চারদিক-কান পেতে রই by রাজীব হাসান
রোদে পুড়ে তামাটে চেহারা। মুখের ভাঁজে বয়সের আঁকিবুকি। নির্লিপ্ত চাহনি, জীবনের সাঁঝবেলায় এসে যেন চারপাশের জগত্টা তাঁর কাছে একদমই অর্থহীন। তবুও তিনি নজর কাড়লেন আমাদের। নজর কাড়ল আসলে তাঁর মাথায় বসানো আয়নার মতো গোল একটা চাকতি, সূর্যের আলো পড়লে যেটা ঝকমকিয়ে ওঠে।
বুকে ঝোলানো কাঠের চারকোনা এক বাকেসা। তাতে রাজ্যের শিশিবোতল। সপ্ততিপর বৃদ্ধের পেশা সম্পর্কে কৌতূহল জাগে আমাদের।
‘আমি হইলাম ডাক্তার।’
কৌতূহল বাড়ে আরও।
‘হ, আমি হইলাম কানের ডাক্তার। কানের যে কুনু সমইস্যা মিনিটেই সমাধান! তারপর ধরেন দাঁতে ব্যথা, পোকা, শিরশিরানি...’
মুখস্থ বিদ্যা আওড়ে চলেন তিনি। ক্রেতা আকর্ষণের আদিম কিন্তু এখনো সমান কার্যকর পদ্ধতি। দুই পয়সা বিদ্যা নেই। তার পরও তিনি বাগেরহাটের আফজাল হোসেন, নিজেকে দাবি করতে চান এই দেশের সেরা চিকিত্সকদের একজন। তাও আবার ‘ডাবল ডিগ্রি’ তাঁর। দাঁত তো বটেই, কানের ‘যে কুনু সমইস্যা’ তিনি সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন মিনিটেই।
আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম হজরত খান জাহান আলীর (রহ.) মাজারের পাশের পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটটায়। গিজগিজে ভিড়। ভিখারির অহেতুক উত্পাত। দর্শনার্থী আর পর্যটকদের মধ্যে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় ‘মানত’ করা অভিভাবকহীন কিছু রাজহাঁস। খানিক দূরেই নাকি বাস করে কালাপাহাড় আর ধলাপাহাড়, যাদের কথা ভেবে টলটলে পুকুর আর লাল শাপলার হাতছানি ভুলে পানিতে পা ডোবানোর লোভ সামলাই আমরা ঢাকাবাসীরা, লাল শাপলা যাদের কাছে ১০৮টি নীলপদ্মের চেয়েও দুর্লভ।
আফজাল হোসেন হেঁটে যাচ্ছিলেন পাশ দিয়েই। হয়তো মাথায় বসানো গোল আয়নায় ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল রোদ্দুর। তারই প্রতিফলিত আলো আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েছিল তাঁর দিকে। ভ্রাম্যমাণ চিকিত্সকের সঙ্গে কথা বলতেই এগিয়ে যাওয়া তাঁর দিকে।
কথা বলতে তিনি রাজি। কিন্তু আমাদের মতো উটকো পর্যটকদের কাছে না থাকতে পারে, সময়ের দাম কাছে অনেক বেশি। নিদেন ১০ টাকা তো বটেই! কারণ কথা বলতে চাইলে তাঁর কাছে দাঁত নয়তো কানের চিকিত্সা নিতে হবে। আর সবার কাছে ২০ টাকা করেই নেন। অতিথি হিসেবে আমাদের বাড়তি খাতির করতেই, কিংবা সেদিন দুপুর পর্যন্ত বউনি হয়নি বলেই কি না চেয়ে বসেন মাত্র ১০ টাকা। প্রস্তাবটার মধ্যে একটা স্বার্থপরতা আছে বলেই বোধহয়, লাজুক একটা হাসিও ঝিলিক দিয়ে যায় বৃদ্ধের মুখে। সহসাই প্রকাশ হয়ে পড়ে তাঁর ফোকলা দাঁতের মাড়ি! দাঁতের চিকিত্সক তো নিজের চিকিত্সায় ব্যর্থ। কানই সই। নিজেদের কান পেতে দিই আমরা।
হেডমাস্টারদের মতো এক হাতে কান টেনে বিজ্ঞের মতো পরখ করতে থাকেন তিনি। এবার বোঝা যায় মাথার ওই আয়নার কারবার। সূর্যের প্রতিফলিত আলো কানের অন্দরমহলে পৌঁছে যায়। ঝানু হাতে দ্রুত সরু একটা লোহার শিকের মাথায় তুলো পেঁচিয়ে ফেলেন। এরপর বাক্সে রাখা কোনো একটা শিশির ভেতরে রাখা তরলে ভিজিয়ে নেন তুলা। এর পরই শুরু কানের চিকিত্সা। আমাদেরই কেউ একজন টিপ্পনি কাটে, ‘চাচা, মাথার ব্যারামের চিকিত্সা নাই? থাকলে ওইটাও একটু করে দিয়েন।’
আমাদের ঠাট্টা-মশকরায় যেন মনোযোগ নেই তাঁর। আফজাল হোসেন এখন আর যেন সাধারণ কেউ নন। যেন তিনি নিমগ্ন এক ভাস্কর। আর তাঁর সামনে বসে থাকা তাঁর রোগী কিংবা খদ্দের যেন কাঠের খণ্ড। ছেনির ছাঁচে ছাঁচে তিনি গড়ে তুলছেন মানবমূর্তি। অভিজ্ঞ হাতের তালুতে শনৈঃ শনৈঃ ঘোরে তুলা লাগানো সরু শিক।
আফজাল নামের চেহারায় কাঠিন্য কিন্তু মনের দিক দিয়ে অতি সরল এই মানুষটার অন্দরমহলে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করি আমরা। জানতে চাই তাঁর জীবনের গল্প। কী একটা গ্রামের নাম বলেন তিনি। পিরোজপুরের দিকের কোনো গ্রাম বলে ঠাওরে নিই আমরা। কল্পনা করে নিই সবুজ স্নিগ্ধ একটা গ্রামের ছবি। যে ছবিটা যতটা না চোখ দিয়ে, তার চেয়ে ইট, পাথর, কংক্রিটের শহুরে বাসিন্দা এই আমরা বেশি চিনি দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের প্রচ্ছদ থেকে।
কিন্তু বাগেরহাট শহরে এলেন কেন? কেনই বা বেছে নিলেন এই অদ্ভুত পেশা? কেন গ্রাম ছেড়েছেন সেই গল্পটা জানাতে আপত্তি তাঁর। পাশ কাটিয়ে যেতে চান অদূরবর্তী নদীটার স্রোতের মতো। হয়তো নদীর গর্ভে চলে গেছে তাঁর ভিটেমাটি। হয়তো জায়গাজমি নিয়ে বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা ভিটেছাড়া করেছে তাঁকে। আফজাল হোসেন কিছুতেই খোলাসা করেন না। সে যে অনেক দিন আগের কথা। স্মৃতিতে জমেছে সময়ের পলিমাটি।
সংসারটংসার নয়, নিজের পেশা নিয়ে কথা বলতেই তাঁর যত আগ্রহ। গুরুমুখী বিদ্যা। গুরুর কাছে থেকে, ফুটফরমায়েশ খেটে শিখতে হয়। তারপর একসময় শিষ্য নিজেই খুলে বসে ভ্রাম্যমাণ চিকিত্সাকেন্দ্র। আফজালও তা-ই শিখেছেন। কাজটাও করছেন অনেক দিন ধরে। কিন্তু পসার নেই খুব একটা, স্বীকার করে নিলেন। ইতিউতি ঘুরেই কাটে সময়। কিন্তু কাউকে অনুরোধ-টনুরোধ করেন না। কেউ স্বেচ্ছায় এলেই তবে চলে তাঁর চিকিত্সা। বেশভূষায় দরিদ্র কিন্তু আত্মসম্মানবোধে অনেক ধনী আফজাল হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধাই জন্মায় আমাদের।
দিনে রোজগার হয় শ খানেক। বাবা খান জাহান আলীর দোয়া থাকলে কোনো কোনো দিন রোজগার শ দেড়েকও হয়। তবে এই অল্প আয়ে সংসারের চাকা ঘোরে না। বাধ্য হয়ে বাগেরহাট পৌরসভায় জুটিয়ে নিয়েছেন একটা চাকরি। আমাদের ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্যালাপ ফুরোনোর আগেই শেষ হয়ে যায় তাঁর কাজ। দারুণ পেশাদারি দেখিয়ে দ্রুত টাকা বুঝে নেন। গোল আয়নার চাকতিটা ফের তুলে নেন কপালে। শিশিগুলো সাজিয়ে নেন যথাস্থানে। নিঃশব্দে হাঁটা দেন নতুন খদ্দেরের সন্ধানে।
একবার ইচ্ছে হলো, আফজাল হোসেনকে পেছন থেকে ডাকি। বলি, আপনার মতো লোকের দরকার এখন সবচেয়ে বেশি। আমাদের সবার কানে যে আপস আর স্বার্থপরতার ধুলো জমে আছে, আমাদের নেতাদের কানে যে এঁটে আছে খিল; নাগরিক নির্লিপ্ততায় আক্রান্ত এই আমাদের কানটা পরিষ্কার করতে আফজাল হোসেনদের যে বড্ড দরকার!
‘আমি হইলাম ডাক্তার।’
কৌতূহল বাড়ে আরও।
‘হ, আমি হইলাম কানের ডাক্তার। কানের যে কুনু সমইস্যা মিনিটেই সমাধান! তারপর ধরেন দাঁতে ব্যথা, পোকা, শিরশিরানি...’
মুখস্থ বিদ্যা আওড়ে চলেন তিনি। ক্রেতা আকর্ষণের আদিম কিন্তু এখনো সমান কার্যকর পদ্ধতি। দুই পয়সা বিদ্যা নেই। তার পরও তিনি বাগেরহাটের আফজাল হোসেন, নিজেকে দাবি করতে চান এই দেশের সেরা চিকিত্সকদের একজন। তাও আবার ‘ডাবল ডিগ্রি’ তাঁর। দাঁত তো বটেই, কানের ‘যে কুনু সমইস্যা’ তিনি সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন মিনিটেই।
আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম হজরত খান জাহান আলীর (রহ.) মাজারের পাশের পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটটায়। গিজগিজে ভিড়। ভিখারির অহেতুক উত্পাত। দর্শনার্থী আর পর্যটকদের মধ্যে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় ‘মানত’ করা অভিভাবকহীন কিছু রাজহাঁস। খানিক দূরেই নাকি বাস করে কালাপাহাড় আর ধলাপাহাড়, যাদের কথা ভেবে টলটলে পুকুর আর লাল শাপলার হাতছানি ভুলে পানিতে পা ডোবানোর লোভ সামলাই আমরা ঢাকাবাসীরা, লাল শাপলা যাদের কাছে ১০৮টি নীলপদ্মের চেয়েও দুর্লভ।
আফজাল হোসেন হেঁটে যাচ্ছিলেন পাশ দিয়েই। হয়তো মাথায় বসানো গোল আয়নায় ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল রোদ্দুর। তারই প্রতিফলিত আলো আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েছিল তাঁর দিকে। ভ্রাম্যমাণ চিকিত্সকের সঙ্গে কথা বলতেই এগিয়ে যাওয়া তাঁর দিকে।
কথা বলতে তিনি রাজি। কিন্তু আমাদের মতো উটকো পর্যটকদের কাছে না থাকতে পারে, সময়ের দাম কাছে অনেক বেশি। নিদেন ১০ টাকা তো বটেই! কারণ কথা বলতে চাইলে তাঁর কাছে দাঁত নয়তো কানের চিকিত্সা নিতে হবে। আর সবার কাছে ২০ টাকা করেই নেন। অতিথি হিসেবে আমাদের বাড়তি খাতির করতেই, কিংবা সেদিন দুপুর পর্যন্ত বউনি হয়নি বলেই কি না চেয়ে বসেন মাত্র ১০ টাকা। প্রস্তাবটার মধ্যে একটা স্বার্থপরতা আছে বলেই বোধহয়, লাজুক একটা হাসিও ঝিলিক দিয়ে যায় বৃদ্ধের মুখে। সহসাই প্রকাশ হয়ে পড়ে তাঁর ফোকলা দাঁতের মাড়ি! দাঁতের চিকিত্সক তো নিজের চিকিত্সায় ব্যর্থ। কানই সই। নিজেদের কান পেতে দিই আমরা।
হেডমাস্টারদের মতো এক হাতে কান টেনে বিজ্ঞের মতো পরখ করতে থাকেন তিনি। এবার বোঝা যায় মাথার ওই আয়নার কারবার। সূর্যের প্রতিফলিত আলো কানের অন্দরমহলে পৌঁছে যায়। ঝানু হাতে দ্রুত সরু একটা লোহার শিকের মাথায় তুলো পেঁচিয়ে ফেলেন। এরপর বাক্সে রাখা কোনো একটা শিশির ভেতরে রাখা তরলে ভিজিয়ে নেন তুলা। এর পরই শুরু কানের চিকিত্সা। আমাদেরই কেউ একজন টিপ্পনি কাটে, ‘চাচা, মাথার ব্যারামের চিকিত্সা নাই? থাকলে ওইটাও একটু করে দিয়েন।’
আমাদের ঠাট্টা-মশকরায় যেন মনোযোগ নেই তাঁর। আফজাল হোসেন এখন আর যেন সাধারণ কেউ নন। যেন তিনি নিমগ্ন এক ভাস্কর। আর তাঁর সামনে বসে থাকা তাঁর রোগী কিংবা খদ্দের যেন কাঠের খণ্ড। ছেনির ছাঁচে ছাঁচে তিনি গড়ে তুলছেন মানবমূর্তি। অভিজ্ঞ হাতের তালুতে শনৈঃ শনৈঃ ঘোরে তুলা লাগানো সরু শিক।
আফজাল নামের চেহারায় কাঠিন্য কিন্তু মনের দিক দিয়ে অতি সরল এই মানুষটার অন্দরমহলে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করি আমরা। জানতে চাই তাঁর জীবনের গল্প। কী একটা গ্রামের নাম বলেন তিনি। পিরোজপুরের দিকের কোনো গ্রাম বলে ঠাওরে নিই আমরা। কল্পনা করে নিই সবুজ স্নিগ্ধ একটা গ্রামের ছবি। যে ছবিটা যতটা না চোখ দিয়ে, তার চেয়ে ইট, পাথর, কংক্রিটের শহুরে বাসিন্দা এই আমরা বেশি চিনি দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের প্রচ্ছদ থেকে।
কিন্তু বাগেরহাট শহরে এলেন কেন? কেনই বা বেছে নিলেন এই অদ্ভুত পেশা? কেন গ্রাম ছেড়েছেন সেই গল্পটা জানাতে আপত্তি তাঁর। পাশ কাটিয়ে যেতে চান অদূরবর্তী নদীটার স্রোতের মতো। হয়তো নদীর গর্ভে চলে গেছে তাঁর ভিটেমাটি। হয়তো জায়গাজমি নিয়ে বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা ভিটেছাড়া করেছে তাঁকে। আফজাল হোসেন কিছুতেই খোলাসা করেন না। সে যে অনেক দিন আগের কথা। স্মৃতিতে জমেছে সময়ের পলিমাটি।
সংসারটংসার নয়, নিজের পেশা নিয়ে কথা বলতেই তাঁর যত আগ্রহ। গুরুমুখী বিদ্যা। গুরুর কাছে থেকে, ফুটফরমায়েশ খেটে শিখতে হয়। তারপর একসময় শিষ্য নিজেই খুলে বসে ভ্রাম্যমাণ চিকিত্সাকেন্দ্র। আফজালও তা-ই শিখেছেন। কাজটাও করছেন অনেক দিন ধরে। কিন্তু পসার নেই খুব একটা, স্বীকার করে নিলেন। ইতিউতি ঘুরেই কাটে সময়। কিন্তু কাউকে অনুরোধ-টনুরোধ করেন না। কেউ স্বেচ্ছায় এলেই তবে চলে তাঁর চিকিত্সা। বেশভূষায় দরিদ্র কিন্তু আত্মসম্মানবোধে অনেক ধনী আফজাল হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধাই জন্মায় আমাদের।
দিনে রোজগার হয় শ খানেক। বাবা খান জাহান আলীর দোয়া থাকলে কোনো কোনো দিন রোজগার শ দেড়েকও হয়। তবে এই অল্প আয়ে সংসারের চাকা ঘোরে না। বাধ্য হয়ে বাগেরহাট পৌরসভায় জুটিয়ে নিয়েছেন একটা চাকরি। আমাদের ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্যালাপ ফুরোনোর আগেই শেষ হয়ে যায় তাঁর কাজ। দারুণ পেশাদারি দেখিয়ে দ্রুত টাকা বুঝে নেন। গোল আয়নার চাকতিটা ফের তুলে নেন কপালে। শিশিগুলো সাজিয়ে নেন যথাস্থানে। নিঃশব্দে হাঁটা দেন নতুন খদ্দেরের সন্ধানে।
একবার ইচ্ছে হলো, আফজাল হোসেনকে পেছন থেকে ডাকি। বলি, আপনার মতো লোকের দরকার এখন সবচেয়ে বেশি। আমাদের সবার কানে যে আপস আর স্বার্থপরতার ধুলো জমে আছে, আমাদের নেতাদের কানে যে এঁটে আছে খিল; নাগরিক নির্লিপ্ততায় আক্রান্ত এই আমাদের কানটা পরিষ্কার করতে আফজাল হোসেনদের যে বড্ড দরকার!
No comments