পার্বত্য চট্টগ্রাম-রাজনৈতিক সমস্যাকে সামরিক চোখে দেখা যাবে না by ফারুক ওয়াসিফ
গত কয়েক দিনে বাঘাইছড়ির হিংসার আগুন খাগড়াছড়ি শহর পর্যন্ত ছড়িয়েছে। বাঘাইছড়ির ঘটনায় দুজন পাহাড়ির লাশ উদ্ধার হয়েছে, পাঁচ থেকে আটজন মারা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর খাগড়াছড়িতে একজন বাঙালির মৃত্যুর খবর এসেছে।
আগুনে কেবল শত শত পাহাড়ির বাড়িঘরই ছাই হয়ে যায়নি, পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে শান্তির যে জলপাই চারাটি লাগানো হয়েছিল, আঁচ লেগেছে তারও গায়ে। তাই উদ্বেগ কেবল পাহাড়ি-বাঙালির জান-মাল নিয়েই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটিও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হয়েছে, পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির পেছনে ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। যথারীতি বিএনপিও হাঁক দিয়েছে, পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহার করে ভুল করেছে সরকার। খুবই মূল্যবান দুটি চিন্তা। কিন্তু গত রোববারের প্রথম আলোর সংবাদ বলছে, ‘রাঙামাটির পুলিশ সুপার মাসুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ভূমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে সেনাবাহিনী ও আদিবাসীদের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে।’ তাঁর এ বক্তব্যেই স্পষ্ট, গুলি কারা ছুড়েছে এবং কারা তাতে নিহত হয়েছে। তাই বিরোধী দলের কাছে প্রশ্ন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যদি সেনা প্রত্যাহার হয়েই থাকে, তাহলে ঘটনার সময় তারা এল এবং গুলিগোলা ছুড়ে পাহাড়িদের তাড়িয়ে দিল কোন জাদুবলে? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বেশ কিছু অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি করা হয়েছে। তার পরও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সেনা সেখানে ঠিকই অবস্থান করছে। বাঘাইহাটের সেদিনের রক্তাক্ত ঘটনায় তাদেরই জড়িত হতে দেখা গেছে। তাই সরকার অন্ধকারে ষড়যন্ত্রকারীদের কালো হাত খুঁজলে খুঁজতে পারে, কিন্তু ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে যারা জড়িত, তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে তা দায় এড়ানোর ছল বলে মনে হবে। নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ভালো কথা, কিন্তু জীবনের কোনো দাম হয় না। বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানুষের শোক ও ক্ষোভের একমাত্র সান্ত্বনা হলো ন্যায়বিচার।
বহু বছর ধরে পার্বত্যবাসী ন্যায়বিচার চেয়ে আসছে। রাজধানী ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে স্থানীয় অধিবাসীদের জোত-জমি ও জীবনের লাগাম অন্য জেলা থেকে আসা লোকেরা নিতে পেরেছে। এ রকম কিছু হলে সেখানে হুলস্থুল লেগে যেত, ‘বহিরাগত তাড়াও’ আন্দোলন হতো। কিন্তু পাহাড়িরা এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যেই প্রায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা ছিল মোট জনসংখ্যার নয় শতাংশ। ১৯৯১ সালের হিসাবে বান্দরবানে বাঙালিরা ছিল ৫২ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে ৫১ শতাংশ এবং রাঙামাটিতে ৪৪ শতাংশ। অভিযোগ রয়েছে, এই হিসাবেও বাঙালিদের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে। বাস্তবে বর্তমানে বাঙালিরা পাহাড়িদের জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে চলে গেছে। এটা করা হয়েছে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমল থেকে। দেশের নানা এলাকার গরিব ভূমিহীনদের প্রশাসনিকভাবে ধরে এনে এনে পার্বত্য জেলাগুলোতে বসত করানো হয়েছে।
এভাবে স্থানীয় জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের জমিতে বাইরে থেকে লোক এনে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার চেষ্টা এখনো চলছে। ভূমিহীনদের প্রতি কোনো রকম দরদ বা দায়িত্ব থেকে এটা করা হয়নি। তা যদি হতো, তাহলে সারা দেশে ভূমিদস্যুদের হাতে চলে যাওয়া জমিতেই ভূমিহীনদের আবাসন দেওয়া যেত। এটা করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা-সমস্যা মনে করে। কোনো এলাকার স্থানীয় অধিবাসীদের সেই এলাকার নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করার থেকে বাতিল চিন্তা আর কী হতে পারে? তবু তা হয়েছে অপশাসনের জন্য, নিয়ন্ত্রণ করার উদগ্র বাসনার জন্য। একটি জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু করে দেওয়ার ফল দুটি। প্রথমত, সংখ্যা কম হওয়ার কারণেই তাদের দমিয়ে রাখা যাবে; দ্বিতীয়ত, বহিরাগত লোকজন নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই পাহাড়িদের বিরুদ্ধে কায়েমি শক্তিকে সমর্থন করবে। এই বহিরাগত বাঙালিদের কার্যত সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে, অঞ্চলটিকে ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন করার জন্য।
সমতলে বাংলাদেশের নাগরিকেরা কখনো সেনাশাসন মেনে নেয়নি। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে গত কয়েক দশক ধরে কার্যত সেটাই চলছে। ‘অপারেশন দাবানলের’ জায়গায় এসেছে ‘অপারেশন উত্তরণ’। অশান্তি জিইয়ে রাখলে সেই সেনা-কর্তৃত্ব জায়েজ করা যায়। বাজেটের কত অংশ সেই সেনা-কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ব্যয় হয়, তা কোনো সরকারই প্রকাশ করে না। স্পষ্টত, গরিব বাঙালির করের টাকা ব্যয় হয় গরিব পাহাড়িকে বন্দুকের নলের মুখে শাসন করার জন্য।
পাহাড়ে এই সেনা-কর্তৃত্বের সবচেয়ে বড় সমর্থক বিএনপি-জামায়াত জোট। তাদের যুক্তি, সেনা-উপস্থিতি না থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন হয়ে যাবে। অথচ তারা তাদের ভূমির হক দাবি করেছে, স্বাধীনতা নয়। তাই জুজুর ভয় দেখানোয় কারও দলীয় স্বার্থ অর্জিত হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের এতে কোনো ফায়দা নেই। পিতৃপুরুষের জমি ও বসতভিটা দখলের হাত থেকে ফেরত চাওয়া যদি ‘স্বাধীনতা’ দাবি হয়, তাহলে অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে করা আদালতের সব মামলাকেই তো স্বাধীনতার ষড়যন্ত্র বলতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে জমিই শান্তির ওপর নাম। পাহাড়িদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা গেলে পাহাড়ি-বাঙালির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথে আর বাধা থাকার কথা নয়।
রাষ্ট্র একচোখা হতে পারে না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী সব নাগরিকই এই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সদস্য। সেই অর্থে বাংলাদেশ বাঙালি বা বাংলাদেশিদের রাষ্ট্র নয়, রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত এই ভূখণ্ডের সব মানুষের রাষ্ট্র। এবং এই রাষ্ট্রের অধীনে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালিকে পাহাড়ি বা পাহাড়িকে বাঙালি হওয়ার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন প্রত্যেককে সমানাধিকার দেওয়ার। বাঙালি ও পাহাড়ির ভাগ্য এক সূত্রেই গাঁথা। তাই বাঙালিদের জন্য এক আইন আর পাহাড়িদের জন্য আরেক আইন চলা মানে তো পাহাড়িদের ভাবতে বাধ্য করা যে, রাষ্ট্র তাদেরকে সমান চোখে দেখে না। বরং পাহাড়ি আন্দোলনকারীরাই রাষ্ট্রের কাছে অধিকার দাবি করার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করতে বলছে। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে বিদ্রোহীরা কার্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্র, সংবিধান ও সরকারের আনুগত্যই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সেই চুক্তি বাস্তবায়ন না করার অর্থ, তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করা। তাদের আবার অশান্তির দিকে ঠেলে দেওয়া। সেই কাজে ইন্ধন জোগানোর লোকের অভাব নেই। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন কেন সেই উসকানিতে মাতলেন? গত মঙ্গলবার তিনি বলেছেন, ‘প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা মোতায়েনের কথা ভাববে সরকার।’ (প্রথম আলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি)
পার্বত্য চট্টগ্রামে কি ইতিমধ্যে বাড়তি সেনা মোতায়েন করা নেই? অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে ঠিক এ কথা বলানোর জন্যই কি বাঘাইহাটে বন্দুকের নল উন্মুক্ত করা হয়েছিল? যারা তা করেছে, তাদের হয়তো জানা ছিল, পাহাড়িরা এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠবে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গড়াবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান ব্যর্থতা বা অর্জন হচ্ছে, রাজনৈতিক সমস্যাকে গায়ের জোরে সামরিক সমস্যায় পরিণত করা। পার্বত্য জনগোষ্ঠীর পক্ষে জনসংহতি সমিতি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সামরিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান আসে। এখন পর্যন্ত এটাই সমাধানের শ্রেষ্ঠ পথ। কিন্তু বাঘাইছড়ির ঘটনা, বিএনপির সেনা মোতায়েনের দাবি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তাতে সায় দেওয়া গরম বক্তব্যে মনে হচ্ছে, আবারও রাজনীতি পিছু হটবে এবং বল প্রয়োগের পথ জায়গা করে নেবে। যারা এই চেষ্টা করছে, তাদের কাছে মানুষ স্বার্থান্বেষী খেলার হাতিয়ার মাত্র। মানুষ মারতে বা মরা মানুষ নিয়ে রাজনীতি করতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। নতুন করে সেনা মোতায়েনের এই চিকন বুদ্ধিটি যদি সরকারের আপন মস্তিষ্ক থেকে এসে থাকে, তাহলে বলতে হয় যে তারা ভুল পথের উসকানির মধ্যে আছে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ সরকারই পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছিল, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক পথেই হওয়া সম্ভব। এবং সময়সাপেক্ষ হলেও সেই সমাধানের জমিন তৈরি হচ্ছিল। শান্তিবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করেছিল এবং তারা ফিরে এসেছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে। তারপর প্রয়োজন ছিল পার্বত্য চুক্তির ফসল ভূমি কমিশনের মাধ্যমে জমির বিবাদ মিটিয়ে ফেলা। যার জমি তার কাছে ফেরত দেওয়ার পরে বাঙালি ও পাহাড়ির বাদবাকি বিষয়ের মীমাংসা সহজেই সম্ভব। তাই ভূমি কমিশনকে অকার্যকর রেখে অস্ত্রকে কার্যকর করা রাষ্ট্র, সরকার ও বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য আত্মঘাতী।
জাত বিচার করা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাজ নয়। এই জাত বিচার করতে গিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্র ’৪৭ থেকে বর্তমান অবধি ডুবছে। জাতিগত দ্বন্দ্ব ভারতের বিরাট এলাকাকে অশান্ত করে রেখেছে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম করা বাংলাদেশ, সব ভাষার সমান অধিকার দাবি করা বায়ান্নর বাংলাদেশ যেন সেই ভুল আর না করে। এই রাষ্ট্রের সব নাগরিক এক ভেলাতেই ভাসছে, ভেলার একাংশ ফুটো হলে বাকি অংশ নিরাপদ থাকবে—এমন ভাবনা আহাম্মকির নামান্তর।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক
farukwasif@yahoo.com
মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হয়েছে, পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টির পেছনে ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। যথারীতি বিএনপিও হাঁক দিয়েছে, পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহার করে ভুল করেছে সরকার। খুবই মূল্যবান দুটি চিন্তা। কিন্তু গত রোববারের প্রথম আলোর সংবাদ বলছে, ‘রাঙামাটির পুলিশ সুপার মাসুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ভূমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে সেনাবাহিনী ও আদিবাসীদের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে।’ তাঁর এ বক্তব্যেই স্পষ্ট, গুলি কারা ছুড়েছে এবং কারা তাতে নিহত হয়েছে। তাই বিরোধী দলের কাছে প্রশ্ন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যদি সেনা প্রত্যাহার হয়েই থাকে, তাহলে ঘটনার সময় তারা এল এবং গুলিগোলা ছুড়ে পাহাড়িদের তাড়িয়ে দিল কোন জাদুবলে? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বেশ কিছু অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের দাবি করা হয়েছে। তার পরও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সেনা সেখানে ঠিকই অবস্থান করছে। বাঘাইহাটের সেদিনের রক্তাক্ত ঘটনায় তাদেরই জড়িত হতে দেখা গেছে। তাই সরকার অন্ধকারে ষড়যন্ত্রকারীদের কালো হাত খুঁজলে খুঁজতে পারে, কিন্তু ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে যারা জড়িত, তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে তা দায় এড়ানোর ছল বলে মনে হবে। নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ভালো কথা, কিন্তু জীবনের কোনো দাম হয় না। বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানুষের শোক ও ক্ষোভের একমাত্র সান্ত্বনা হলো ন্যায়বিচার।
বহু বছর ধরে পার্বত্যবাসী ন্যায়বিচার চেয়ে আসছে। রাজধানী ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে স্থানীয় অধিবাসীদের জোত-জমি ও জীবনের লাগাম অন্য জেলা থেকে আসা লোকেরা নিতে পেরেছে। এ রকম কিছু হলে সেখানে হুলস্থুল লেগে যেত, ‘বহিরাগত তাড়াও’ আন্দোলন হতো। কিন্তু পাহাড়িরা এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যেই প্রায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা ছিল মোট জনসংখ্যার নয় শতাংশ। ১৯৯১ সালের হিসাবে বান্দরবানে বাঙালিরা ছিল ৫২ শতাংশ, খাগড়াছড়িতে ৫১ শতাংশ এবং রাঙামাটিতে ৪৪ শতাংশ। অভিযোগ রয়েছে, এই হিসাবেও বাঙালিদের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে। বাস্তবে বর্তমানে বাঙালিরা পাহাড়িদের জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে চলে গেছে। এটা করা হয়েছে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমল থেকে। দেশের নানা এলাকার গরিব ভূমিহীনদের প্রশাসনিকভাবে ধরে এনে এনে পার্বত্য জেলাগুলোতে বসত করানো হয়েছে।
এভাবে স্থানীয় জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের জমিতে বাইরে থেকে লোক এনে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার চেষ্টা এখনো চলছে। ভূমিহীনদের প্রতি কোনো রকম দরদ বা দায়িত্ব থেকে এটা করা হয়নি। তা যদি হতো, তাহলে সারা দেশে ভূমিদস্যুদের হাতে চলে যাওয়া জমিতেই ভূমিহীনদের আবাসন দেওয়া যেত। এটা করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা-সমস্যা মনে করে। কোনো এলাকার স্থানীয় অধিবাসীদের সেই এলাকার নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করার থেকে বাতিল চিন্তা আর কী হতে পারে? তবু তা হয়েছে অপশাসনের জন্য, নিয়ন্ত্রণ করার উদগ্র বাসনার জন্য। একটি জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু করে দেওয়ার ফল দুটি। প্রথমত, সংখ্যা কম হওয়ার কারণেই তাদের দমিয়ে রাখা যাবে; দ্বিতীয়ত, বহিরাগত লোকজন নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই পাহাড়িদের বিরুদ্ধে কায়েমি শক্তিকে সমর্থন করবে। এই বহিরাগত বাঙালিদের কার্যত সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে, অঞ্চলটিকে ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন করার জন্য।
সমতলে বাংলাদেশের নাগরিকেরা কখনো সেনাশাসন মেনে নেয়নি। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে গত কয়েক দশক ধরে কার্যত সেটাই চলছে। ‘অপারেশন দাবানলের’ জায়গায় এসেছে ‘অপারেশন উত্তরণ’। অশান্তি জিইয়ে রাখলে সেই সেনা-কর্তৃত্ব জায়েজ করা যায়। বাজেটের কত অংশ সেই সেনা-কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ব্যয় হয়, তা কোনো সরকারই প্রকাশ করে না। স্পষ্টত, গরিব বাঙালির করের টাকা ব্যয় হয় গরিব পাহাড়িকে বন্দুকের নলের মুখে শাসন করার জন্য।
পাহাড়ে এই সেনা-কর্তৃত্বের সবচেয়ে বড় সমর্থক বিএনপি-জামায়াত জোট। তাদের যুক্তি, সেনা-উপস্থিতি না থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন হয়ে যাবে। অথচ তারা তাদের ভূমির হক দাবি করেছে, স্বাধীনতা নয়। তাই জুজুর ভয় দেখানোয় কারও দলীয় স্বার্থ অর্জিত হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের এতে কোনো ফায়দা নেই। পিতৃপুরুষের জমি ও বসতভিটা দখলের হাত থেকে ফেরত চাওয়া যদি ‘স্বাধীনতা’ দাবি হয়, তাহলে অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে করা আদালতের সব মামলাকেই তো স্বাধীনতার ষড়যন্ত্র বলতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে জমিই শান্তির ওপর নাম। পাহাড়িদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা গেলে পাহাড়ি-বাঙালির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথে আর বাধা থাকার কথা নয়।
রাষ্ট্র একচোখা হতে পারে না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী সব নাগরিকই এই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সদস্য। সেই অর্থে বাংলাদেশ বাঙালি বা বাংলাদেশিদের রাষ্ট্র নয়, রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত এই ভূখণ্ডের সব মানুষের রাষ্ট্র। এবং এই রাষ্ট্রের অধীনে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালিকে পাহাড়ি বা পাহাড়িকে বাঙালি হওয়ার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন প্রত্যেককে সমানাধিকার দেওয়ার। বাঙালি ও পাহাড়ির ভাগ্য এক সূত্রেই গাঁথা। তাই বাঙালিদের জন্য এক আইন আর পাহাড়িদের জন্য আরেক আইন চলা মানে তো পাহাড়িদের ভাবতে বাধ্য করা যে, রাষ্ট্র তাদেরকে সমান চোখে দেখে না। বরং পাহাড়ি আন্দোলনকারীরাই রাষ্ট্রের কাছে অধিকার দাবি করার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করতে বলছে। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে বিদ্রোহীরা কার্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্র, সংবিধান ও সরকারের আনুগত্যই মেনে নিয়েছে। কিন্তু সেই চুক্তি বাস্তবায়ন না করার অর্থ, তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করা। তাদের আবার অশান্তির দিকে ঠেলে দেওয়া। সেই কাজে ইন্ধন জোগানোর লোকের অভাব নেই। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন কেন সেই উসকানিতে মাতলেন? গত মঙ্গলবার তিনি বলেছেন, ‘প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা মোতায়েনের কথা ভাববে সরকার।’ (প্রথম আলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি)
পার্বত্য চট্টগ্রামে কি ইতিমধ্যে বাড়তি সেনা মোতায়েন করা নেই? অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে ঠিক এ কথা বলানোর জন্যই কি বাঘাইহাটে বন্দুকের নল উন্মুক্ত করা হয়েছিল? যারা তা করেছে, তাদের হয়তো জানা ছিল, পাহাড়িরা এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠবে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গড়াবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান ব্যর্থতা বা অর্জন হচ্ছে, রাজনৈতিক সমস্যাকে গায়ের জোরে সামরিক সমস্যায় পরিণত করা। পার্বত্য জনগোষ্ঠীর পক্ষে জনসংহতি সমিতি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সামরিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান আসে। এখন পর্যন্ত এটাই সমাধানের শ্রেষ্ঠ পথ। কিন্তু বাঘাইছড়ির ঘটনা, বিএনপির সেনা মোতায়েনের দাবি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তাতে সায় দেওয়া গরম বক্তব্যে মনে হচ্ছে, আবারও রাজনীতি পিছু হটবে এবং বল প্রয়োগের পথ জায়গা করে নেবে। যারা এই চেষ্টা করছে, তাদের কাছে মানুষ স্বার্থান্বেষী খেলার হাতিয়ার মাত্র। মানুষ মারতে বা মরা মানুষ নিয়ে রাজনীতি করতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। নতুন করে সেনা মোতায়েনের এই চিকন বুদ্ধিটি যদি সরকারের আপন মস্তিষ্ক থেকে এসে থাকে, তাহলে বলতে হয় যে তারা ভুল পথের উসকানির মধ্যে আছে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ সরকারই পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেছিল, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক পথেই হওয়া সম্ভব। এবং সময়সাপেক্ষ হলেও সেই সমাধানের জমিন তৈরি হচ্ছিল। শান্তিবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করেছিল এবং তারা ফিরে এসেছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে। তারপর প্রয়োজন ছিল পার্বত্য চুক্তির ফসল ভূমি কমিশনের মাধ্যমে জমির বিবাদ মিটিয়ে ফেলা। যার জমি তার কাছে ফেরত দেওয়ার পরে বাঙালি ও পাহাড়ির বাদবাকি বিষয়ের মীমাংসা সহজেই সম্ভব। তাই ভূমি কমিশনকে অকার্যকর রেখে অস্ত্রকে কার্যকর করা রাষ্ট্র, সরকার ও বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের জন্য আত্মঘাতী।
জাত বিচার করা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাজ নয়। এই জাত বিচার করতে গিয়েই পাকিস্তান রাষ্ট্র ’৪৭ থেকে বর্তমান অবধি ডুবছে। জাতিগত দ্বন্দ্ব ভারতের বিরাট এলাকাকে অশান্ত করে রেখেছে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম করা বাংলাদেশ, সব ভাষার সমান অধিকার দাবি করা বায়ান্নর বাংলাদেশ যেন সেই ভুল আর না করে। এই রাষ্ট্রের সব নাগরিক এক ভেলাতেই ভাসছে, ভেলার একাংশ ফুটো হলে বাকি অংশ নিরাপদ থাকবে—এমন ভাবনা আহাম্মকির নামান্তর।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক
farukwasif@yahoo.com
No comments