রাজনীতি-তারেক বিএনপির পর এখন পবন বিএনপি? by সোহরাব হাসান

সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সজীব ওয়াজেদ জয়ের আওয়ামী লীগের সদস্যপদ গ্রহণকে স্বাগত জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, শিক্ষিত ও ভদ্রলোক সজীবের আওয়ামী লীগে যোগদানের ফলে দলটির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার


বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো—বিরোধী দলে থাকতে নেতারা সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যান, মনে হয় তাঁরা ভাজা মাছটি উল্টে খেতেও জানেন না। আর ক্ষমতায় থাকতে তাঁরা আইনকানুন, নিয়ম-রীতির তোয়াক্কা করেন না। দেশটাকে মনে করেন বাপ-দাদার তালুক।
নজরুল ইসলাম খান রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলের যে কথা বলেছেন, তার সঙ্গে দ্বিমত করার উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন—ক্ষমতায় থাকতে তাঁদের এ চৈতন্যোদয় হয় নি কেন? এখন তিনি সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছে যে শুভবোধ ও সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি আশা করছেন, বিএনপির কাছেও সেটি প্রত্যাশিত ছিল। তখন বিএনপির চালকের আসনে ছিলেন তারেক রহমান। দুর্মুখরা বলেন, এখনো আছেন। লন্ডন থেকে তাঁর আদেশ-নির্দেশেই দলীয় কার্যক্রম চলছে। তারেক রহমান যখন রাজনীতিতে আসেন, সবাই হূষ্টচিত্তে স্বাগত জানিয়েছিলেন। নতুন প্রজন্মের নেতা হিসেবে তাঁর কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশাও ছিল অনেক। তার এক শতাংশ পূরণ হলেও হয়তো ১/১১-এর ঘটনা ঘটত না।
রাজনীতিতে সজীব ওয়াজেদ জয়ের আগমন অনেকটা নীরবে হলেও তারেক রহমান এসেছিলেন মহা শোরগোল তুলে। তিনি ব্যাপকসংখ্যক তরুণকে দলে টানতে পেরেছিলেন। বিশুদ্ধ বাংলায় তিনি বক্তৃতা করতেন, যা আমাদের অনেক রাজনীতিকই পারেন না। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির বিপুল বিজয়ের পেছনেও তারেক রহমানের অবদান ছিল সব চেয়ে বেশি।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমরা কী দেখলাম? নির্বাচন শেষ না হতেই বিধ্বস্ত ও বিপন্ন বিরোধী দলের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিজয়ী দলের ক্যাডাররা। গ্রামের পর গ্রাম সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে তারা। অনেক মা-বোন লাঞ্ছিত হলেন, সম্ভ্রম হারালেন। প্রাণ বাঁচাতে অনেকে আশ্রয় নিলেন উদবাস্তুশিবিরে। কেউ কেউ দেশত্যাগী হলেন। ১৯৭১ সালের পর দেশজুড়ে এ রকম বিভীষিকাময় পরিস্থিতি আর ঘটেনি। কিন্তু ক্ষমতার মোহে অন্ধ বিএনপির নেতা এবং তাঁদের অনুগত বুদ্ধিজীবীদের বিবেক তখন তালাবদ্ধ ছিল। এক পর্যায়ে বিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে বিএনপি নেতারা হাত মেলালেন হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি, বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান, মুফতি হান্নানদের সঙ্গে। রাজশাহীতে কার্যত গড়ে তোলা হলো জেএমবির মুক্তাঞ্চল; কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে এসে নির্যাতন করা হলো আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের। মানুষ মেরে লাশ গাছে লটকে রাখা হল।
খেলা এখানেই শেষ নয়। মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ তাদের টার্গেট হলেন। আক্রান্ত হলেন শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ। যখন রাজশাহী অঞ্চলে বাংলা ভাইয়ের ত্রাসের রাজত্ব চলছে তখনো জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী বললেন, বাংলা ভাই বলে কেউ নেই, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি। গ্রেনেড হামলা করে হত্যা করা হলো শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে। জিঘাংসার বলি হলেন আহসানউল্লাহ মাস্টার, মনজুরুল ইমামসহ অসংখ্য নেতাকর্মী । ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার প্রধান টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা, তিনি বেঁচে গেলেও নিহত হন ২২ জন নেতা-কর্মী। প্রতিটি ক্ষেত্রে দোষ চাপানো হলো বিরোধী দলের ওপর। দেশে একটি আইনানুগ সরকার থাকতে কীভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটল? কিভাবে জঙ্গিদের উত্থান ঘটল? কারা ঘটাল? বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত সংঘর্ষ আগেও ছিল। কিন্তু প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে এভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডর চালিয়ে তাদের রাজনীতি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ঘটনা আর ঘটেনি। কে ছিলেন এর মাস্টারমাইন্ড? আমরা জানি না। তবে এ কথা জানি, ২০০১-২০০৬ সালে বাংলাদেশে সবকিছুই চলত বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানের নির্দেশে। মন্ত্রী-নেতারা ছিলেন বহিরাবরণ মাত্র। কোনো সরকারি পদে না থেকেও তিনি ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যেমন বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়, তেমনি মন্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতাবান ছিলেন তার আর্শীবাদপুষ্ট প্রতিমন্ত্রীরা। তারেকের একজন প্রিয় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন লুত্ফুজ্জামান বাবর, যৌথ জিজ্ঞাসাবাদে যিনি মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তাকে একবার বহিষ্কার করে আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্য কি তার মুখ বন্ধ করা? লন্ডনে চিকিত্সা শেষে সুস্থ হয়ে তারেক রহমান রাজনীতিতে ফিরে আসুন, কারো আপত্তি নেই। কিন্তু এ সব প্রশ্নের উত্তর তাকে দিতে হবে। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ- মামলা আছে, তার ন্যায়সঙ্গত নিষ্পত্তিই চায় দেশবাসী। আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। আইনের উর্ধে কেউ নন। তারেক রহমান রাজনীতি করেন বলে সাতখুন মাফ পেয়ে যাবে কিংবা অযথা হয়রানির শিকার হবেন তা হতে পারে না।

২.
জিয়ার বিএনপির সঙ্গে খালেদা জিয়ার বিএনপির পার্থক্য আছে। পার্থক্য আছে খালেদা জিয়ার বিএনপির সঙ্গে তারেক জিয়ার বিএনপিরও। জিয়াউর রহমান দল করেছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় বিভিন্ন সংগঠন থেকে লোক ভাগিয়ে নিয়ে। অন্যদিকে খালেদা জিয়াকে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি সুদৃঢ় করেছিলেন, দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা এরশাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার পরও। তারেক জিয়া এসে সেই সাজানো দলকে তছনছ করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারও বিএনপির যে ক্ষতি করতে পারেনি তারেক জিয়া তার চেয়ে বেশি করেছেন।
বিএনপি নেতাদের দাবি, সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ২১ আগস্টের বোমা হামলার সঙ্গে তারেক রহমানকে জড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এর সমর্থনে তাঁদের হাতে কি যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে? থাকলে তা প্রকাশ করছেন না কেন? তাঁদের বলতে হবে, গ্রেনেড হামলার মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন কারা? গোয়েন্দা কর্মকর্তারা কাদের নির্দেশে জজ মিয়া কাহিনী সাজিয়েছেন? তাঁদের এটাও বলতে হবে, সরকারের একজন উপমন্ত্রীর (আবদুস সালাম পিন্টু) বাড়িতে ঘাতকদের বৈঠক করার খবর সত্য কি না? তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনের সঙ্গে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনের যোগসাজশ ছিল কি না?
বিএনপির আমলে সংঘটিত প্রতিটি হত্যা ও গ্রেনেড হামলার টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ, বামপন্থী কিংবা সাধারণ মানুষ। বিএনপির নেতাদের বলতে হবে, তখন সরকার ঘাতক-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল? তাঁদের বলতে হবে, শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার তদন্ত কারা ভিন্নখাতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন? জঙ্গিদের হাতে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ আক্রান্ত হওয়ার পর তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী কেন আওয়ামী লীগের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়েছিলেন? ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা হামলার পর অপরাধীদের আড়াল করতে কেন মুক্তবুদ্ধির লেখক-বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতার করা হয়েছিল? ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যতগুলো হত্যা ও বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা ছাড়া বিএনপির আমলে আর কোনোটির বিচার হয়নি। কারা মামলার তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া থামিয়ে রেখেছিল—সে সব প্রশ্নের জবাব বিএনপিকে দিতে হবে।
বিএনপির নেতারা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছে যে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি আশা করেন, একই রাজনৈতিক সংস্কৃতি তারেক রহমানের কাছেও প্রত্যাশিত। সুস্থতা ও সুরুচি এক পক্ষ থেকে এলে হবে না, উভয় পক্ষ থেকেই আসতে হবে। দেশবাসীও চায়, তরুণ নেতৃত্ব রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনবে।দেশবাসী চায়, একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি তার ভূমিকা পালন করুক। আর সে জন্যই তাকে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের পথ পরিহার করতে হবে। দল থেকে জঙ্গি, ঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিতাড়িত করতে হবে (দুর্নীতির বিষয়টি এখানে আনলাম না, কেননা দুই বড় দলেই চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ আছেন)।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির চেয়ারপারসন অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তাঁদের গত ১৪ মাসের কাজকর্মে ভুল শোধরানোর কোনো লক্ষণ নেই। বরং তাঁরা সেই পুরোনো ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব নিয়ে এগুচ্ছেন। বাংলাদেশে যাঁরাই নির্বাচনে হারেন, তাঁরা ষড়যন্ত্র খোঁজেন। আগে আওয়ামী লীগের নেতারা খুঁজেছেন, এখন খুঁজছেন বিএনপির নেতারা। এভাবে এক দল অন্য দলের ওপর একহাত নেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের কেউ সরকারে আর কেউ বিরোধী দলের আসনে বসেন। তাতে নেতাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও দেশ ও জনগণের দুর্ভোগ কমেনা।
বিএনপির নেতারা সরকারের কাছে বিরোধীদলীয় নেত্রীর নিরাপত্তা জোরদার করার দাবি জানিয়েছেন। আমরাও দৃঢ়ভাবে এই দাবিকে সমর্থন করি। শুধু বিরোধীদলীয় নেত্রী কেন, দেশের প্রতিটি নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ নেতারাও অনুরূপ দাবি জানিয়ে আসছিলেন এবং যথারীতি সরকার তা নাকচ করে দিয়েছিল।
এখন বিএনপি নেতারা বলছেন, তাঁরা ভুল করলে আওয়ামী লীগ তা সংশোধন করে নিতে পারে। কত আইনই তো সংশোধন করছেন। কোন প্রেক্ষাপটে বিএনপির চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা জোরদার করার দাবি উঠেছে তাও সবার জানা। তাঁর গুলশানের অফিসের সামনে একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয় সম্প্রতি। তড়িঘড়ি বিএনপির নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ মির্জা আজমকে দায়ী করেন। তিনি নাকি বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিসের সামনের রাস্তা দিয়ে কয়েকবার ঘোরাফেরা করেছেন। কিন্তু পুলিশ দাবি করছে, ঘটনার হোতা ছিলেন খোন্দকার দেলোয়ারের সুযোগ্য তনয় আবদুল হামিদ পবন। দলের নগর কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার জন্যই বন্ধুদের সহায়তায় তিনি এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। পুলিশের বক্তব্য সত্য হলে, বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব কোথায় গিয়ে পৌছেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মনে হচ্ছে বিএনপি এখন চতুর্থ প্রজন্মের নেতৃত্ব বরণ করতে যাচ্ছে। জিয়া থেকে খালেদা জিয়া; খালেদা জিয়া থেকে তারেক জিয়া। এখন আরও নবীন ও ‘সুদক্ষ’ প্রজন্মের সন্ধান পেয়েছে বিএনপি। তার নাম পবন-আলিম (প্রথম জন বিএনপি আমলে সন্ত্রাসের দায়ে আটক হয়ে এবং শেষোক্ত জন অধুনা ছাত্রদলের সভাপতিকে মেরে রক্তাক্ত করে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিলেন) প্রজন্ম।
এদের হাতে দেশ তো দূরের কথা, দলও যে নিরাপদ নয়, তা কি বিএনপির নেতারা অস্বীকার করতে পারবেন?
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.