দূরত্ব-বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক ও মনস্ত্তাত্ত্বিক বাধা by মহিউদ্দিন আহমদ

পাকিস্তানের সিভিল সমাজের প্রতিনিধি, অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও রাজনীতিক, যাঁদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়েছে, তাঁদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন ছিল: বাংলাদেশে যখন গণহত্যা চলে, তখন তোমরা কেন প্রতিবাদ করনি। পাঞ্জাবি, পাঠান, সিন্ধি, মোহাজের—সবার কাছেই আমি এ প্রশ্ন রেখেছি।


বেশির ভাগ উত্তরই ছিল আত্মরক্ষামূলক এবং অনুতাপসুলভ বা অ্যাপোলোজেটিক। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও ছিল। একাত্তরে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভূমিকার প্রতিবাদ করে জেল খেটেছেন, এমন মানুষের সঙ্গেও দেখা হয়েছে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের যখন জন্ম হয়, এর পেছনে বাংলার প্রায় সব মুসলমান নেতাই এক কাতারে শামিল ছিলেন। জিন্নাহকে নেতা মেনে এ দেশের প্রধান নেতাদের মধ্যে ভাসানী, ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান চেয়েছিলেন বলেই তা হতে পেরেছিল। কিন্তু ওই সময় বালুচিস্তান পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হয়নি। কেননা বালুচিস্তান (কালাত) ইংরেজ-শাসিত ভারত সাম্রাজ্যের আওতাধীন ছিল না। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর চাপে পড়ে জনমত উপেক্ষা করে ১৯৪৮ সালের ২৭ মার্চ কালাতের শাসক আহমেদ ইয়ার খান পাকিস্তান রাষ্ট্রে অঙ্গীভূত হওয়ার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর দেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দাপটের কাছে বালুচদের সার্বভৌম সত্তা বিলীন হয়ে যায়।
পরবর্তী ইতিহাস আরও করুণ। ১৯৫৮ সালের ৫ অক্টোবর ব্রিগেডিয়ার টিক্কা খানের নেতৃত্বে কালাতে সেনা অভিযান শুরু হয়। কালাতের ‘খান’কে গ্রেপ্তার করে লাহোরে এনে অন্তরীণ করা হয়। টিক্কা খানের আবির্ভাব ঘটে নতুন নামে—বালুচিস্তানের কসাই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে একই সেনাপতির নেতৃত্বে এই নাটকের পুনর্মঞ্চায়ন হয়েছিল। আর প্রযোজকের ভূমিকায় ছিলেন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার উত্তরসূরি জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। ১৯৫৮ সালে বালুচদের সমর্থনে ঢাকায় কোনো প্রতিবাদ মিছিল হয়নি। কেন হয়নি, এক বালুচ যুবকের এই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারিনি। ১৯৭১ সালে যখন একই কসাই বাংলাদেশে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল, পশ্চিমে এটা নিয়ে তেমন একটা প্রতিবাদের ঝড় ওঠেনি। এটাই নিশ্চিতভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমাদের উভয়ের মনোজগতেই অন্যের উপস্থিতি নেই। আমরা উভয়েই স্বতন্ত্র, আলাদা। এটা বুঝতে বুঝতেই ২৩ বছর গড়িয়ে গেছে।

দুই.
১৯৯৭ সালে আমি যখন দ্বিতীয়বার পাকিস্তান সফরে যাই, তখন ঘটা করে সেখানে পাকিস্তানের সুবর্ণজয়ন্তী উত্সব চলছিল। এ উপলক্ষে একটি গণমাধ্যমে মতামত জরিপ চালানো হয়। প্রশ্ন ছিল দুটি। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রধান ঘটনা কী এবং সম্পূরক প্রশ্নটি ছিল, এ ঘটনার জন্য কে বা কারা দায়ী। প্রথম প্রশ্নের উত্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জবাব ছিল, ‘ঢাকার পতন।’ দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ৩৩ শতাংশ মানুষ বলেছিল, ভুট্টো দায়ী। ২৬ শতাংশ মানুষ অভিযুক্ত করেছিল জেনারেল ইয়াহিয়াকে। এবং মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ দায়ী করেছেন শেখ মুজিবকে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে যখনই কোনো বৈঠকের আয়োজন করা হয়, তখনই আমরা গণমাধ্যমে একটা প্রচার দেখি এজেন্ডা নিয়ে। এই এজেন্ডার মধ্যে অবধারিতভাবে থাকে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানিদের’ ফিরিয়ে নেওয়া এবং যুদ্ধ-পূর্ববর্তী রাষ্ট্রীয় সম্পদের ন্যায়সংগত অংশ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু এ বিষয়গুলো নিয়ে কী আলোচনা হয়, কী সিদ্ধান্ত হয়, তা আমরা বিস্তারিত কিছুই জানতে পারি না। শীর্ষ বৈঠক শেষ হয়ে গেলে আরেকটি বৈঠকের আয়োজন না হওয়া পর্যন্ত এর কোনো ফলোআপ থাকে না। আসলেই কি এ দুটি বিষয় এই দুই দেশের আন্তসম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা?
ইতিমধ্যে একটি বিষয়ের মীমাংসা হয়ে গেছে। ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ প্রশ্নের সম্মানজনক সুরাহা হয়েছে তাঁদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নেওয়ার রাজনৈতিক ও মানবিক সিদ্ধান্তে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁদের সমন্বয়ের বিষয়টি সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানে যে লাখ লাখ বাঙালি বসবাস করছেন, তাঁদের পাকিস্তানের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার আছে। করাচির কোরাঙ্গি এলাকায়ই ১০ লাখেরও বেশি বাঙালির বসবাস বলে ধারণা করা হয়। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণও এ রকমই ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশ তাঁদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করে। তাঁরা এখন রাষ্ট্রবিহীন মানুষ এবং প্রায় প্রতিদিন পুলিশ ও কর্মস্থলে নিয়োগকর্তার হয়রানির শিকার হচ্ছেন। করাচির কয়েকটি এনজিও তাঁদের সঙ্গে কাজ করে এবং সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে, যাতে তাঁরা হয়রানির বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। সার্ক সোশ্যাল চার্টারের আওতা পরিমার্জন করে এসব ‘অননুমোদিত’ শ্রমিককে ‘অভিবাসী শ্রমিক’ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার জন্যও দাবি করছে করাচির কয়েকটি এনজিও। যাঁরা বাংলাদেশে বসবাস করতে চান, তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিক হবেন এবং যাঁরা পাকিস্তানে রুটি-রুজির আশায় গেছেন এবং সেখানেই থাকতে চান, তাঁদের পাকিস্তানের নাগরিকত্ব দিতে হবে। এই দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ রকম সিদ্ধান্ত হওয়া দরকার।
আমাদের স্মৃতিতে ১৯৭১ একটা বড় রকমের ক্ষত তৈরি করেছে। আমরা চাই, পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাক। পাকিস্তানের সিভিল সমাজ থেকেও এ দাবি উঠেছে এবং গত ২৫ বছরে অনেকেই প্রকাশ্যে এ দাবির প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। এ দুই দেশের সিভিল সমাজের প্রতিনিধিরা যখন বিভিন্ন আঞ্চলিক ফোরামে একত্র হন, তখন এ আশাবাদ জাগে, এ রকম একটি দাবির প্রতি পাকিস্তানের সর্বস্তরের নাগরিক একদিন না একদিন সমর্থন দেবেনই। এ জন্য একটা অনুকূল আবহ দরকার, প্রয়োজন সিভিল সমাজের আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন। জেনারেল পারভেজ মোশাররফই প্রথম পাকিস্তানি সরকারপ্রধান, যিনি প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আমাদেরও একটু ধৈর্য ধরতে হবে এবং আমাদের কাজগুলোও করতে হবে। একটি বিভক্ত জাতির পক্ষে এ ধরনের একটি অর্জন হবে সময়সাপেক্ষ ও কষ্টকর। আমাদের জাতীয় ঐক্য দরকার সবার আগে।
রাজনৈতিক সমঝোতা ও স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তা বজায় রাখার পথটি সহজ নয়। এটিকে সহজতর করা যায়, যদি সম্পর্কের অন্য জানালাগুলো আমরা খুলে দিই। নাগরিকদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য বাড়ানোর মধ্য দিয়ে আমরা সম্পর্কের সিঁড়িগুলো তৈরি করতে পারি। এখন ঢাকা থেকে কলকাতা রেলগাড়িতে যাতায়াত করা যায়। অমৃতসর থেকে লাহোর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ আছে এবং তা বেশ জনপ্রিয়। আমরা কি পারি না ঢাকা-লাহোর সরাসরি রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে? রেললাইন তো আছেই।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক, গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.