উন্নয়ন বাজেট-প্রশ্নবিদ্ধ সরকারি বিনিয়োগ
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েকটি বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি খাতে বরাদ্দ রাজস্ব খাতের চেয়ে বেশি থাকত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোর চিত্র ভিন্ন_ উন্নয়ন বাজেটের আকার রাজস্ব খাতের ধারেকাছেও থাকে না এবং এ ব্যবধান ক্রমে বেড়ে চলেছে।
তার পরও শঙ্কা_ উন্নয়ন খাতের লক্ষ্য অর্জন করা যাবে তো? এ বাজেটের আকার কি বেশি হয়নি? আগামী ২০১১-২০১২ অর্থবছরের জন্য উন্নয়ন খাত অর্থাৎ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য ৪৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করার প্রস্তাব করার পরও এ প্রশ্ন উঠেছে_ এ বাজেট বাস্তবায়ন করা যাবে তো? বাংলাদেশকে নিয়ে এক সময়ে আন্তর্জাতিক মহলে উপহাস করার মতো 'বিশেষজ্ঞ' কম ছিল না। তাদের মনে হয়েছিল_ এ দেশটি কেবল উন্নত দেশগুলোর করুণার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকবে। কারণ এখানে প্রাকৃতিক সম্পদ অপ্রতুল, কৃষি সেকেলে এবং শিল্পে পিছিয়ে। সর্বোপরি রয়েছে জনসংখ্যার চাপ, যাদের সিংহভাগই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এই দেশটিই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের 'বাস্কেট কেস' অপবাদ ঘুচিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে_ পরপর কয়েক বছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে থাকছে। নিকট ভবিষ্যতেই যা ৭ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে। এ বাস্তবতায় উন্নয়ন বাজেটের আকার বড় হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ৪৬ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য বরাদ্দের পরও সংশয় প্রবল। এর কারণ অনুসন্ধানে দূরে যাওয়ার দরকার নেই_ চলতি বছরের প্রতি নজর ফেললেই চলে। এ বাজেটের জন্য প্রথমে বরাদ্দ করা হয় ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। নানা পর্যায়ে সংশোধনের পর সর্বশেষ আকার দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬০ শতাংশ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। এ হিসাবও করা হয়েছে অর্থ ছাড়ের পরিমাণ বিবেচনায়, প্রকৃত কাজ আরও কম বলেই অভিযোগ। আগামী বছর দৃশ্যপট বদলাবে এমন ভরসা অর্থনীতিবিদ এবং আর্থ-সামাজিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের খুবই কম। তাদের বক্তব্য স্পষ্ট_ দেশের প্রয়োজনের তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার বরং কম, কিন্তু প্রশাসনের বাস্তবায়নের দক্ষতা বিচার করা হলে এই সীমিত বাজেটও অনেক বড় মনে হয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন কিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যার লক্ষ্য যতটা না দেশের তার চেয়ে ঢের যেন ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর। প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী মহলের চাপের কাছে নতিস্বীকারের ঘটনাও রয়েছে। আগামী অর্থবছরে এসবের হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলবে, এমন প্রত্যাশা করাই সঙ্গত। কিন্তু ভরসার স্থানটি বড়ই দুর্বল। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি রোববার অনুমোদিত হয়েছে। আমরা আশা করব, জাতীয় সংসদে এ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলো নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হবে। কেন বছরের পর বছর একই ব্যর্থতা, তার পর্যালোচনা হওয়া জরুরি। প্রশাসনের ভেতরেও এ বিষয়ে নিবিড় আলোচনা দরকার। প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, এটা জানা কথা। বিনিয়োগের চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত। তার পরও এটা সর্বজনস্বীকৃত, সরকারি বিনিয়োগের বিকল্প নেই। কিন্তু কেন এ বিনিয়োগ বরাদ্দ প্রতিবছরই প্রশ্নবিদ্ধ থাকে?
No comments