উন্নয়ন ও পরিবেশ-বনের মৃত্যুদণ্ড ও একটি প্রশ্নহীন সড়ক by পাভেল পার্থ

কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন টেকনাফ উপজেলার জাহাজপুরা সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য প্রায় ৩৬টি প্রবীণ গর্জনবৃক্ষের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এই গর্জন বন নিশ্চিহ্ন হতে পারে এই আশঙ্কায় বন বিভাগের শিলখালী রেঞ্জ নির্মাণ কাজ বন্ধ করার প্রস্তাব রাখে (প্রথম আলো, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)।


বন আইনের (১৯২৭) ২৬ নং ধারা অনুযায়ী বন বিপদাপন্ন হতে পারে এমন কিছু বনের ভেতর রেখে যাওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কক্সবাজার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর শিলখালী বনের গর্জনগাছ কেটে সড়ক নির্মাণের যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তা সরাসরি রাষ্ট্রের বিদ্যমান বন আইনকে লঙ্ঘন করছে। আমরা বুঝতে পারি না, কীভাবে রাষ্ট্রের কোনো একটি সরকারি কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ আইন লঙ্ঘন করে।
বাংলাদেশেই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আয়তনের একক ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত রাষ্ট্র এই বনভূমি এবং বনভূমির সঙ্গে জড়িত বনজীবী ও স্থানীয় বন বিভাগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। পাশাপাশি দেশের সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্ষারণ্য, হাওর ও বিল এলাকার জলাবন, মধুপুর-ভাওয়াল-দিনাজপুরের শালবনভূমি, সীমান্ত এলাকার বন ও গ্রামীণ বনের কোনো প্রতিবেশবান্ধব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি এখনো।
একটা সময় সিলেট-পার্বত্য চট্টগ্রাম, শালবনসহ দেশের সমুদ্র উপকূলীয় বনে গর্জন বৃক্ষের অবিস্মরণীয় বিস্তার ছিল। গর্জনকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের ভেতর দিয়ে আমাদের প্রাকৃতিক বনভূমিগুলো গর্জনশূন্য করা হয়েছে। শিলখালী, চুনাতিসহ সমুদ্র উপকূলীয় বনভূমিতেই দেশের প্রাকৃতিক গর্জনগাছগুলো টিকে আছে এখনো। প্রাকৃতিক বনের উচ্চসারির এই বৃক্ষ-প্রজাতি বনের বাস্তুসংস্থান এবং খাদ্যশৃঙ্খলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চিহ্নপ্রায় মধুপুর শালবনের দোখলা রেঞ্জে এখনো হাতেগোনা কয়েকটি প্রবীণ গর্জন বাঁচিয়ে রেখেছেন আদিবাসীরা।
শিলখালীর প্রবীণ ও পোয়াতি গর্জনবৈচিত্র্য বিপন্ন করে কোনোভাবেই সড়ক নির্মাণ করা ঠিক হবে না। সড়ক নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে, মাত্র ৩৬টি গর্জনগাছ কেটে ফেললে বনের না কি কোনো সমস্যা হবে না। জন-উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রতিবেশবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এই সিদ্ধান্ত ও মন্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এটিকে আমি কেবল উন্নয়ন ও পরিবেশের বিরাজমান বিতর্ক হিসেবেই পাঠ করছি না। এটি সর্বোতভাবে স্থানীয় প্রতিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের জটিল সম্পর্ককে অবমাননা ও মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার শামিল।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ জেলাপ্রশাসক সড়ক নির্মাণ শেষ না করা গেলে তা আবার জাপানকে ফেরত দিতে হবে বলে আক্ষেপ করেছেন। তাঁদের এই মনোজাগতিক অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। কারণ, নিজের বনভূমি এবং বাস্তুসংস্থান বিপন্ন করে কী দরকার উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণের? এটি কি সড়ক নির্মাণে সহায়তাদানকারী জাপান সরকারও মনে করে? কক্সবাজারের এই সড়ক নির্মাণের ঘটনাটি আমাদের এ বিষয়টি নিয়েও সরকারকে ভাববার দাবি জানাচ্ছে।
রাস্তা-সেতুসহ নানা উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণের আগেভাগেই সেটির প্রাথমিক পরিবেশগত প্রভাব যাচাই ও মূল্যায়ন করতে হয়। আমাদের জানার অধিকার আছে, কক্সবাজারের এ সড়ক নির্মাণের আগে এ ধরনের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে কি না। যদি হয়, সেই প্রতিবেদনে গর্জন বনের কী ধরনের পরিবেশগত সমস্যার কথা বলা হয়েছে। যদি হয় তাহলে এলজিইডি সেই প্রতিবেদন কীভাবে মূল্যায়ন ও বিবেচনা করছে। আর যদি তা না হয় তবে আমাদের প্রশ্ন—কেন এটি করা হয়নি? স্পর্শকাতর একটি বনভূমিকে বিপন্ন করে সড়ক নির্মাণ করা হবে আর তার আগেভাগে কোনো ধরনের প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যগত প্রভাবকে মূল্যায়ন করা হবে না তা কি কোনো সরকারি কর্মসূচির ক্ষেত্রে হওয়া উচিত?
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ)(সংশোধন) আদেশ ১৯৭৪-এর ১ নং অনুচ্ছেদের ধারাবলে জাতীয় উদ্যানের ভেতর কোনো বিস্ফোরক পোঁতা এবং গর্ত খোঁড়া বা খনন নিষিদ্ধ। আমরা জানি, এই আইন লঙ্ঘন করেই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর রেললাইন-সড়কপথ বহাল রয়েছে। বেশ কয়েকবার বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিকে খনন এবং জরিপের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনে শেল কোম্পানিকে তেল জরিপের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। মধুপুর সংরক্ষিত বনভূমিতে তৈরি হয়েছে বিমানবাহিনীর বোম্বিং ও ফায়ারিং রেঞ্জ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বন-পাহাড় নিশ্চিহ্ন করে তৈরি করা হয়েছে সামরিক স্থাপনা। কিন্তু আমরা আশা করব, এসব ঘটনাকে কোনোভাবেই এলজিইডি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা অন্য কেউ উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে কোনোভাবেই কক্সবাজারের গর্জন বন নিশ্চিহ্ন করে সড়কপথ নির্মাণ করার আবদার তুলবে না। কেবল বনভূমিকে অগ্রাহ্য করা নয়, হবিগঞ্জের সাতছড়ি সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে ঢাকা-সিলেট ব্যস্ততম সড়কপথ বদলিয়ে অন্যদিকে করা হয়েছিল, এমন নজিরও আছে।
পাশাপাশি গর্জন বন বাঁচাতে এলজিইডির নির্মাণাধীন সড়ক উন্নয়ন কর্মসূচির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বন বিভাগ সম্প্রতি প্রতিবেশবান্ধব যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা মনে করি বন বিভাগ সারাদেশে তার এই সাহসী ও দরদী পদক্ষেপ অব্যাহত রাখবে। আশা করি, সরকার দ্রুত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গর্জন বনকে কোনো রকমে বিপন্ন না করে অন্য কোনোভাবে অন্য কোনো পথে সড়ক নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করবে। কারণ, স্থানীয় গ্রামবাসীর জন্য এ সড়ক নির্মাণও একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি। এ দাবিটি সরকারকেই পূরণ করতে হবে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জনজীবনকে কোনোভাবেই বিপন্ন না করে।
জলবায়ু বিপর্যয়ের এই দুনিয়ায় যেখানে প্রাকৃতিক বনভূমি ও বৃক্ষ রক্ষার পক্ষে ব্যাপক গণমত তৈরি হচ্ছে, সরকারও যেখানে প্রাকৃতিক বনভূমি রক্ষায় জনবান্ধব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে গর্জনগাছ কেটে রাস্তা নির্মাণ করলে তা সরকারের ভূমিকা এবং দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক পরিসরে। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, বন বিভাগ, এলজিইডি, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, স্থানীয় জনগণ সবাই মিলেই সম্মিলিতভাবে গর্জনের এই মাতৃঅরণ্য বাঁচিয়ে অন্য কোনোভাবে রাস্তা নির্মাণ করে নিশ্চিত করবে স্থানীয় অধিবাসীদের গণদাবি।
পাভেল পার্থ: প্রাণ ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক।
animistbangla@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.