃত্তি করা পঙ্গু ভিক্ষুকদের উপর একটি গবেষণা জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, এদের ৭০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়া মানুষ। ৭৯ জনের মধ্যে ৫৫ জনই পঙ্গু হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। উল্লেখ্য, এই ৫৫ জনের মধ্যে ৬ জন সুস্থ জীবনে মোটর শ্রমিক ছিলেন। নারী ছিলেন ১ জন ও শিশু ৩ জন। এসব ভিক্ষুকের পূর্ববর্তী কর্ম ও পেশা সম্পর্কে জানা যায়, তারা কেউ হকার বা মুদি দোকানদার ছিলেন। কেউ নিজের অল্প কিছু জমি চাষ করতেন, কেউ বর্গাচাষী কিংবা কৃষিশ্রমিক ছিলেন। অন্যান্য কাজের দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকও ছিলেন কেউ কেউ।
দুর্ঘটনার পর আহত হয়ে চিকিৎসা করতে গিয়ে চাষের জমি ও বসতভিটা বিক্রি করতে হয়েছে তাদের। কাউকে দোকানদারী করার পুঁজিসহ ধার-দেনা করে চিকিৎসা করতে হয়েছে। চিকিৎসা পরবর্তীতে শারীরিকভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক না হবার কারণে ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করতে হচ্ছে। এই মানুষগুলো কেউ রাস্তায় চলতে বা পারাপারের সময় গাড়ি চাপায় অথবা ধাক্কায় আহত হয়েছেন। কেউ কেউ পরিবহনের যাত্রী বা শ্রমিক হিসেবে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।
ওদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এসকল মানুষদের দিয়ে রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি ভিক্ষা বাণিজ্য চলে। ৩ লাখেরও বেশি ভিক্ষুক এখন রাজধানীর অলি গলিসহ ব্যস্ততম প্রধান সড়ক ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। রাজধানীতে রয়েছে শতাধিক অবৈধ ভিক্ষুক কল্যাণ সমিতি। এসব সমিতি পরিচালনা করেন প্রভাবশালী চাঁদাবাজ চক্র। রাজধানীতে ভিক্ষুক কল্যাণ সমিতি নামে সংস্থা আছে কমপক্ষে ২০০টি। এসব সমিতিতে ভিক্ষুকদের প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা জমা দিতে হয়। আর ভিক্ষা শুরুর আগে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। একেকটি চক্রের আওতায় রয়েছে ৪শ’ থেকে দুই হাজার ভিক্ষুক।
অবশ্য সমাজকল্যাণ অধিদফতরের পরিসংখ্যানে রাজধানী ঢাকায় নিয়মিত ভিক্ষুক রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার।
রাজধানীসহ সারাদেশের রেলস্টেশন’ বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্ট, হাসপাতাল, স্কুল কলেজের সামনে, মাজার, বাসা বাড়ি, রাস্তা ঘাটেই ভিক্ষুকদের দেখা মেলে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে, দেশে এখনো ১২ লাখ ভিক্ষুক রয়েছে। যার অধিকাংশই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১০ সালে দেশে দারিদ্র নিরসনে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও ভিক্ষাবৃত্তির মতো অমর্যাদাকর পেশা থেকে নিবৃত্ত করার লক্ষ্যে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর আবাসন, ভরন- পোষণ এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি নেয়া হয়।
সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে বলা হয়, সারা দেশে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ভিক্ষুক আছে।
১০টি এনজিওর মাধ্যমে ঢাকা শহরকে ১০টি জোনে ভাগ করে ১০ হাজার ভিক্ষুকের ওপর জরিপ পরিচালনা করে তাদের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ভিক্ষুক পুনর্বাসন খাতে ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ অনুমোদন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১ম কিস্তির অর্থ থেকে খুলনা জেলায় ১২০ জন ভিক্ষুককে বিভিন্ন স্কীমের বিপরীতে পুনর্বাসন খাতে ৭ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। ২য় কিস্তির অর্থ থেকে বরিশাল জেলায় ১৪০ জনকে ভিক্ষুক পুনর্বাসন খাতে ৭ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে জেলার চাহিদা অনুযায়ী ৩য় ও ৪র্থ কিস্তি বাবদ ৭ জেলায় ২ লাখ টাকা করে ১৪ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, দিনাজপুর, সুনামগঞ্জ এবং রাজবাড়ী।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, দেশে প্রকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রতিবেশি অথবা সমাজের উচ্চবৃত্তরা সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে কেই ওভাবে সাহায্য করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আহত ব্যক্তি পরিবারের প্রধান উপর্যনকারী ব্যক্তি হয়ে থাকেন। ফলে তার চিকিৎসায় প্রথমে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করা হয়। এরপর গবাদী পশু, বসত ভিটা ইত্যাদি বিক্রি করে তার চিকিৎসা করানো হয়। একটা সময় পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে যায়। পরবর্তীতে তারাই সমাজের বিভিন্ন নিন্ম শ্রেণীর পেশায় যুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড.শামসুজ্জামান শাহীন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর উক্ত ব্যক্তির পরিবারে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে শিশু শ্রমের দিকে চলে যায়। কিন্তু সরাসরি ভিক্ষবৃত্তির পেশায় যাওয়ার বিষয়টা কিছুটা বেমানান মনে হয়। এক্ষেত্রে আহতরা সরকারি সুযোগ সুবিধা নিতে চাইলে সেটা তারা পেয়ে থাকে। এতে করে কিছুটা হলেও তাদের আর্থিকভাবে সাহায্য হয়। তাদের অধিকাংশ মেজর অপারেশনগুলো হাসপাতালের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে করা হয়। এক্ষেত্রে তাদের কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সেবাগুলো পেতে হয়। সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার নামে হাসপাতালের যে ট্রাস্টিবোর্ড আছে সেখান থেকেও তারা মাসিক কিছু ভাতা পেতে পারে।
এ ব্যাপারে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এবং ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা আয়ের উৎস হিসাবে ভিক্ষাবৃত্তিসহ সমাজের নিম্নবৃত্ত সব কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের ভিক্ষুকদের মধ্যে ৭০ ভাগই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গু। কোনো উপায় না পেয়ে এ পেশায় নেমেছে।
সুখ একদিনেই অসুখে পরিণত হয়। যে গাড়িতে তিনি হেলপারি করতেন সে গাড়ির নিচেই তিনি চাপা পড়েন। গাড়ির চাকা তার শরীরের এক পাশ দিয়ে চলে যায়। ৫ বছর আগের এ দুর্ঘটনায় তার একটি পা কেটে বাদ দেয়া হয়। আর একটি হাত অকেজো হয়ে পড়ে। একেবারে হয়ে উঠেন কর্মহীন। সংসারের রয়েছে স্ত্রী ও দুই সন্তান। অভাব থেকে মুক্তি পেতে তিনি বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। শাহবাগ ও গুলিস্থান রুটের গাড়িতে ভিক্ষা করেন তিন। একটি দুর্ঘটনা তাকে একেবারে ভিক্ষুক বানিয়ে ছাড়ে।
রাশেদ বলেন, এই হাতে একসময় হাজার হাজার টাকা কামিয়েছি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ সেই হাত পেতে মানুষের কাছে ভিক্ষা চেয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে। প্রথম দিকে কারো চোখের দিকে তাকিয়ে ভিক্ষা চাইতে পারতাম না। খুব লজ্জা লাগতো। মনে হতো এই বুঝি কোনো পরিচিত লোকের সামনে পড়ে যাই। এখন আর লজ্জা লাগে না। রাশেদ বলেন, অন্তত ছোট একটা চায়ের দোকানা দিতে পারলেও এভাবে ভিক্ষা করতে হতো না। সরকার যদি আমাদের জন্য কোনো কর্মসংস্থান বা কাজের ব্যবস্থা করতো তাহলে হয়তো আমার মতো রাশেদের আজ ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশাকে বেছে নিতে হতো না।
বকুল বেগম রাজধানীর মিরপুরের এক বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজিরপুর। ৭ বছর আগে স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে চলে গেছে। দুই ছেলে মেয়ে আর বিধবা মাকে নিয়ে তার সংসার। বাচ্চারা নানীর সাথে গ্রামে থাকেন। ঈদের ছুটিতে বাচ্চাদের সঙ্গে ঈদ করতে ঢাকা থেকে একটি নৈশ কোচে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন। হঠাৎ চালক গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। গাড়িটি সড়কে থাকা একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে খাদে পড়ে যায়। গাড়ির সিটের নিচে বকুলের পা দুটি আটকা পরে। এতে তার ডান পা হাটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। আরেক পা দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হাটতে পারেন না। তাই ক্রাচে ভর দিয়ে মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করে বেড়ান। ভিক্ষা করতে তার ভালো লাগে না। প্রায়ই মানুষের বাজে কথা শুনতে হয়। নিজের তেমন কোনো সঞ্চিত টাকা পয়সা নেই। যে ছোট খাটো একটি পান বিড়ির দোকান করবো। শুনেছি সরকার আমাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করবে। সেই অপেক্ষায় দিন গুনছি।
বাংলাদেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় যোগ হচ্ছে আহত পঙ্গু জনসংখ্যার মিছিল। এসকল পঙ্গু বা আহত ব্যক্তিদের যথাযথ পূণর্বাসনের ব্যবস্থা না থাকায় তাদের নামতে হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৫ হাজার লোক পঙ্গু হচ্ছে। এর একটা বড় অংশ হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামের একটি সংস্থা ২০১৭ সালে রাজধানীর গাবতলী, ফার্মগেইট, মহাখালী, সায়েদাবাদ, সদরঘাট, গুলিস্থান, পল্টন, মালিবাগ, উত্তরা, নীলক্ষেত এলাকায় ক্রাসে ভর দিয়ে, খুঁড়িয়ে পায়ে হেঁটে ও বাসে ভিক্ষাবৃত্তি করা পঙ্গু ভিক্ষুকদের উপর একটি গবেষণা জরিপ চালায়। জরিপে দেখা যায়, এদের ৭০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়া মানুষ। ৭৯ জনের মধ্যে ৫৫ জনই পঙ্গু হয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। উল্লেখ্য, এই ৫৫ জনের মধ্যে ৬ জন সুস্থ জীবনে মোটর শ্রমিক ছিলেন। নারী ছিলেন ১ জন ও শিশু ৩ জন। এসব ভিক্ষুকের পূর্ববর্তী কর্ম ও পেশা সম্পর্কে জানা যায়, তারা কেউ হকার বা মুদি দোকানদার ছিলেন। কেউ নিজের অল্প কিছু জমি চাষ করতেন, কেউ বর্গাচাষী কিংবা কৃষিশ্রমিক ছিলেন। অন্যান্য কাজের দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকও ছিলেন কেউ কেউ।
দুর্ঘটনার পর আহত হয়ে চিকিৎসা করতে গিয়ে চাষের জমি ও বসতভিটা বিক্রি করতে হয়েছে তাদের। কাউকে দোকানদারী করার পুঁজিসহ ধার-দেনা করে চিকিৎসা করতে হয়েছে। চিকিৎসা পরবর্তীতে শারীরিকভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক না হবার কারণে ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করতে হচ্ছে। এই মানুষগুলো কেউ রাস্তায় চলতে বা পারাপারের সময় গাড়ি চাপায় অথবা ধাক্কায় আহত হয়েছেন। কেউ কেউ পরিবহনের যাত্রী বা শ্রমিক হিসেবে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।
ওদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এসকল মানুষদের দিয়ে রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি ভিক্ষা বাণিজ্য চলে। ৩ লাখেরও বেশি ভিক্ষুক এখন রাজধানীর অলি গলিসহ ব্যস্ততম প্রধান সড়ক ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে। রাজধানীতে রয়েছে শতাধিক অবৈধ ভিক্ষুক কল্যাণ সমিতি। এসব সমিতি পরিচালনা করেন প্রভাবশালী চাঁদাবাজ চক্র। রাজধানীতে ভিক্ষুক কল্যাণ সমিতি নামে সংস্থা আছে কমপক্ষে ২০০টি। এসব সমিতিতে ভিক্ষুকদের প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা জমা দিতে হয়। আর ভিক্ষা শুরুর আগে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। একেকটি চক্রের আওতায় রয়েছে ৪শ’ থেকে দুই হাজার ভিক্ষুক।
অবশ্য সমাজকল্যাণ অধিদফতরের পরিসংখ্যানে রাজধানী ঢাকায় নিয়মিত ভিক্ষুক রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার।
রাজধানীসহ সারাদেশের রেলস্টেশন’ বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্ট, হাসপাতাল, স্কুল কলেজের সামনে, মাজার, বাসা বাড়ি, রাস্তা ঘাটেই ভিক্ষুকদের দেখা মেলে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে, দেশে এখনো ১২ লাখ ভিক্ষুক রয়েছে। যার অধিকাংশই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১০ সালে দেশে দারিদ্র নিরসনে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন ও ভিক্ষাবৃত্তির মতো অমর্যাদাকর পেশা থেকে নিবৃত্ত করার লক্ষ্যে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর আবাসন, ভরন- পোষণ এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি নেয়া হয়।
সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে বলা হয়, সারা দেশে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ভিক্ষুক আছে।
১০টি এনজিওর মাধ্যমে ঢাকা শহরকে ১০টি জোনে ভাগ করে ১০ হাজার ভিক্ষুকের ওপর জরিপ পরিচালনা করে তাদের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ভিক্ষুক পুনর্বাসন খাতে ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ অনুমোদন পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১ম কিস্তির অর্থ থেকে খুলনা জেলায় ১২০ জন ভিক্ষুককে বিভিন্ন স্কীমের বিপরীতে পুনর্বাসন খাতে ৭ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। ২য় কিস্তির অর্থ থেকে বরিশাল জেলায় ১৪০ জনকে ভিক্ষুক পুনর্বাসন খাতে ৭ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে জেলার চাহিদা অনুযায়ী ৩য় ও ৪র্থ কিস্তি বাবদ ৭ জেলায় ২ লাখ টাকা করে ১৪ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, দিনাজপুর, সুনামগঞ্জ এবং রাজবাড়ী।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, দেশে প্রকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রতিবেশি অথবা সমাজের উচ্চবৃত্তরা সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিকে কেই ওভাবে সাহায্য করে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আহত ব্যক্তি পরিবারের প্রধান উপর্যনকারী ব্যক্তি হয়ে থাকেন। ফলে তার চিকিৎসায় প্রথমে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করা হয়। এরপর গবাদী পশু, বসত ভিটা ইত্যাদি বিক্রি করে তার চিকিৎসা করানো হয়। একটা সময় পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে যায়। পরবর্তীতে তারাই সমাজের বিভিন্ন নিন্ম শ্রেণীর পেশায় যুক্ত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড.শামসুজ্জামান শাহীন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর উক্ত ব্যক্তির পরিবারে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসে। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে শিশু শ্রমের দিকে চলে যায়। কিন্তু সরাসরি ভিক্ষবৃত্তির পেশায় যাওয়ার বিষয়টা কিছুটা বেমানান মনে হয়। এক্ষেত্রে আহতরা সরকারি সুযোগ সুবিধা নিতে চাইলে সেটা তারা পেয়ে থাকে। এতে করে কিছুটা হলেও তাদের আর্থিকভাবে সাহায্য হয়। তাদের অধিকাংশ মেজর অপারেশনগুলো হাসপাতালের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে করা হয়। এক্ষেত্রে তাদের কিছু প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সেবাগুলো পেতে হয়। সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার নামে হাসপাতালের যে ট্রাস্টিবোর্ড আছে সেখান থেকেও তারা মাসিক কিছু ভাতা পেতে পারে।
এ ব্যাপারে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এবং ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা আয়ের উৎস হিসাবে ভিক্ষাবৃত্তিসহ সমাজের নিম্নবৃত্ত সব কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের ভিক্ষুকদের মধ্যে ৭০ ভাগই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গু। কোনো উপায় না পেয়ে এ পেশায় নেমেছে।
No comments