চারদিক-তিন পাগলে হলো মেলা... by আজাদুর রহমান
দোলপূর্ণিমার খোলা জোছনায় লালন শিষ্যদের নিয়ে মচ্ছব করতেন। সেই ধারা মেনেই ফাগুনের জোছনায় মরাগাঙের পাড়ে সাধুদের বাজার বসেছে। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার বাউল যোগ দিয়েছেন পূর্ণিমা উৎসবে। ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এ মেলা চলবে টানা পাঁচ দিন।
বাউলেরা দেশময় ছড়িয়ে থাকলেও তাদের মন পড়ে থাকে লালনের বারামখানায়। বছরে দুটো বড় আয়োজন ছাড়াও সুযোগ পেলেই নানা ছুতো তুলে বাউলেরা চলে আসেন তাঁদের মনতীর্থে। সংখ্যাতীত ভক্ত-অনুরাগী, আউল-বাউল সাধু-বৈষ্ণব আর ফকির-দেওয়ানাদের পদচারণে ক্রমেই আরও ভারী হয়ে যাচ্ছে আখড়াবাড়ি। অঞ্চলগত বাউলেরা একতারা, দোতারা, ঢোলখোল, হারমনি, বাঁশি, জোয়ারি, চাকতি, খমক হাতে যে যার মতো শামিয়ানা তুলে মজমা দিয়েছে। ভাবজগতের মধ্যে বেজে উঠেছে, ‘তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে’। এ যেন কুষ্টিয়া নয়, সে সময়ের নদীয়ায় বুঝি জমে গেছে পাগলের মেলা! লালনবাড়ির বাউলদের আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। দূরাগত বাউলদের বোহেমিয়ান স্রোতে তাঁরাও মিলেমিশে একাকার। অন্য সময়ও আখড়ার বাউলরা যে কারও নজরে আসে তাও না। গান শুনিয়ে দর্শনার্থীরা দয়া করে যা দেয় তাই দিয়ে সারা বছর কোনোমতে টিকে থাকে লালনবাড়ির বাউলসমাজ। রবীন্দ্রনাথ যেন যথার্থই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, ‘...তাঁরা (বাউলরা) গরীব। পোষাক-পরিচ্ছদ নাই। দেখলে বোঝবার জো নাই তারা কত মহত্। কিন্তু কত গভীর বিষয় কত সহজভাবে তারা বলতে পারত।’
সত্যিই তাই, জীবনের নিগূঢ় কথাগুলো দরিদ্র বাউলেরা সহজেই বলে যেতে পারেন। পুরোনো বাউল ফকির বজলু শাহের কথাই ধরা যাক। গত ৪০ বছর ধরে তিনি আখড়াতেই আছেন। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের আলাপ-পরিচয়। একান্ত নিরিবিলিতে বসে শোনা যায় তাঁর নিগূঢ় কথা। সেসব স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা এবং আলাপচারিতায় উঠে আসেন সহজ মানুষ ফকির বজলুশাহ্।
মাঝবয়সী মাঝারি গড়নের এই বাউলের জন্ম ছেঁউড়িয়ার কারিকরপাড়ায়। বয়স ৫৬। পড়াশোনা পঞ্চম শ্রেণী। কম ঝুলের সাদা পাঞ্জাবি গায়ে বজলু শাহ্ একতারা হাতে অগ্রগামী ভঙ্গিমায় গান করেন। গান শুধুই গান নয়, তাঁর কাছে গান হলো জ্ঞান।
পাবলিক ফার্মে কিছু দিন চাকরি করেছিলেন। তার আগে পাকিস্তান আমলে ঘেটো যাত্রাদল করতেন। সে সময় যাত্রাদলে মেয়েরা তেমন আসত না বলে নিজেই অনেক সময় পুরুষ চরিত্রের পাশাপাশি মহিলাদের চরিত্রে অভিনয় করতেন। রাজকুমার, সাগরভাসা, বেদের মেয়ে জোছনার তারাসহ নানাবিধ চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে তাঁকে। যাত্রা করতে গিয়ে গান শেখার শুরু। ফকির মোকসেদ আলী শাহ্ এবং গফুর শাহের কাছে পুরোদমে চর্চা করেন লালনের গান। একদিন ফকির খোদা বকস্ শাহের গান শুনে বজলু উন্মাদ হয়ে গেলেন। গানে গানে ভেসে গেলেন বজলু শাহ্। খোদা বকসেক অনুরোধ করলেন, ‘গুরু আমাকে মানুষ করুন।’ এরপর দীর্ঘ ২০ বছর তাঁর সঙ্গে ছিলেন। খোদা বকসের কাছেই তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা। তিনিই তাঁর গুরু। গুরুভক্তির বিষয়ে বজলু শাহের কথা হলো—
‘আমার উনিই তো সব
দাতাগত ঋণ
বাড়িগত মিন
গুরু শিষ্য মিল
থাকে চিরদিন
তাদের নাই ভেদাভেদ
পুরায় মনের খেদ
বিচ্ছেদ কখনো থাকে না।’
বজলুর মতে, বাউলের কোনো গ্রন্থ নেই। বাউল একটা টাইটেল। যারা সন্ধানে চলেন তারাই বাউল। লালনের গানের মধ্যে কোথাও বাউল লালন এমন সম্বোধন পাওয়া যায় না। সবখানে ফকির লালন এবং দরবেশ সিরাজ সাঁই। লালনধর্ম মূলত মানুষতত্ত্ব ফকিরিধর্ম আর ফকিরের দর্শন হলো নিষ্কাম ভজনা। লালনের ভাষায় আত্মতত্ত্বই পরমতত্ত্ব। নিজের সঙ্গে যার নিজের দর্শন হয়, তিনিই তো অমৃত জ্ঞান লাভ করলেন আর যিনি আত্মতত্ত্বে ফাজিল পাস করলেন তিনিই জানেন সাঁইয়ের নিগূঢ় কারখানা। সাঁই মানে সেই নূরেই দুনিয়া—আমি, আদম সব। সহজ মোমিন মানুষের কলবেই বাস করেন দয়াময়। যখন দুই রূপ এক রূপ হবে তখন চেনা যাবে আপনারে। দুই রূপ এক রূপ হলেই আত্মসিদ্ধি হয়।
‘আমি কে তাই জানলে পারে
সাধন সিদ্ধি হয়।
আমি কথার অর্থভারী
আমাতে সে আমি নয়।।’
মানুষের মধ্যেই বিরাজ করেন আমার দয়াময়। সাধু জনমটা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। পূর্বসুকৃতির পাওনা না থাকলে সাধু হওয়া যায় না। সাধু হওয়া এক জনমের কাজ নয়—
‘থাকিলে পূর্ব সুকৃতি
দেখিতে শুনিতে হয় গুরুপদে মতি।’
বজলু বিশ্বাস করেন, ‘সাধুবৃত্তি করার জন্য গৃহত্যাগের প্রয়োজন নেই, বরং ভোগের মধ্যে যাঁরা ত্যাগী তাঁরাই পরম বৈষ্ণব। আল্লাহই তো বলেন, আমি তোমার নফসের ভিতরে আছি, তুমি আমাকে দেখতে পাও না?’
বজলু শাহ্ সংসার করেছেন এবং সাধুও হয়েছেন। তাঁর ভাষায়, আমি তো পরম শান্তিতে আছি। অনেকটা খেয়ে না খেয়ে সংসার চলে তাঁর। তবু মুখে-চোখে কোনো দুঃখ নেই। পঞ্চভূতে আবির্ভূত দেহটা, দেহের ভেতরে রুহুটা সময় হলেই উড়ে যাবে। তাই আশঙ্কা নেই তাঁর, বরং ফকির বজলু শাহ্ গান ধরেন—
‘খাঁচা ফেলে পাখি আমার
কোন বনে পালায়।’
সন্ধ্যা নামে পঞ্চভূতে আবির্ভূত আমাদের দেহগুলো অন্ধকারে হারিয়ে যায়। বজলু আর আমি মুখোমুখি বসে থাকি। তারপর জোছনা গভীর হয়ে আসে। মঞ্চ থেকে ভেসে আসে সমস্বর—
‘এলাহি আল মিনগো আল্লাহ বাদশা আলমপানা তুমি।
ডুবাইয়ে ভাসাইতে পার, ভাসাইয়ে কিনার দাও কারও...’
সত্যিই তাই, জীবনের নিগূঢ় কথাগুলো দরিদ্র বাউলেরা সহজেই বলে যেতে পারেন। পুরোনো বাউল ফকির বজলু শাহের কথাই ধরা যাক। গত ৪০ বছর ধরে তিনি আখড়াতেই আছেন। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের আলাপ-পরিচয়। একান্ত নিরিবিলিতে বসে শোনা যায় তাঁর নিগূঢ় কথা। সেসব স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা এবং আলাপচারিতায় উঠে আসেন সহজ মানুষ ফকির বজলুশাহ্।
মাঝবয়সী মাঝারি গড়নের এই বাউলের জন্ম ছেঁউড়িয়ার কারিকরপাড়ায়। বয়স ৫৬। পড়াশোনা পঞ্চম শ্রেণী। কম ঝুলের সাদা পাঞ্জাবি গায়ে বজলু শাহ্ একতারা হাতে অগ্রগামী ভঙ্গিমায় গান করেন। গান শুধুই গান নয়, তাঁর কাছে গান হলো জ্ঞান।
পাবলিক ফার্মে কিছু দিন চাকরি করেছিলেন। তার আগে পাকিস্তান আমলে ঘেটো যাত্রাদল করতেন। সে সময় যাত্রাদলে মেয়েরা তেমন আসত না বলে নিজেই অনেক সময় পুরুষ চরিত্রের পাশাপাশি মহিলাদের চরিত্রে অভিনয় করতেন। রাজকুমার, সাগরভাসা, বেদের মেয়ে জোছনার তারাসহ নানাবিধ চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে তাঁকে। যাত্রা করতে গিয়ে গান শেখার শুরু। ফকির মোকসেদ আলী শাহ্ এবং গফুর শাহের কাছে পুরোদমে চর্চা করেন লালনের গান। একদিন ফকির খোদা বকস্ শাহের গান শুনে বজলু উন্মাদ হয়ে গেলেন। গানে গানে ভেসে গেলেন বজলু শাহ্। খোদা বকসেক অনুরোধ করলেন, ‘গুরু আমাকে মানুষ করুন।’ এরপর দীর্ঘ ২০ বছর তাঁর সঙ্গে ছিলেন। খোদা বকসের কাছেই তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা। তিনিই তাঁর গুরু। গুরুভক্তির বিষয়ে বজলু শাহের কথা হলো—
‘আমার উনিই তো সব
দাতাগত ঋণ
বাড়িগত মিন
গুরু শিষ্য মিল
থাকে চিরদিন
তাদের নাই ভেদাভেদ
পুরায় মনের খেদ
বিচ্ছেদ কখনো থাকে না।’
বজলুর মতে, বাউলের কোনো গ্রন্থ নেই। বাউল একটা টাইটেল। যারা সন্ধানে চলেন তারাই বাউল। লালনের গানের মধ্যে কোথাও বাউল লালন এমন সম্বোধন পাওয়া যায় না। সবখানে ফকির লালন এবং দরবেশ সিরাজ সাঁই। লালনধর্ম মূলত মানুষতত্ত্ব ফকিরিধর্ম আর ফকিরের দর্শন হলো নিষ্কাম ভজনা। লালনের ভাষায় আত্মতত্ত্বই পরমতত্ত্ব। নিজের সঙ্গে যার নিজের দর্শন হয়, তিনিই তো অমৃত জ্ঞান লাভ করলেন আর যিনি আত্মতত্ত্বে ফাজিল পাস করলেন তিনিই জানেন সাঁইয়ের নিগূঢ় কারখানা। সাঁই মানে সেই নূরেই দুনিয়া—আমি, আদম সব। সহজ মোমিন মানুষের কলবেই বাস করেন দয়াময়। যখন দুই রূপ এক রূপ হবে তখন চেনা যাবে আপনারে। দুই রূপ এক রূপ হলেই আত্মসিদ্ধি হয়।
‘আমি কে তাই জানলে পারে
সাধন সিদ্ধি হয়।
আমি কথার অর্থভারী
আমাতে সে আমি নয়।।’
মানুষের মধ্যেই বিরাজ করেন আমার দয়াময়। সাধু জনমটা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। পূর্বসুকৃতির পাওনা না থাকলে সাধু হওয়া যায় না। সাধু হওয়া এক জনমের কাজ নয়—
‘থাকিলে পূর্ব সুকৃতি
দেখিতে শুনিতে হয় গুরুপদে মতি।’
বজলু বিশ্বাস করেন, ‘সাধুবৃত্তি করার জন্য গৃহত্যাগের প্রয়োজন নেই, বরং ভোগের মধ্যে যাঁরা ত্যাগী তাঁরাই পরম বৈষ্ণব। আল্লাহই তো বলেন, আমি তোমার নফসের ভিতরে আছি, তুমি আমাকে দেখতে পাও না?’
বজলু শাহ্ সংসার করেছেন এবং সাধুও হয়েছেন। তাঁর ভাষায়, আমি তো পরম শান্তিতে আছি। অনেকটা খেয়ে না খেয়ে সংসার চলে তাঁর। তবু মুখে-চোখে কোনো দুঃখ নেই। পঞ্চভূতে আবির্ভূত দেহটা, দেহের ভেতরে রুহুটা সময় হলেই উড়ে যাবে। তাই আশঙ্কা নেই তাঁর, বরং ফকির বজলু শাহ্ গান ধরেন—
‘খাঁচা ফেলে পাখি আমার
কোন বনে পালায়।’
সন্ধ্যা নামে পঞ্চভূতে আবির্ভূত আমাদের দেহগুলো অন্ধকারে হারিয়ে যায়। বজলু আর আমি মুখোমুখি বসে থাকি। তারপর জোছনা গভীর হয়ে আসে। মঞ্চ থেকে ভেসে আসে সমস্বর—
‘এলাহি আল মিনগো আল্লাহ বাদশা আলমপানা তুমি।
ডুবাইয়ে ভাসাইতে পার, ভাসাইয়ে কিনার দাও কারও...’
No comments