গণতন্ত্র-রাজনৈতিক সংসৃ্কতিতে পরিবর্তন কোন পথে? by বদিউল আলম মজুমদার

বহু দিন থেকেই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের কথা অনেকে বলে আসছেন। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজসচেতন সব নাগরিক, এমনকি সাধারণ জনগণকেও আমাদের বিরাজমান অসহিষ্ণু, দ্বন্দ্বাত্মক ও কলহপ্রবণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যায়।


এক-এগারোর প্রেক্ষাপট এবং পরবর্তী দুই বছরের দুঃখজনক ঘটনাবলীর কারণে এ অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এবং এই সংস্কৃতি পরিবর্তনের দাবি আরও জোরদার হয়েছে। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের ‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারেও ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা’র অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘একটি কার্যকর সংসদ, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, রাষ্ট্র ও সামাজিক সব শক্তির মধ্যে কার্যকর সমঝোতা’ প্রতিষ্ঠার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে জাতিকে আশ্বস্ত করেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমাদের সরকার হবে সকলের ... বিরোধী দলকে আমরা সংখ্যা দিয়ে বিচার করব না ... আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। হানাহানির রাজনীতি পরিহার করতে চাই। দেশে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি উপহার দিতে চাই।’ (প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি, ২০০৯)। তিনি প্রতিশোধের পরিবর্তে সবকিছু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার, সরকারে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার না করার, এমনকি বেগম খালেদা জিয়ার অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ সহযোগিতা নেওয়ার, বিরোধী দলকে ডিপুটি স্পিকারের পদ দেওয়ার এবং রাজি হলে বিরোধী দলকে মন্ত্রিত্ব দেওয়ার কথাও সংবাদ সম্মেলনে বলেন। উল্লেখ্য, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এমন আহ্বানের কথা শুনে নাগরিক হিসেবে সেদিন আমরা বড় গর্ব বোধ করেছিলাম এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ রাজনীতি সম্পর্কে দারুণ আশাবাদী হয়েছিলাম।
এটি সুস্পষ্ট যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ গুণগত পরিবর্তন মোটামুটিভাবে আমাদের একটি জাতীয় অঙ্গীকার। সাধারণ জনগণও মনে-প্রাণে তা চায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ পরস্পরকে আঘাত করার জন্য ‘লাশ নিয়ে রাজনীতি’র যে অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন, তা আমাদের দারুণভাবে স্তম্ভিত করেছে। আমরা মর্মাহত হয়েছি আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের আচরণ দেখে, যাঁরা গত দুই সপ্তাহে পরস্পরের প্রতি অশালীনতা প্রদর্শনের এক নগ্ন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন এবং নিজেদের উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছেন। এই প্রতিযোগিতা জাতীয় সংসদের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে জনসমক্ষে দারুণভাবে হেয় করছে। এর মাধ্যমে ‘সংসদ ও সাংসদদের বিশেষ অধিকার’ও চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। আমরা বিশেষভাবে ব্যথিত এই দেখে যে, আমাদের অতি শ্রদ্ধাভাজন মাননীয় স্পিকার এ ব্যাপারে কোনোরূপ ব্যবস্থা নিতে মনে হয় যেন অপারগ, যদিও সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী তাঁর অগাধ এমনকি বিশৃঙ্খল আচরণের জন্য সদস্যদের বহিষ্কারের ক্ষমতাও রয়েছে।
আমাদের দুই নেত্রীর পক্ষ থেকেও ঘৃণার রাজনীতি বন্ধ করার কোনো উদ্যোগই লক্ষ করা যাচ্ছে না। বরং মনে হয়, মাননীয় সংসদ সদস্যরা তাঁদের নেতৃদ্বয়কে খুশি করার জন্যই যেন এই অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। উপরন্তু আমাদের আশঙ্কা, সরকারের পক্ষ থেকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম বদলের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের পথে একটি পর্বতপ্রমাণ বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সরকার কি এর পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে ভেবে দেখেছে? এটা কারও অজানার কথা নয় যে শিক্ষা দেওয়া ও নেওয়ার প্রতিযোগিতার কোনো শেষ নেই। আর আগুন দিয়ে আগুন ঠেকাতে গেলে ছাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
আমরা মনে করি, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার জন্য অবশ্যই আমাদের রাজনীতিতে (১) সহিষ্ণুতা ও শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে রাজনীতিতে (২) অনৈতিকতার অবসান। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় (৩) নিয়মতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠাও পরিবর্তিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হওয়া উচিত। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য আরও প্রয়োজন স্লোগানের পরিবর্তে (৪) বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতির চর্চা।
আমাদের রাজনীতি আজ চরমভাবে রোগগ্রস্ত। কোনো রোগের চিকিত্সা করতে হলে যেমন প্রথমেই রোগের কারণ নির্ণয় করতে হয়, তেমনিভাবে রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা ও শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠা করতে হলেও এর পেছনের কারণ উদ্ঘাটন আবশ্যক। শুধু উপসর্গের চিকিত্সা করলে রোগের মূলোত্পাটন হবে না।
আমরা মনে করি, আমাদের রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতার অন্যতম কারণ হলো ‘উইনার-টেক-অল’ (winner-take-all) বা বিজয়ীদেরই সবকিছু করায়ত্ত করার বিরাজমান অপসংস্কৃতি। আমাদের দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাঁরা যান, তাঁরা রাতারাতি রাষ্ট্রের সবকিছুর ‘মালিক’ বনে যান। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে শুরু করে বাস টার্মিনাল পর্যন্ত সবকিছুই দখলে নিয়ে নেন। আর এগুলো অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা কর্মী-সমর্থক ও আপনজনদের মধ্যে ফায়দা হিসেবে বিতরণ করেন। এভাবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের ধারক-বাহক না হয়ে বহুলাংশে সিন্ডিকেটের রূপ ধারণ করে।
এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো, ‘রাষ্ট্র’, ‘সরকার’ ও ‘দলের’ মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন সম্পর্কে অজ্ঞতা। রাষ্ট্র একটি স্থায়ী সত্তা, যা গঠিত হয় একটি ভূখণ্ড, জনগোষ্ঠী, সরকার নিয়ে এবং জনগণের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার প্রয়োজন, কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো কিছুরই মালিকানা সরকারের নয় বরং সবকিছুর মালিকানা জনগণের। সরকার সব জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রীয় সম্পদের হেফাজতকারী মাত্র।
আর একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই দলের প্রয়োজন হয়। দলের সৃষ্টি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে সুনির্দিষ্ট আদর্শ বা কর্মসূচি বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ নিজেদের সমর্থকদের মধ্যে বিতরণ নয়। তাই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দলবাজি ও ফায়দাবাজির কোনো অবকাশ নেই। কারণ রাষ্ট্রের সব সম্পদের মালিক জনগণ এবং সরকারের দায়িত্ব ‘রাগ বা বিরাগের বশবর্তী’ না হয়ে দলমতনির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করা।
এ ছাড়া গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার কাঠামো (সংসদীয় কমিটি, আদালত, দুদক ইত্যাদির কার্যকারিতা) আমাদের দেশে দুর্বল বলে ক্ষমতাসীনেরা অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নে লিপ্ত হয়ে পার পেয়ে যান। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রে এক ধরনের লুটপাটের ইজারা প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়। রক্ষকেরা ভক্ষকে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আর বর্তমান ও সম্ভাব্য ইজারাদারদের মধ্যকার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিযোগিতা অনেক সময় প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে রূপ নিতে এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। গত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এমনি ধরনের ইজারাতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই ইজারা বংশপরম্পরায় টিকিয়ে রাখার জন্য ক্ষমতাসীনেরা সব ধরনের ম্যানিপুলেশনের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের জন্য পদ্ধতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই।
আমরা বিশ্বাস করি, গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার কাঠামো শক্তিশালী ও কার্যকর হলে লুটপাটের ইজারাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হবে এবং এ নিয়ে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনাও হ্রাস পাবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের জন্য অবশ্য আরও প্রয়োজন হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী বিরোধী দলকে সরকারের অংশ হিসেবে গণ্য করা এবং উইনার-টেক-অল ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটানো।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের জন্য একই সঙ্গে প্রয়োজন হবে নৈতিকতাভিত্তিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য রাজনীতিতে শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে দুর্নীতিবাজ-দুর্বৃত্তদের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিতাড়িত করা। রাজনীতিকে যাঁরা জনকল্যাণের পরিবর্তে ‘ব্যবসায়িক’ হাতিয়ারে পরিণত করেছেন, তাঁদের করাল গ্রাস থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করা। আরও প্রয়োজন হবে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সব ক্ষেত্রে নৈতিক আচরণ। সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং আদালতের নির্দেশ মেনে চলা তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, মানবাধিকার সংরক্ষণে অবিচল থাকা, ক্ষমতার অপব্যবহার না করা, কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি নৈতিক আচরণের বৈশিষ্ট্য। তাই রাজনীতিতে অনৈতিকতার অবসান ঘটলেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলের পথ সুগম হবে।
রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠাও রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য। রাজনীতি হলো সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া। সব মত ও পথের অনুসারীদের সঙ্গে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিংবা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানকল্পে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায়ই রাজনীতি। আনুষ্ঠানিক-আনুষ্ঠানিক বৈঠকের বাইরে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি পরিচালিত হয় জাতীয় সংসদের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এটি হলো সংবিধানসম্মত পদ্ধতি। আর জাতীয় সংসদে খোলামেলা বিতর্কের সময় সরকার ও বিরোধী দল ইচ্ছা করলে পরস্পরের প্রতি শালীন ও ভদ্রোচিত আচরণ করতে পারে।
নিয়মতান্ত্রিকতার পরিবর্তে সমস্যা ‘সমাধানের’ বিকল্প হলো রাজপথ—রাজপথের আন্দোলন। এটি সংবিধানবহির্ভূত পদ্ধতি। মিছিল, ধর্মঘট, হরতাল, অবরোধের মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডই সাধারণত রাজপথের আন্দোলনের হাতিয়ার। এ প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে এবং ধ্বংসাত্মক রূপ নিতে পারে। জ্বালাও-পোড়াও ও সহিংসতায় পরিণত হতে পারে। তাই যত দিন রাজপথ সমস্যা সমাধানের বিকল্প হিসেবে থাকবে, তত দিন আমাদের রাজনীতিতে সহনশীলতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠিত হবে না।
এ কথা সুস্পষ্ট যে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর করতে এবং জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন হবে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন। আর মানসিকতার পরিবর্তন হলেই আচরণ বদলাবে এবং আচরণ বদলালেই রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহযোগিতাভিত্তিক সংস্কৃতি সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হবে, ঘৃণাবোধের অবসান ঘটবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাজনীতিতে প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও ঘৃণাবোধের পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন যে চোখের বদলে চোখ নিলে সারা পৃথিবী অন্ধ হয়ে যায়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।

No comments

Powered by Blogger.