নিসর্গ নির্মাণ-জাতীয় বৃক্ষ, পুষ্প উৎসব ও অন্যান্য by মোকারম হোসেন

আমাদের জাতীয় ফুল, ফল, পতাকা, পশু, পাখি, সংগীত, মাছ—সবকিছুই আছে কিন্তু জাতীয় বৃক্ষ কোনটি? অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এ বিষয়ে যখন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাইনি। দু-একটি ওয়েবসাইটে অবশ্য দ্বিধান্বিতভাবে বটগাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাতে শঙ্কা কাটে না। নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।


শেষে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ঘুরে বন অধিদপ্তর থেকে কিছু আশাপ্রদ তথ্য মিলল। বন সংরক্ষক হারাধন বণিক জানালেন, বেশ কয়েক বছর আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে বটগাছকে জাতীয় বৃক্ষের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রচারণার অভাবে এ তথ্য আজানাই থেকে যায়। এমনকি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে অন্যান্য জাতীয় প্রতীকগুলো উপস্থাপন করা হলেও বাদ পড়েছে জাতীয় বৃক্ষ।
ভারতের জাতীয় বৃক্ষও বট হওয়ায় নিসর্গী ও প্রকৃতিবিদদের অনেকেই জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে শালগাছের নাম প্রস্তাব করেছেন। কারণ শাল আমাদের আদিবৃক্ষ। একসময় মধুপুরসহ সমগ্র লালমাটি অঞ্চলই ছিল শালবৃক্ষে আবৃত। শালের স্থানীয় নাম গজারি। নিসর্গ নির্মাণ ও নান্দনিক ভাবনা গ্রন্থে দ্বিজেন শর্মা জানিয়েছেন, ‘ভারতের ডুয়ার্স থেকে মেঘালয়ের গারো পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত শালবন গোটা বরেন্দ্র অঞ্চল হয়ে ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু কিভাবে এ বন যমুনা পেরুল সে এক রহস্য। প্লিয়োস্টিন যুগের দুই লাখ বছর আগে শেষ ভূমিকম্পে সৃষ্ট লালমাটির আত্মজ এই শালবন খুবই প্রাচীন।’ তা ছাড়া গড়নের দিক থেকেও শাল রাজসিক। দারুমূল্য, পাতার আকৃতি, বংশবৃদ্ধির কৌশল সবকিছুতেই অনন্য। শালকে জাতীয় বৃক্ষ করা হলে দুটি কাজ হবে। প্রথমত, শাল সম্পর্কে মানুষ নতুন করে জানতে আগ্রহী হবে; দ্বিতীয়ত, গাছটি কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। বট বাংলার নিজস্ব গাছ হলেও জাতীয় বৃক্ষ করার প্রথম সুযোগটি ভারত নিয়েছে। আমরা পারিনি। আশা করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অতি দ্রুত জাতীয় বৃক্ষ সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষকে অবহিত করবে। ২০১১ সালের নতুন গ্রন্থে স্কুলের শিশুরা যেন জাতীয় বৃক্ষের পরিচয় জানতে পারে। বাংলাদেশের মতো একটি সবুজ-শ্যামল দেশে জাতীয় বৃক্ষের কথা কেউ জানবে না, এটা মোটেই কাম্য নয়।
নানাভাবে আমাদের দেশে এসে থিতু হওয়া বিদেশি গাছগুলোকে দেশি নাম দিয়ে বরণ করা উচিত। রবীন্দ্রনাথ সেই কবে থেকে শ্রুতিমধুর নাম দিয়ে অনেক বিদেশি গাছপালাকে আপন করে নিয়েছেন। রেঙ্গুনক্রিপারের নাম রেখেছেন মধুমঞ্জরিলতা, মিলিংটোনিয়ার নাম হিমঝুরি। এমন আরও কিছু গাছকে তিনি বাংলা নাম দিয়ে আদৃত করেছেন। কিন্তু তারপর এক বিরাট শূন্যতা! বছরের পর বছর ধরে অনেক বিদেশি গাছ আমাদের দেশে এসে থিতু হয়েছে, অথচ তাদের কোনো বাংলা নাম নেই। ফলে শুরু হয়েছে বিভ্রান্তি। একেকজন একেক নামে চেনে। এসব বিদেশি গাছপালা সংখ্যায় নেহাত কম নয়। দেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানী, নিসর্গী, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে নামকরণের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। উদ্যোগটি নিতে পারে বাংলা একাডেমী। তাহলে বিদেশি গাছের নাম নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না।
বোটানিক্যাল গার্ডেন কোনো সম্পূর্ণ বিনোদন উদ্যান নয়। তা ছাড়া এর জন্মও কিন্তু বিনোদনের উদ্দেশ্যে নয়। যে দেশে মানুষ এখনো নির্বিচারে গাছ কাটে, নদী ভরাট করে, খাল দখল করে, বন উজাড় করে, সে দেশের মানুষ বোটানিক্যাল গার্ডেনে কি শুধু গাছপালা দেখতে যায়? আজকাল উদ্যান মানে শুধু বৃক্ষশালা নয়; হার্বেরিয়াম, গবেষণাগার, গ্রন্থাগার, জাদুঘর ইত্যাদি নিয়েই পূর্ণাঙ্গ উদ্যান। সেখানে শুধু উপস্থাপনই নয়, নতুন নতুন উদ্ভাবনও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যদি আমাদের আবাদিত নতুন নতুন জাত উপহার না দিতে পারে, তাহলে এখানকার আঞ্চলিক বৃক্ষাদির উৎকর্ষ সাধনের দায়িত্ব নেবে কে? আমরা জানি, বিনোদনমূল্য বোটানিক্যাল গার্ডেনের পূর্বশর্ত নয়। এ ক্ষেত্রে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বিদেশি প্রজাতির যথাযথ সংরক্ষণ প্রধান কাজ। পৃথিবীজুড়েই হার্বেরিয়াম বোটানিক গার্ডেনের একটি অংশ। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠান দুটি যেন চিরবৈরী।
সার্বিক অর্থে বোটানিক্যাল গার্ডেন অপরাপর বাগান ও পার্ক থেকে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত প্রজাতি সংরক্ষণ, শিক্ষা, গবেষণা, বিনোদন ও পারিপার্শ্বিক অনেক কিছু। উদ্যান রচনার ক্ষেত্রে যথাযথ নকশা অনুসরণ করে যাবতীয় কর্মকাণ্ড সুসম্পন্ন করলে তার ফল সুদূরপ্রসারী হয়। কাজেই আমাদের ন্যাশনাল বোটানিক গার্ডেনটিকে শুধু পার্ক হিসেবে বিবেচনা না করে এর যাবতীয় চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মনে রাখা উচিত, বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রত্যক্ষভাবে আর্থিক লাভালাভের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, এর ফল সর্বদাই অদৃশ্য, চলমান ও সুদূরপ্রসারী।
একবার ভেবে দেখুন, আপনার চোখের সামনে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পথ। তার দুই পাশে থরে থরে সাজানো জারুল, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়া। বিন্যাসটা এমন যে প্রথমে একটি কৃষ্ণচূড়া, তারপর সোনালু, সোনালুর পর জারুল; এভাবেই তৈরি করা হয়েছে তিন রঙের সুসজ্জিত বীথি। জারুলের রং উজ্জ্বল বেগুনি, সোনালুর রং হলুদ সোনালি আর কৃষ্ণচূড়ার প্রধান রং টকটকে লাল। আর সেখানেই যদি হয় আমাদের পুষ্প উৎসব, তাহলে কেমন হয়? আমরা এমন একটি পুষ্প উৎসবের স্বপ্ন দেখছি দীর্ঘদিন। গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে ছড়ানো থাকে যাবতীয় উন্মাদনার রং। কৃষ্ণচূড়ার রং পাগল করা। অনেক দূর থেকেই তার উজ্জ্বল রং আমাদের উতলা করে। তাহলে কেন আমরা বঞ্চিত হচ্ছি এমন একটি নান্দনিক উৎসব থেকে? আমাদের দেশে এমন একটি এভিন্যু তৈরি করা কি খুব ব্যয়বহুল?
কোনো জাতীয় উৎসব মানেই সম্প্রীতির মেলবন্ধন। আর পুষ্প উৎসবের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সেতুবন্ধন আরও অটুট হবে। সেই সঙ্গে প্রকৃতির প্রতি আমাদের দরদ যেমন বাড়বে তেমনি ভাবনার পরিধি আরও বিস্তৃত হবে।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
tarupallab@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.