অর্থনীতি-বিদেশি ঋণের কি আদৌ দরকার আছে? by আবু আহমেদ
আসলে বাংলাদেশ তো ভালো গ্রাহক পেলে নিজেই ঋণ দিতে পারে, তাহলে বিদেশ থেকে কখনো বাণিজ্যিক হারে, কখনো উঁচু সুদে ও শর্তে ঋণ কিনছে কেন? সেই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর, সরকারের হয়ে যাঁরা বিদেশি উত্স থেকে ঋণ কিনছেন, তাঁরা কখনো দেননি।
তবে এতটুকু বুঝি যে সরকারের বিরাট বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য স্বদেশ-বিদেশ থেকে ঋণ করা জরুরি। আমাদের কিছু লোক বলেই চলেছেন আজও অর্থায়নের দিক দিয়ে বাংলাদেশ স্বনির্ভর হয়নি, তাঁদের এ কথা শুনলে মনে হবে বাংলাদেশ কখনো স্বনির্ভর হবে না। ব্যক্তি খাত বিদেশি উত্স থেকে ঋণ করলে সেখানে বাংলাদেশের জন্য কিছু অর্থনীতি থাকলেও থাকতে পারে, তবে সরকারি খাত ঋণ করলে সেখানে কী অর্থনীতি আছে সেটা অতি কষ্ট করে ব্যাখ্যার বিষয়। বাংলাদেশ সরকার তো সেই ঋণকে নিজ দেশের মুদ্রা টাকায় রূপান্তর করে প্রজেক্টে অর্থায়ন, বিদেশ থেকে পণ্য কেনা—এসব কাজেই ব্যয় করছে। তাহলে ঋণটা স্বদেশি উত্স থেকে টাকায় নিলে কী ক্ষতি হয়? বিশেষ করে আমাদের যেখানে বিদেশি মুদ্রার অভাব নেই। তবে একটা ব্যাখ্যা উনারা দেন সেটা হলো, বিদেশি উত্স থেকে ডলার-ইউরোতে ঋণ নাকি সস্তায় পাওয়া যায়, যেটা আবার আমার মতো অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি বলে মনে হয় না। আগে ব্যাখ্যা করি, আমরা কীভাবে বিদেশের উপযুক্ত গ্রাহককে ঋণ দিতে পারি। সেই ব্যাখ্যাটা হলো আর কিছুই না, যেহেতু আমরা আমাদের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভকে বিদেশি কেন্দ্রীয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রায় বিনা সুদে ফেলে রেখেছি, তাহলে সেই রিজার্ভকে সামান্য বেশি সুদে উপযুক্ত এবং নিরাপদ গ্রাহকদের কাছে বেচতে সমস্যা কোথায়? আমাদের সেই অর্থ তো বিদেশিরা ঠিকই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খাটাচ্ছে, শুধু আমাদের উপযুক্ত মূল্যটা দিচ্ছে না। তবে কথা হলো বাংলাদেশ বিশ্বের অর্থবাজারগুলো থেকে ঋণ করে না, আবার অর্থবাজারের মাধ্যমে ঋণও বেচে না। অনেকটা আমাদের অবস্থা কথিত দরিদ্র দেশগুলোর মতো, যারা শুধু ঋণ নেবে, ঋণ দেবে না। আমাদের ঋণ করার কাহিনি অনেক পুরোনো, স্বাধীনতার থেকেও পুরোনো। আমাদের সব সময় নজর ছিল আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিশ্ব অর্থব্যবস্থার তদারকি সংস্থা আইএমএফ থেকে কীভাবে বেশি করে ঋণ নেওয়া যায় সেদিকে। ভাবা হতো ওদের ঋণ ছাড়া এবং ওদের পরামর্শ ছাড়া আমাদের অর্থনীতিটা চালানো যাবে না। তাই অন্য অনেক দরিদ্র দেশের মতো এখানেও ওই সব ঋণবিক্রেতা সংস্থার বিরাট বিরাট অফিস খুলে বসেছে, ওরা প্রজেক্ট গ্রহণ করে সরকারের কাছে পেশ করে অনুমোদনের জন্য। আবার কখনো সরকারই প্রকল্প গ্রহণ করে ওদের দরবারে ছোটাছুটি করে অর্থায়নের আশ্বাস পাওয়ার জন্য। দুই পক্ষেরই উপকার হয়। একপক্ষ ঋণ, কনসালট্যান্সি এবং সেই সঙ্গে কিছু সামগ্রী বেচতে পারে, অন্য পক্ষ ওই প্রজেক্টে অর্থায়নের সমস্যা দূর হয়েছে বলে চারদিকে জানান দেয়। আর আইএমএফের ঋণ ছোট হলে কী হবে, ওদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ। আইএমএফ সার্টিফাই করে বা সনদ দেয় যে আমাদের অর্থনীতি বিশেষ করে ম্যাক্রো অর্থনীতি ঠিক আছে, এই দেশের কাছে ঋণ বিক্রি করা যায়। এই সার্টিফিকেট পেলে অন্য ঋণবিক্রেতারা আরও দ্বিগুণ উত্সাহে আমাদের কাছে ঋণ বিক্রয় করতে লেগে যায়। আমাদের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে ওদের ক্রেডিট রেটিং কোম্পানিগুলো কাজ করে না, তবে তাদের হয়ে আইএমএফই কাজটি করে দেয়। আইএমএফ রেটিং করে সরকারের ঋণ গ্রহণের ক্ষমতা। তারা যদি দেখে সরকার ঋণ শোধ করতে সক্ষম, তাহলে এ ক্ষেত্রে ভালো সনদ মেলে। আর বাংলাদেশ তো বরাবরই বিদেশি ঋণের একটা ভালো গ্রাহক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে। সরকার বিদেশি ঋণ ফেরত দিতে কখনো ব্যর্থ হয়নি। সরকার বিদেশি ঋণ নিয়েছে বিমানের জন্য, কখনো টেলিফোনের জন্য, কখনো ব্যাংকগুলোর মূলধন কমতিকে পুনঃ অর্থায়নের জন্য। বিমান না চললেও ঋণকে কিন্তু ফেরত দিতে হয়েছে। আর সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি আরও বাড়লেও বিশ্বব্যাংক এবং এডিবির ঋণ কিন্তু ঠিকই ফেরত দিতে হয়েছে। ঋণ নিয়ে, ঋণের ব্যবহার নিয়ে এবং ঋণের অর্থনীতি নিয়ে অনেক অধ্যয়নও হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রেও অধ্যয়নটা করেছে ওরা, যারা ঋণের উপকারভোগী। এই ঋণের পক্ষে শত শত পৃষ্ঠার দলিল তৈরি করতে তাদের কোনো অসুবিধাই হয়নি। বরং বলা চলে এমন অধ্যয়ন প্রায় দেখাই যাবে না যে অধ্যয়নের আলোকে ঋণকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, একই ক্ষেত্রে এবং একই ধরনের অধ্যয়নের ক্ষেত্রে দেশীয় অর্থও ব্যয় করা হয়। তবে অধ্যয়নটা তেমন করা হয় না। এটা কেন? সেটারও উত্তর, যারা ঋণ বেচে তাদের ঋণের শর্তের মধ্যেই অধ্যয়নের কথা থাকে। ওদের ঋণকে ঘিরেই তো এই দেশে একটা কনসালট্যান্সি শিল্প গড়ে উঠছে। আর সেই কনসালট্যান্টরা একত্রে অনেক বেশি প্রভাবশালী। তবুও ভাগ্য ভালো, দেশ বিদেশি ঋণের ভারে ডুবে যায়নি। ১৮ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ আজও এ দেশের স্থিতিপত্রে জমা আছে। আর এই ঋণের বিপরীতে, জানামতে ফি-বছর আমরা ৬০০ মিলিয়ন ডলার সুদ দিচ্ছি। তবুও ঋণ নেওয়ার আগ্রহের কমতি নেই। এই যে সেদিন দেখলাম, আমাদের পলিসিমেকারসদের সভায় একটা সিদ্ধান্ত হলো, পদ্মা সেতু অর্থায়নের জন্য প্রায় পুরোটাই বিদেশিদের থেকে ঋণ নেওয়া হবে। কিন্তু আমাদের স্থূল হিসাব মতে, ওই ১২ হাজার কোটি টাকার কমপক্ষে অর্ধেক আমাদের উঠতি শেয়ারবাজারসহ আর্থিক বাজার ও জনগণ থেকে নেওয়া যেত। দেশের জনগণ থেকে ঋণ করার অন্য সুবিধাও ছিল, ঋণের বদলে তারা লাভ পেত, অন্যদিকে এ ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় তাদের আয় বেড়ে ভোগও বেড়ে যেত। দেশের লোকজন জুতসই ঋণ বেচার বাজার না পেয়ে দলে দলে শেয়ারবাজারের দিকে ছুটছে, সরকারের যেন সেদিকটার প্রতি নজর নেই। এত দিন তো ঋণ বেচত বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং আইএমএফ। এখন ভারতীয় সরকারও আমাদের কাছে ঋণ বেচা শুরু করেছে। আমরা চেয়েছি তাদের কাছে পানি, আর তারা দিয়েছে ঋণ। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেই ঋণের জন্যও গর্ব করছেন। এহেন ভালো ঋণ ক্রেতা অবশ্য ভারত অন্যত্র সহজে পাচ্ছে না। পাচ্ছে না বলেই তাদের বিশাল অঙ্কের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারের সামান্য অংশ ব্যয় করে বিদেশ থেকে স্বর্ণ কেনা শুরু করেছে।
ভারতের এখন ডলারকে বড় ভয়। ডলার মূল্য হারাতে পারে। আর সেই চিন্তায় সম্পদ ধারণের ক্ষেত্রে ভারত বৈচিত্র্য আনছে। ভারতীয় ঋণ কোন কাজে লাগবে? সিএনজি বাস কিনতে, রেলের ট্র্যাক ঠিক করতে, রেলওয়ার্কশপ আধুনিকায়ন করতে আর রাস্তা তৈরি করতে। এসবের উপকারভোগীও হবে ভারত; যদি ভারত আমাদের রেল-বাস-জনপদ ব্যবহার করে তার মালপত্র মেশিন সামগ্রী একদিক থেকে অন্যদিকে নিতে চায় তাহলে ঋণটা আমাদের স্থিতিপত্রে থাকবে কেন? এখানেই আমরা বোকা, তারা বুদ্ধিমান। তারা ঋণ বেচল, স্থাপনাও তাদের জন্য তৈরি করা হলো অথচ বাংলাদেশ বলছে, এখানেও তারা জয়ী হয়েছে!
জয়ী যদি হতেই হতো তাহলে এক বিলিয়ন ডলারের অঙ্কটা ঋণ না হয়ে গ্রান্ট হতে পারত। আর এই ঋণ কেনা দেখে অন্য যারা আমাদের কিছু অনুদান দিত, তারাও পিছিয়ে যাবে। কারণ, অন্য দেশ তো আর তৈরি অবকাঠামোকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না। যাহোক, প্রত্যেক পক্ষই চাইবে জয়ী হতে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জয়ী হতে পারেনি। শুধু তিস্তার পানি উত্তোলনের মাধ্যমে ভারত আমাদের যে ক্ষতি করছে, তার মূল্য তো অবশ্যই এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। তাহলে আমাদের তো উচিত ছিল এটা বলা যে আগে পানি দিন, তারপর না হয় আপনাদের ঋণটাও কিনলাম।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ভারতের এখন ডলারকে বড় ভয়। ডলার মূল্য হারাতে পারে। আর সেই চিন্তায় সম্পদ ধারণের ক্ষেত্রে ভারত বৈচিত্র্য আনছে। ভারতীয় ঋণ কোন কাজে লাগবে? সিএনজি বাস কিনতে, রেলের ট্র্যাক ঠিক করতে, রেলওয়ার্কশপ আধুনিকায়ন করতে আর রাস্তা তৈরি করতে। এসবের উপকারভোগীও হবে ভারত; যদি ভারত আমাদের রেল-বাস-জনপদ ব্যবহার করে তার মালপত্র মেশিন সামগ্রী একদিক থেকে অন্যদিকে নিতে চায় তাহলে ঋণটা আমাদের স্থিতিপত্রে থাকবে কেন? এখানেই আমরা বোকা, তারা বুদ্ধিমান। তারা ঋণ বেচল, স্থাপনাও তাদের জন্য তৈরি করা হলো অথচ বাংলাদেশ বলছে, এখানেও তারা জয়ী হয়েছে!
জয়ী যদি হতেই হতো তাহলে এক বিলিয়ন ডলারের অঙ্কটা ঋণ না হয়ে গ্রান্ট হতে পারত। আর এই ঋণ কেনা দেখে অন্য যারা আমাদের কিছু অনুদান দিত, তারাও পিছিয়ে যাবে। কারণ, অন্য দেশ তো আর তৈরি অবকাঠামোকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবে না। যাহোক, প্রত্যেক পক্ষই চাইবে জয়ী হতে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জয়ী হতে পারেনি। শুধু তিস্তার পানি উত্তোলনের মাধ্যমে ভারত আমাদের যে ক্ষতি করছে, তার মূল্য তো অবশ্যই এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। তাহলে আমাদের তো উচিত ছিল এটা বলা যে আগে পানি দিন, তারপর না হয় আপনাদের ঋণটাও কিনলাম।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments