বেতন অনিয়মিত, উঠছে না খরচও-মালদ্বীপে ৫০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশির কষ্টের প্রহর by শরিফুল হাসান

বিদেশে গিয়ে ভাগ্য ফেরাবেন—এমন স্বপ্নে দুই লাখ টাকা খরচ করে ২০০৯ সালে মালদ্বীপে যান ২১ বছরের তরুণ ওমর ফারুক। কিন্তু গত দুই বছরেও খরচের টাকা তুলতে পারেননি, উল্টো বৈধ কাগজপত্র না থাকার নানা সমস্যায় দিন কাটছে তাঁর।


মালদ্বীপে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের বেশির ভাগ—অন্তত ৫০ হাজার কর্মীর অবস্থা ওমর ফারুকের মতো। তাঁদের কারোরই এখন দেশটিতে কাজ করার বৈধ কাগজ নেই।
গত এক সপ্তাহে ভারত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপদেশটির বিভিন্ন রাস্তায়, দোকানপাটে কথা হয়েছে শ খানেক বাংলাদেশির সঙ্গে। তাঁদের অনেকের সমস্যাই চাঁদপুরের ওমর ফারুকের মতো। কেউ কেউ কথা বলতে বলতে দেশের জন্য কেঁদে ফেলেন।
সমস্যাগ্রস্ত ওই প্রবাসী শ্রমিকেরা বলেন, তাঁরা বৈধভাবেই মালদ্বীপে এসেছিলেন। কিন্তু দুই দেশের অসৎ দালাল চক্রের কারণে কাজ না পেয়ে তাঁরা অবৈধ হয়ে পড়েছেন। অনেক কোম্পানি এখন অবৈধ শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন দেয় না। গুরুতর অসুস্থ হলেও কোনো হাসপাতাল অবৈধদের চিকিৎসা দিতে চায় না।
মালদ্বীপে ঠিক কত বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় কিংবা মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাইকমিশনের কাছে নেই। প্রবাসীদের ধারণা, মালদ্বীপের লাখ খানেক বিদেশি শ্রমিকের মধ্যে আশি থেকে নব্বই হাজারই বাংলাদেশি। হাইকমিশনার এ এস এম এ আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালদ্বীপে যাঁরা কাজ করতে আসছেন, তাঁদের ব্যাপারে হাইকমিশনের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে আমরা ধারণা করছি, ৭০ থেকে ৮০ হাজার শ্রমিক এখানে আছেন। তাঁদের মধ্যে ৫০ হাজারেরই এখন যথাযথ কাগজপত্র নেই।’
হাইকমিশনার জানান, মালদ্বীপের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বৈধকরণ প্রক্রিয়া থমকে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মালদ্বীপ সরকারের সঙ্গে কথা বলছি। একপর্যায়ে মালদ্বীপ সরকার এই শ্রমিকদের বৈধ করতে একমতও হয়। এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে নিবন্ধন-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁদের বৈধ করার কথা ছিল। কিন্তু এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আমরা এখনো সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি।’
অবৈধ হওয়ার কারণ: মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, মালদ্বীপের কোনো প্রতিষ্ঠানে বিদেশি শ্রমিক লাগলে শ্রম ও মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিতে হয়। স্থানীয় অসাধু চক্র প্রায়ই মিথ্যা প্রয়োজনের কথা বলে লোক নিয়োগের সরকারি অনুমতি নিয়ে ঢাকার অসাধু জনশক্তি ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠায়। এই অনুমতির বিপরীতে দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে শ্রমিকেরা মালদ্বীপে এসে দেখতে পান, জনশক্তি প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করা নামে কোনো কোম্পানিই নেই। এভাবে শ্রমিকেরা এসে অবৈধ হয়ে পড়েন।
টাঙ্গাইলের আলী আজহার শিকদার দুই লাখ টাকা খরচ করে পাঁচ মাস আগে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে মালদ্বীপে আসেন। কিন্তু এসে কোনো কাজ পাননি। আর কোম্পানির অস্তিত্ব না থাকায় তিনি এখন অবৈধ। বরিশালের সজীব হোসেনও জানালেন, যে কোম্পানির কথা বলে তাঁকে আনা হয়েছিল, সেই নামে নাকি কোনো কোম্পানিই নেই। তিনি এখন বিভিন্ন স্থানে নির্মাণশ্রমিকের কাজ করেন।
একই অবস্থার কথা জানিয়েছেন মুন্সিগঞ্জের বিল্লাল হোসেন, ঢাকার আবদুল হালিম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোস্তফা কামালসহ অনেকে। তাঁদের অভিযোগ, মালদ্বীপের যেসব কোম্পানি লোক আনার নামে প্রতারণা করছে, তার সব কটির সঙ্গেই কোনো না কোনো বাংলাদেশি দালাল যুক্ত।
হাইকমিশনার এ এস এম এ আউয়াল বলেন, ‘২০১০ সালে হাইকমিশন মাত্র ৫৮ জন লোকের কাজের অনুমতিপত্র সত্যায়ন করেছে। কিন্তু লোক এসেছেন হাজার হাজার। দালাল চক্র বিভিন্ন কোম্পানির নামে অনুমতি নিয়ে লোক আনছে। কিন্তু পরে তাঁরা আর কাজ পাচ্ছেন না।’
হাইকমিশনারের মতে, এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে হাইকমিশনের সত্যায়ন, স্মার্ট কার্ডসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া একজন কর্মীও যেন ঢাকার বিমানবন্দর পার না হতে পারেন, তা নিশ্চিত করা। তিনি জানান, তাঁরা স্থানীয় দালালদের একটি তালিকা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মালদ্বীপ সরকারকে অনুরোধও জানিয়েছেন।
হাইকমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ: প্রবাসী শ্রমিকদের অভিযোগ, বাংলাদেশ হাইকমিশনে গেলে তাঁরা যথাযথ সহায়তা পান না, তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়। অনেকেই দেশে ফিরতে চান। কিন্তু পাসপোর্ট নেই। ফলে তাঁদের ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ লাগে। এই ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিতে হাইকমিশনের দীর্ঘ সময় লেগে যায়। অনেক সময় এ জন্য টাকাও দাবি করা হয় বলে একাধিক কর্মী অভিযোগ তুলেছেন ।
তবে দূতালয়প্রধান (হেড অব চ্যান্সেরি) অহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেছেন, এ ধরনের অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। তা ছাড়া প্রতিদিন কয়েক শ লোক ট্রাভেল ডকুমেন্টের জন্য আসছেন। হাইকমিশনে জনবল একেবারেই কম। অহিদুজ্জামান বলেন, কেউ দেশে চলে যেতে চাইলে তিনি যে কোম্পানিতে কাজ করতেন, সেখানে কোনো সমস্যা ছিল কি না, কর্মীর কোনো পাওনা আছে কি না—এসব দেখতে মালদ্বীপ সরকারের কাছে একটি ফরম পাঠাতে হয়। সেটি ফেরত আসতে আসতে অনেক সময় লেগে যায়।

No comments

Powered by Blogger.