ঢাকা-বিশ্বের দ্বিতীয় খারাপ শহরটি যখন আমাদের রাজধানী by জাকারিয়া স্বপন

বিদেশে বসে দেশকে নিয়ে কিছু লেখার কোনো অর্থ নেই। দুই দিন হলো, একটি খবর খুবই মনঃকষ্টের কারণ হয়েছে। খবরটি হলো, বিশ্ববিখ্যাত দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার। প্রতিবছরের মতো তারা এবারও পুরো পৃথিবীর দেশগুলোর মধ্যে বাসযোগ্য শহরগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। বছরজুড়ে তারা তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করে তাদের গবেষক দল


একটি তালিকা বের করেছে, যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে ভালো বাসযোগ্য শহরগুলোকে দেখানো হয়েছে। সেই তালিকায় প্রথম রয়েছে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহর। সারা পৃথিবীর প্রথম ১০টি বাসযোগ্য শহরের মধ্যে ভ্যাঙ্কুভার এক নম্বরে। গত বছরও তারা প্রথম স্থানেই ছিল।
একটি শহরের স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা, অবকাঠামো, নিরাপত্তাসহ ৩০টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে যে নম্বর দেওয়া হয়েছে, তাতে ভ্যাঙ্কুভার পেয়েছে শতকরা ৯৮ ভাগ। মোট ১৪০টি শহরের মধ্যে যে ১০টি শহর সবচেয়ে বেশি বাসযোগ্য তার প্রথম তিনটি হলো ভ্যাঙ্কুভার (কানাডা), ভিয়েনা (অস্ট্রিয়া) ও মেলবোর্ন (অস্ট্রেলিয়া)। ৪. টরন্টো (কানাডা) ৫. ক্যালগ্যারি (কানাডা) ৬. হেলসিঙ্কি (ফিনল্যান্ড) ৭. সিডনি (অস্ট্রেলিয়া) ৮. পার্থ (অস্ট্রেলিয়া) ৯. অ্যাডিলেড (অস্ট্রেলিয়া) ও ১০. অকল্যান্ড (অস্ট্রেলিয়া)। দেখা যাচ্ছে, ১০টির তিনটিই হলো কানাডার আর চারটি অস্ট্রেলিয়ার শহর। এখানে উল্লেখ্য, এই দুটো দেশই সারা পৃথিবী থেকে বিভিন্ন মানুষকে অভিবাসনের সুযোগ দিচ্ছে এবং আধা-সোশ্যালিস্ট দেশ হিসেবে সুপরিচালিত। হয়তো বর্তমান সময়ে এটাই সবচেয়ে ভালো রাষ্ট্রপদ্ধতি। পুঁজিবাদনির্ভর দেশ যুক্তরাষ্ট্র্রের কোনো শহর এ তালিকায় দশের মধ্যে নেই। লস অ্যাঞ্জেলেসের অবস্থান ৪৭তম, নিউইয়র্কের অবস্থান ৫৬তম এবং লন্ডনের অবস্থান ৫৪তম।
ব্যক্তিগতভাবে আমি ভ্যাঙ্কুভার শহরটি দেখেছি। আমি যদি আরও কিছু বছর আগে ভ্যাঙ্কুভারটা দেখতে পেতাম, তাহলে হয়তো আমি ওখানেই থাকাটা বেছে নিতাম। ভ্যাঙ্কুভার এমন সুন্দর একটি শহর, যার প্রেমে না পড়ে কোনো উপায় নেই। ভ্যাঙ্কুভারের কথা এলে একটি ছোট উদাহরণ না দিলেই নয়। আমার এক আত্মীয় থাকেন ওই শহরে। ভদ্রলোক ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ভ্যাঙ্কুভারে আমরা তাঁর ছোট বাসাতেই ছিলাম। বুড়ো-বুড়ি দুজন মিলে থাকেন। তখনই জানলাম, সরকারি হাসপাতালের নার্স প্রতিদিন বাড়িতে এসে তাঁর সেবা করে যাচ্ছেন। এগুলো বইতে ছোটবেলায় পড়তাম। এখন নিজের চোখে দেখলাম। আমরা ফিরে আসার কিছুদিন পর একদিন শুনলাম, ভদ্রলোকের স্ট্রোক করেছে। ১৫ মিনিটের মধ্যে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স এসে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। যদি তাঁর চিকিত্সা আর ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে করা না যেত, তাহলে তাঁকে বাঁচানো যেত না। তাঁর এই চিকিত্সার জন্য নিজের পকেট থেকে একটি পয়সাও খরচ করতে হয়নি। আমি কোনো তুলনা করার জন্য উদাহরণটি দিইনি। শুধু বলতে চাইলাম, সেবা কী মানের হতে পারে এবং একটি রাষ্ট্রের কাজ কী হতে পারে। তারা ধনী দেশ, লোকসংখ্যা কম, তারা অনেক কিছুই পারে। তাদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করাটা ঠিক হবে না। কিন্তু মানুষের যখন জীবন-মরণের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, তখন হয়তো সবাই একটু ভালো চিকিত্সার জন্য খড়কুটোটুকুও আঁকড়ে ধরতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক।
এবার বসবাসযোগ্যতার তালিকায় সবচেয়ে খারাপ শহরগুলোর প্রথম তিনটির নাম দেখা যাক: ১. হারারে (জিম্বাবুয়ে) ২. ঢাকা (বাংলাদেশ) ৩. আলজিয়ার্স (আলজেরিয়া)। এর অর্থ হলো, ঢাকা শহর হলো নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়। ঢাকা শহর যে তালিকায় ঠিক জায়গায় নেই, এ কথাটি কেউ বলেননি। সবাই একবাক্যে মেনে নিয়েছেন যে দি ইকোনমিস্ট-এর তালিকা ঠিকই আছে। এটা টিআইবির রিপোর্টের মতো বিতর্কিত বলে মনে হয়নি।
ঢাকা শহরের সমস্যাগুলো কতটা প্রকট, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। দুই সপ্তাহ আগেই আমি ঢাকা গিয়েছিলাম। ময়মনসিংহ থেকে গাজীপুর আসতে আমার সময় লাগল দুই ঘণ্টা, আর গাজীপুর থেকে ধানমন্ডি যেতে পাঁচ ঘণ্টা। বিকেলে ময়মনসিংহ থেকে যাত্রা করে গভীর রাতে ঢাকা পৌঁছালাম। ঢাকায় জীবনধারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে—এ কথাটি আমার নয়, ঢাকায় যারা থাকে, তারাই প্রতিদিন বলছে। কোনো একটা কিছু যদি পরিকল্পনামাফিক হতো! ঢাকা শহর ও বাংলাদেশ তো এখন আর বর্গিরা পরিচালনা করছে না। আমাদের শহর ও দেশ আমরাই চালাচ্ছি। এটাই কি একটা খুব বড় পরিমাপ নয় যে আমরা কেমন চালাচ্ছি। আমাদের সক্ষমতা কেমন, সেটা পরিমাপের জন্য আর কী কিছুর প্রয়োজন? পুরো শহরটি যখন পুরোনো ঢাকার মতো গলিতে পরিণত হবে, তখন হয়তো আমরা নতুন করে কিছু করতে শুরু করব। আমি জানি, অনেকেই ঢাকা শহরের এ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে বিভিন্ন রকম চিন্তা করছেন। তাঁদের সঙ্গে কয়েকটি চিন্তা আমিও যোগ করতে চাই।
১. ঢাকা শহরে এমন মেয়র চাই, যিনি সত্যিই জানেন একটি উন্নত নগরের জীবনযাপনে কী কী জিনিসের প্রয়োজন। শিগগিরই ঢাকায় নতুন মেয়রের নির্বাচন হবে। সব মিডিয়া যদি মানুষকে ভোটের ব্যাপারটি সচেতন করতে পারে, তাহলে বেশ বড় একটা কাজ হয়। একজন ভালো মেয়র ছাড়া একটি ভালো শহর কিছুতেই হতে পারে না। ঢাকা শহরকে যদি বাসযোগ্য করতে হয়, তাহলে চাই একজন স্মার্ট মেয়র, যিনি জানেন, আজ থেকে আরও ২০-২৫ বছর পর এই শহরের অবস্থা কী হবে।
২. ঢাকা শহরের পুলিশ এবং পুরো ব্যবস্থাপনা থাকবে মেয়রের অধীনে। মেয়রের কাজ যদি হয় শুধু ময়লার গাড়ি ঠিক করা, তাহলে সেই শহর তো বস্তিতে পরিণত হবেই। ঢাকা শহরের পুরো প্রশাসন থাকতে হবে মেয়রের অধীনে। ঢাকা শহরের অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী নন; মেয়র। মেয়র মূলত তাঁকে ঢাকা শহরে থাকতে দিয়ে, আতিথেয়তা দিয়ে রেখে নিজেকে ধন্য করছেন। পৃথিবীর উন্নত বিশ্বে পুলিশ, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রসাশন—এগুলো মেয়রের অধীনেই থাকে। এবং এটা খুব ভালো কাজও করে। আমরা অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এগুলোও আমাদের চিন্তা করতে হবে।
৩. ঢাকা শহরে অনেকেই বিভিন্ন রকম পরিবহনব্যবস্থার কথা বলে থাকে। পাতাল রেল, মাটির ওপর দিয়ে রেল, ঘন ঘন বাস ইত্যাদি। এগুলো আমাদের কোনোটাই কাজ করবে না। প্রতিটির বিভিন্ন অসুবিধা আছে। আবার পাবলিক পরিবহনের সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়গুলো খুব জড়িত। সমাধান হলো, আমাদের কাউকে না কাউকে ঢাকা শহর ছাড়তেই হবে। এটাই এখন বাস্তবতা। মানুষ না কমলে এ শহর কিছুতেই ঠিক হবে না। যেখানে রান্না করব, সেখানেই খাব, সেখানেই ঘুমাব আবার সেখানেই মল ত্যাগ করব—এই কনসেপ্ট থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। পুরো দেশটাই আমাদের। এবং উন্নয়ন পুরো ৫৫ হাজার বর্গমাইলের অধিকার। শুধু ঢাকার মাটির একার সেই অধিকার নয়।
৪. ভূমিদস্যুতা বন্ধ করতে হবে। এবং সেটা সরকার একা করতে পারবে তা নয়। আমরা যারা ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে অধিক টাকায় জমি কিনি, তারাও সমানভাবে দায়ী। আমরা তো জেনেশুনেই সেই জমিগুলো কিনছি এবং সরাসরি ভূমিদস্যুদের কাজকে আরও শক্তিশালী করছি, তাই না? অনেকেই হয়তো বলতে পারে, জমি কীভাবে দখল হয়, সেটা তো ক্রেতা হিসেবে আমার দেখার কথা নয়! তার উত্তর হলো, অবশ্যই দেখার কথা। আর যদি দেখার কথা না হয়, তাহলে ধরে নিন, ঢাকা শহরের পরিবেশদূষণের ভারে আপনার সন্তান যখন পঙ্গু হয়ে জন্মাবে, আপনার কিশোর শিশুর যখন মস্তিষ্কে সমস্যা হবে, আপনার সন্তান যখন অকালে তার বাবাকে হারাবে, তার মাকে হারাবে, আপনার পিতাকে যখন অ্যাম্বুলেন্স ট্রাফিক জ্যামের কারণে হাসপাতালে নিতে পারবেন না আর তখন চিত্কার করে কারও সাহায্য চেয়েও পাবেন না, সেদিনও কারও কিছু বলার থাকবে না, দেখার থাকবে না।
এখনো সময় আছে। চলুন, আমাদের সন্তানদের জন্য আমরা এই কাজগুলো করতে শুরু করি। আজকে শুরু করতে না পারলেও ভাবতে তো শুরু করি। তারপর একদিন ঠিকই পেরে যাব। মানুষ পারে না, এমন তো কিছু নেই!
সিলিকন ভ্যালি, যুক্তরাষ্ট্র
জাকারিয়া স্বপন: তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।
zakariaswapan@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.