সময়চিত্র-রক্তভেজা হৃদয়, বুকভরা প্রত্যয় by আসিফ নজরুল

২৫ ডিসেম্বর ১৯৮৫ সাল। সাভার স্মৃতিসৌধ থেকে ফেরার পথে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান বাংলাদেশের প্রথম মহিলা যুগ্ম সচিব নাজমা আহমেদ, তাঁর স্বামী, দুই কন্যা এবং দুজন নিকটাত্মীয়। এই দুই কন্যার একজন শেরেজাদ আহমেদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মেধাবী ছাত্রী, দেশসেরা বিতার্কিক এবং সুস্থধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের উদ্যোক্তা।


আরেকজন সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম স্থানে থাকা তাজিন আহমেদ। শেরী আমাদেরই ক্লাসমেট, আমাদের পরমপ্রিয় বন্ধু। তুখোড় মেধাবী, প্রাণবন্ত আর উদ্যমী এই পরিবারের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নামে পরিচিত সব মহলে। বন্ধু আর স্বজনদের কাছে এই মৃত্যু ছিল সকল অর্থেই আকস্মিক আর অবিশ্বাস্য।
কিছু মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না, কিছু মৃত্যুর বিস্ময় কোনো দিন যায় না। আমার মতো অনেকের মনে হতো নাজমা আহমেদের পরিবারের আচমকা তিরোধানের পর কোনো মৃত্যুই আর বিস্মিত আর বাকরুদ্ধ করবে না আমাদের। যেকোনো মানুষ খুব আকস্মিকভাবে স্বজন আর বন্ধুবান্ধব হারালে তা-ই ভাবেন।
আমাদের ধারণা সঠিক হয় না সব সময়। গতবছর ২৫ ফেব্রুয়ারিতে সূচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ড নির্মমভাবে এ উপলদ্ধি এনে দেয় আমাদের অনেকের জীবনে। নির্মম এই হত্যাকাণ্ডে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৩ জন নিহত হন বিডিআর সদস্যদের হাতে। মৃত্যুতে এর শেষ হয়নি। মৃত্যুর পর তাঁদের শরীর শিকার হয় আরেক দফা ভয়াবহ পৈশাচিকতার।
বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড কিংবা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শোক বহন করেছে। কর্নেল তাহের, খালেদ মোশাররফসহ বহু বীর মুক্তিযোদ্ধার করুণ মৃত্যু দেখেছে। ব্যক্তিগত জীবনে অনেকে আকস্মিকভাবে হারিয়েছে তাদের স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের। কোনো মৃত্যু অন্য কোনোটির সঙ্গে তুলনীয় নয়। তবু ২৫ ফেব্রুয়ারির বর্বরতা ছাপিয়ে যায় অন্য অনেক বেদনা। ২৫ ফেব্রুয়ারির পর পুরো দুই দিন খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়েছে আমাদের শ্রেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের। ঘামে-শ্রমে যে শরীর তাঁরা দিনে দিনে প্রস্তুত করেছেন দেশকে রক্ষার জন্য, আগুনে পুরো ছাই করে দেওয়া হয়েছে তাকে। টেনেহিঁচড়ে কারও মৃতদেহ ফেলা হয়েছে নোংরা ডোবা-নর্মদায়। স্বাধীন দেশে দিন-রাত নিশ্চিত ঘাতকের আতঙ্কে মুহ্যমান হয়ে দিন কেটেছে তাঁদের স্বজন আর সন্তানদের। প্রকাশ্য ও চরম অবমাননাকর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ।
রাষ্ট্র ছিল সেদিন, ছিল প্রতিরক্ষা আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, গোলাবারুদ। মাটিতে ছিল ট্যাংক, আকাশে হেলিকপ্টার, পিলখানার ফটকে র্যাব। কিন্তু তার পরও বহু প্রহর বাথরুম, নর্মদা আর রান্নঘরের ডেকচিতে লুকিয়ে ছিলেন সেনা কর্মকর্তারা। মোবাইল ফোনে বারবার সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন তাঁরা। অস্ত্র হাতে তাঁরা পরাজিত করেছেন বিদ্রোহী, জঙ্গি আর অপরাধীদের। অস্ত্রহীন অবস্থায় বারবার আকুলভাবে সাহায্য চেয়েছেন রাষ্ট্রের কাছে, বাহিনীর কাছে, স্বজনের কাছে। কোনো সাহায্য আসেনি, এসেছে মৃত্যু। কী আক্ষেপ, অসহায়ত্ব আর মর্মযাতনায় কেটেছে তাঁদের শেষ মূহূর্তগুলো! এসব ভেবে কেমন করে বেঁচে আছেন সন্তানহারা মা, আকস্মিক বৈধব্যের নারী আর কোমলপ্রাণ সন্তানসন্ততিরা!
এই মৃত্যু ভয়াবহভাবে খর্ব করেছে আমাদের রাষ্ট্রকে বাদবাকি বিশ্বের কাছে। খর্ব করেছে নিজেদের কাছে। দেশে দেশে রাষ্ট্রনায়ক খুন হন, মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় জীবন হারায় অনেক প্রাণপ্রিয় মানুষ, সংঘর্ষে মৃত্যু ঘটে বহু বীরের। কিন্তু গণতন্ত্র আর গণমাধ্যমের দেশে দুই দিনব্যাপী এই প্রকাশ্য গণহত্যার এমন নজির আর কোথাও আছে কি? এমন অপরিমেয় ব্যর্থতায় কারও চাকরি যায়নি, আত্মগ্লানি আর লজ্জায় কেউ পদত্যাগ করেনি, কেউ ভুলও স্বীকার করেনি! এমনকি কেউ জানতে পারেনি রক্তপিপাসু খুনিদের আত্মবিশ্বাস আর স্পর্ধার উত্স।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড অপরিমেয় বেদনার। আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া সীমাহীন লজ্জার।

২.
বিডিআর বিদ্রোহের বিচার হচ্ছে দেশে। ঢাকার বাইরেও বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছে, সৌভাগ্যবশত সেখানে প্রাণহানি হয়নি। ঢাকার বাইরের বিদ্রোহে বুঝে কিংবা না বুঝে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছি আমরা অনেকে। সরকার প্রথমে একজন বিদ্রোহী নেতার কাছে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিয়ে আর বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বিভ্রান্তিকর বার্তা দিয়েছে। বিরোধী দল সর্বনাশের সময়ে প্রায় বিলুপ্ত আর অদৃশ্য থেকে ভুল সংকেত দিয়েছে। কিছু গণমাধ্যম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জানার আগে নানাভাবে বিদ্রোহকে মহীয়ান করে সংবাদ প্রচার করেছে, বিদ্রোহে উত্সাহ জুগিয়েছে। কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সেনাকর্মকর্তা ১/১১-পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের অপকর্ম করে গোটা সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণকে বিদ্বিষ্ট করার অপচেষ্টা করেছেন।
ঢাকার বাইরের অল্পশিক্ষিত আর রক্ত গরম বিডিআর সদস্যরা এসব অনুপ্রেরণায় হয়তো বিভ্রান্ত হয়েছেন। বিডিআর আদালতের বিচারে তাঁদের অনেকের কারাবাস হবে, দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আরও শক্তিক্ষয় (সংখ্যায় এবং মানসিকভাবে) হবে। ইতিমধ্যে হয়েছেও। ঢাকার পুলিশ কমিশনার নিজে সেদিন বললেন, সীমান্তে শক্তি কমে যাওয়ার কারণে অস্ত্র আর অপরাধীদের ঢোকা সহজ হয়েছে। অনেকের ধারণা, এতে সহজতর হয়েছে মুড়ি-মুড়কির মতো সীমান্তে বাংলাদেশিদের লাশ ফেলে দেওয়া, যখন-তখন সীমান্ত অতিক্রম করে অন্য দেশের বাহিনীর ঢুকে পড়া।
বিচার শুরু হয়েছে ঢাকার পিলখানায়ও। পিলখানার বিদ্রোহীরা প্রকৃত অপরাধী বা তাদের সহযোগী। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে কিংবা বিদ্রোহ দমনে বিরত থেকেছে। বিডিআর আইনে সাত বছরের শাস্তি হতে পারে তাদের অনেকের। এই শাস্তি যথেষ্ট নয়। যে রক্তপিপাসুরা আমাদের দেশপ্রেমিক অকুতোভয় সেনা কর্মকর্তাদের পৈশাচিক বর্বরতায় হত্যা করেছে, মৃত্যুদণ্ডই তাদের একমাত্র নিয়তি হওয়া উচিত। এদের জন্য মৃত্যুদণ্ড আর গোটা জাতির নিরন্তর ঘৃণাও হয়তো যথেষ্ট নয়। কিন্তু এই বিচার সম্পাদন আমাদের পরম কর্তব্য। এও পরম কর্তব্য যে বিচারের ভুলে নিরপরাধ একজনও যেন চিহ্নিত না হন ঘৃণিত খুনি হিসেবে।
বিচারের তদন্তকালে আমরা অনেক করুণ মৃত্যু দেখেছি। কয়েকজন বিডিআর জওয়ান মারা গেছেন নির্যাতনের ফল হিসেবে এমন অভিযোগও আছে। তাঁরা কি সবাই দোষী ছিলেন? নাকি অন্য কারও দোষ ঢাকার প্রয়োজনে মারা গেছেন তাঁদের কেউ কেউ? দোষী হলেও নির্যাতনে মৃত্যু নিন্দনীয় বর্বরতা। যদি সত্যিই নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে তাহলে জানতে হবে কারা করেছেন এসব, কাদের নির্দেশে। জানতে হবে কী ছিল তাঁদের প্রকৃত উদ্দেশ্য?

৩.
আদালতের বিচার যথেষ্ট নয়, সম্পূর্ণও নয়। বড় হত্যাযজ্ঞে আরও নয়। বড় হত্যাযজ্ঞে নেপথ্যে থাকে বড় বড় মানুষ, কখনো বিদেশি শক্তি। তাদের অনেকে শাস্তি এড়িয়ে যেতে পারে আইন আর আদালতের সীমাবদ্ধতার কারণে। দক্ষিণ আফ্রিকা, কম্পুচিয়া, রুয়ান্ডা, বসনিয়া, চিলি, ভারত, পাকিস্তান বহু দেশে ঘটেছে এমন ঘটনা। উন্নত বিশ্বে নেতাদের ইচ্ছায় বা স্বার্থে সামপ্রতিক সময়ে লাখো মানুষ প্রাণ দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য আর দক্ষিণ এশিয়ায়। তারা আদালতের বিচারের ঊর্ধ্বে। কিন্তু জনগণ আর ইতিহাসের বিচারের ঊর্ধ্বে নয় কেউ। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যেও শক্তিশালী মানুষ আর দেশি-বিদেশি মহলের সংশ্লিষ্টতা থাকা সম্ভব। আমরা জানি, আদালত আর আইন তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু ইতিহাস পারবে।
পিলখানায় নিহত সেনাদের জন্য আমাদের গ্লানি আর অপরাধবোধ থাকবে। এই গ্লানি আর অপরাধবোধ সামান্য হলেও মোচন করা সম্ভব পিলখানার বর্বরতার সুষ্ঠু, পূর্ণাঙ্গ ও উপযুক্ত বিচারের মাধ্যমে। সম্ভব আর কখনো এমন ঘটনা না ঘটতে পারে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে। এমন নেতৃত্ব অবশ্যই একদিন আসবে বাংলাদেশে।
যে জাতি একাত্তর আর তার পরে বারবার বিজয়ী হয়েছে, সেই জাতি কোনো একদিন পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্তও উন্মোচন করতে পারবে। যে জাতি টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারে, সে জাতি অর্ধশতাধিক চৌকস কমান্ডারকে হারানোর ক্ষতি নিয়েও এগোতে পারবে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর অভাবের মধ্যে যে জাতি দৃপ্তহাতে তুলে নিতে পারে পতাকা, সমৃদ্ধ করতে পারে দেশকে, সে জাতির পরাজয় নেই।

৪.
বাংলাদেশে আর কোনো ট্র্যাজেডি দেখতে চায় না মানুষ। চিরদিন বেদনার্ত আর অনুতপ্ত থাকার মতো বহু ঘটনা ঘটেছে দেশে। আরও কোনো নতুন ক্ষতি বহনের শক্তি আমাদের নেই। পিলখানার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তির যেকোনো ধরনের আশঙ্কা তাই আমাদের অবশ্যই রোধ করতে হবে।
শুধু বিচার আর সত্য উন্মোচন এ জন্য যথেষ্ট নয়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে আত্মসমালোচনা এবং প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হবে। তাদের পুনর্নির্মাণ ও আধুনিকায়নের কথা ভাবতে হবে। এই লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংসদে এবং সংসদের বাইরে নাগরিক সমাজকে নিয়ে খোলামেলা ও আন্তরিক আলোচনা করতে হবে।
ভয়াবহ স্মৃতিকে বুকে নিয়ে হলেও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে। রক্তভেজা হূদয়ে এটিই হোক আমাদের প্রত্যয় আর প্রতিজ্ঞা।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.