সহজিয়া কড়চা-বই ও বইমেলা: বাঙালির সৃষ্টিশীলতা ও জ্ঞানচর্চা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বইমেলা নামটি সার্থক। বাংলা একাডেমী চত্বরের মেলাটি বইয়েরই মেলা। তার সঙ্গে সাহিত্যের—বাংলা সাহিত্যের এবং বাঙালির মননের ও জ্ঞানজগতের সম্পর্কও আছে। ওই মেলায় বেত-বাঁশ ও মাটির তৈরি হস্তশিল্প অথবা ফ্রিজ-টিভি-প্রেশার কুকার প্রভৃতি কিংবা বস্ত্রশিল্প বিকিকিনি হয় না। বই বিক্রি হয়। সুতরাং তা বইয়েরই মেলা।
বইয়ের সংজ্ঞা কী? কিছু লেখা ছাপাখানায় কাগজে ছেপে পিচবোর্ড দিয়ে বাঁধাই করে মলাট পরানোর পর যে বস্তুতে পরিণত হয়, তার নাম বই। সব বইয়ের—অধিকাংশ বইয়ের—বিষয়বস্তু সাহিত্য নয়; সব সাহিত্যকর্মই রচিত হওয়ার পর একসময় বই আকারে প্রকাশিত হয়। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগে হাতে লিখে তৈরি হতো বই। প্লেটো, অ্যারিস্টটল, ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন, কৌটিল্য, ওমর খৈয়াম, বৈষ্ণব কবিদের পদাবলি পাঁচ শ বা এক হাজার কপি ছেপে সুদৃশ্য মলাটশোভিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি বই আকারে।
সাহিত্য অতি পুরোনো জিনিস, বইয়ের বয়স কম। শেক্সপিয়ারের নাটক ও সনেটগুলো রচিত হয়েছে আগে, বই হয়েছে বেশ পরে। বৈষ্ণব পদাবলি খাঁটি বাংলা সাহিত্য। বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, চণ্ডীদাসের পদাবলি রচিত হয়েছে আগে, রচয়িতারা বই প্রকাশের কথা চিন্তাও করেননি, কিন্তু তা সংকলিত হয়ে ‘বই’ আকারে বেরিয়েছে বহু পরে।
সাহিত্য—সৃষ্টিশীল রসের সাহিত্য অথবা জ্ঞানের সাহিত্য কী? মানবমনের সূক্ষ্ম আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ঘটে সৃষ্টিশীল বা রসের সাহিত্যে—কবিতায়-গল্পে-নাটকে-গানে। জ্ঞান ও গভীর চিন্তার প্রকাশ ঘটে মননশীল সাহিত্যে। জ্ঞানদাস জ্ঞানের কথা বলেন না, ভাবের কথা ও রসের কথা বলেন: ‘মেঘ যামিনি অতি ঘন আন্ধিয়ার/ ঐছে সময়ে ধনি কর অভিসার।’ অথবা বড়ু চণ্ডীদাস বলেন: ‘সজনি কি হেরিলুঁ যমুনার কূলে।/ ব্রজকুলনন্দন হরিল আমার মন/ ত্রিভঙ্গ দাঁড়াইঞা তরুমূলে।’ মধ্যযুগের সৈয়দ মোর্তজা মন্দ বলেননি: ‘ভুবন মোহন রূপ অতি মনোহর।/ ঝলমল করে রূপ দেখিতে সুন্দর।’ এগুলোর নাম কবিতা অর্থাত্ সাহিত্য।
জ্ঞানের কথা বা বিজ্ঞানবিষয়ক বইও সাহিত্য। ইবনে সিনার ‘কানুন’ মহাবিজ্ঞান সাহিত্য। ইবনে খালদুন নাগরিক সমাজের ধারণা নিয়ে লিখেছেন কোনো রকম গোলটেবিল না করেই। তাঁর ‘মুকাদ্দিমা’ সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মহাসাহিত্য। একালের ডি. ডি. কোশাম্বি বা রোমিলা থাপারের বইগুলোও উঁচুমানের ইতিহাস-সাহিত্য। কার্ল মার্ক্স ও অর্মত্য সেনের বই অর্থনীতি-সাহিত্য। বাতাসে ভেসে থাকা লালন সাঁইয়ের গানগুলো বইয়ে ধারণ করা হয়েছে। এখন তা অমূল্য মরমি ও মানবতাবাদী সাহিত্য। এ-জাতীয় বই যে মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রি হয়, তার নাম বইমেলা।
জ্ঞানের জগতের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। জীবন ও জগেকন্দ্রিক যেকোনো বিষয়ই জ্ঞানের বিষয়। উইলিয়াম মাস্টার্স এবং ভার্জিনিয়া জনসনের Human Sexual Response নর-নারীর যৌনতা বিষয়ে মহাগ্রন্থ অর্থাত্ যৌনবিজ্ঞানসাহিত্য। ছদ্মনামে লেখা একান্ত গোপন কথা বা বাসরঘরে নরনারীর করণীয় শীর্ষক বইকে জ্ঞানজগতের কোনো শ্রেণীতেই ফেলব না। ইসলামি ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বই হয় কিন্তু ‘দোয়া-তাবিজের ফজিলত’ যদি কোনো বইমেলায় বেচাকেনা হয় তখন হতবাক হতে হয়। আলালের ঘরের দুলাল অথবা হুতুম পেঁচার নকশা সাহিত্য, কিন্তু তোরে নিয়াই ঘর করব বা স্বামী সোহাগিনীর মনের কথার লেখককে তাঁর বই বিক্রি করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সাধ্য আমাদের নেই, কিন্তু জাতীয় বইমেলায় যখন ওসব বেচাকেনা হবে তখন আমাদের আপত্তি। তা ছাড়া বই মানেই নির্ভুল ও সুলিখিত বই—যা খুশি তা-ই নয়।
আমাদের বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের একুশে বইমেলা নিয়ে বড় বেশি কথা হয়। কথা বলেন লেখক, প্রকাশক, পাঠক, প্রচ্ছদশিল্পী; এবং যাঁরা বই কেনেনও না, পড়েনও না; মেলায় ঘুরে বেড়ান—সেই সব ভবঘুরেও। পত্রপত্রিকার একটি কোনা তাদের কথা বলার জন্য একটি মাস বরাদ্দ থাকে। টিভি চ্যানেলেও দেয় কিছুটা সময়। হেনরি জেমস বা জেমস জয়েস বা টমাস মান সারা জীবনে যত সাক্ষাত্কার দিয়েছেন, আমাদের লেখকেরা ফেব্রুয়ারি মাসে মেলা সম্পর্কে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি সাক্ষাত্কার দেন। পেঙ্গুইনের প্রতিষ্ঠাতা স্যার অ্যালেন লেন জীবনে কোনো সাক্ষাত্কার দেননি, আমাদের প্রকাশকেরা দেন ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিন। লেখককে রয়্যালটির টাকা দেওয়ার চেয়ে সাক্ষাত্কার দেওয়া সহজ।
বিখ্যাত লেখকেরাও বলছেন, এটা ‘প্রাণের মেলা’। ফ্র্যাঙ্কফুর্ট, তেহরান, বেইজিং, দিল্লি বা কলকাতার বইমেলা প্রাণহীন জড় পদার্থের মেলা নয়। বিনা পয়সায় ঢোকা যায় বলে দলবেঁধে মেলার মধ্যে যতক্ষণ খুশি ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে প্রাণের প্রকাশ কিছু থাকলেও থাকতে পারে, অলস সময় কাটানোর প্রবণতার প্রকাশই বেশি ঘটে।
কেউ কেউ বলছেন, বাংলা একাডেমীর বইমেলা একুশের ‘প্রত্যক্ষ ফসল’। কথাটার মধ্যে সামান্য সারবস্তু আছে—সম্পূর্ণ সত্য নেই। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে এই বইমেলার সম্পর্ক আছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। তা হলে তো ১৯৫৩-তেই বইমেলা শুরু হতো। প্রকাশকদের উদ্যোগে এবং বাংলা একাডেমীর পৃষ্ঠপোষকতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বইমেলা বিকশিত হয়েছে গত তিন দশকে।
আমার মনে পড়ে, ষাটের দশকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সরদার জয়েনউদ্দীনসহ আরও কারও চেষ্টায় ‘শিশু গ্রন্থমেলা’ ঢাকায় হয়েছে। বাংলাদেশে বইমেলার সূচনা কীভাবে হয়েছে, তা নানা ঝামেলায় থাকার ফলে আমাদের গুণীজনদের অনেকেই অবগত নন। তবে কারও কারও নিশ্চয়ই মনে আছে, ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ‘প্রগতি প্রকাশন’-এর বিপুল বই আমদানি করা হতো। তার মধ্যে অনেক মূল্যবান বই ছিল। রুহুল আমিন নিজামীর স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং ঝিনুক প্রকাশনী থেকে রবীন্দ্রনাথ ও শরত্চন্দ্রের বইয়ের সুলভ সংস্করণ বের হয়েছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের অবিক্রীত বই বেশি কমিশনে বিক্রির ধারণা থেকে ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারির সময় রাস্তায় চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু হয় ১৯৬৯-এ। ১৯৭২ থেকে শহীদ মিনারের আশপাশে এবং বাংলা একাডেমীর রাস্তার পাশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বই, মুক্তধারা এবং সম্ভবত তাজুল ইসলামের বর্ণমিছিল ও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের বই বিক্রি হতে থাকে।
আত্মপ্রসঙ্গে কথা বলা খুবই নিম্নরুচির পরিচায়ক। বাধ্য হয়ে কখনো তা করতে হয়। আজ থেকে নয় বছর আগে প্রথম আলোতে আমার এই উপসম্পাদকীয়র আস্ত একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম চিত্তরঞ্জন সাহা সম্পর্কে। তখন তিনি হাসপাতালে মরণাপন্ন। দীর্ঘ লেখাটি পড়ে দাদা আমার ছেলের, যাকে তিনি আপন ভাতিজার মতো ভালোবাসতেন, হাত ধরে কেঁদে দিয়েছিলেন। তাঁর একটি কথা মনে পড়ে। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার আর কোনো পুরস্কারের বা স্বীকৃতির দরকার নাই।’ তখন তাঁর নামটিও উচ্চারণ করতেন না কোনো লেখক ও তাঁর সহ-প্রকাশকেরা।
বইয়ের আড়ং আর জাতীয় বইমেলা এক জিনিস নয়। যাঁরা যুক্তিতে বিশ্বাস করেন তাঁরা জানেন, কোনো রকম একুশের চেতনা ছাড়াই বাংলা ভাষা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সময় থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত অগ্রগতি অর্জন করেছিল। ১৯৫২ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এর চেয়ে বেশি উন্নতি করেছে কি না, তা যে তিন হাজার ৩৫৪টি নতুন বই ২৮ দিনে বইমেলায় এসেছে, তার দেড় হাজার নতুন লেখক বলতে পারবেন। আমার মতো লেখকের শুধু মনে হচ্ছে, কোনো রকম ভাষা আন্দোলন ছাড়াই বঙ্কিমবাবু, রবিবাবু, শরত্বাবু ও কাজী সাহেবেরা কী করে লিখতে পারলেন?
বই প্রকাশ একটি ব্যবসা—একটি শিল্প। প্রকাশক এখানে পুঁজি খাটান। শখ করে খাটান না, মুনাফার জন্য টাকা খাটান। তিনি চাইবেন, যত দ্রুত সম্ভব টাকা তুলতে এবং লাভবান হতে। সে জন্য তাঁরা জনপ্রিয় লেখকদের বই প্রকাশে বেশি আগ্রহী হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। যে লেখকের বই বছরে ১২ কপি বিক্রি হয়, তাঁকে প্রকাশক বহু দূর থেকেই সালাম জানাবেন।
বারবারা কাটল্যান্ডের দু-তিনটি বই আমি পড়েছিলাম। হালকা ছলোছলো প্রেমের নভেল। ছয় শর মতো উপন্যাস লিখেছেন। প্রতি ১৪ দিনে একটি করে নভেল লিখতেন। একই ঢঙে লেখা। নব্বইয়ের দশকে শুনেছিলাম, তাঁর বই ৬০ কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে ই এম ফরস্টার, ভার্জিনিয়া উলফ, ডি এইচ লরেন্সের সঙ্গে তো নয়ই; রেবেকা ওয়েস্টের সঙ্গেও কার্টল্যান্ডের নাম উচ্চারিত হবে না।
নজরুল, শরত্চন্দ্র, রবিঠাকুর, বঙ্কিম চাটুজ্জেদের মতো কিছু লোক সামান্য লেখালেখি করে গেছেন বলে বাংলা সাহিত্যের একটা মান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের মানের লেখা হওয়া দরকার নেই, কিন্তু ন্যূনতম ভাষার শুদ্ধতাটা তো থাকবে। কিছু মানুষ একসঙ্গে তাঁদের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বইটি বের করতে গিয়ে জীবনীশক্তি অর্ধেক শেষ করেছেন। সঞ্চিত টাকাকড়ি শেষ করে ফতুর হয়েছেন তা-ই নয়, এমন ঋণে জড়িয়ে পড়েছেন, হয়তো অবশিষ্ট জীবনে তা পরিশোধ হবে না। যে প্রেসে বই ছেপেছেন তার ত্রিসীমানায় ইহজীবনে যাবেন না। অনেক বিত্তবান ও তাদের স্ত্রীদের কোনো পরোয়া নেই। দু-চার লাখ টাকা যায় তো যাক, বই তো মেলায় গেল। এক কপিও বিক্রি না হোক, সারা বছর যাকে পাবেন তাকেই উপহার দেবেন। নাম লিখে লিখবেন—অমুক ভাই বা আপা বা দুলাভাই শ্রদ্ধাস্পদেষু।
বাঙালি উঠতি মধ্যবিত্ত প্রথম চাইত ঢাকায় একটু মাথা গোঁজার মতো বাড়ি। তারপর ১০ বছর যাবত্ চাইছে একটি গাড়ি। কয়েক বছর যাবত্ চাইছে নিজের প্রকাশিত একটি বই। সে বইও প্রকাশ করতে হবে মেলার মধ্যে—অন্য সময় নয়। শুধু তা-ই নয়। নজরুলমঞ্চে বইটির মোড়ক উন্মোচিত না হলে প্রকাশই বৃথা। কোনো কোনো বইয়ের প্রকাশনা উত্সবে যে খরচ হয়, ওই পরিমাণ টাকা অদ্বৈত মল্লবর্মণকে বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিলে তাঁরা আরও তিন বছর বাঁচতেন। নজরুলের পরিবার পেলে ছয় মাস একটু ভালো খেতে পারতেন। লেখক হওয়ার তালিকায় এখন অন্তত দেড় কোটি মানুষ অপেক্ষমাণ। বই প্রকাশের যে বেগ শুরু হয়েছে, তা বাংলা একাডেমীর বুলন্দ দরোজায় কে রুধিবে দিয়ে বালির বাঁধ?
কম্পিউটার ও মুদ্রণপ্রযুক্তির অতি দ্রুত প্রসার ঘটায় এবং পত্রপত্রিকার আনুকূল্য পাওয়া বইমেলার মধ্যে এত বই প্রকাশিত হচ্ছে। শতকরা ৯০টি বইয়ের প্রচ্ছদ একই রকম রংচঙে। কারণ, কম্পিউটার। শিল্পী নন, কম্পিউটারই যা করার করছে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশের সৃষ্টিশীল ও চিন্তাশীল সাহিত্যের ভবিষ্যত্ অন্ধকার। সবই গেছে বিভিন্ন চেতনার ঠেলায়। চলচ্চিত্র গেছে। সংগীত গেছে। বাঙালির অহংকার করার মতো সাহিত্যটা ছিল। সেটাও এখন যায়।
মেলা উপলক্ষে হাবিজাবি প্রকাশ করায় ক্ষতিগ্রস্ত যে শুধু ওই লেখক-প্রকাশকেরা হচ্ছেন তা নয়, প্রধান লেখকদেরও সাংঘাতিক ক্ষতি হচ্ছে। তাঁদের দরকারি বই প্রকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কাগজ আমদানি করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে বিদেশ থেকে। কাগজের দুষ্প্রাপ্ততা দেখা দেয়। ছাপাখানা কাজ করে কূল পায় না। বাঁধাইখানার লোকদের মরণাপন্ন অবস্থা। ভালো বইটিই হয়তো ঠিক সময়ই বেরোতে পারে না। ক্লাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে না।
প্রতিবছর আমাদের নতুন লেখকও দরকার। এখনকার বিখ্যাত ব্যক্তিরা একদিন নতুন ছিলেন। এবারও মেলার মধ্যে প্রকাশিত নতুনদের শ-খানেক বই যথেষ্ট উন্নত মানের লেখা। কিছু আমি নাড়াচাড়া করে দেখেছি। খুবই সম্ভাবনাময় তাঁরা। আনুকূল্য পেলে তাঁরা ভবিষ্যতে ভালো করবেন। কিন্তু আবর্জনার ভিড়ে একসময় হয়তো তাঁরা হারিয়ে যাবেন।
আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন রবীন্দ্রনাথের চৈতালীর অনুকরণে একটি কবিতার বই ছাপতে গিয়েছিলাম। আমার বাবার ষড়যন্ত্রে সে পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভক্ত। ‘বাঙ্গালা নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ শীর্ষক বঙ্কিমচন্দ্রের একটি ১২-দফা ফতোয়া আছে। আমার বাবা সেটি আমার পড়ার টেবিলের সামনে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। বঙ্কিমবাবুর বিরক্তিকর দফাগুলোর মধ্যে ছিল: ১. যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে। ২. টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে, এবং টাকাও পায়, লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সেদিন হয় নাই। ৩. যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন।
চাটুজ্জে সবচেয়ে সর্বনাশা নসিহতটি করেছিলেন পাঁচ নম্বর দফায়। তাঁর ভাষায়: ‘যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাত্ ছাপাইবেন না। কিছুকাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছুকাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য নাটক উপন্যাস দুই এক বত্সর ফেলিয়া রাখিয়া তার পর সংশোধন করিলে বিশেষ উত্কর্ষ লাভ করে।’ এখন যদি তিনি এই কথা নজরুলমঞ্চের গাছতলায় দাঁড়িয়ে বলতেন, স্লোগান উঠত: চাটুজ্জের চামড়া—।
একুশ সামনে রেখে হয় বলে আমরা বলি একুশে বইমেলা, আসলে এটা জাতীয় বইমেলা। সুতরাং এখানে সেই সব বই-ই প্রদর্শিত ও বেচাকেনা হবে, যাতে জাতির চৈতন্যের প্রকাশ ঘটে। আমাদের সৃষ্টিশীল প্রকাশনা সংস্থা ৬৫টি, কিন্তু পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সদস্য ১২ থেকে ১৪ হাজার। এবার ৫০৬ জন প্রকাশক ও প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। স্টলের ইউনিট ছিল ৫২২টি। ‘প্রথমা প্রকাশন’ যে স্টলটি বরাদ্দ পায় তার পরিসর একটি পান দোকানের চেয়ে ছোট। একাডেমী প্রাঙ্গণে জায়গা কম। অসৃজনশীল প্রকাশকেরা ঢুকে পড়লে জায়গাসংকট হবেই। অসুবিধা হবে পাঠক-ক্রেতার, ক্ষতি হবে লেখক ও প্রকাশকের।
মেলা শেষ হওয়ার আগের দিন আমাদের কয়েকজন লেখক ও সৃজনশীল প্রকাশককে ডেকেছিলেন একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। তিনি আমাদের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন ও দুপুরে খাওয়ালেন। বইমেলার সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হলো। আমরা বলেছি, মেলা একাডেমী প্রাঙ্গণেই হোক, প্রয়োজনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও কিছুটা বিস্তৃত করা যেতে পারে। কিন্তু বইমেলাটি হবে সৃজনশীল প্রকাশকদের, অন্য বই প্রকাশক ও বিক্রেতাদের ভিড়ে যেন মেলার পরিবেশ নষ্ট না হয়।
একুশের চেতনাও আমরা বইমেলায় প্রতিফলিত দেখতে চাই। কী সেই চেতনা? সে চেতনা হলো আপসহীন জাতীয়তাবোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা, স্বাধীন চিন্তার বিকাশ এবং সরকারি স্বেচ্ছাচারিতার কাছে আত্মসমর্পণ না করা। ১৯৫১-তে পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষার যে অবস্থা ছিল আজ তার দশা আরও খারাপ। বিজাতীয় দুশমনদের আমরা পরাভূত করেছি, আজ বাংলা ভাষার শত্রু বাঙালি স্বয়ং। যদি উন্নত মানের সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক গবেষণার অভিসন্দর্ভ, দার্শনিক তত্ত্বমূলক গ্রন্থ, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতিবিষয়ক বই যথেষ্ট প্রকাশিত না হয়, তাহলে খুব সুশৃঙ্খল একটি বইমেলা করেও জাতির কোনো উপকার হবে না। প্রতি ফেব্রুয়ারিতে হাজার হাজার বই প্রকাশিত হবে, বইমেলায় ক্রমাগত ভিড় বাড়বে, জনগণ কোনো রকমে টিকে থাকবে, কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা হয়ে যাব বিনষ্ট।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সাহিত্য অতি পুরোনো জিনিস, বইয়ের বয়স কম। শেক্সপিয়ারের নাটক ও সনেটগুলো রচিত হয়েছে আগে, বই হয়েছে বেশ পরে। বৈষ্ণব পদাবলি খাঁটি বাংলা সাহিত্য। বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, চণ্ডীদাসের পদাবলি রচিত হয়েছে আগে, রচয়িতারা বই প্রকাশের কথা চিন্তাও করেননি, কিন্তু তা সংকলিত হয়ে ‘বই’ আকারে বেরিয়েছে বহু পরে।
সাহিত্য—সৃষ্টিশীল রসের সাহিত্য অথবা জ্ঞানের সাহিত্য কী? মানবমনের সূক্ষ্ম আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ঘটে সৃষ্টিশীল বা রসের সাহিত্যে—কবিতায়-গল্পে-নাটকে-গানে। জ্ঞান ও গভীর চিন্তার প্রকাশ ঘটে মননশীল সাহিত্যে। জ্ঞানদাস জ্ঞানের কথা বলেন না, ভাবের কথা ও রসের কথা বলেন: ‘মেঘ যামিনি অতি ঘন আন্ধিয়ার/ ঐছে সময়ে ধনি কর অভিসার।’ অথবা বড়ু চণ্ডীদাস বলেন: ‘সজনি কি হেরিলুঁ যমুনার কূলে।/ ব্রজকুলনন্দন হরিল আমার মন/ ত্রিভঙ্গ দাঁড়াইঞা তরুমূলে।’ মধ্যযুগের সৈয়দ মোর্তজা মন্দ বলেননি: ‘ভুবন মোহন রূপ অতি মনোহর।/ ঝলমল করে রূপ দেখিতে সুন্দর।’ এগুলোর নাম কবিতা অর্থাত্ সাহিত্য।
জ্ঞানের কথা বা বিজ্ঞানবিষয়ক বইও সাহিত্য। ইবনে সিনার ‘কানুন’ মহাবিজ্ঞান সাহিত্য। ইবনে খালদুন নাগরিক সমাজের ধারণা নিয়ে লিখেছেন কোনো রকম গোলটেবিল না করেই। তাঁর ‘মুকাদ্দিমা’ সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মহাসাহিত্য। একালের ডি. ডি. কোশাম্বি বা রোমিলা থাপারের বইগুলোও উঁচুমানের ইতিহাস-সাহিত্য। কার্ল মার্ক্স ও অর্মত্য সেনের বই অর্থনীতি-সাহিত্য। বাতাসে ভেসে থাকা লালন সাঁইয়ের গানগুলো বইয়ে ধারণ করা হয়েছে। এখন তা অমূল্য মরমি ও মানবতাবাদী সাহিত্য। এ-জাতীয় বই যে মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রি হয়, তার নাম বইমেলা।
জ্ঞানের জগতের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। জীবন ও জগেকন্দ্রিক যেকোনো বিষয়ই জ্ঞানের বিষয়। উইলিয়াম মাস্টার্স এবং ভার্জিনিয়া জনসনের Human Sexual Response নর-নারীর যৌনতা বিষয়ে মহাগ্রন্থ অর্থাত্ যৌনবিজ্ঞানসাহিত্য। ছদ্মনামে লেখা একান্ত গোপন কথা বা বাসরঘরে নরনারীর করণীয় শীর্ষক বইকে জ্ঞানজগতের কোনো শ্রেণীতেই ফেলব না। ইসলামি ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বই হয় কিন্তু ‘দোয়া-তাবিজের ফজিলত’ যদি কোনো বইমেলায় বেচাকেনা হয় তখন হতবাক হতে হয়। আলালের ঘরের দুলাল অথবা হুতুম পেঁচার নকশা সাহিত্য, কিন্তু তোরে নিয়াই ঘর করব বা স্বামী সোহাগিনীর মনের কথার লেখককে তাঁর বই বিক্রি করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সাধ্য আমাদের নেই, কিন্তু জাতীয় বইমেলায় যখন ওসব বেচাকেনা হবে তখন আমাদের আপত্তি। তা ছাড়া বই মানেই নির্ভুল ও সুলিখিত বই—যা খুশি তা-ই নয়।
আমাদের বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের একুশে বইমেলা নিয়ে বড় বেশি কথা হয়। কথা বলেন লেখক, প্রকাশক, পাঠক, প্রচ্ছদশিল্পী; এবং যাঁরা বই কেনেনও না, পড়েনও না; মেলায় ঘুরে বেড়ান—সেই সব ভবঘুরেও। পত্রপত্রিকার একটি কোনা তাদের কথা বলার জন্য একটি মাস বরাদ্দ থাকে। টিভি চ্যানেলেও দেয় কিছুটা সময়। হেনরি জেমস বা জেমস জয়েস বা টমাস মান সারা জীবনে যত সাক্ষাত্কার দিয়েছেন, আমাদের লেখকেরা ফেব্রুয়ারি মাসে মেলা সম্পর্কে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি সাক্ষাত্কার দেন। পেঙ্গুইনের প্রতিষ্ঠাতা স্যার অ্যালেন লেন জীবনে কোনো সাক্ষাত্কার দেননি, আমাদের প্রকাশকেরা দেন ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিন। লেখককে রয়্যালটির টাকা দেওয়ার চেয়ে সাক্ষাত্কার দেওয়া সহজ।
বিখ্যাত লেখকেরাও বলছেন, এটা ‘প্রাণের মেলা’। ফ্র্যাঙ্কফুর্ট, তেহরান, বেইজিং, দিল্লি বা কলকাতার বইমেলা প্রাণহীন জড় পদার্থের মেলা নয়। বিনা পয়সায় ঢোকা যায় বলে দলবেঁধে মেলার মধ্যে যতক্ষণ খুশি ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে প্রাণের প্রকাশ কিছু থাকলেও থাকতে পারে, অলস সময় কাটানোর প্রবণতার প্রকাশই বেশি ঘটে।
কেউ কেউ বলছেন, বাংলা একাডেমীর বইমেলা একুশের ‘প্রত্যক্ষ ফসল’। কথাটার মধ্যে সামান্য সারবস্তু আছে—সম্পূর্ণ সত্য নেই। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে এই বইমেলার সম্পর্ক আছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। তা হলে তো ১৯৫৩-তেই বইমেলা শুরু হতো। প্রকাশকদের উদ্যোগে এবং বাংলা একাডেমীর পৃষ্ঠপোষকতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বইমেলা বিকশিত হয়েছে গত তিন দশকে।
আমার মনে পড়ে, ষাটের দশকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সরদার জয়েনউদ্দীনসহ আরও কারও চেষ্টায় ‘শিশু গ্রন্থমেলা’ ঢাকায় হয়েছে। বাংলাদেশে বইমেলার সূচনা কীভাবে হয়েছে, তা নানা ঝামেলায় থাকার ফলে আমাদের গুণীজনদের অনেকেই অবগত নন। তবে কারও কারও নিশ্চয়ই মনে আছে, ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ‘প্রগতি প্রকাশন’-এর বিপুল বই আমদানি করা হতো। তার মধ্যে অনেক মূল্যবান বই ছিল। রুহুল আমিন নিজামীর স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং ঝিনুক প্রকাশনী থেকে রবীন্দ্রনাথ ও শরত্চন্দ্রের বইয়ের সুলভ সংস্করণ বের হয়েছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের অবিক্রীত বই বেশি কমিশনে বিক্রির ধারণা থেকে ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারির সময় রাস্তায় চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু হয় ১৯৬৯-এ। ১৯৭২ থেকে শহীদ মিনারের আশপাশে এবং বাংলা একাডেমীর রাস্তার পাশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বই, মুক্তধারা এবং সম্ভবত তাজুল ইসলামের বর্ণমিছিল ও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের বই বিক্রি হতে থাকে।
আত্মপ্রসঙ্গে কথা বলা খুবই নিম্নরুচির পরিচায়ক। বাধ্য হয়ে কখনো তা করতে হয়। আজ থেকে নয় বছর আগে প্রথম আলোতে আমার এই উপসম্পাদকীয়র আস্ত একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম চিত্তরঞ্জন সাহা সম্পর্কে। তখন তিনি হাসপাতালে মরণাপন্ন। দীর্ঘ লেখাটি পড়ে দাদা আমার ছেলের, যাকে তিনি আপন ভাতিজার মতো ভালোবাসতেন, হাত ধরে কেঁদে দিয়েছিলেন। তাঁর একটি কথা মনে পড়ে। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার আর কোনো পুরস্কারের বা স্বীকৃতির দরকার নাই।’ তখন তাঁর নামটিও উচ্চারণ করতেন না কোনো লেখক ও তাঁর সহ-প্রকাশকেরা।
বইয়ের আড়ং আর জাতীয় বইমেলা এক জিনিস নয়। যাঁরা যুক্তিতে বিশ্বাস করেন তাঁরা জানেন, কোনো রকম একুশের চেতনা ছাড়াই বাংলা ভাষা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সময় থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত অগ্রগতি অর্জন করেছিল। ১৯৫২ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এর চেয়ে বেশি উন্নতি করেছে কি না, তা যে তিন হাজার ৩৫৪টি নতুন বই ২৮ দিনে বইমেলায় এসেছে, তার দেড় হাজার নতুন লেখক বলতে পারবেন। আমার মতো লেখকের শুধু মনে হচ্ছে, কোনো রকম ভাষা আন্দোলন ছাড়াই বঙ্কিমবাবু, রবিবাবু, শরত্বাবু ও কাজী সাহেবেরা কী করে লিখতে পারলেন?
বই প্রকাশ একটি ব্যবসা—একটি শিল্প। প্রকাশক এখানে পুঁজি খাটান। শখ করে খাটান না, মুনাফার জন্য টাকা খাটান। তিনি চাইবেন, যত দ্রুত সম্ভব টাকা তুলতে এবং লাভবান হতে। সে জন্য তাঁরা জনপ্রিয় লেখকদের বই প্রকাশে বেশি আগ্রহী হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। যে লেখকের বই বছরে ১২ কপি বিক্রি হয়, তাঁকে প্রকাশক বহু দূর থেকেই সালাম জানাবেন।
বারবারা কাটল্যান্ডের দু-তিনটি বই আমি পড়েছিলাম। হালকা ছলোছলো প্রেমের নভেল। ছয় শর মতো উপন্যাস লিখেছেন। প্রতি ১৪ দিনে একটি করে নভেল লিখতেন। একই ঢঙে লেখা। নব্বইয়ের দশকে শুনেছিলাম, তাঁর বই ৬০ কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে ই এম ফরস্টার, ভার্জিনিয়া উলফ, ডি এইচ লরেন্সের সঙ্গে তো নয়ই; রেবেকা ওয়েস্টের সঙ্গেও কার্টল্যান্ডের নাম উচ্চারিত হবে না।
নজরুল, শরত্চন্দ্র, রবিঠাকুর, বঙ্কিম চাটুজ্জেদের মতো কিছু লোক সামান্য লেখালেখি করে গেছেন বলে বাংলা সাহিত্যের একটা মান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের মানের লেখা হওয়া দরকার নেই, কিন্তু ন্যূনতম ভাষার শুদ্ধতাটা তো থাকবে। কিছু মানুষ একসঙ্গে তাঁদের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বইটি বের করতে গিয়ে জীবনীশক্তি অর্ধেক শেষ করেছেন। সঞ্চিত টাকাকড়ি শেষ করে ফতুর হয়েছেন তা-ই নয়, এমন ঋণে জড়িয়ে পড়েছেন, হয়তো অবশিষ্ট জীবনে তা পরিশোধ হবে না। যে প্রেসে বই ছেপেছেন তার ত্রিসীমানায় ইহজীবনে যাবেন না। অনেক বিত্তবান ও তাদের স্ত্রীদের কোনো পরোয়া নেই। দু-চার লাখ টাকা যায় তো যাক, বই তো মেলায় গেল। এক কপিও বিক্রি না হোক, সারা বছর যাকে পাবেন তাকেই উপহার দেবেন। নাম লিখে লিখবেন—অমুক ভাই বা আপা বা দুলাভাই শ্রদ্ধাস্পদেষু।
বাঙালি উঠতি মধ্যবিত্ত প্রথম চাইত ঢাকায় একটু মাথা গোঁজার মতো বাড়ি। তারপর ১০ বছর যাবত্ চাইছে একটি গাড়ি। কয়েক বছর যাবত্ চাইছে নিজের প্রকাশিত একটি বই। সে বইও প্রকাশ করতে হবে মেলার মধ্যে—অন্য সময় নয়। শুধু তা-ই নয়। নজরুলমঞ্চে বইটির মোড়ক উন্মোচিত না হলে প্রকাশই বৃথা। কোনো কোনো বইয়ের প্রকাশনা উত্সবে যে খরচ হয়, ওই পরিমাণ টাকা অদ্বৈত মল্লবর্মণকে বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিলে তাঁরা আরও তিন বছর বাঁচতেন। নজরুলের পরিবার পেলে ছয় মাস একটু ভালো খেতে পারতেন। লেখক হওয়ার তালিকায় এখন অন্তত দেড় কোটি মানুষ অপেক্ষমাণ। বই প্রকাশের যে বেগ শুরু হয়েছে, তা বাংলা একাডেমীর বুলন্দ দরোজায় কে রুধিবে দিয়ে বালির বাঁধ?
কম্পিউটার ও মুদ্রণপ্রযুক্তির অতি দ্রুত প্রসার ঘটায় এবং পত্রপত্রিকার আনুকূল্য পাওয়া বইমেলার মধ্যে এত বই প্রকাশিত হচ্ছে। শতকরা ৯০টি বইয়ের প্রচ্ছদ একই রকম রংচঙে। কারণ, কম্পিউটার। শিল্পী নন, কম্পিউটারই যা করার করছে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশের সৃষ্টিশীল ও চিন্তাশীল সাহিত্যের ভবিষ্যত্ অন্ধকার। সবই গেছে বিভিন্ন চেতনার ঠেলায়। চলচ্চিত্র গেছে। সংগীত গেছে। বাঙালির অহংকার করার মতো সাহিত্যটা ছিল। সেটাও এখন যায়।
মেলা উপলক্ষে হাবিজাবি প্রকাশ করায় ক্ষতিগ্রস্ত যে শুধু ওই লেখক-প্রকাশকেরা হচ্ছেন তা নয়, প্রধান লেখকদেরও সাংঘাতিক ক্ষতি হচ্ছে। তাঁদের দরকারি বই প্রকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কাগজ আমদানি করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে বিদেশ থেকে। কাগজের দুষ্প্রাপ্ততা দেখা দেয়। ছাপাখানা কাজ করে কূল পায় না। বাঁধাইখানার লোকদের মরণাপন্ন অবস্থা। ভালো বইটিই হয়তো ঠিক সময়ই বেরোতে পারে না। ক্লাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে না।
প্রতিবছর আমাদের নতুন লেখকও দরকার। এখনকার বিখ্যাত ব্যক্তিরা একদিন নতুন ছিলেন। এবারও মেলার মধ্যে প্রকাশিত নতুনদের শ-খানেক বই যথেষ্ট উন্নত মানের লেখা। কিছু আমি নাড়াচাড়া করে দেখেছি। খুবই সম্ভাবনাময় তাঁরা। আনুকূল্য পেলে তাঁরা ভবিষ্যতে ভালো করবেন। কিন্তু আবর্জনার ভিড়ে একসময় হয়তো তাঁরা হারিয়ে যাবেন।
আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন রবীন্দ্রনাথের চৈতালীর অনুকরণে একটি কবিতার বই ছাপতে গিয়েছিলাম। আমার বাবার ষড়যন্ত্রে সে পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভক্ত। ‘বাঙ্গালা নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ শীর্ষক বঙ্কিমচন্দ্রের একটি ১২-দফা ফতোয়া আছে। আমার বাবা সেটি আমার পড়ার টেবিলের সামনে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। বঙ্কিমবাবুর বিরক্তিকর দফাগুলোর মধ্যে ছিল: ১. যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে। ২. টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে, এবং টাকাও পায়, লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সেদিন হয় নাই। ৩. যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন।
চাটুজ্জে সবচেয়ে সর্বনাশা নসিহতটি করেছিলেন পাঁচ নম্বর দফায়। তাঁর ভাষায়: ‘যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাত্ ছাপাইবেন না। কিছুকাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছুকাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য নাটক উপন্যাস দুই এক বত্সর ফেলিয়া রাখিয়া তার পর সংশোধন করিলে বিশেষ উত্কর্ষ লাভ করে।’ এখন যদি তিনি এই কথা নজরুলমঞ্চের গাছতলায় দাঁড়িয়ে বলতেন, স্লোগান উঠত: চাটুজ্জের চামড়া—।
একুশ সামনে রেখে হয় বলে আমরা বলি একুশে বইমেলা, আসলে এটা জাতীয় বইমেলা। সুতরাং এখানে সেই সব বই-ই প্রদর্শিত ও বেচাকেনা হবে, যাতে জাতির চৈতন্যের প্রকাশ ঘটে। আমাদের সৃষ্টিশীল প্রকাশনা সংস্থা ৬৫টি, কিন্তু পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সদস্য ১২ থেকে ১৪ হাজার। এবার ৫০৬ জন প্রকাশক ও প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। স্টলের ইউনিট ছিল ৫২২টি। ‘প্রথমা প্রকাশন’ যে স্টলটি বরাদ্দ পায় তার পরিসর একটি পান দোকানের চেয়ে ছোট। একাডেমী প্রাঙ্গণে জায়গা কম। অসৃজনশীল প্রকাশকেরা ঢুকে পড়লে জায়গাসংকট হবেই। অসুবিধা হবে পাঠক-ক্রেতার, ক্ষতি হবে লেখক ও প্রকাশকের।
মেলা শেষ হওয়ার আগের দিন আমাদের কয়েকজন লেখক ও সৃজনশীল প্রকাশককে ডেকেছিলেন একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। তিনি আমাদের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন ও দুপুরে খাওয়ালেন। বইমেলার সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হলো। আমরা বলেছি, মেলা একাডেমী প্রাঙ্গণেই হোক, প্রয়োজনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও কিছুটা বিস্তৃত করা যেতে পারে। কিন্তু বইমেলাটি হবে সৃজনশীল প্রকাশকদের, অন্য বই প্রকাশক ও বিক্রেতাদের ভিড়ে যেন মেলার পরিবেশ নষ্ট না হয়।
একুশের চেতনাও আমরা বইমেলায় প্রতিফলিত দেখতে চাই। কী সেই চেতনা? সে চেতনা হলো আপসহীন জাতীয়তাবোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা, স্বাধীন চিন্তার বিকাশ এবং সরকারি স্বেচ্ছাচারিতার কাছে আত্মসমর্পণ না করা। ১৯৫১-তে পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষার যে অবস্থা ছিল আজ তার দশা আরও খারাপ। বিজাতীয় দুশমনদের আমরা পরাভূত করেছি, আজ বাংলা ভাষার শত্রু বাঙালি স্বয়ং। যদি উন্নত মানের সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক গবেষণার অভিসন্দর্ভ, দার্শনিক তত্ত্বমূলক গ্রন্থ, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতিবিষয়ক বই যথেষ্ট প্রকাশিত না হয়, তাহলে খুব সুশৃঙ্খল একটি বইমেলা করেও জাতির কোনো উপকার হবে না। প্রতি ফেব্রুয়ারিতে হাজার হাজার বই প্রকাশিত হবে, বইমেলায় ক্রমাগত ভিড় বাড়বে, জনগণ কোনো রকমে টিকে থাকবে, কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা হয়ে যাব বিনষ্ট।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments