কণ্ঠস্বর-মালদ্বীপ ও ভারত মহাসাগর by রাহাত খান
তিন দিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ নাসিম। ঢাকা পেঁৗছেছিলেন ২৯ মে। ঢাকা ত্যাগ করবেন হয়তো আজই, ৩১ মে। মালদ্বীপের উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
প্রতিনিধি দলে আছেন পর্যটন সচিব ও ওই মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এবং আমদানি-রফতানি বিভাগের একজন কর্মকর্তা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ নাসিমের এই সফরে চিকিৎসক পাঠানো এবং সংস্কৃতি বিনিময়বিষয়ক দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে বাংলাদেশের সঙ্গে। মালদ্বীপ তাদের রিক্লেমেশন প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশের বালু নিতে খুব আগ্রহী। বাংলাদেশ বালু রফতানির একটি চুক্তিও করতে পারে মালদ্বীপের সঙ্গে। মালদ্বীপের এই উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলটি সাক্ষাৎ করতে পারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা এবং বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী জিএম কাদেরের সঙ্গে। তারা বাংলাদেশের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন।
মালদ্বীপ খুব ছোট ছোট ১২ হাজার দ্বীপের ৬৩০ বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র দেশ। তবে মাছ রফতানি করে এবং প্রতি বছর কয়েক হাজার লোকের মালদ্বীপে বেড়াতে আসার সুবাদে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। মাত্র তিন লাখ লোকের ছোট দেশের জন্য সেটা বলতে গেলে বিশাল আয়। মালদ্বীপের রয়েছে রফতানির আরও কয়েকটি খাত, যা থেকে তারা যথেষ্ট আয়রোজগার করে। বিশ-পঁচিশ বছর আগে দেশটা ছিল জেলেদের দেশ। দেখতে দেখতে নিজেদের কর্মক্ষমতার গুণে রীতিমতো একটি বিত্তশালী দেশে পরিণত হয়েছে মালদ্বীপ।
মালদ্বীপের ১২ হাজার ক্ষুদ্র দ্বীপই প্রবালের তৈরি। চারদিকে ভারত মহাসাগর। প্রবালের তৈরি বলে চারদিকের জলরাশি নানা রঙ ধারণ করে। কোথাও জল খুব গাঢ় নীল, কোথাও গোধূলির রঙে ডোবানো জল, কোথাওবা টলটল করা জলে রঙধনুর মেলা বসে।
এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে দু'বার গেছি, দু'বারই তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদের সার্ক অঞ্চলীয় দেশে সফরসঙ্গী হয়ে। প্লেন নিচে নামার সময় মনে হয় ভারত মহাসাগরে বুঝি সবারই সলিলসমাধি ঘটতে যাচ্ছে! অন্য কারও কথা জানি না। আমি তটস্থ। পরে সমুদ্রঘেরা ছোট একটা স্থলখণ্ডে বিমান যথারীতি ল্যান্ড করার পর ধড়ে প্রাণ এলো। ছোট এয়ারপোর্ট। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এক-তৃতীয়াংশ জায়গার বেশি নয়। কম হতে পারে। প্লেন নিচুতে নামতে থাকার সময় ভারি সুন্দর দেখায় ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশটিকে। মনে হয় রাঙানো যেনবা এক স্বপ্নরাজ্য।
তবে মালদ্বীপ অবশ্যই কোনো স্বপ্নরাজ্য নয়। মানুষেরই দেশ। মানুষগুলো বেশিরভাগ ছোটখাটো, কালো ও স্বাস্থ্যবান। মালদ্বীপবাসীর অনেকে নিজেদের বাঙালি ও তামিল বংশোদ্ভূত বলে মনে করে। রাজধানী মালের অনতিদূরে বাঙালিপাড়া নামে একটি দ্বীপও আছে। কোনো বাঙালির সঙ্গে দেখা হলে খুব খুশি হয় তারা। বোঝা যায় বাংলাদেশ ও বাঙালিদের বেশ পছন্দ তাদের। তারা ভয় পায় ভারত কিংবা আরব ভূখণ্ডের কোনো দেশকে নয়। তাদের ভয় 'বিগ ব্রাদার' শ্রীলংকা ও ভারত মহাসাগরকে।
শ্রীলংকাকে ভয় পায় কারণ জাহাজে করে শ্রীলংকার জলদস্যুরা মালদ্বীপে আসে। এসে দ্বীপের লোকজনের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ওদের মালপত্র লুট করে নিয়ে যায়। শ্রীলংকার কাছাকাছি বহু দ্বীপ এ জন্য লোকশূন্য। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে শ্রীলংকা চাপও সৃষ্টি করে মালদ্বীপ সরকারের ওপর। ছোট দেশ। একশ'-দেড়শ' লোকের একটা সেনাবাহিনী আছে। আছে কয়েকটা কামান ও আগ্নেয়াস্ত্র। এই সামান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে মালদ্বীপবাসী তো তাদের কাছে, তাদের বাস্তবতায় 'বৃহৎ' শক্তি শ্রীলংকাকে উপেক্ষা বা চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। সে জন্যই তাদের ভয় শ্রীলংকাকে।
ভারত মহাসাগরকে মালদ্বীপবাসীর ভয়ের একটাই কারণ। পানির মাত্র কয়েক ইঞ্চি ওপরে ভাসছে মালদ্বীপ। প্রবাল দ্বীপ বলে ঝড়-ঝঞ্ঝার ভয় নেই। তবে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সমুদ্র যদি এক ফুট ওপরে উঠে যায়, তাহলে পানিতে ডুবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে গোটা দেশ। ভারত মহাসাগরকে ভয় তাদের এ জন্য। তা নইলে এ সাগরই তো তাদের বেঁচে থাকা এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকার মূল। সাগর তাদের শুধু যে পর্যাপ্ত মাছের জোগান দেয় তাই নয়, সাগরঘেরা নারকেল বীথির কুঞ্জ দ্বীপগুলোর পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয়। সাইপ্রাস, মাল্টা, ফিজি প্রভৃতি ছোট দেশেও পর্যটকের ভিড় লেগে আছে। তবে মালদ্বীপের মতো পর্যটনের আকর্ষণীয় স্পট ওই ছোট দেশগুলোর নেই। প্রতিবছর মাছ রফতানি বাবদ অনূ্যন পাঁচ থেকে ছয়শ' মিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় তো আছেই, আরও আছে প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পর্যটন খাত।
মালদ্বীপের লোকশূন্য অনেক দ্বীপ আছে যেগুলো বিদেশিরা ভাড়া নেয়। তারা থাকে নিজেদের মতো করে। অনেক দম্পতি বা প্রেমিক-প্রেমিকা যায় ছোট নির্জন দ্বীপ ভাড়া নিয়ে আনন্দঘন সময় কাটাতে। প্রায় প্রতিটি দ্বীপে পর্যটনের অবকাঠামো তৈরি করাই আছে। লোকবসতি আছে এমন দ্বীপে পর্যটনের অবকাঠামো বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিটি বাড়িতে একটি বা দুটি আরামদায়ক কক্ষ থাকা। সেখানে রাত্রিযাপন, আপ্যায়ন, বোটে করে সমুদ্রে বেড়ানো_ এসবেরই ব্যবস্থা আছে। মালদ্বীপের প্রায় শতভাগ অধিবাসী মুসলমান। ওদের কোনো গোঁড়ামি নেই। ম্যাক্সি পরা মেয়েরা সরকারি অফিস, হোটেল ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান_ সর্বত্র কাজ করছে। মালদ্বীপে পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও দাপট একটু বেশি। সে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। সমাজ অনেকটাই মাতৃতান্ত্রিক।
রাজধানী মালে, ১৯৮৫-৮৬ সালে আয়তনে এক বর্গমাইলের বেশি ছিল না। আমি ও হামিদুজ্জামান রবি (বিএসএস) হেঁটে হেঁটে শহরটা দেখে ফেলেছিলাম ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। এখন শুনতে পাই, মাটি ভরাট করে মালের আয়তন দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। বেশিরভাগ দ্বীপের ভূউচ্চতা বাড়ানোর জন্য মালদ্বীপ নানা দেশ থেকে মাটি ও বালু কিনছে। মালদ্বীপের খাবার পানিরও প্রায় অর্ধেকটা কিনতে হয় বাইরে থেকে। কিনতে হয় চাল, আটা, গমসহ নানা প্রয়োজনীয় দ্রব্য। কারণ প্রবাল দ্বীপ বলে এখানে নলকূপ বসিয়ে পানি তোলার কিংবা কাঁকর ও কঠিন মৃত্তিকায় চাষবাস কিছুই করা সম্ভব নয়। সুপেয় পানির অর্ধেকটা তারা সংগ্রহ করে বৃষ্টি থেকে। প্রায় প্রতিটা বাড়িতে ছাদ এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে ঘরের টুই বেয়ে বৃষ্টির পানি নিচের জলাধারে গিয়ে সঞ্চিত হয়।
মালদ্বীপের কথা হঠাৎ এমন লিখছি কেন? লিখছি এটা বোঝাতে যে, মালদ্বীপের আছে বলতে ভারত মহাসাগর। সে জমিহীন, সম্পদহীন দেশের মানুষকে কত সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়। এরপরও শুধু সেই দেশের মানুষের অশেষ পরিশ্রম ও উদ্যোগের ফলে দেশটা সমৃদ্ধ ও বিত্তশালী। বাংলাদেশের সঙ্গে মালদ্বীপের তুলনা করলে একটু অবাকই হতে হয়। বাংলাদেশের মাটি এত উর্বর। দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ৬০ শতাংশের কম নয়। কয়লা ও গ্যাসসম্পদে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমানায় রয়েছে ভারত মহাসাগরের উপশাখা বঙ্গোপসাগর। এ ছাড়া আছে সুশোভিত সমতল অঞ্চল। রয়েছে পাহাড়-পর্বত, টিলা ও বৃক্ষসম্পদে ঘেরা গ্রামাঞ্চল। রয়েছে বড় বড় নদ-নদী ও পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। তবু তুলনা করলে বলতেই হয়, বাংলাদেশে শোচনীয় দরিদ্র লোকের সংখ্যা শতকরা ২০ ভাগের চেয়ে বেশি। গত কয়েক বছরে খাদ্যোৎপাদন দ্বিগুণ, তিনগুণ বেড়েছে। তবু বাইরে থেকে বাংলাদেশে আমাদের চাল কিনতে হয় প্রতিবছর। উর্বর মাটি থাকা সত্ত্বেও পেঁয়াজ, রসুন, আদা ইত্যাদি আমদানি করতে হয়। আর সরিষা চাষ প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে কেন যে বাইরে থেকে প্রয়োজনের ৯০ শতাংশ ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়, সেটা অতীত ইতিহাসে নীল চাষ এবং নীলকরদের দৌরাত্ম্যই যেনবা মনে করিয়ে দেয়। এ দেশে বিভিন্ন আমলে যারা নীতিনির্ধারক ছিলেন, সরিষা চাষ নিরুৎসাহিত করার, রেলওয়ে ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেশে একশ্রেণীর দুর্বৃত্ত বাস মালিকের উদ্ভব ঘটানো এবং দেশে যাতায়াত সংকট সৃষ্টি ইত্যাদি নীলকরদের মতো তাদের ঘাড়েই পড়ে বৈকি।
অবশ্য স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের সাফল্যের পরিধি একেবারে কম নয়। জনসংখ্যা, তৈরি পোশাকশিল্প, হিমায়িত মাছ রফতানি, ইদানীং পাট ইত্যাদি খাত থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে খাদ্য, শাক-সবজি, দেশীয় ফলফলারি ইত্যাদি উৎপাদনেও দেশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। তবে বিশেষ মহল মনে করে, নানা ক্ষেত্রে সাফল্য লাভের পরও বাংলাদেশ যে পিছিয়ে আছে, এর পেছনকার প্রধান কারণ দেশের সাংঘর্ষিক রাজনীতি। এই সাংঘর্ষিক রাজনীতি সাংঘর্ষিক না হয়ে যদি প্রতিযোগিতামূলক এবং ইতিবাচক হতো, তাহলে বাংলাদেশ বার্ষিক উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে চীন না হোক, মালয়েশিয়া, ভারত ও থাইল্যান্ডের পর্যায়ে পেঁৗছতে পারত অতি অনায়াসে। কিন্তু বাংলাদেশে সাংঘর্ষিক রাজনীতির অবসান হওয়া দূরে থাক, রাজনীতির নামে অপরাজনীতি যেন দিন দিন বাড়ছে।
হালফিল খবর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এক রকম প্রায় পাকা। বর্তমান সরকার বোধ হয় চাইছে, বিরোধী দলের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ ও দেশে গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন করার উপযোগী শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা এবং অনির্বাচিত একটি তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি ঘটানো।
প্রথমে মনে হতে পারে, এটা বুঝিবা বিরোধী দলের রাজনৈতিক স্বার্থের বিপক্ষে যাবে। মনে হতে পারে, বুঝিবা বিরোধী দলের সরকার আবার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টির গভীরে গেলে বোঝা যায়, নিরপেক্ষ নির্বাচন করা বহু ক্ষেত্রেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দিয়ে হয় না। আমরা বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলীর এবং আবু হেনার নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ও বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে। আর শেষে রাষ্ট্রপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন সাহেব মেরুদণ্ডহীনতা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতির যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, তা লজ্জার চেয়েও লজ্জাজনক, কলঙ্কের চেয়েও কলঙ্কজনক। আমাদের বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে এই উপসংহারে পেঁৗছা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো গ্যারান্টি নয়। বারান্তরে এ বিষয়ে আরও আলোচনার ইচ্ছা রইল।
রাহাত খান : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ নাসিমের এই সফরে চিকিৎসক পাঠানো এবং সংস্কৃতি বিনিময়বিষয়ক দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে বাংলাদেশের সঙ্গে। মালদ্বীপ তাদের রিক্লেমেশন প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশের বালু নিতে খুব আগ্রহী। বাংলাদেশ বালু রফতানির একটি চুক্তিও করতে পারে মালদ্বীপের সঙ্গে। মালদ্বীপের এই উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলটি সাক্ষাৎ করতে পারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা এবং বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী জিএম কাদেরের সঙ্গে। তারা বাংলাদেশের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন।
মালদ্বীপ খুব ছোট ছোট ১২ হাজার দ্বীপের ৬৩০ বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র দেশ। তবে মাছ রফতানি করে এবং প্রতি বছর কয়েক হাজার লোকের মালদ্বীপে বেড়াতে আসার সুবাদে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। মাত্র তিন লাখ লোকের ছোট দেশের জন্য সেটা বলতে গেলে বিশাল আয়। মালদ্বীপের রয়েছে রফতানির আরও কয়েকটি খাত, যা থেকে তারা যথেষ্ট আয়রোজগার করে। বিশ-পঁচিশ বছর আগে দেশটা ছিল জেলেদের দেশ। দেখতে দেখতে নিজেদের কর্মক্ষমতার গুণে রীতিমতো একটি বিত্তশালী দেশে পরিণত হয়েছে মালদ্বীপ।
মালদ্বীপের ১২ হাজার ক্ষুদ্র দ্বীপই প্রবালের তৈরি। চারদিকে ভারত মহাসাগর। প্রবালের তৈরি বলে চারদিকের জলরাশি নানা রঙ ধারণ করে। কোথাও জল খুব গাঢ় নীল, কোথাও গোধূলির রঙে ডোবানো জল, কোথাওবা টলটল করা জলে রঙধনুর মেলা বসে।
এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে দু'বার গেছি, দু'বারই তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদের সার্ক অঞ্চলীয় দেশে সফরসঙ্গী হয়ে। প্লেন নিচে নামার সময় মনে হয় ভারত মহাসাগরে বুঝি সবারই সলিলসমাধি ঘটতে যাচ্ছে! অন্য কারও কথা জানি না। আমি তটস্থ। পরে সমুদ্রঘেরা ছোট একটা স্থলখণ্ডে বিমান যথারীতি ল্যান্ড করার পর ধড়ে প্রাণ এলো। ছোট এয়ারপোর্ট। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এক-তৃতীয়াংশ জায়গার বেশি নয়। কম হতে পারে। প্লেন নিচুতে নামতে থাকার সময় ভারি সুন্দর দেখায় ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশটিকে। মনে হয় রাঙানো যেনবা এক স্বপ্নরাজ্য।
তবে মালদ্বীপ অবশ্যই কোনো স্বপ্নরাজ্য নয়। মানুষেরই দেশ। মানুষগুলো বেশিরভাগ ছোটখাটো, কালো ও স্বাস্থ্যবান। মালদ্বীপবাসীর অনেকে নিজেদের বাঙালি ও তামিল বংশোদ্ভূত বলে মনে করে। রাজধানী মালের অনতিদূরে বাঙালিপাড়া নামে একটি দ্বীপও আছে। কোনো বাঙালির সঙ্গে দেখা হলে খুব খুশি হয় তারা। বোঝা যায় বাংলাদেশ ও বাঙালিদের বেশ পছন্দ তাদের। তারা ভয় পায় ভারত কিংবা আরব ভূখণ্ডের কোনো দেশকে নয়। তাদের ভয় 'বিগ ব্রাদার' শ্রীলংকা ও ভারত মহাসাগরকে।
শ্রীলংকাকে ভয় পায় কারণ জাহাজে করে শ্রীলংকার জলদস্যুরা মালদ্বীপে আসে। এসে দ্বীপের লোকজনের ওপর নির্যাতন চালিয়ে ওদের মালপত্র লুট করে নিয়ে যায়। শ্রীলংকার কাছাকাছি বহু দ্বীপ এ জন্য লোকশূন্য। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে শ্রীলংকা চাপও সৃষ্টি করে মালদ্বীপ সরকারের ওপর। ছোট দেশ। একশ'-দেড়শ' লোকের একটা সেনাবাহিনী আছে। আছে কয়েকটা কামান ও আগ্নেয়াস্ত্র। এই সামান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে মালদ্বীপবাসী তো তাদের কাছে, তাদের বাস্তবতায় 'বৃহৎ' শক্তি শ্রীলংকাকে উপেক্ষা বা চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। সে জন্যই তাদের ভয় শ্রীলংকাকে।
ভারত মহাসাগরকে মালদ্বীপবাসীর ভয়ের একটাই কারণ। পানির মাত্র কয়েক ইঞ্চি ওপরে ভাসছে মালদ্বীপ। প্রবাল দ্বীপ বলে ঝড়-ঝঞ্ঝার ভয় নেই। তবে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সমুদ্র যদি এক ফুট ওপরে উঠে যায়, তাহলে পানিতে ডুবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে গোটা দেশ। ভারত মহাসাগরকে ভয় তাদের এ জন্য। তা নইলে এ সাগরই তো তাদের বেঁচে থাকা এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকার মূল। সাগর তাদের শুধু যে পর্যাপ্ত মাছের জোগান দেয় তাই নয়, সাগরঘেরা নারকেল বীথির কুঞ্জ দ্বীপগুলোর পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয়। সাইপ্রাস, মাল্টা, ফিজি প্রভৃতি ছোট দেশেও পর্যটকের ভিড় লেগে আছে। তবে মালদ্বীপের মতো পর্যটনের আকর্ষণীয় স্পট ওই ছোট দেশগুলোর নেই। প্রতিবছর মাছ রফতানি বাবদ অনূ্যন পাঁচ থেকে ছয়শ' মিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় তো আছেই, আরও আছে প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পর্যটন খাত।
মালদ্বীপের লোকশূন্য অনেক দ্বীপ আছে যেগুলো বিদেশিরা ভাড়া নেয়। তারা থাকে নিজেদের মতো করে। অনেক দম্পতি বা প্রেমিক-প্রেমিকা যায় ছোট নির্জন দ্বীপ ভাড়া নিয়ে আনন্দঘন সময় কাটাতে। প্রায় প্রতিটি দ্বীপে পর্যটনের অবকাঠামো তৈরি করাই আছে। লোকবসতি আছে এমন দ্বীপে পর্যটনের অবকাঠামো বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিটি বাড়িতে একটি বা দুটি আরামদায়ক কক্ষ থাকা। সেখানে রাত্রিযাপন, আপ্যায়ন, বোটে করে সমুদ্রে বেড়ানো_ এসবেরই ব্যবস্থা আছে। মালদ্বীপের প্রায় শতভাগ অধিবাসী মুসলমান। ওদের কোনো গোঁড়ামি নেই। ম্যাক্সি পরা মেয়েরা সরকারি অফিস, হোটেল ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান_ সর্বত্র কাজ করছে। মালদ্বীপে পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও দাপট একটু বেশি। সে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। সমাজ অনেকটাই মাতৃতান্ত্রিক।
রাজধানী মালে, ১৯৮৫-৮৬ সালে আয়তনে এক বর্গমাইলের বেশি ছিল না। আমি ও হামিদুজ্জামান রবি (বিএসএস) হেঁটে হেঁটে শহরটা দেখে ফেলেছিলাম ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। এখন শুনতে পাই, মাটি ভরাট করে মালের আয়তন দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। বেশিরভাগ দ্বীপের ভূউচ্চতা বাড়ানোর জন্য মালদ্বীপ নানা দেশ থেকে মাটি ও বালু কিনছে। মালদ্বীপের খাবার পানিরও প্রায় অর্ধেকটা কিনতে হয় বাইরে থেকে। কিনতে হয় চাল, আটা, গমসহ নানা প্রয়োজনীয় দ্রব্য। কারণ প্রবাল দ্বীপ বলে এখানে নলকূপ বসিয়ে পানি তোলার কিংবা কাঁকর ও কঠিন মৃত্তিকায় চাষবাস কিছুই করা সম্ভব নয়। সুপেয় পানির অর্ধেকটা তারা সংগ্রহ করে বৃষ্টি থেকে। প্রায় প্রতিটা বাড়িতে ছাদ এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে ঘরের টুই বেয়ে বৃষ্টির পানি নিচের জলাধারে গিয়ে সঞ্চিত হয়।
মালদ্বীপের কথা হঠাৎ এমন লিখছি কেন? লিখছি এটা বোঝাতে যে, মালদ্বীপের আছে বলতে ভারত মহাসাগর। সে জমিহীন, সম্পদহীন দেশের মানুষকে কত সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়। এরপরও শুধু সেই দেশের মানুষের অশেষ পরিশ্রম ও উদ্যোগের ফলে দেশটা সমৃদ্ধ ও বিত্তশালী। বাংলাদেশের সঙ্গে মালদ্বীপের তুলনা করলে একটু অবাকই হতে হয়। বাংলাদেশের মাটি এত উর্বর। দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ৬০ শতাংশের কম নয়। কয়লা ও গ্যাসসম্পদে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমানায় রয়েছে ভারত মহাসাগরের উপশাখা বঙ্গোপসাগর। এ ছাড়া আছে সুশোভিত সমতল অঞ্চল। রয়েছে পাহাড়-পর্বত, টিলা ও বৃক্ষসম্পদে ঘেরা গ্রামাঞ্চল। রয়েছে বড় বড় নদ-নদী ও পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। তবু তুলনা করলে বলতেই হয়, বাংলাদেশে শোচনীয় দরিদ্র লোকের সংখ্যা শতকরা ২০ ভাগের চেয়ে বেশি। গত কয়েক বছরে খাদ্যোৎপাদন দ্বিগুণ, তিনগুণ বেড়েছে। তবু বাইরে থেকে বাংলাদেশে আমাদের চাল কিনতে হয় প্রতিবছর। উর্বর মাটি থাকা সত্ত্বেও পেঁয়াজ, রসুন, আদা ইত্যাদি আমদানি করতে হয়। আর সরিষা চাষ প্রায় ধ্বংস করে দিয়ে কেন যে বাইরে থেকে প্রয়োজনের ৯০ শতাংশ ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়, সেটা অতীত ইতিহাসে নীল চাষ এবং নীলকরদের দৌরাত্ম্যই যেনবা মনে করিয়ে দেয়। এ দেশে বিভিন্ন আমলে যারা নীতিনির্ধারক ছিলেন, সরিষা চাষ নিরুৎসাহিত করার, রেলওয়ে ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেশে একশ্রেণীর দুর্বৃত্ত বাস মালিকের উদ্ভব ঘটানো এবং দেশে যাতায়াত সংকট সৃষ্টি ইত্যাদি নীলকরদের মতো তাদের ঘাড়েই পড়ে বৈকি।
অবশ্য স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের সাফল্যের পরিধি একেবারে কম নয়। জনসংখ্যা, তৈরি পোশাকশিল্প, হিমায়িত মাছ রফতানি, ইদানীং পাট ইত্যাদি খাত থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর কয়েক বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে খাদ্য, শাক-সবজি, দেশীয় ফলফলারি ইত্যাদি উৎপাদনেও দেশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর। তবে বিশেষ মহল মনে করে, নানা ক্ষেত্রে সাফল্য লাভের পরও বাংলাদেশ যে পিছিয়ে আছে, এর পেছনকার প্রধান কারণ দেশের সাংঘর্ষিক রাজনীতি। এই সাংঘর্ষিক রাজনীতি সাংঘর্ষিক না হয়ে যদি প্রতিযোগিতামূলক এবং ইতিবাচক হতো, তাহলে বাংলাদেশ বার্ষিক উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে চীন না হোক, মালয়েশিয়া, ভারত ও থাইল্যান্ডের পর্যায়ে পেঁৗছতে পারত অতি অনায়াসে। কিন্তু বাংলাদেশে সাংঘর্ষিক রাজনীতির অবসান হওয়া দূরে থাক, রাজনীতির নামে অপরাজনীতি যেন দিন দিন বাড়ছে।
হালফিল খবর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এক রকম প্রায় পাকা। বর্তমান সরকার বোধ হয় চাইছে, বিরোধী দলের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ ও দেশে গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন করার উপযোগী শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করা এবং অনির্বাচিত একটি তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি ঘটানো।
প্রথমে মনে হতে পারে, এটা বুঝিবা বিরোধী দলের রাজনৈতিক স্বার্থের বিপক্ষে যাবে। মনে হতে পারে, বুঝিবা বিরোধী দলের সরকার আবার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টির গভীরে গেলে বোঝা যায়, নিরপেক্ষ নির্বাচন করা বহু ক্ষেত্রেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দিয়ে হয় না। আমরা বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলীর এবং আবু হেনার নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন ও বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে। আর শেষে রাষ্ট্রপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন সাহেব মেরুদণ্ডহীনতা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতির যে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, তা লজ্জার চেয়েও লজ্জাজনক, কলঙ্কের চেয়েও কলঙ্কজনক। আমাদের বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে এই উপসংহারে পেঁৗছা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো গ্যারান্টি নয়। বারান্তরে এ বিষয়ে আরও আলোচনার ইচ্ছা রইল।
রাহাত খান : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
No comments