জিএম খাদ্য-আমাদের অতি প্রিয় বেগুনকে দূষিত করবেন না by ফরিদা আখতার
সবজির মধ্যে বেগুন পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুব কমই আছে। যাঁরা রান্না করেন তাঁদের কাছেও বেগুন খুবই প্রিয়। এটা রান্না করতে সহজ, সময় কম লাগে, আবার খেতেও মজা। ইলিশ মাছ দিয়ে রান্না, শুঁটকি কিংবা শুধু আলু দিয়ে ভাজি করা যায়।
খিচুড়ি করলে আর কিছু না থাক, চাকা করে কেটে সরিষার তেলে ভেজে বেগুন অত্যন্ত মজা করে খাওয়া যায়। তাছাড়া বিশেষ রকম বেগুন রান্নার জন্য রান্নার বইগুলোতেও অনেক প্রণালী পাওয়া যায়। তার মানে যত সহজই হোক, বেগুনের রকমারি রান্নার নিয়ম রয়েছে। আরও মজার কথা হচ্ছে, চৈত্র মাসে তিতা গিমাশাক একটু বেগুনসহ রান্না করলে খেতে ভালো লাগে। তিতা শাক বাচ্চাদের খাওয়াতে অসুবিধা হলে এভাবে খাওয়ানো দারুণ দাওয়াই। চৈত্র মাসে তিতা খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি। বেগুন ছাড়া অনেকেরই তখন চলে না। গিমা বাংলার প্রাচীন খাদ্যব্যবস্থার মধ্যে শীর্ষে। আর বেগুন মাত্রই বাংলার এমন সবজি, যাকে ছাড়া বাঙালির খাদ্যব্যবস্থার কথা ভাবাই যায় না। কিছু অসুখের জন্য খেতে নিষেধ করা হয়। সেটাও আমাদের খাদ্যব্যবস্থার অংশ। খাদ্য এবং পথ্যের ভেদজ্ঞান নিয়েই আমাদের খাদ্য, পুষ্টি ও আয়ুরক্ষা।
অনেকের আবার এলার্জি থাকে। তবে কীটনাশক বা সার ব্যবহারের কারণেই এ এলার্জির আধিক্য অধিক। বেগুন কখনোই বিষাক্ত নয়। উচ্চ ফলনশীল বা ইরি বেগুন এবং বর্তমানে হাইব্রিড বেগুনেই কেবল কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কোনো দেশীয় জাতের বেগুনে কীটনাশক দিতে হয় না। পোকা লাগলে ছাইয়ের ব্যবহারই যথেষ্ট। বাণিজ্যিক চাষের জন্য উচ্চ ফলনশীল বেগুনে বিষ বা কীটনাশক দিতে হয়। এক বীজ বিক্রেতার কাছে তথ্য নিয়ে জানা গেছে—সুপার সোমনাথ, ড্রাগ স্টোন, চমক ইত্যাদি নামের হাইব্রিড বেগুন বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এরই সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের কীটনাশক। এই বেগুন বাজারে আসার আগ পর্যন্ত বিষ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে বেগুনের অনেক স্থানীয় জাত রয়েছে। বলা হয়, বাংলাদেশ বেগুনের অন্যতম প্রধান উত্সস্থল। এলাকাবিশেষে বেগুনের নানা ধরনও পাওয়া যায়। যেমন—পার্বত্য চট্টগ্রামের ফুতা বেগুন, গফরগাঁওয়ের তবলা বা তাল বেগুনসহ অনেক জাতের বেগুন এখনো কৃষকদের হাতে আছে। নয়া কৃষির কৃষকদের সংগ্রহ করা কয়েকটি বেগুনের জাতের নাম উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে এসব বেগুন এখনো কৃষকেরা চাষ করছেন। যেমন—লেইট্যা, গোল, আউশা, কাটা, লম্বা, আমনে, পাহাড়ি, ক্ষুদে, তিতা, ঢোপা, বারমাসে, ডিম, বতুলা, বেগুনি, লানি, কালো, বুটকা, কামরাঙ্গা, তাল বা তবলা, সাদা, সংলা, টুপরি, ভোলানাথ, কালগোলা, ঘিকাঞ্চন, কলা, শ্যামলা, হিংলা সইলা, সাদা বীন, সবুজ লম্বা, সবুজ মোটা বেগুন ইত্যাদি। সব বেগুন দিয়ে ভর্তা হয় না, যেমন—কাটা, লম্বা, চিকন, ক্ষুদে, ঝুমকা বেগুন দিয়ে ভর্তা করে লাভ নেই। ভর্তা হয় এমন বেগুন হচ্ছে—গোল, আইসা, আমনে, ঢোপা, তবলা ইত্যাদি। ইলিশ মাছ দিয়ে রান্না করা যায় কাটা, লম্বা ও চিকন বেগুন। ঝুমকা আর ক্ষুদে বেগুনের টক রান্না ভালো হয়। ভাজির জন্য ভালো হচ্ছে গোল বেগুন, সাদা বেগুন, ভোলানাথ (দেখতে খুব সরল বলে)। শুঁটকি মাছ দিয়ে রান্নার জন্য লম্বা বেগুন ভালো। গিমাশাক দিয়ে রান্না করা যায় ঢোপা, গোল আর আউশা বেগুন। তবে একই ধরনের বেগুন বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন নামেও পাওয়া যেতে পারে। কারণ, কৃষক বেগুনের আকার বা রং বা মৌসুম হিসেবে নামকরণ করে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে পেটেন্ট করে না। তারা একই বেগুনের ভিন্ন নাম শুনে হাসি-তামাসা করে, কিন্তু মামলা করে না বা রয়্যালটি দাবি করে না। হাজার বছর ধরে কৃষক এসব বেগুন রক্ষা করে আসছে।
বেগুনের মতো এত সহজ-সরল একটি সবজি নিয়ে লেখার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বেগুন নিয়ে কোনো গবেষণার ফলাফল জানানোর জন্য নয়। আমাদের দেশে এত জাতের বেগুন থাকতে ইরি এবং হাইব্রিড বেগুন এসে আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। বেগুনের বাণিজ্যিক চাষ করে বিষাক্ত করে ফেলেছে। কিন্তু সেই পর্ব শেষ না হতেই এখন জিএম বেগুন প্রবর্তন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইরি এবং হাইব্রিড বেগুন বাজারে আসার আগে অনেকেই জানতেও পারেনি। বাণিজ্যিক চাষের মাধ্যমে সোজা বাজারে চলে এসেছে। তারই সঙ্গে এসেছে বিষ। ঢাকার বাজারে বাণিজ্যিক চাষ করা যেসব বেগুন আসে সেগুলো বিষে ভরা। স্বাস্থ্যের জন্য এসব বেগুন নিরাপদ নয়। বেগুনের সহজ ভাবটা এর মধ্যে আর থাকে না। অর্থাত্ সহজে সিদ্ধ হয় না, খেতেও মজা লাগে না। অবশ্য বাজারে এখনো সাধারণ কৃষকের উত্পাদন করা দেশীয় জাতের বেগুনগুলোও পাওয়া যায়। বিষের বেগুনে পোকা নেই, কিন্তু বিষ আছে। দেশীয় বেগুনে দু’একটা পোকা থাকলেও ভালো, কারণ এতে বিষ নেই। বুদ্ধিমান ক্রেতারা ঠিকই দেশি জাতের বেগুন কেনেন।
কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, বেগুনকে বিষমুক্ত করার জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে বিটি-ব্রিনজাল বা বিটি-বেগুন প্রবর্তন করা হবে। ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিড কোম্পানি (মাহাইকো) বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্তোর কাছ থেকে কীট ব্যবস্থাপনার বিশেষ প্রযুক্তি Bt cry1Ac gene technology-এর লাইসেন্স পেয়ে ভারতে বিটি বেগুনের গবেষণা করেছে। মাহাইকো ভারতের দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (বারি) এবং এটি বেসরকারি বীজ কোম্পানি ইস্ট-ওয়েস্ট সিড বাংলাদেশের মাধ্যমে প্রবর্তন করার জন্য গবেষণা করছে। অর্থাত্ মনসান্তো-মাহাইকো বিটি বেগুনের প্রবর্তন শুধু ভারতের বাজারকে নিয়ে পরিকল্পনা করেনি, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বাজারজাত করার চিন্তাভাবনা নিয়েই এগোচ্ছে। এই প্রযুক্তি প্রবর্তনের জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি, Agricultural Biotechnology Support Project II, (ABSPII) প্রকল্পের মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি সাহায্য পেয়েই এই প্রকল্পের কাজ করছে। জানা গেছে, প্রায় চার বছর ধরে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারি-তে বায়োটেকনোলজি বিভাগের বিজ্ঞানীরা এই বিটি বেগুনের গবেষণা করছেন। এই বেগুন কৃষকপর্যায়ে ছাড়ার আগে আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে বায়োসেফটি আইন পাস হতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে বায়োসেফটি গাইডলাইন রয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন এই বায়োসেফটি গাইডলাইন অনুসারে দেশে কোনো জিএম শস্য প্রবর্তন করতে হলে দেখতে হবে, এর ফলে স্থানীয় জাত ও প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না। আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে, বিটি বেগুনের গবেষণাকে আগেভাগেই যেভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, তাতে বায়োসেফটি গাইডলাইন অনুসারে বিবেচনা করার জন্য যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হবে কি না।
আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন গ্রিন পিস এ বিষয়ে বলেছে, মলিকুলার বায়োলজিতে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফলে চিকিত্সা-বিজ্ঞানে কিছু অবদান দেখে আমরা বাণিজ্যিক স্বার্থে পুরো প্রাকৃতিক পরিবেশকে তাদের গবেষণাগার বানিয়ে ফেলতে পারি না। প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিবেশের সুরক্ষা খাদ্যের জোগানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এর ওপর কোনো প্রকার হুমকি পুরো মানব জাতিকে বিপদের মুখে ফেলবে।
বিটি বেগুনের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হচ্ছে, ব্যাকটেরিয়া থেকে বিষাক্ত প্রোটিন উদ্ভাবনের জিন ব্যাকটেরিয়া থেকে আলাদা করে জেনেটিক প্রক্রিয়ায় বেগুনের জিনোমের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে বেগুনের মধ্যেই একই ধরনের বিষাক্ত প্রোটিন উত্পাদিত হয়। ফলে বেগুনের মধ্যে সাধারণভাবে আমরা যে পোকা সব সময় দেখি, সেই ব্রিঞ্জাল ফ্রুট অ্যান্ড শুটবরার বা লেদাপোকা বেগুনের গায়ে আক্রমণ করলে বা বেগুনের কোনো অংশ খেলে এগুলোর পুষ্টিনালি ছিদ্র হয়ে মারা যায়। অর্থাত্ বেগুনগাছ নিজেই তখন বিষ হিসেবে কাজ করে। কাজেই এই বেগুন উত্পাদনের সময় বাইরের কোনো বিষ ব্যবহার করতে হয় না। ইরি এবং হাইব্রিডের বিষাক্ত বেগুন চাষ দেখে যাঁরা বিরক্ত এবং আতঙ্কিত তাঁরা নিশ্চয়ই বিটি বেগুনের দিকে ঝুঁকতে পারেন। কিন্তু বিটি বেগুন এতই বিষাক্ত যে পোকা খাওয়ারও উপযোগী নয়, সেই বেগুন কী করে মানুষের খাওয়ার উপযুক্ত হতে পারে, সে প্রশ্ন কি তোলা উচিত নয়? বেগুন ছাড়াও তুলা এবং ভুট্টার ক্ষেত্রে বিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এবং কোনো ক্ষেত্রেই সফল হতে পারেনি। বরং বিটি তুলা চাষ করে লাখ লাখ কৃষকের সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ভারতে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিটি প্রযুক্তির মাধ্যমে বিষ ব্যবহার না করার কথা বলা মিথ্যা এবং প্রতারণা। আসলে বিষ ব্যবহার বন্ধ নয়, বরং বিষাক্ত বীজ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা কোম্পানি বা উদ্ভাবক নিজেই কৃষককে করে দিচ্ছে। খাদ্যশস্য উত্পাদনে বিষ ব্যবহার বন্ধের একটাই উপায় আছে সেটা হচ্ছে, যে বীজ স্থান ও পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সেই পরিবেশে গড়ে ওঠা স্থানীয় বীজের ব্যবহার, মাটির উর্বরতা রক্ষা করা এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসলের উত্পাদন করা। কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে বীজকে বিকৃত করলেই শস্য নিরাপদ হয়ে যায় না।
ভারতে এই বিটি বেগুনের প্রবর্তনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফলে সরকার এই বেগুনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১০। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মন্ত্রী জয়রাম রামেশ এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। যদিও মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠিত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্রোভালস কমিটি (জিইএসি) বিটি বেগুনে ছাড়পত্র প্রায় দিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু মন্ত্রী দেখেছেন, ভারতের বিজ্ঞানীদের মধ্যেও এই বিটি বেগুনের নিরাপত্তার প্রশ্নে মতৈক্য নেই এবং কৃষক ও পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে যেসব নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলা হয়েছে উদ্ভাবকেরা তার সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। কৃষক এবং পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের মুখে মন্ত্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে মতবিনিময় করতে বাধ্য হন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝেছেন, এই বেগুন সম্পর্কে বিটি বেগুনের ছাড়পত্র দিয়ে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম দেশ হওয়ার গৌরব অর্জনের জন্য তাড়াহুড়োর দরকার নেই। কিন্তু ভারতে বন্ধ হলেও বিটি বেগুনের গবেষণার কাজ যেহেতু একই কোম্পানির উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে শুরু হয়েছে, বাংলাদেশে এই বেগুনের ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এরই মধ্যে ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ তারিখে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি বিল ২০১০ উত্থাপিত হয়েছে। যদিও বলা হয়েছে, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কৃষি-প্রযুক্তির প্রবর্তনের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করবে, তথাপি জিএম শস্যের ছাড়পত্র দেওয়ার জন্যও এই প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিলটিতে বিস্তারিত কী আছে তা আমরা জানি না। এ ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ বিল নিয়ে জনগণের মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। কারণ, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে আমাদের দেশের কোটি কোটি কৃষকের ভাগ্য, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের প্রশ্ন।
শুরু করেছিলাম বেগুনের নানা জাতের কথা বলে। বাংলাদেশে বিটি বেগুন আসার অর্থ হচ্ছে, স্থানীয় জাতের বেগুন বিলুপ্ত হওয়ার পথ তৈরি করা। শুধু তাই নয়, মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের কথা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তাহলে আমাদের এই বিতর্কিত এবং পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জিএম বেগুন আনতে হবে কেন? বিদেশি কোম্পানির লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বাংলাদেশে প্রাইভেট কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ দেশের সাধারণ কৃষকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে না—এইটুকু অবশ্যই বোঝা যায়।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
অনেকের আবার এলার্জি থাকে। তবে কীটনাশক বা সার ব্যবহারের কারণেই এ এলার্জির আধিক্য অধিক। বেগুন কখনোই বিষাক্ত নয়। উচ্চ ফলনশীল বা ইরি বেগুন এবং বর্তমানে হাইব্রিড বেগুনেই কেবল কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কোনো দেশীয় জাতের বেগুনে কীটনাশক দিতে হয় না। পোকা লাগলে ছাইয়ের ব্যবহারই যথেষ্ট। বাণিজ্যিক চাষের জন্য উচ্চ ফলনশীল বেগুনে বিষ বা কীটনাশক দিতে হয়। এক বীজ বিক্রেতার কাছে তথ্য নিয়ে জানা গেছে—সুপার সোমনাথ, ড্রাগ স্টোন, চমক ইত্যাদি নামের হাইব্রিড বেগুন বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এরই সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের কীটনাশক। এই বেগুন বাজারে আসার আগ পর্যন্ত বিষ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে বেগুনের অনেক স্থানীয় জাত রয়েছে। বলা হয়, বাংলাদেশ বেগুনের অন্যতম প্রধান উত্সস্থল। এলাকাবিশেষে বেগুনের নানা ধরনও পাওয়া যায়। যেমন—পার্বত্য চট্টগ্রামের ফুতা বেগুন, গফরগাঁওয়ের তবলা বা তাল বেগুনসহ অনেক জাতের বেগুন এখনো কৃষকদের হাতে আছে। নয়া কৃষির কৃষকদের সংগ্রহ করা কয়েকটি বেগুনের জাতের নাম উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে এসব বেগুন এখনো কৃষকেরা চাষ করছেন। যেমন—লেইট্যা, গোল, আউশা, কাটা, লম্বা, আমনে, পাহাড়ি, ক্ষুদে, তিতা, ঢোপা, বারমাসে, ডিম, বতুলা, বেগুনি, লানি, কালো, বুটকা, কামরাঙ্গা, তাল বা তবলা, সাদা, সংলা, টুপরি, ভোলানাথ, কালগোলা, ঘিকাঞ্চন, কলা, শ্যামলা, হিংলা সইলা, সাদা বীন, সবুজ লম্বা, সবুজ মোটা বেগুন ইত্যাদি। সব বেগুন দিয়ে ভর্তা হয় না, যেমন—কাটা, লম্বা, চিকন, ক্ষুদে, ঝুমকা বেগুন দিয়ে ভর্তা করে লাভ নেই। ভর্তা হয় এমন বেগুন হচ্ছে—গোল, আইসা, আমনে, ঢোপা, তবলা ইত্যাদি। ইলিশ মাছ দিয়ে রান্না করা যায় কাটা, লম্বা ও চিকন বেগুন। ঝুমকা আর ক্ষুদে বেগুনের টক রান্না ভালো হয়। ভাজির জন্য ভালো হচ্ছে গোল বেগুন, সাদা বেগুন, ভোলানাথ (দেখতে খুব সরল বলে)। শুঁটকি মাছ দিয়ে রান্নার জন্য লম্বা বেগুন ভালো। গিমাশাক দিয়ে রান্না করা যায় ঢোপা, গোল আর আউশা বেগুন। তবে একই ধরনের বেগুন বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন নামেও পাওয়া যেতে পারে। কারণ, কৃষক বেগুনের আকার বা রং বা মৌসুম হিসেবে নামকরণ করে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে পেটেন্ট করে না। তারা একই বেগুনের ভিন্ন নাম শুনে হাসি-তামাসা করে, কিন্তু মামলা করে না বা রয়্যালটি দাবি করে না। হাজার বছর ধরে কৃষক এসব বেগুন রক্ষা করে আসছে।
বেগুনের মতো এত সহজ-সরল একটি সবজি নিয়ে লেখার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বেগুন নিয়ে কোনো গবেষণার ফলাফল জানানোর জন্য নয়। আমাদের দেশে এত জাতের বেগুন থাকতে ইরি এবং হাইব্রিড বেগুন এসে আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে। বেগুনের বাণিজ্যিক চাষ করে বিষাক্ত করে ফেলেছে। কিন্তু সেই পর্ব শেষ না হতেই এখন জিএম বেগুন প্রবর্তন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইরি এবং হাইব্রিড বেগুন বাজারে আসার আগে অনেকেই জানতেও পারেনি। বাণিজ্যিক চাষের মাধ্যমে সোজা বাজারে চলে এসেছে। তারই সঙ্গে এসেছে বিষ। ঢাকার বাজারে বাণিজ্যিক চাষ করা যেসব বেগুন আসে সেগুলো বিষে ভরা। স্বাস্থ্যের জন্য এসব বেগুন নিরাপদ নয়। বেগুনের সহজ ভাবটা এর মধ্যে আর থাকে না। অর্থাত্ সহজে সিদ্ধ হয় না, খেতেও মজা লাগে না। অবশ্য বাজারে এখনো সাধারণ কৃষকের উত্পাদন করা দেশীয় জাতের বেগুনগুলোও পাওয়া যায়। বিষের বেগুনে পোকা নেই, কিন্তু বিষ আছে। দেশীয় বেগুনে দু’একটা পোকা থাকলেও ভালো, কারণ এতে বিষ নেই। বুদ্ধিমান ক্রেতারা ঠিকই দেশি জাতের বেগুন কেনেন।
কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, বেগুনকে বিষমুক্ত করার জন্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে বিটি-ব্রিনজাল বা বিটি-বেগুন প্রবর্তন করা হবে। ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিড কোম্পানি (মাহাইকো) বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্তোর কাছ থেকে কীট ব্যবস্থাপনার বিশেষ প্রযুক্তি Bt cry1Ac gene technology-এর লাইসেন্স পেয়ে ভারতে বিটি বেগুনের গবেষণা করেছে। মাহাইকো ভারতের দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (বারি) এবং এটি বেসরকারি বীজ কোম্পানি ইস্ট-ওয়েস্ট সিড বাংলাদেশের মাধ্যমে প্রবর্তন করার জন্য গবেষণা করছে। অর্থাত্ মনসান্তো-মাহাইকো বিটি বেগুনের প্রবর্তন শুধু ভারতের বাজারকে নিয়ে পরিকল্পনা করেনি, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বাজারজাত করার চিন্তাভাবনা নিয়েই এগোচ্ছে। এই প্রযুক্তি প্রবর্তনের জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি, Agricultural Biotechnology Support Project II, (ABSPII) প্রকল্পের মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি সাহায্য পেয়েই এই প্রকল্পের কাজ করছে। জানা গেছে, প্রায় চার বছর ধরে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারি-তে বায়োটেকনোলজি বিভাগের বিজ্ঞানীরা এই বিটি বেগুনের গবেষণা করছেন। এই বেগুন কৃষকপর্যায়ে ছাড়ার আগে আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে বায়োসেফটি আইন পাস হতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে বায়োসেফটি গাইডলাইন রয়েছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন এই বায়োসেফটি গাইডলাইন অনুসারে দেশে কোনো জিএম শস্য প্রবর্তন করতে হলে দেখতে হবে, এর ফলে স্থানীয় জাত ও প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না। আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে, বিটি বেগুনের গবেষণাকে আগেভাগেই যেভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, তাতে বায়োসেফটি গাইডলাইন অনুসারে বিবেচনা করার জন্য যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হবে কি না।
আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন গ্রিন পিস এ বিষয়ে বলেছে, মলিকুলার বায়োলজিতে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফলে চিকিত্সা-বিজ্ঞানে কিছু অবদান দেখে আমরা বাণিজ্যিক স্বার্থে পুরো প্রাকৃতিক পরিবেশকে তাদের গবেষণাগার বানিয়ে ফেলতে পারি না। প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিবেশের সুরক্ষা খাদ্যের জোগানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এর ওপর কোনো প্রকার হুমকি পুরো মানব জাতিকে বিপদের মুখে ফেলবে।
বিটি বেগুনের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হচ্ছে, ব্যাকটেরিয়া থেকে বিষাক্ত প্রোটিন উদ্ভাবনের জিন ব্যাকটেরিয়া থেকে আলাদা করে জেনেটিক প্রক্রিয়ায় বেগুনের জিনোমের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে বেগুনের মধ্যেই একই ধরনের বিষাক্ত প্রোটিন উত্পাদিত হয়। ফলে বেগুনের মধ্যে সাধারণভাবে আমরা যে পোকা সব সময় দেখি, সেই ব্রিঞ্জাল ফ্রুট অ্যান্ড শুটবরার বা লেদাপোকা বেগুনের গায়ে আক্রমণ করলে বা বেগুনের কোনো অংশ খেলে এগুলোর পুষ্টিনালি ছিদ্র হয়ে মারা যায়। অর্থাত্ বেগুনগাছ নিজেই তখন বিষ হিসেবে কাজ করে। কাজেই এই বেগুন উত্পাদনের সময় বাইরের কোনো বিষ ব্যবহার করতে হয় না। ইরি এবং হাইব্রিডের বিষাক্ত বেগুন চাষ দেখে যাঁরা বিরক্ত এবং আতঙ্কিত তাঁরা নিশ্চয়ই বিটি বেগুনের দিকে ঝুঁকতে পারেন। কিন্তু বিটি বেগুন এতই বিষাক্ত যে পোকা খাওয়ারও উপযোগী নয়, সেই বেগুন কী করে মানুষের খাওয়ার উপযুক্ত হতে পারে, সে প্রশ্ন কি তোলা উচিত নয়? বেগুন ছাড়াও তুলা এবং ভুট্টার ক্ষেত্রে বিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এবং কোনো ক্ষেত্রেই সফল হতে পারেনি। বরং বিটি তুলা চাষ করে লাখ লাখ কৃষকের সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ভারতে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিটি প্রযুক্তির মাধ্যমে বিষ ব্যবহার না করার কথা বলা মিথ্যা এবং প্রতারণা। আসলে বিষ ব্যবহার বন্ধ নয়, বরং বিষাক্ত বীজ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা কোম্পানি বা উদ্ভাবক নিজেই কৃষককে করে দিচ্ছে। খাদ্যশস্য উত্পাদনে বিষ ব্যবহার বন্ধের একটাই উপায় আছে সেটা হচ্ছে, যে বীজ স্থান ও পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সেই পরিবেশে গড়ে ওঠা স্থানীয় বীজের ব্যবহার, মাটির উর্বরতা রক্ষা করা এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসলের উত্পাদন করা। কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে বীজকে বিকৃত করলেই শস্য নিরাপদ হয়ে যায় না।
ভারতে এই বিটি বেগুনের প্রবর্তনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফলে সরকার এই বেগুনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১০। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মন্ত্রী জয়রাম রামেশ এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। যদিও মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠিত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্রোভালস কমিটি (জিইএসি) বিটি বেগুনে ছাড়পত্র প্রায় দিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু মন্ত্রী দেখেছেন, ভারতের বিজ্ঞানীদের মধ্যেও এই বিটি বেগুনের নিরাপত্তার প্রশ্নে মতৈক্য নেই এবং কৃষক ও পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে যেসব নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলা হয়েছে উদ্ভাবকেরা তার সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। কৃষক এবং পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের মুখে মন্ত্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে মতবিনিময় করতে বাধ্য হন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝেছেন, এই বেগুন সম্পর্কে বিটি বেগুনের ছাড়পত্র দিয়ে পৃথিবীর মধ্যে প্রথম দেশ হওয়ার গৌরব অর্জনের জন্য তাড়াহুড়োর দরকার নেই। কিন্তু ভারতে বন্ধ হলেও বিটি বেগুনের গবেষণার কাজ যেহেতু একই কোম্পানির উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে শুরু হয়েছে, বাংলাদেশে এই বেগুনের ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে কী হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এরই মধ্যে ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ তারিখে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি বিল ২০১০ উত্থাপিত হয়েছে। যদিও বলা হয়েছে, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কৃষি-প্রযুক্তির প্রবর্তনের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করবে, তথাপি জিএম শস্যের ছাড়পত্র দেওয়ার জন্যও এই প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিলটিতে বিস্তারিত কী আছে তা আমরা জানি না। এ ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ বিল নিয়ে জনগণের মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। কারণ, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে আমাদের দেশের কোটি কোটি কৃষকের ভাগ্য, পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের প্রশ্ন।
শুরু করেছিলাম বেগুনের নানা জাতের কথা বলে। বাংলাদেশে বিটি বেগুন আসার অর্থ হচ্ছে, স্থানীয় জাতের বেগুন বিলুপ্ত হওয়ার পথ তৈরি করা। শুধু তাই নয়, মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের কথা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তাহলে আমাদের এই বিতর্কিত এবং পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জিএম বেগুন আনতে হবে কেন? বিদেশি কোম্পানির লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বাংলাদেশে প্রাইভেট কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ দেশের সাধারণ কৃষকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে না—এইটুকু অবশ্যই বোঝা যায়।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
No comments