খোলা চোখে-যুদ্ধ যুদ্ধ অথবা শান্তি শান্তি খেলা by হাসান ফেরদৌস
আমার পাকিস্তানি কূটনীতিক বন্ধু। তাঁর কথা আমি বারকয়েক আপনাদের বলেছি। গত সপ্তাহে বিনা নোটিশে আমার দপ্তরে এসে হাজির। হাসি হাসি মুখ। সদ্য দেশ থেকে ফিরেছেন, সঙ্গে আমার জন্য তোফা। জানালেন, পাকিস্তানের পরিস্থিতি একদম ঘুরে গেছে। সেখানে তালেবান এখন সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে রয়েছে।
দেশের মানুষের ভেতর যে অল্পবিস্তর সমর্থন ছিল, তাও শেষ। কিন্তু এই অবস্থা আবার ফের ঘুরে যেতে পারে যদি আমেরিকা তাদের ড্রোন হামলা না থামায়। ড্রোন, মানে চালকবিহীন বোমারু বিমান। গত কয়েক মাস থেকেই আমেরিকায় বসে কম্পিউটারে বোতাম টিপে ড্রোন বিমানে একের পর এক তালেবান নেতা ঘায়েল করা হচ্ছে। সর্বশেষ যে দুজন তালেবান নেতা ড্রোন আক্রমণে মারা গেছেন তাঁরা উভয়েই মাসুদ সম্প্রদায়ের তালেবান নেতা বায়তুল্লাহ মাসুদ ও হাকিমুল্লাহ মাসুদ। তালেবানদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর বলে এই মাসুদ উপদলের সুনাম রয়েছে। আফগান তালেবানের এক বড় নেতা মোল্লা গনি বারাদারও ধরা পড়েছেন।
ভদ্রলোক জানালেন, তাঁর আশার কারণ দুটি। এক. পাকিস্তানের রাজনৈতিক কালচারে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে দেশের নিরপেক্ষ ও স্বাধীনচেতা প্রধান বিচারপতির আপসহীন মনোভাবের কারণে। এত দিন রাজনীতিবিদ ও সেনাপতিরা নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে যা খুশি তাই করে গেছেন। বিচার বিভাগকে ডিঙিয়ে তা করা এখন আর সম্ভব নয়। আর সেই বিচার বিভাগই যদি আবার ফের পা হড়কে পড়ে যায় অর্থাত্ তারাও ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়, তাহলে দেশের মানুষ তাদের গিলে খাবে। রাজনীতিবিদ বা উর্দিওয়ালারা কেউই তাঁদের ঠেকাতে হাইটুকু পর্যন্ত তুলবে না। আশার অন্য কারণ, আমার পাকিস্তানি বন্ধু জানালেন পাকিস্তানের অসম্ভব প্রাণবন্ত তথ্যমাধ্যম। দেশের ভেতরে তো বটেই, স্যাটেলাইটের কারণে এখন দেশের বাইরে থেকেও নানা রকম টিভি নেটওয়ার্ক চালু হয়েছে। একদম স্বাধীন। প্রধান কোনো বড় দলের লেজুড় নয় বা সেনা দপ্তরের খয়েরখা নয়—এমন পত্রপত্রিকায় দেশ ছেয়ে গেছে। চাইলেও এদের মুখ বন্ধ করা যাবে না।
সমঝদার পাকিস্তানি কূটনীতিক নিজ দেশ নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন, তাঁর সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার কিছু নেই। নিরপেক্ষ ভাষ্যকারেরাও পাকিস্তানে বরফ গলার ইঙ্গিতই করেছেন। তাদের কেউ কেউ মনে করেন, পাকিস্তান যে অবশেষে পথে আসছে বলে মনে হচ্ছে তার এক বড় কারণ মাথার ওপর শাবল নিয়ে বসে থাকা আমেরিকা। আমেরিকা আগেও মাথার ওপর ছিল, কিন্তু এখন তার তরফ থেকে যতটা চাপ আসছে, আগে তা আসেনি। কারণ ওবামার রাজনৈতিক ভবিষ্যত্। আফগানিস্তানে সামরিক বিজয়ের ওপর বারাক ওবামার প্রেসিডেন্সি অনেকটা নির্ভর করছে। আর এ কথা তিনি খুব ভালো করেই জানেন, আফগানিস্তানে শান্তি ও সামরিক বিজয় অর্জন করতে হলে তাঁকে পাকিস্তানের ভেতর দিয়েই যেতে হবে। তালেবানকে পেলেপুষে টিকিয়ে রেখেছে পাকিস্তানই। আফগানিস্তানের বাইরে তাদের বড় ঘাঁটি এই পাকিস্তানেই। যত দিন পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগ এই তালেবানের ওপর তাদের ছাতা ধরা বন্ধ না করে, তত দিন অবস্থা বদলাবে না। আর সেই ছাতা ধরা বন্ধ করতে আমেরিকা একদিকে চাকু, অন্যদিকে মুলো ঝুলাচ্ছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ছাতা ধরার অভ্যাস হয়তো চাপে পড়েই বদলাতে বাধ্য হচ্ছে পাকিস্তান। তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী মোল্লা ওসমান গনি সম্প্রতি ধরা পড়েছেন। আর তা সম্ভব হয়েছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের সরাসরি সহযোগিতার ফলেই। মার্কিন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, এমন ভাবার কারণ রয়েছে যে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কায়ানি এবং গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল সুজা এখন সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন তালেবানদের কাবু না করতে পারলে পাকিস্তানের নিজের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
কিন্তু সবাই যে এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত তা নয়। পাকিস্তানের ভেতরের খবর যারা রাখেন, তাঁরা মোল্লা গনির গ্রেপ্তারের মধ্যে ভিন্ন গন্ধ পাচ্ছেন। তাঁদের ধারণা, এটি হয়তো পাকিস্তানের একটি চাল। গত কয়েক মাস ধরে আমেরিকা তালেবানদের ব্যাপারে এক নতুন নীতি গ্রহণ করেছে। তারা তালেবানদের ভালো ও মন্দ—এই দুই ভাগে ভাগ করে ‘ভালো’ তালেবানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছে। শুধু সামরিক অভিযান চালিয়ে তালেবানকে ঘায়েল করা যাবে না, এ কথা এখন দিনের মতো ফর্সা। আর আমেরিকাও অনন্তকাল ধরে আফগানিস্তানে পড়ে থাকতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট ওবামা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন ২০১১ সাল নাগাদ সে দেশ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে। ২০১২ সালে তাঁকে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। কিন্তু আফগানিস্তানে যুদ্ধ জিইয়ে রেখে সে নির্বাচনে জেতা তাঁর পক্ষে কঠিন হবে। ফলে যেভাবেই হোক এক ধরনের ‘পোশাকি বিজয়’ তাঁকে অর্জন করতেই হবে। আর সে লক্ষ্যেই ভালো তালেবানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইও এই রণকৌশলের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন।
কিন্তু সমস্যা হলো পাকিস্তানকে নিয়ে। আফগানিস্তানকে নিজের তালুক ভাবতেই তারা ভালোবাসে। ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধে এই আফগানিস্তানকে ব্যবহার করা যাবে এমন এক চিন্তা থেকেই তারা তালেবান পোষা শুরু করে প্রায় তিন দশক আগে থেকে। ২০০১ সালে তালেবানের পতনের পর থেকে কাবুলের ওপর পাকিস্তানের প্রভাব যেমন কমেছে, তেমনি ভারতের প্রভাব বেড়েছে। হামিদ কারজাই বা মার্কিনপন্থী কোনো সরকার কাবুলে ক্ষমতায় টিকে থাকলে সেখানে পাকিস্তানের নয়, ভারতের প্রভাবই বহাল থাকবে। এ কথা সবারই জানা, কারজাই পাকিস্তানকে দুচক্ষে দেখতে পারেন না। অন্যদিকে ভারত ও আমেরিকা কৌশলগত আঁতাতে লিপ্ত। একে অপরের স্বার্থ রক্ষায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ অবস্থায় আফগানিস্তানে যদি যুদ্ধ শেষ হয় এবং রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে ওঠে, তাহলে পাকিস্তানের তো কোনো জায়গা হবে না। ইসলামাবাদ হিসাবে করে দেখেছে, আজ হোক আর কাল, আমেরিকা আফগানিস্তান ছাড়বেই। আর তখন কাবুলে ক্ষমতা দখলে তালেবানকে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এই ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের যুক্তি, পাকিস্তান চায় না তালেবানদের সঙ্গে আমেরিকার বা কাবুল সরকারের কোনো রকম সমঝোতা হোক। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের ধারণা, মোল্লা গনিকে সমঝোতার পথে টোপ ফেলেছিল আমেরিকা। তিনি তাতে সাড়াও দিয়েছিলেন। যাতে সত্যি সত্যি তাঁদের মধ্যে কোনো রকম সমঝোতা না গড়ে ওঠে, সে উদ্দেশ্যেই পাকিস্তান আগ বাড়িয়ে মোল্লা গনিকে গ্রেপ্তার করে। এখন যদি সে কাবুল বা ওয়াশিংটনের সঙ্গে কথা বলতে চায়, তাহলে তাকে পাকিস্তানের হাত ধরেই যেতে হবে।
ওয়াশিংটনের নামজাদা থিংক-ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিসের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক তেরেসিতা শেফার সম্প্রতি এ ব্যাপারে তাঁর সন্দেহের কথা খোলামেলাভাবেই বলেছেন। মিসেস শেফার একসময় ঢাকায় ও ইসলামাবাদে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উপমহাদেশের অনেকের সঙ্গেই তাঁর তুই-তোকারি সম্পর্ক। মিসেস শেফারের ধারণা, মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা বন্ধের লক্ষ্যে মোল্লা গনিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। চাইলে পাকিস্তান অনেক আগেই তাঁকে বা তাঁর দলের অনেক নেতাকেই আটকাতে পারত। তা ছাড়া মোল্লা গনিকে যেভাবে ধরা হলো, তা নিয়েও নানা রকম সন্দেহ রয়েছে। পাকিস্তান জানিয়েছিল তাঁকে করাচি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দাদের ধারণা, ঘোষিত তারিখের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে গনিকে আটক করা হয় করাচিতে নয়, বেলুচিস্তানের কোনো শহর থেকে। আর তাঁকে যদি করাচি থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়ে থাকে তাহলে বোঝা গেল পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহরে বসে থেকে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মোল্লা গনি। তাঁর নেতা মোল্লা ওমরও হয়তো এই শহরে লুকিয়ে আছেন।
আমেরিকা দীর্ঘদিন থেকে তালেবানদের অন্যতম উপদল হাক্কানি গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে। এই উপদলের নেতা মোল্লা জালাউদ্দিন হাক্কানি দীর্ঘদিন থেকে উপজাতীয় এলাকা দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছেন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কোনো গোপন ব্যাপার নয়। মার্কিন কর্তাব্যক্তিরা ইসলামাবাদে এসে মোল্লা হাক্কানির দলের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু এ পর্যন্ত তাতে কোনো কাজ হয়নি।
এ অবস্থা বদলাতে হলে দুটি ঘটনা ঘটাতে হবে। এক. ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সন্দেহ ও ঘৃণার বাতাবরণ দূর করতে হবে। পাকিস্তান যত দিন তালেবানের বদলে ভারতকে তার প্রধান শত্রু বিবেচনা করবে, তত দিন সে দেশের রণকৌশলের বদল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি ভারতকেও এ কথা মানতে হবে, পাকিস্তান ও সে দেশের মানুষের ভারতের ব্যাপারে কিছু কিছু স্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। কাশ্মীর তার অন্যতম। এই প্রশ্ন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে সংকট, তা কার্পেটের নিচে ঠেলে রেখে বন্ধুত্বের কথা বলা অর্থহীন। আশার কথা, কোনো পূর্ব শর্তারোপ ছাড়াই এই দুই দেশ নিজেদের মধ্যে ফের কথা বলা শুরু করেছে। নাটকীয় কোনো ফল এই আলোচনা থেকে আসবে না, দিল্লিতে অনুষ্ঠিত অমীমাংসিত প্রথম আলোচনা থেকেই তা বোঝা গেছে। কিন্তু তারা কথা বলছে যুদ্ধের ভাষায় নয়, শান্তির ভাষায়। সেটাই আশার কথা।
অন্য যে কাজটা করা উচিত তা হলো তালেবান ও অন্য সব মৌলবাদী সহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরালো করা। তালেবান যদি ফের কাবুলে চড়াও হয়, তো তার আগুনে কেবল এক আফগানিস্তানই পুড়বে না, পুড়বো আমরাও।
নিউইয়র্ক, ২ মার্চ ২০১০
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
ভদ্রলোক জানালেন, তাঁর আশার কারণ দুটি। এক. পাকিস্তানের রাজনৈতিক কালচারে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে দেশের নিরপেক্ষ ও স্বাধীনচেতা প্রধান বিচারপতির আপসহীন মনোভাবের কারণে। এত দিন রাজনীতিবিদ ও সেনাপতিরা নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে যা খুশি তাই করে গেছেন। বিচার বিভাগকে ডিঙিয়ে তা করা এখন আর সম্ভব নয়। আর সেই বিচার বিভাগই যদি আবার ফের পা হড়কে পড়ে যায় অর্থাত্ তারাও ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়, তাহলে দেশের মানুষ তাদের গিলে খাবে। রাজনীতিবিদ বা উর্দিওয়ালারা কেউই তাঁদের ঠেকাতে হাইটুকু পর্যন্ত তুলবে না। আশার অন্য কারণ, আমার পাকিস্তানি বন্ধু জানালেন পাকিস্তানের অসম্ভব প্রাণবন্ত তথ্যমাধ্যম। দেশের ভেতরে তো বটেই, স্যাটেলাইটের কারণে এখন দেশের বাইরে থেকেও নানা রকম টিভি নেটওয়ার্ক চালু হয়েছে। একদম স্বাধীন। প্রধান কোনো বড় দলের লেজুড় নয় বা সেনা দপ্তরের খয়েরখা নয়—এমন পত্রপত্রিকায় দেশ ছেয়ে গেছে। চাইলেও এদের মুখ বন্ধ করা যাবে না।
সমঝদার পাকিস্তানি কূটনীতিক নিজ দেশ নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন, তাঁর সঙ্গে দ্বিমত হওয়ার কিছু নেই। নিরপেক্ষ ভাষ্যকারেরাও পাকিস্তানে বরফ গলার ইঙ্গিতই করেছেন। তাদের কেউ কেউ মনে করেন, পাকিস্তান যে অবশেষে পথে আসছে বলে মনে হচ্ছে তার এক বড় কারণ মাথার ওপর শাবল নিয়ে বসে থাকা আমেরিকা। আমেরিকা আগেও মাথার ওপর ছিল, কিন্তু এখন তার তরফ থেকে যতটা চাপ আসছে, আগে তা আসেনি। কারণ ওবামার রাজনৈতিক ভবিষ্যত্। আফগানিস্তানে সামরিক বিজয়ের ওপর বারাক ওবামার প্রেসিডেন্সি অনেকটা নির্ভর করছে। আর এ কথা তিনি খুব ভালো করেই জানেন, আফগানিস্তানে শান্তি ও সামরিক বিজয় অর্জন করতে হলে তাঁকে পাকিস্তানের ভেতর দিয়েই যেতে হবে। তালেবানকে পেলেপুষে টিকিয়ে রেখেছে পাকিস্তানই। আফগানিস্তানের বাইরে তাদের বড় ঘাঁটি এই পাকিস্তানেই। যত দিন পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগ এই তালেবানের ওপর তাদের ছাতা ধরা বন্ধ না করে, তত দিন অবস্থা বদলাবে না। আর সেই ছাতা ধরা বন্ধ করতে আমেরিকা একদিকে চাকু, অন্যদিকে মুলো ঝুলাচ্ছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ছাতা ধরার অভ্যাস হয়তো চাপে পড়েই বদলাতে বাধ্য হচ্ছে পাকিস্তান। তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী মোল্লা ওসমান গনি সম্প্রতি ধরা পড়েছেন। আর তা সম্ভব হয়েছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বিভাগের সরাসরি সহযোগিতার ফলেই। মার্কিন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, এমন ভাবার কারণ রয়েছে যে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কায়ানি এবং গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল সুজা এখন সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন তালেবানদের কাবু না করতে পারলে পাকিস্তানের নিজের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
কিন্তু সবাই যে এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত তা নয়। পাকিস্তানের ভেতরের খবর যারা রাখেন, তাঁরা মোল্লা গনির গ্রেপ্তারের মধ্যে ভিন্ন গন্ধ পাচ্ছেন। তাঁদের ধারণা, এটি হয়তো পাকিস্তানের একটি চাল। গত কয়েক মাস ধরে আমেরিকা তালেবানদের ব্যাপারে এক নতুন নীতি গ্রহণ করেছে। তারা তালেবানদের ভালো ও মন্দ—এই দুই ভাগে ভাগ করে ‘ভালো’ তালেবানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছে। শুধু সামরিক অভিযান চালিয়ে তালেবানকে ঘায়েল করা যাবে না, এ কথা এখন দিনের মতো ফর্সা। আর আমেরিকাও অনন্তকাল ধরে আফগানিস্তানে পড়ে থাকতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট ওবামা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন ২০১১ সাল নাগাদ সে দেশ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে। ২০১২ সালে তাঁকে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। কিন্তু আফগানিস্তানে যুদ্ধ জিইয়ে রেখে সে নির্বাচনে জেতা তাঁর পক্ষে কঠিন হবে। ফলে যেভাবেই হোক এক ধরনের ‘পোশাকি বিজয়’ তাঁকে অর্জন করতেই হবে। আর সে লক্ষ্যেই ভালো তালেবানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইও এই রণকৌশলের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন।
কিন্তু সমস্যা হলো পাকিস্তানকে নিয়ে। আফগানিস্তানকে নিজের তালুক ভাবতেই তারা ভালোবাসে। ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধে এই আফগানিস্তানকে ব্যবহার করা যাবে এমন এক চিন্তা থেকেই তারা তালেবান পোষা শুরু করে প্রায় তিন দশক আগে থেকে। ২০০১ সালে তালেবানের পতনের পর থেকে কাবুলের ওপর পাকিস্তানের প্রভাব যেমন কমেছে, তেমনি ভারতের প্রভাব বেড়েছে। হামিদ কারজাই বা মার্কিনপন্থী কোনো সরকার কাবুলে ক্ষমতায় টিকে থাকলে সেখানে পাকিস্তানের নয়, ভারতের প্রভাবই বহাল থাকবে। এ কথা সবারই জানা, কারজাই পাকিস্তানকে দুচক্ষে দেখতে পারেন না। অন্যদিকে ভারত ও আমেরিকা কৌশলগত আঁতাতে লিপ্ত। একে অপরের স্বার্থ রক্ষায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ অবস্থায় আফগানিস্তানে যদি যুদ্ধ শেষ হয় এবং রাজনৈতিক সমঝোতা গড়ে ওঠে, তাহলে পাকিস্তানের তো কোনো জায়গা হবে না। ইসলামাবাদ হিসাবে করে দেখেছে, আজ হোক আর কাল, আমেরিকা আফগানিস্তান ছাড়বেই। আর তখন কাবুলে ক্ষমতা দখলে তালেবানকে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এই ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের যুক্তি, পাকিস্তান চায় না তালেবানদের সঙ্গে আমেরিকার বা কাবুল সরকারের কোনো রকম সমঝোতা হোক। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের ধারণা, মোল্লা গনিকে সমঝোতার পথে টোপ ফেলেছিল আমেরিকা। তিনি তাতে সাড়াও দিয়েছিলেন। যাতে সত্যি সত্যি তাঁদের মধ্যে কোনো রকম সমঝোতা না গড়ে ওঠে, সে উদ্দেশ্যেই পাকিস্তান আগ বাড়িয়ে মোল্লা গনিকে গ্রেপ্তার করে। এখন যদি সে কাবুল বা ওয়াশিংটনের সঙ্গে কথা বলতে চায়, তাহলে তাকে পাকিস্তানের হাত ধরেই যেতে হবে।
ওয়াশিংটনের নামজাদা থিংক-ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিসের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক তেরেসিতা শেফার সম্প্রতি এ ব্যাপারে তাঁর সন্দেহের কথা খোলামেলাভাবেই বলেছেন। মিসেস শেফার একসময় ঢাকায় ও ইসলামাবাদে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উপমহাদেশের অনেকের সঙ্গেই তাঁর তুই-তোকারি সম্পর্ক। মিসেস শেফারের ধারণা, মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা বন্ধের লক্ষ্যে মোল্লা গনিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। চাইলে পাকিস্তান অনেক আগেই তাঁকে বা তাঁর দলের অনেক নেতাকেই আটকাতে পারত। তা ছাড়া মোল্লা গনিকে যেভাবে ধরা হলো, তা নিয়েও নানা রকম সন্দেহ রয়েছে। পাকিস্তান জানিয়েছিল তাঁকে করাচি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দাদের ধারণা, ঘোষিত তারিখের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে গনিকে আটক করা হয় করাচিতে নয়, বেলুচিস্তানের কোনো শহর থেকে। আর তাঁকে যদি করাচি থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়ে থাকে তাহলে বোঝা গেল পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহরে বসে থেকে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মোল্লা গনি। তাঁর নেতা মোল্লা ওমরও হয়তো এই শহরে লুকিয়ে আছেন।
আমেরিকা দীর্ঘদিন থেকে তালেবানদের অন্যতম উপদল হাক্কানি গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে। এই উপদলের নেতা মোল্লা জালাউদ্দিন হাক্কানি দীর্ঘদিন থেকে উপজাতীয় এলাকা দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছেন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কোনো গোপন ব্যাপার নয়। মার্কিন কর্তাব্যক্তিরা ইসলামাবাদে এসে মোল্লা হাক্কানির দলের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু এ পর্যন্ত তাতে কোনো কাজ হয়নি।
এ অবস্থা বদলাতে হলে দুটি ঘটনা ঘটাতে হবে। এক. ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সন্দেহ ও ঘৃণার বাতাবরণ দূর করতে হবে। পাকিস্তান যত দিন তালেবানের বদলে ভারতকে তার প্রধান শত্রু বিবেচনা করবে, তত দিন সে দেশের রণকৌশলের বদল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি ভারতকেও এ কথা মানতে হবে, পাকিস্তান ও সে দেশের মানুষের ভারতের ব্যাপারে কিছু কিছু স্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। কাশ্মীর তার অন্যতম। এই প্রশ্ন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে সংকট, তা কার্পেটের নিচে ঠেলে রেখে বন্ধুত্বের কথা বলা অর্থহীন। আশার কথা, কোনো পূর্ব শর্তারোপ ছাড়াই এই দুই দেশ নিজেদের মধ্যে ফের কথা বলা শুরু করেছে। নাটকীয় কোনো ফল এই আলোচনা থেকে আসবে না, দিল্লিতে অনুষ্ঠিত অমীমাংসিত প্রথম আলোচনা থেকেই তা বোঝা গেছে। কিন্তু তারা কথা বলছে যুদ্ধের ভাষায় নয়, শান্তির ভাষায়। সেটাই আশার কথা।
অন্য যে কাজটা করা উচিত তা হলো তালেবান ও অন্য সব মৌলবাদী সহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরালো করা। তালেবান যদি ফের কাবুলে চড়াও হয়, তো তার আগুনে কেবল এক আফগানিস্তানই পুড়বে না, পুড়বো আমরাও।
নিউইয়র্ক, ২ মার্চ ২০১০
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments