দলীয়করণ-সরকারের ক্ষতি করে কারা by মশিউল আলম

রংপুরের বদরগঞ্জে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন ২৬ জন সাংবাদিক। স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও জাতীয় পার্টির নেতারা প্রকাশ্য জনসভায় ওই সাংবাদিকদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন বলে সাধারণ ডায়েরিতে অভিযোগ করা হয়েছে। কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মামলাও করা হয়েছে।


গত মঙ্গলবার রাতে বরিশালের একটি সংবাদপত্রের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে আসবাবপত্র ভাঙচুর ও পাঁচ সাংবাদিককে মারধর করেছেন ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় সন্ত্রাসী। একটি মানবাধিকার সংস্থার জরিপ প্রতিবেদন বলছে, এ সরকারের গত ১৪ মাসে সারা দেশে মোট ৩২৪ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে সংসদকক্ষ উত্তপ্ত করেছেন বিরোধী দলের একজন বড় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী। তাঁদের সরকারের আমলেও যে সাংবাদিকেরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন পাল্টা কথা এসেছে সরকারদলীয় উপনেতার মুখ থেকে।
সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বেশি লেখালেখি হলে অনেকে ভাবেন, আমরা সাংবাদিকেরা নিজেদের নিয়েই বেশি চিন্তিত। তাই এ বিষয়ে বেশি কিছু বলব না। কিন্তু এটুকু বলা দরকার যে সরকারের জন্য এটা একটা খারাপ লক্ষণ। অতীতের সব সরকারের সময় আমরা দেখেছি, সাংবাদিকদের নির্যাতন-হয়রানি ঘটলে শেষ পর্যন্ত সরকারের কী অবস্থা হয়। দেশের ভেতর ও বাইরে সরকারের ভাবমূর্তি কেমন দাঁড়ায়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার পক্ষে সরকারের নেতারা যতই বক্তৃতা-বিবৃতি দেন না কেন, বাস্তবে সেগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ে।
বর্তমান মহজোটের সরকার গত প্রায় দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সরকার। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর সংসদে এত বেশিসংখ্যক আসনে জয়ী হয়ে এর আগে কখনো কোনো দল বা জোট সরকার গঠন করেনি। এমন জনপ্রিয় সরকারের প্রতি সংবাদমাধ্যমের একটা সাধারণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার মানে জনগণের রায়ের প্রতি সম্মান জানানো। কিন্তু সেই সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা যদি সরকারি দল ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর একশ্রেণীর নেতা-কর্মীদের নির্যাতন-হয়রানি, হুমকি-ধমকির শিকার হয়, তাহলে অচিরেই সংবাদমাধ্যমের অবস্থান পাল্টে যাওয়ার কথা। একজন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হলেও তার যে প্রতিক্রিয়া সারা দেশে ঘটে, তা সরকারের জন্য প্রীতিকর হয় না। আর সংখ্যা যখন বাড়ে, তখন প্রতিক্রিয়া এত বেশি হয় যে সরকারের মনে হতে শুরু করে যে সংবাদমাধ্যম তাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে, বৈরী হয়ে গেছে। সে অবস্থা আসার আগেই সরকারের সতর্ক হওয়া ভালো। যাঁরা সরকারি দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নামে সাংবাদিকদের নির্যাতন-হয়রানি করবেন, হুমকি-ধমকি দেবেন, সরকারের নিজের স্বার্থেই তাঁদের থামানো উচিত। কারণ এসব লোকের এহেন আচরণে চূড়ান্ত ক্ষতিটা হবে সরকারেরই।
শুধু সাংবাদিকদের নির্যাতন করলেই সরকারের ক্ষতি হয় তা নয়, সাধারণ মানুষ অন্যায়-অবিচারের শিকার হলেও তা-ই ঘটে। কিন্তু সেটা উপলব্ধি করার মানসিকতা সরকারের নেতাদের থাকে কি না বোঝা যায় না। সরকার তার প্রশাসনিক কাঠামো ও লোকবল দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। আর সমাজটাকে পরিচালিত করতে চায় সরকারি দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের দিয়ে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী সম্প্রদায় ও জনপদকে তাঁরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বা আনতে চেষ্টা করেন। এটা একদম ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। গত বুধবার প্রথম আলোয় একটি খবর ছাপা হলো, নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামের একটি পরিবার এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়ে মামলা করে আসামিদের নির্যাতনে ও হুমকিতে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হতে চলেছে। দেখা গেল, ওই এসিড নিক্ষেপকারীদের একজন লেবুতলা ইউনিয়নের যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক বিটু। এসিড নিক্ষেপের ঘটনাটি ২০০৭ সালের, নাজমুল হক বিটুসহ চারজন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে সবাই জামিনে ছাড়া পেয়ে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য পরিবারটিকে চাপ দেন, নির্যাতন করেন, ভয়-ভীতি দেখান। এবং যা বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো, সেটা হলো, মামলাটি তুলে নিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য সালিস-বৈঠকের আয়োজন করা হয়; সে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মনোহরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল হক, আর বৈঠক পরিচলালনা করেন সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান। এমনকি স্থানীয় থানা-পুলিশের প্রচ্ছন্ন সায়ও ছিল যেন বিষয়টি সামাজিকভাবে নিষ্পত্তি করা হয়, আসামিরা মামলা তুলে নেন।
খবরটি প্রকাশের পরদিন প্রথম আলোয় একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়; স্থানীয় প্রশাসনের টনক নড়ে, পরিবারটিকে আর ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে হয়নি। সরকারি দলের প্রভাব যে তৃণমূলের সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা পর্যন্ত বিস্তৃত, সেটা এ ঘটনা থেকে দৃশ্যমান হয়। এমনটি শুধু একটি উপজেলায় নয়, সারা দেশেই। এবং এটা শুধু এ সরকারের আমলের কথা নয়, আগের সরকারগুলোর আমলেও এমনই ছিল। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন দলের ক্ষমতা ছড়িয়ে রয়েছে জালের মতো সমগ্র দেশে। সেটা তাত্ত্বিকভাবে খারাপ কিছু নয়। আসলে, সরকারি দলের কর্তব্যই হলো সংগঠনের প্রতিটি স্তরে সরকারি নীতি-কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে সমর্থন জোগানো, সহযোগিতা করা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, হয়েছে উল্টোটা। দল ও দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর আশ্রয়ে থেকে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করাই হয়ে উঠেছে প্রধান প্রবণতা। তা করতে গিয়ে আইনলঙ্ঘন, আইন প্রয়োগে বাধা দেওয়া, প্রশাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব খাটানো হয়। সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকলে অন্যায়-অপরাধ করে পার পাওয়া যায়—এটাই যখন বাস্তবতা, তখন যা ঘটছে তা না ঘটার কী কারণ থাকতে পারে?
সব সরকার এই বাস্তব সত্য অস্বীকার করতে চায় যে সরকারি দল অন্যায় কিছু করছে। সংবাদমাধ্যমে সেসব খবর বেশি প্রকাশিত হলে সরকার সংবাদমাধ্যমের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়; কখনো কখনো কড়া ভাষায় সমালোচনা করে। কোনো কোনো সংবাদপত্র সরকারের কোপানলেও পড়ে যায়। অবশ্য বর্তমান সরকারের দিক থেকে এখনো সংবাদমাধ্যমকে দোষারোপ করা হচ্ছে না; বরং ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকারি দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর একশ্রেণীর নেতা-কর্মীর অন্যায়-অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবরাদি সরকারের নেতারা গুরুত্বের সঙ্গেই নিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি যে সরকারের জন্য একটা বিব্রতকর ব্যাপার হয়েছে তা প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীর কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এসব বন্ধ করার যে স্বাভাবিক আইনসিদ্ধ পন্থা রয়েছে, সরকারের গুরুত্ব সেই দিকে কম। সর্বশেষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে টেন্ডার নিয়ে যাতে সহিংস ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের ‘বোঝানোর’ দায়িত্ব পালন করবেন মন্ত্রী-সাংসদেরা। এই ‘বোঝানো’ যে ফলপ্রসূ হবে না তা আগে থেকেই বলে দেওয়া যায়। এর আগে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ব্যাপারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর খেদযুক্ত মন্তব্য বিফলে গেছে। মন্ত্রিসভা কমিটির ওই বৈঠকে বলা হয়েছে, সারা দেশে টেন্ডারের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি প্রভাবশালী মহল জড়িত। টেন্ডার-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে ওই ব্যক্তিরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ফলে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলার ওপর প্রভাব ফেলে। এটা কী করে মন্ত্রিসভা কমিটির বক্তব্য হতে পারে তা বোঝা মুশকিল। ওই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কি খোদ সরকারের চেয়েও ক্ষমতাধর? আইন প্রয়োগে বাধা দিতে পারে কারা? সরকার কি তাদের কাছে অসহায়?
ওই সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ষড়যন্ত্রকারীরা সরকারকে নাজেহাল করছে। এটা বিরোধী দলের প্রতি ইঙ্গিত। কিন্তু বিরোধী দল সরকারকে কীভাবে, কতটুকু ‘নাজেহাল’ করতে পারছে, সেটা একটা প্রশ্ন। উল্টো বিরোধী দলের অভিযোগ, সরকারি দলের লোকজন আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিলে তাদের নেতা-কর্মীদের যারপরনাই নাজেহাল করে চলেছে। যা-ই হোক না কেন, সরকারের নেতারা যদি এ মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে শত্রু না খুঁজে নিজের প্রতি মনোযোগী হয়, তাহলে সরকারের মঙ্গল হবে, জনগণের অমঙ্গলও কমবে। এত জনপ্রিয় সরকারের ক্ষতি এ রকম অজনপ্রিয় বিরোধী দলের পক্ষে করা সম্ভব হবে না; যদি সরকার ঠিকঠাকমতো নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারে। সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা তার দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর একশ্রেণীর নেতা-কর্মীর অন্যায়-অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সরকারকে যদি মনে করা হয় একটি জীবন্ত প্রাণীদেহ, তাহলে এসব উপাদান হলো ক্ষতিকর ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া, যা ওই দেহের মধ্যে সক্রিয় হয়েছে। এসব ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা না হলে দেহটি রুগ্ণ হতে হতে শেষে বিপর্যস্ত হবে। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এগুলোকে উপকারী ব্যাকটেরিয়ায় পরিণত করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন ওষুধ প্রয়োগ করা: এই ক্ষেত্রে আইনের চেয়ে বড় অষুধ আর হয় না।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.