রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগে আশার আলো

মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে অবস্থানরত ওই দেশের কয়েক লাখ নাগরিককে (রোহিঙ্গা) ফেরত পাঠানোর বিষয়টিতে আশার আলো দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এ ব্যাপারে উৎসাহ দেখানোর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা দীর্ঘদিনের এই সমস্যা সমাধানের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।


সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও ইইউ প্রতিনিধিদলের প্রধান রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হানা তাঁদের বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশি কূটনীতিক ও শরণার্থী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে আশা প্রকাশ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো মিয়ানমারের কাছে বিষয়টি জোর দিয়ে উপস্থাপন করবে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত মিয়ানমারের কয়েক লাখ নাগরিক ও প্রায় ২৯ হাজার শরণার্থীকে মানবিক সহায়তা দেওয়ার পক্ষে। সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশই রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিচ্ছে। অবৈধভাবে এ দেশে বছরের পর বছর অবস্থান করলেও তারা এখানে অনেকটা অবাধ বিচরণের সুযোগ পাচ্ছে, যার নজির বিশ্বে তেমন একটা নেই।
সূত্র আরো জানায়, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ কোনো নিবর্তনমূলক নীতি গ্রহণ করেনি। এর পরও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দৃশ্যত মিয়ানমারের ওপর যতটা চাপ, তার চেয়েও বেশি যেন বাংলাদেশের ওপর। পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারী মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অবস্থার ব্যাপারে বিভিন্ন সময় উদ্বেগ জানিয়েছে। অথচ তাদেরকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে এতটুকু উদ্যোগও তারা নেয়নি।
গত জুন মাসে বাংলাদেশ সফরকালে জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসনবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরিক পি শোয়ার্জ বলেছিলেন, 'বার্মায় (মিয়ানমার) পরিবর্তন আসার আগে এ দেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত দেশটির জনগণকে ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না।' তবে শনিবার ঢাকায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে হিলারি ক্লিনটন বলেন, 'বার্মায় (মিয়ানমার) চলমান সংস্কার দেখে আমরা আনন্দিত। এ সংস্কার প্রথমত ওই দেশের জনগণের জন্য বিশাল সুযোগ আনবে। পাশাপাশি প্রতিবেশী বাংলাদেশও লাভবান হবে।' তিনি আরো বলেন, 'আমরা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে অবস্থানরত হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ঘিরে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেছি। বার্মায় (মিয়ানমার) সংস্কার শুরুর পর আমরা এখন এ সমস্যার সমাধান খোঁজা শুরু করতে পারি।'
এদিকে গতকাল বুধবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমারের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহারের ব্যাপারে ইইউ রোহিঙ্গা ইস্যুটি যোগ করবে কি না জানতে চাইলে উইলিয়াম হানা বলেন, 'মিয়ানমারে এ বছর যা হচ্ছে তাতে আমরা সবাই উৎসাহ বোধ করছি। ইইউভুক্ত অনেক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সেখানে গেছেন, যা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। ইইউ মিয়ানমারে প্রতিনিধি পাঠাতে যাচ্ছে। এতে করে ভবিষ্যতে মিয়ানমারের সঙ্গে ইইউর সহযোগিতা আরো জোরদার হবে।'
উইলিয়াম হানা বলেন, 'রোহিঙ্গারা কেবল বাংলাদেশের নয়, এটি আরো অনেক বড় পরিসরের সমস্যা। আমি মনে করি, বৃহৎ পরিসরে সব দেশ মিলে এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে হবে। জাতিসংঘও শরণার্থী ইস্যুকে বিশ্বের অন্যতম বড় সমস্যা হিসেবে দেখে।'
রাষ্ট্রদূত হানা আরো বলেন, 'রোহিঙ্গাদেরকে অবশ্যই স্বদেশে ফিরে যেতে আগ্রহী হতে হবে। তবে তার আগে সেখানে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হতে হবে এবং তাদের নিরাপদ বোধ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সময়ে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ইইউ কাজ করে যাবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে আমরা অবগত। মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় অবশ্যই এটিসহ আরো অনেক সমস্যার বিষয় রয়েছে।'
হিলারি ও হানার ওই বক্তব্যের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গতকাল ঢাকায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, 'তাদের বক্তব্য ইতিবাচক। এটা স্পষ্ট যে, মিয়ানমারের কয়েক লাখ নাগরিকের জন্য বাংলাদেশকে প্রতিবছর বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ তার জায়গায় মিয়ানমারের ওই নাগরিকদের থাকতে দিয়েছে। আমাদের দেশের অনেক সমস্যা আছে। মিয়ানমারের কয়েক লাখ নাগরিকের বোঝা এ দেশের জন্য অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর দিক থেকে যেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তেমনি বাংলাদেশেরও এ ব্যাপারে জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নয়ন সহযোগী বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকেও এ ব্যাপারে কাজে লাগানো উচিত।
শরণার্থী, প্রত্যাবাসন ও ত্রাণ কমিশনের (আরআরসি) অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ সালাহউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'রোহিঙ্গা ইস্যুটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ওপর বোঝা হয়ে আছে। কোনোভাবেই এর সমাধান বের হয়ে আসছে না। মিয়ানমারের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উন্নয়ন সহযোগীদের কাজে লাগিয়ে এ সমস্যার সমাধান পেলে তা হবে বড় প্রাপ্তি। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করছে। দেশ-বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তিও নষ্ট করছে। তাদেরকে ফেরত পাঠাতে পারলে আমরা বেঁচে যাই।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ঢাকায় ইইউ প্রতিনিধিদলের প্রধানের বক্তব্য অত্যন্ত ইতিবাচক। মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিবর্তন স্থায়ী হলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ মিয়ানমারকে কতটা চাপ দিতে পারে তাও গুরুত্বপূর্ণ।'

No comments

Powered by Blogger.