ধর্ম-মাতৃভাষায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
মাতৃভাষা মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিরাট নিয়ামত ও বিশেষ দান। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির সেরা জীবরূপে মানুষ সৃষ্টি করে তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। জন্মগতভাবেই মানুষ তার মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। মানুষ যা বলে তা-ই ভাষা, যদ্দ্বারা পারস্পরিক মনোভাব প্রকাশিত হয়।
কারণ আল্লাহ পাক মানুষের জন্মের পর তাকে মাতৃভাষায় কথা বলতে শিখিয়েছেন। মহান স্রষ্টার অনেক বিস্ময়কর নিদর্শনার মধ্যে ভাষা একটি অন্যতম নিদর্শন। প্রকৃতপক্ষে ভাষা আল্লাহ তাআলার এক অপূর্ব সৃষ্টি। তাঁর সীমাহীন কুদরতের মধ্যে এটি একটি শ্রেষ্ঠ অবদান। আল্লাহর অপরিসীম কুদরত ভাষা ও বর্ণের অনন্য নিদর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা আর-রূম, আয়াত-২২)
জগতে বিচিত্র ধরনের অসংখ্য ভাষা রয়েছে। জগত্জুড়ে ভাষাবৈচিত্র্যের এই যে অপরূপ সমাহার, সেটা আল্লাহর মহান কুদরত। ভাষা মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম। একজন মানবসন্তান যে জনপদে জন্মগ্রহণ করে, যে পরিবেশ-প্রকৃতিতে বয়োপ্রাপ্ত হয়, যে মায়ের কোলে সে লালিত-পালিত হয়, সেই জনপদে লোকালয়ের মানুষের ভাষা, সেই পরিবেশের ভাষা, সেই মায়ের ভাষা তার আপন ভাষায় পরিণত হয়। ভূপৃষ্ঠে মানবজাতির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার উত্পত্তি হয়েছে। পৃথিবীতে আগত আদিমানব ও সর্বপ্রথম নবী হজরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া (আ.) নিজেদের মনের কথা প্রকাশের জন্য বেহেশত থেকে আরবি ভাষা শিখে এসেছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের সবকিছুর নাম শিক্ষা দিয়েই ভূপৃষ্ঠে প্রেরণ করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তিনি (আল্লাহ) আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-৩১)
ইসলামের শিক্ষা মানুষকে বিভিন্ন ভাষাচর্চায় দারুণভাবে উত্সাহিত করে ও বিশেষ অনুপ্রেরণা জোগায়। ইসলাম মাতৃভাষার উত্কর্ষ সাধনে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেছে। বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানার্জন করতে হলে মানুষের অবশ্যই প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান থাকতে হবে। প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী-গুণী হতে হলে ভাষা সম্পর্কে ব্যাপক অনুশীলন করা উচিত। পড়াশোনার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের সঙ্গে ভাষাচর্চাও যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। পবিত্র কোরআনের বাণী থেকে ভাষাচর্চার প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সর্বপ্রথম নাজিলকৃত আয়াতে জ্ঞানার্জন তথা বিদ্যাশিক্ষার জন্য মানবজাতির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সত্পথ প্রদর্শনের জন্য ইসলাম প্রচার ও প্রসারে দুনিয়ায় অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা আল্লাহর অমিয় বাণী মানুষের কাছে সহজভাবে পৌঁঁছে দেওয়ার জন্য পৃথিবীতে এসেছেন। যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা যেসব অঞ্চলে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন, তাঁদের সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষাভাষী করেছেন। আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলদের নিজস্ব মাতৃভাষায় আসমানি কিতাব নাজিল করে তাঁদের ভাষাকে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহর বাণী সহজ, সুন্দর, সাবলীল ও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য সংশ্লিষ্ট জাতির ভাষাভাষী করে নবী-রাসূলদের প্রেরণ করা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য, অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সত্পথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা ইবরাহীম, আয়াত-৪)
প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের স্বীয় মাতৃভাষার মর্যাদা অপরিসীম। ইসলামের দৃষ্টিতে সব ভাষাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সমানভাবে মর্যাদাসম্পন্ন। সব ভাষা মহান আল্লাহর দান। আল্লাহর কাছে সব ভাষাই গ্রহণযোগ্য। মহান সৃষ্টিকর্তা সব ভাষাভাষী মানুষের কথা শোনেন ও বোঝেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে মানুষকে কোনো বিষয় বোঝানো যায়, তা অন্য কোনো ভাষায় তত সহজে করা যায় না। তাই আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলদের তাঁদের নিজ নিজ সমপ্রদায়ের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। প্রত্যেক নবী-রাসূল নিজেদের মাতৃভাষায় মানুষের কাছে তাওহিদ বা আল্লাহর একত্বের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এবং বিপথগামী মানুষকে চিরসত্য ও সুন্দরের পথে আহ্বান করেছেন।
আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জাতির স্বীয় মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করে স্ব স্ব জাতির নিজস্ব ভাষায় আসমানি কিতাবসমূহ নাজিল করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রধান চারটি আসমানি কিতাবের মধ্যে হজরত মূসা (আ.)-এর প্রতি ‘তাওরাত’ হিব্রু ভাষায়, হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি ‘ইঞ্জিল’ সুরিয়ানি ভাষায়, হজরত দাউদ (আ.)-এর প্রতি ‘যাবুর’ ইউনানি ভাষায় এবং বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ‘আল-কোরআন’ আরবি ভাষায় নাজিল হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। তাঁর কাছে মানবজাতির দিশারী এবং সত্পথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে সর্বশেষ আসমানি কিতাব ‘আল-কোরআন’ অবতীর্ণ হয়। এ ঐশী ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনের ভাষা আরবি। বিশ্বনবীর মাতৃভাষায় পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আমি কোরআনকে তোমার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি তা দিয়ে মুত্তাকিদের সুসংবাদ দিতে পার এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পার।’ (সূরা মার্য়াম, আয়াত-৯৭)
আল্লাহর একত্বের আহ্বান সফলভাবে ধর্মপ্রাণ লোকের কাছে পৌঁছাতে হলে সেই জনপদের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রচার কাজ চালানো দরকার। প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান না থাকলে সফলভাবে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো সহজ নয়। যথার্থ ভাষাজ্ঞান না থাকলে এ জাতীয় দায়িত্ব পালন খুবই কঠিন। ইসলামি আদর্শ যেমন সর্বজনীন ইসলামে ভাষা তেমনি সর্বজনীন। এভাবে ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে ইসলাম চিরন্তন শাশ্বত সত্য-সুন্দর ধর্ম প্রচারে মাতৃভাষা চর্চার জোরালো তাগিদ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে বুদ্ধিমত্তা ও উত্তম বাক্য দ্বারা দ্বীন ইসলাম প্রচারের আহ্বান জানিয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে হিকমত (বিজ্ঞানসম্মত) ও সদুপদেশ দ্বারা আহবান কর এবং তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে আলোচনা কর।’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত-১২৫) তাই নবী করিম (সা.) সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত জানলেও তোমরা তা পৌঁছে দাও।’(বুখারি)
পরবর্তী সময়ে যুগে যুগে ইসলামধর্মের প্রচারকেরা পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে গিয়েছেন সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করে সেই ভাষাতেই ইসলামের সুমহান বাণী এতদ্ঞ্চলের মানুষের কাছে সহজ সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। তাদের মাতৃভাষায় মুসলমানদের অনুসৃত প্রধান ধর্মগ্রন্থ ‘আল-কোরআন’ অনুবাদ করে অনুসারীদের পবিত্র কোরআন-হাদিসের জ্ঞান দান করেছেন এবং ইসলামের বিধি-বিধান ও নিয়মকানুন শিক্ষা দিয়েছেন। মাতৃভাষার ওপর ইসলাম অত্যধিক গুরুত্ব আরোপের কারণে মুসলিম মননে মাতৃভাষা প্রীতি সঞ্চারিত হয়েছে।
সুতরাং নিজ মাতৃভাষা বাংলা ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা একান্ত অপরিহার্য বিষয়। মহান আল্লাহর দেওয়া এ অপার নিয়ামতকে সার্থক করতে হলে মাতৃভাষাকে জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণের কাজে লাগাতে হবে। পবিত্র কোরআন ও হাদিস বাংলা ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকে ইসলামি সাহিত্য সমন্বিত করে মাতৃভাষায় ধর্মের ব্যাপক প্রচার-প্রসারে মুসলমানদের এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামের আলোকে ধর্মপ্রাণ মানুষের সত্ মনোভাব প্রকাশের দ্বারা মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, ইসলাম প্রচার ও প্রসারে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা এবং সর্বোপরি বিশ্বমানবতার কল্যাণে মাতৃভাষার চর্চা, অনুশীলন, সংরক্ষণ ও উত্কর্ষ সাধনে ভাষাশহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে তাঁদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনে সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এভাবে ইসলামে মাতৃভাষার চর্চাকে উত্সাহিত করা হয়েছে, আর ব্যাপকহারে ভাষাচর্চা বিভিন্ন জাতির মাতৃভাষাকে বিকশিত করবে নিঃসন্দেহে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সা.)। dr.munimkhan@yahoo.com
জগতে বিচিত্র ধরনের অসংখ্য ভাষা রয়েছে। জগত্জুড়ে ভাষাবৈচিত্র্যের এই যে অপরূপ সমাহার, সেটা আল্লাহর মহান কুদরত। ভাষা মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম। একজন মানবসন্তান যে জনপদে জন্মগ্রহণ করে, যে পরিবেশ-প্রকৃতিতে বয়োপ্রাপ্ত হয়, যে মায়ের কোলে সে লালিত-পালিত হয়, সেই জনপদে লোকালয়ের মানুষের ভাষা, সেই পরিবেশের ভাষা, সেই মায়ের ভাষা তার আপন ভাষায় পরিণত হয়। ভূপৃষ্ঠে মানবজাতির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার উত্পত্তি হয়েছে। পৃথিবীতে আগত আদিমানব ও সর্বপ্রথম নবী হজরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া (আ.) নিজেদের মনের কথা প্রকাশের জন্য বেহেশত থেকে আরবি ভাষা শিখে এসেছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁদের সবকিছুর নাম শিক্ষা দিয়েই ভূপৃষ্ঠে প্রেরণ করেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তিনি (আল্লাহ) আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-৩১)
ইসলামের শিক্ষা মানুষকে বিভিন্ন ভাষাচর্চায় দারুণভাবে উত্সাহিত করে ও বিশেষ অনুপ্রেরণা জোগায়। ইসলাম মাতৃভাষার উত্কর্ষ সাধনে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করেছে। বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানার্জন করতে হলে মানুষের অবশ্যই প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান থাকতে হবে। প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী-গুণী হতে হলে ভাষা সম্পর্কে ব্যাপক অনুশীলন করা উচিত। পড়াশোনার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের সঙ্গে ভাষাচর্চাও যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। পবিত্র কোরআনের বাণী থেকে ভাষাচর্চার প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সর্বপ্রথম নাজিলকৃত আয়াতে জ্ঞানার্জন তথা বিদ্যাশিক্ষার জন্য মানবজাতির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সত্পথ প্রদর্শনের জন্য ইসলাম প্রচার ও প্রসারে দুনিয়ায় অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা আল্লাহর অমিয় বাণী মানুষের কাছে সহজভাবে পৌঁঁছে দেওয়ার জন্য পৃথিবীতে এসেছেন। যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা যেসব অঞ্চলে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন, তাঁদের সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষাভাষী করেছেন। আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলদের নিজস্ব মাতৃভাষায় আসমানি কিতাব নাজিল করে তাঁদের ভাষাকে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহর বাণী সহজ, সুন্দর, সাবলীল ও পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য সংশ্লিষ্ট জাতির ভাষাভাষী করে নবী-রাসূলদের প্রেরণ করা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য, অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সত্পথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা ইবরাহীম, আয়াত-৪)
প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের স্বীয় মাতৃভাষার মর্যাদা অপরিসীম। ইসলামের দৃষ্টিতে সব ভাষাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সমানভাবে মর্যাদাসম্পন্ন। সব ভাষা মহান আল্লাহর দান। আল্লাহর কাছে সব ভাষাই গ্রহণযোগ্য। মহান সৃষ্টিকর্তা সব ভাষাভাষী মানুষের কথা শোনেন ও বোঝেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে মানুষকে কোনো বিষয় বোঝানো যায়, তা অন্য কোনো ভাষায় তত সহজে করা যায় না। তাই আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলদের তাঁদের নিজ নিজ সমপ্রদায়ের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। প্রত্যেক নবী-রাসূল নিজেদের মাতৃভাষায় মানুষের কাছে তাওহিদ বা আল্লাহর একত্বের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এবং বিপথগামী মানুষকে চিরসত্য ও সুন্দরের পথে আহ্বান করেছেন।
আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক জাতির স্বীয় মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করে স্ব স্ব জাতির নিজস্ব ভাষায় আসমানি কিতাবসমূহ নাজিল করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রধান চারটি আসমানি কিতাবের মধ্যে হজরত মূসা (আ.)-এর প্রতি ‘তাওরাত’ হিব্রু ভাষায়, হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি ‘ইঞ্জিল’ সুরিয়ানি ভাষায়, হজরত দাউদ (আ.)-এর প্রতি ‘যাবুর’ ইউনানি ভাষায় এবং বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ‘আল-কোরআন’ আরবি ভাষায় নাজিল হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। তাঁর কাছে মানবজাতির দিশারী এবং সত্পথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে সর্বশেষ আসমানি কিতাব ‘আল-কোরআন’ অবতীর্ণ হয়। এ ঐশী ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআনের ভাষা আরবি। বিশ্বনবীর মাতৃভাষায় পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আমি কোরআনকে তোমার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে তুমি তা দিয়ে মুত্তাকিদের সুসংবাদ দিতে পার এবং কলহকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পার।’ (সূরা মার্য়াম, আয়াত-৯৭)
আল্লাহর একত্বের আহ্বান সফলভাবে ধর্মপ্রাণ লোকের কাছে পৌঁছাতে হলে সেই জনপদের জনগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রচার কাজ চালানো দরকার। প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান না থাকলে সফলভাবে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো সহজ নয়। যথার্থ ভাষাজ্ঞান না থাকলে এ জাতীয় দায়িত্ব পালন খুবই কঠিন। ইসলামি আদর্শ যেমন সর্বজনীন ইসলামে ভাষা তেমনি সর্বজনীন। এভাবে ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে ইসলাম চিরন্তন শাশ্বত সত্য-সুন্দর ধর্ম প্রচারে মাতৃভাষা চর্চার জোরালো তাগিদ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে বুদ্ধিমত্তা ও উত্তম বাক্য দ্বারা দ্বীন ইসলাম প্রচারের আহ্বান জানিয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে হিকমত (বিজ্ঞানসম্মত) ও সদুপদেশ দ্বারা আহবান কর এবং তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে আলোচনা কর।’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত-১২৫) তাই নবী করিম (সা.) সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত জানলেও তোমরা তা পৌঁছে দাও।’(বুখারি)
পরবর্তী সময়ে যুগে যুগে ইসলামধর্মের প্রচারকেরা পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে গিয়েছেন সেই অঞ্চলের মানুষের ভাষা আয়ত্ত করে সেই ভাষাতেই ইসলামের সুমহান বাণী এতদ্ঞ্চলের মানুষের কাছে সহজ সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। তাদের মাতৃভাষায় মুসলমানদের অনুসৃত প্রধান ধর্মগ্রন্থ ‘আল-কোরআন’ অনুবাদ করে অনুসারীদের পবিত্র কোরআন-হাদিসের জ্ঞান দান করেছেন এবং ইসলামের বিধি-বিধান ও নিয়মকানুন শিক্ষা দিয়েছেন। মাতৃভাষার ওপর ইসলাম অত্যধিক গুরুত্ব আরোপের কারণে মুসলিম মননে মাতৃভাষা প্রীতি সঞ্চারিত হয়েছে।
সুতরাং নিজ মাতৃভাষা বাংলা ভাষার স্বকীয়তা রক্ষা করা একান্ত অপরিহার্য বিষয়। মহান আল্লাহর দেওয়া এ অপার নিয়ামতকে সার্থক করতে হলে মাতৃভাষাকে জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণের কাজে লাগাতে হবে। পবিত্র কোরআন ও হাদিস বাংলা ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকে ইসলামি সাহিত্য সমন্বিত করে মাতৃভাষায় ধর্মের ব্যাপক প্রচার-প্রসারে মুসলমানদের এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামের আলোকে ধর্মপ্রাণ মানুষের সত্ মনোভাব প্রকাশের দ্বারা মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, ইসলাম প্রচার ও প্রসারে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা এবং সর্বোপরি বিশ্বমানবতার কল্যাণে মাতৃভাষার চর্চা, অনুশীলন, সংরক্ষণ ও উত্কর্ষ সাধনে ভাষাশহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে তাঁদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনে সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এভাবে ইসলামে মাতৃভাষার চর্চাকে উত্সাহিত করা হয়েছে, আর ব্যাপকহারে ভাষাচর্চা বিভিন্ন জাতির মাতৃভাষাকে বিকশিত করবে নিঃসন্দেহে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মদ (সা.)। dr.munimkhan@yahoo.com
No comments