বিলুপ্ত ট্রুথ কমিশন-সরকারি দপ্তরে দুর্নীতির স্বরূপ by মনজুর রশীদ খান

২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে সত্য ও জবাবদিহিতা অধ্যাদেশ-২০০৮ বলে গঠিত পাঁচ মাস স্থায়ী সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশনে (ট্রুথ কমিশন নামেও পরিচিত) দায়িত্ব পালন করে যে অপূর্ব অভিজ্ঞতা হলো, তা আগ্রহী পাঠকদের জানানোর প্রবল ইচ্ছা নিয়ে এই লেখার ধৃষ্টতা।


যা শুনেছি, দেখেছি ও উপলব্ধি করেছি, সেই বিরল অভিজ্ঞতা তুলনাহীন ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমাদের সমাজে দুর্নীতি, অসাধুতা ও অনৈতিকতার বিস্তৃতি যে সর্বত্র, তা আবারও উপলব্ধি করলাম। উপস্থিত হওয়া কুশীলবদের মুখ থেকে কেচ্ছাকাহিনী শুনে বোঝা গেল দুর্নীতির শেকড় উত্পাটন খুবই কঠিন। সব সরকারেরই নেতা-নেত্রীরা ক্ষমতায় বসে প্রায়ই দুর্নীতি নির্মূল বা উত্পাটনের কথা বলেন কিন্তু তাঁদের সদিচ্ছার যে দারুণ ঘাটতি রয়েছে, তা ক্রমেই আরও পরিদৃশ্যমান হচ্ছে। রাজনৈতিক মহলের মতৈক্য, সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও পক্ষপাতহীন কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া দুর্নীতি দমন যে সম্ভব নয়, তা সবাই স্বীকার করে থাকেন বটে, তবে বাস্তবতা ভিন্ন। ২০০৬ সালের ভয়াবহ রাজনৈতিক সংঘাত-সংকট পরবর্তী পটপরিবর্তনের পর দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) কয়েকটি সংস্থার পরিচালিত অভিযানে দুর্নীতি ও দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপের ব্যাপকতা ও গভীরতার যে মারাত্মক চিত্র ধরা পড়ে, তা শুধু শিক্ষিত-সচেতন নাগরিক সমাজকে নয়, সাধারণ মানুষকেও বিস্মিত করে তোলে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে বিপুল জনসমর্থন দেখা যায়। দেশবাসী আশান্বিত হলো যে, এবারের ধাক্কায় দুর্নীতিবাজদের সমুচিত শিক্ষা হবে। চুনোপুঁটি থেকে আরম্ভ করে রাঘববোয়ালদের অনেকেই হয় আটক হলেন, নয় পালিয়ে রইলেন। কিন্তু দুই বছর শেষ হওয়ার আগেই যা দেখা গেল, তা দুর্নীতির যে মারাত্মক চিত্র ধরা পড়ে, তার চেয়েও বিপজ্জনক ও অনিষ্ট সাধনের ক্ষমতাসম্পন্ন। সেটি হলো দুর্নীতি নামক ব্যাধিকে গ্রহণীয় ও সহনীয় করে তোলার প্রচ্ছন্ন সংকেত। এককথায় বলতে হয়, দুর্নীতির সঙ্গে সহাবস্থানের মনোভাব সৃষ্টি। অসাধু-অসত্ কার্যকলাপের পরিণাম যেকোনো দিন ভয়ংকর হয়ে দেখা দিতে পারে, সেই ভয় কমে যাচ্ছে। তবে পটপরিবর্তনের পর সেই ভয়ংকর পরিণতির কিছুটা ছোঁয়া অনেকের গায়ে সাময়িক হলেও লেগেছে। তাঁদেরই একটি অংশকে দেখার ও শোনার সুযোগ হয়েছিল।
কয়েকটি সরকারি-আধাসরকারি দপ্তর ও সংস্থায় যে অসাধুতা-দুর্নীতি পাকাপাকি অবস্থান নিয়েছে, তার কিছু বর্ণনা আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শোনালেন। অসাধু উপার্জনের বিস্তৃতি শুধু যে বেড়েছে তা নয়, কোনো কোনো দপ্তরে যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ছোট-বড় যার যেখানে সুযোগ আছে ক্ষমতা খাটিয়ে কিছু বাগিয়ে নিচ্ছেন। যেসব অফিসে একসময় ঘুষ-উেকাচের সুযোগ সীমিত ছিল, সেখানেও বিস্তার ঘটে চলেছে। যা শুনেছি ও জেনেছি তার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া কঠিন, সময়সাপেক্ষ এবং সম্ভবও নয়। সময়স্বল্পতা, নানা বাধ্যবাধকতা, সীমাবদ্ধতা ও সময় সময় প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ট্রুথ কমিশন দায়িত্ব সমাপ্ত করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ে পেশ করেছে। এই লেখায় আমি যেসব দিক তুলে ধরেছি, পর্যবেক্ষণ করেছি ও মন্তব্য রেখেছি, তা নিতান্ত নিজস্ব হলেও এর সঙ্গে দুই সদস্য মহোদয় একমত পোষণ করবেন বলেই আমার বিশ্বাস। এখানে পাঁচ মাসের অভিজ্ঞতারই চুম্বক অংশ।
আমরা সর্বমোট ৪৫২ জনের শুনানি গ্রহণ করেছিলাম। বলে রাখতে চাই যে, প্রধানত অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের উদ্দেশ্যে কমিশন গঠিত হলেও হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই সরকারি, আধাসরকারি দপ্তর/সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কিছু সাধারণ পেশার ব্যক্তি। আরও উল্লেখ্য যে, কয়েকটি মাত্র সরকারি দপ্তর/সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী অনুকম্পাপ্রার্থী হয়েছিলেন। তাঁদের সবাই যৌথ বাহিনী পরিচালিত দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্সের অভিযানের ফলে বা কোনো সংস্থা কর্তৃক অপকর্ম ধরা পড়ায় এ-মুখি হয়েছিলেন। বেশির ভাগই এসেছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা, ডেসা, দুটি গ্যাস কোম্পানি, সাব-রেজিস্ট্রার, ডাক বিভাগ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বিআরটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী। এসব দপ্তরের দুর্নীতির খবর সমাজে অজানা ছিল না। কয়েকটি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, তাঁদের দপ্তরগুলোতে পিসি (পার্সেনটেজ) নামের ছদ্মাবরণে ঘুষ নেওয়ার প্রথাকে কেউ দুর্নীতি মনে করেন না। সংস্থার শীর্ষে পৌঁছেন এমন এক কর্মকর্তা জানান, নবীন বয়সে তিনি এই টাকা নিতেন না। কিন্তু পরে নেওয়া শুরু করেন। শীর্ষ পদে অবস্থানকালেও নিয়েছেন। অনেক সংস্থায় বিশেষ করে প্রকৌশল সংস্থাগুলোতে পিসি নেওয়াটা একটা সাধারণ ব্যাপার। কেউ যে নেন না, এমন হয়তো অতি বিরল, থাকলেও তিনি চাকরির সিঁড়ির ধাপে বেশি দূর উঠবেন না। এই সংস্থাগুলোর অনুকম্পাপ্রার্থীর বেশির ভাগই ছিলেন মধ্যম থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
৩৩ বছর চাকরিতে ছিলেন এমন এক সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা দাবি করেন, দপ্তরে উন্নয়নমূলক কাজের সময় পিসি নেওয়া, উপঢৌকন হিসেবে কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে যা নেওয়া হতো তা নাকি ‘প্রচলিত নিয়মেই’ নেওয়া হতো। অর্থাত্ তিনি অবৈধ মনে করেন না। তিনি আরও দাবি করেন, এতে সরকারের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়নি। (উল্লেখ্য, বিগত আয়কর বছরে তিনি এক কোটির অধিক টাকা জমা দিয়ে কালো টাকা সাদা করেছেন বলে জানান)। উপরিউক্ত উপরি ছাড়াও আরও আছে ছোট-বড় নানা রকম অবৈধ সুযোগ-সুবিধা। বড় কন্ট্রাক্ট দেওয়ার সময় বড় লেনদেন, ফিল্ডে কাজ চলাকালে কন্ট্রাক্টরদের থেকে নেওয়া, বিয়েশাদি ও সামাজিক অনুষ্ঠানের খরচপাতি গ্রহণ ইত্যাদি। ছোট-বড় অফিসের (বিশেষত বিল পাসের সঙ্গে যারা সংযুক্ত) প্রায় সবাই ভাগ পান। কন্ট্রাক্টর বিল নিতে এসে সংশ্লিষ্ট সব টেবিলেই কিছু না কিছু দিয়ে যান। বড় প্রকল্পের কন্ট্রাক্ট বিতরণে যে টাকার খেলা চলে, তাতে শীর্ষ কর্মকর্তা, মন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের অনেকেই ভাগ পান। একটি সংস্থার প্রকৌশলীরা কীভাবে বাসায় গিয়ে মন্ত্রীকে টাকা হস্তান্তর করতেন, সে বর্ণনা শুনেছি। মন্ত্রী নিজের অতি ঘনিষ্ঠজনকে সংস্থার প্রধান করে নিয়েছিলেন। এই কেসে তাঁর ঘনিষ্ঠজনসহ (যাঁদের অনেকেই পলাতক) কয়েকজন প্রকৌশলী আসামি ছিলেন। আরেকজন খুবই প্রভাবশালী রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি (যিনিও পলাতক) এক চতুর ব্যক্তিগত সহকারীকে দিয়ে অর্থ সংগ্রহের কাজটি করাতেন এবং তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই জমা রাখতেন (দস্তখত করা চেকবইটি নিজের হেফাজতে থাকত)। সেসব বর্ণনা শুনেছি। তার ধরনটা ব্ল্যাকমেইলিংয়ে অভ্যস্ত অপরাধীদের সঙ্গে তুলনা করা যাবে। এমন আরও একজনের কথা শুনেছি। তিনি চাপ দিয়ে কৌশলে প্রকল্প বানিয়ে অর্থ জোগানের ব্যবস্থা করেন। অনেক সময়ই আমরা পত্রপত্রিকায় পড়ে থাকি যে অমুক নেতার আত্মীয়স্বজন ত্রাস সৃষ্টি করে উন্নয়নকাজ বাগিয়ে নেন এবং কর্মকর্তারা বাধ্য হয়ে চাহিদামতো কাজ করেন। এর সত্যতাও দেখলাম। তবে কর্মকর্তারা বাধ্য হয়ে নয়, অনেকে খুশি মনেই চাহিদামতো কাজ করে দেন। কারণ, তাঁরাও ভাগ পান। দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ঊর্ধ্বতনদের খুশি করে ভবিষ্যতের আরও প্রাপ্তির পথটা সুগম করে রাখেন।
একটি সেবা সংস্থায় (বাণিজ্যিক) যেভাবে সরকারি অর্থ আত্মসাত্ কাজটি বছরের পর বছর নির্বিঘ্নে চলে আসছিল, তার যে নজির দেখলাম তা অবিশ্বাস্য। এই সংস্থার রাজস্ব বিভাগের কিছু অপকর্ম একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হলে সিআইডি কর্তৃপক্ষ তদন্ত করলে থলের বেড়াল বের হয়ে পড়ে। মামলাটি দুদকে পাঠালে ট্রুথ কমিশনের মাধ্যমে অনুকম্পা পাওয়ার সুযোগ নিতে অভিযুক্ত নয়জনের মধ্যে চারজন আবেদন করেন। (অধ্যাদেশ বিধি মোতাবেক আবেদন গ্রহণ করা ও শোনা বাধ্যতামূলক ছিল)। এখানে কী কৌশলে ও কী নির্ভয়ে অর্থ আত্মসাতের প্রক্রিয়া চলে আসছিল, তা বিস্তারিত না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন। তাঁদের একজন বললেন, তিনি ২৯ বছর যাবত্ এসব চলে আসতে দেখে আসছেন। সংস্থার এই বিভাগে বড় মাপের কাজের কন্ট্রাক্ট দেওয়ার সুযোগ ছিল না। অন্য বিভাগগুলোতে উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করার মাধ্যমে প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা লোপাটের সুযোগ রয়েছে। রাজস্ব বিভাগে সে সুযোগ ছিল না বলে এঁরা পিছিয়ে থাকবেন কেন। তাঁরাও অর্থ পকেটস্থ করার কৌশল বের করে নেন। নিজেরাই বাজেটের অর্থ বরাদ্দ থেকে শুরু করে বিল পাস, বিতরণ প্রভৃতির জন্য এমনভাবে চিঠিপত্র-নথি জালিয়াতি করছিলেন যে, তাই প্রচলিত নিয়ম হয়ে পড়েছিল। বখরার বিনিময়ে অডিট দলকেও ম্যানেজ করা হতো। বিশ্বাস করতে হলো যে, আত্মসাত্ করা অর্থের একটি বড় অংশ সর্বোচ্চ স্তরের কর্মকর্তারাও (কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে) পেয়ে আসছিলেন। তাঁরা নিয়মিত অনারিয়াম বা সম্মানী নামে এই ভাতা নিতেন। প্রতি মাসে কাকে কত দেওয়া হতো, সেসব বর্ণনা শুনেছি ও কাগজি কিছু প্রমাণ আমাদের দেখানো হয়েছে। শুনানিতে যা শুনেছি, তাতে ওই সংস্থার অন্য বিভাগের অবস্থা আরও শোচনীয় বলে মনে হলো। উল্লেখ্য, এই অনুকম্পাপ্রার্থীদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
মনজুর রশীদ খান: অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। সদস্য, বিলুপ্ত সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশন।

No comments

Powered by Blogger.