শ্রদ্ধাঞ্জলি-মায়ের কথা বলছি by সালমা খান

নব্বই বছর পূর্ণ করে ১৯ জানুয়ারি ইহলোক ত্যাগ করলেন হাজেরা খাতুন খান। সেই যুগের যেকোনো সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতো হাজেরা খাতুনের জীবনের শুরুটাও ছিল সামাজিক প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাবা-মায়ের আদরের বড় মেয়ে হলেও, টাঙ্গাইলের ডাকসাইটে পুলিশ কর্মকর্তা বাবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে বদলি হয়ে সেখানকার খাঁ বাড়ির


জমিদারের সঙ্গে সদ্য গড়ে ওঠা বন্ধুত্বকে পাকাপোক্ত করতে নিজের নয় বছর বয়সের শিশুকন্যাকে বিয়ে দিলেন জমিদারের ১৮ বছর বয়সের ছেলে আবদুস শাকুর খানের সঙ্গে; যে সদ্য পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছে। তবে ছোটবেলা থেকে মেয়ের শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ দেখে বাবা একটি শর্ত জুড়ে দিয়েছেন যে মেয়ে নাইন-টেন অবধি পড়া শেষ করে শ্বশুরবাড়ি যাবে। অবশেষে মিশন স্কুলে ক্লাস নাইনে উঠে হাজেরা স্বামীর ঘর করতে গেলেন এবং ১৫ বছর বয়সে একমাত্র ছেলে হাবিবউল্লাহ খানের, যাঁকে অনেকেই রানু বলে চেনে, মা হলেন। রানুর সূত্রে আরও অনেক বছর পর তিনি আমারও মা হলেন। নিজের মাকে আম্মা আর শাশুড়িকে মা বলে ডাকতাম; যাঁর সঙ্গে নিজের মায়ের তুলনায় আমি আমার জীবনের দীর্ঘতম সময় অতিবাহিত করেছি এবং ক্রমশ তিনি বন্ধুর মতো পাশে থেকে আমাকে ‘আমি’ হয়ে গড়ে উঠতে সহায়তা করেছেন।
নয় সন্তানের মধ্যে আমি সবার ছোট হওয়ায়, কিছুটা ভাইবোনদের প্রশ্রয়ে আর কিছুটা স্বভাবগতভাবে স্বাধীনচেতা হওয়ায় আমার সব সময় চিন্তা ছিল অন্য পরিবারে আমার মানিয়ে চলার ব্যাপারে। তার ওপর আগেই ঘোষণা দিয়েছি—সারা জীবন চাকরি করব, রান্নাবাড়ার কোনো দায়িত্ব নেব না। তাতে পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথমে দেখে ওর মাকে বেশ গম্ভীর আর রাশভারী মনে হয়েছিল। তা ছাড়া একমাত্র সন্তানের মা, স্বভাবতই ছেলের প্রতি আধিপত্যপ্রবণ হবেন, এমন আশঙ্কাও ছিল। কিন্তু মা সম্পর্কে প্রথম যে বিষয়টি আমার মনে রেখাপাত করে, তা ছিল একমাত্র সন্তানের সুশিক্ষার জন্য তাঁর সাহসী সিদ্ধান্ত। রানুর যখন স্কুলে যাওয়ার বয়স, তখন বাবা গ্রামাঞ্চলের ছোট-ছোট থানায় বদলি হতেন বলে থানার কর্মস্থল মুরাদনগরে রানুর পড়াশোনা শুরু হয়। পরে বাবা চট্টগ্রামে বদলি হলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনায় চট্টগ্রামকে ‘নন ফ্যামিলি এরিয়া’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় বিধায় ছেলেকে চট্টগ্রামের স্কুলে পড়ানো সম্ভব হলো না। মা তখন খোঁজখবর নিয়ে সুদূর পাঞ্জাবের তত্কালীন বিখ্যাত আলীগড় বিদ্যালয়ে ছেলেকে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিলেন এবং মাত্র নয় বছর বয়সের ছেলেকে এক মামার সহায়তায় আলীগড়ে পাঠিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করান।
বছরে মাত্র দুই বার বাড়ি আসার সুযোগ হতো, তাও একা। এক দূরদর্শী মা সেভাবেই ছেলেকে প্রস্তুত করলেন—লেখাপড়া শিখতে হলে সাহসী হতে হবে, একা দূরপথ পাড়ি দিতে হবে। নিজেরা খুলনার ট্রেনে তুলে দিতেন ছেলেকে। গোয়ালন্দ হয়ে কলকাতা পৌঁছে এক রাত থাকতে হতো দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায়। পরদিন হাওড়া থেকে ট্রেনে ২৭ ঘণ্টায় আলীগড়ে পৌঁছে টাঙ্গা ভাড়া করে স্কুলের বোর্ডিংয়ে পৌঁছানো। ফোন নেই, দুই-তিন সপ্তাহ লাগে চিঠি আসতে। আজকের দিনেও অধিকাংশ মা-বাবা নয়-দশ বছরের ছেলেকে এভাবে একা স্কুলে পাঠাতে দ্বিধান্বিত হবেন। চার বছর আলীগড়ে পড়ার পর দেশভাগ হলে ক্লাস নাইনে আবার দেশে ফেরা। নিজের ক্ষুদ্র পরিসরে থেকেও এক উদার ও ত্যাগী বিশাল মানসিকতার জন্ম হয়েছিল মায়ের মধ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর ছেলে বিএসসি পাস করলে তিনি ছেলেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত পাঠাতে মনস্থ করলেন। কিছু সঞ্চয় থাকলেও পুরো খরচের সংকুলান ছিল না। তখন বাবা বরিশালে কর্মরত। প্রত্যন্ত অঞ্চলে পুলিশের ট্যুর করার জন্য একটা বড় নৌকা বরাদ্দ ছিল। তখন মা স্থির করলেন, শহরের বাড়িতে থাকলে খরচ বেশি হবে, তার চেয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে নৌকায় বাস করলে খরচও বাঁচবে, যখন-তখন ট্যুর করতেও সুবিধা হবে। এভাবে বছর দেড়েক নৌকায় কাটিয়ে দিলেন। সে সময়টাকে মা মনে করতেন তার জীবনের খুব চমত্কার অভিজ্ঞতার একটা সময়; চাঁদনী রাতে নৌকার চাতালে প্রায়ই গানবাজনার আসর বসত, নৌকায় বাস করার কারণে ঘাটে বাঁধা নৌকায় অনেক বন্ধু বেড়াতে আসতে পছন্দ করতেন।
বিয়ের কয়েক বছর আলাদা বসবাস করার পর মুক্তিযুদ্ধের আগের সময় থেকে আমরা একসঙ্গে হলাম। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি আর রানু দেশের একমাত্র মোটরগাড়ি, ট্রাক প্রস্তুত ও সংযোজন কারখানা গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রির কর্ণধার। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষকবন্ধু ও সংস্কৃতিসেবী বাঙালি ও গান্ধারার তরুণ প্রকৌশলীদের নিয়ে আমাদের বাসায় গড়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক দল। মায়ের উদ্যোগে খিচুড়ি, ডিম ও বেগুনভাজা দিয়ে খাবার চলত যখন-তখন। বিশিষ্ট শিল্পী রশীদ চৌধুরীকে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে নিয়ে গেলে তাঁকে গান্ধারার রংমিস্ত্রি পরিচয়ে বহু কষ্টে আর্মি ক্যাম্প থেকে রানু ছাড়িয়ে আনার পর মা নির্দেশ দিলেন—এখন থেকে আমাদের বাসায় লুকিয়ে থাকতে হবে তাঁকে। মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক সংগঠন হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তরুণ ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত ‘অতি সাম্প্রতিক আমরা’য় বিভিন্ন সহায়তা দিতে মায়ের উত্সাহ আমাকে অনুপ্রাণিত করত।
১৯৭৩ সালে বাবার মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই মায়ের আমাদের সঙ্গে থাকাটা পাকাপাকি হয়ে গেল। ১৯৭৬ সাল আমরা ঢাকায় চলে এলাম—চাকরি ও বাসস্থান দুটিই পরিবর্তন হলো। ঢাকায় ফেরার একটা বড় আকর্ষণ ছিল, আমার আম্মা ঢাকায় থাকতেন। আম্মার যোগ্য সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে তিন ছেলে ও দুই মেয়ে ঢাকায়। আগে বড় ছেলের সঙ্গে থাকলেও আমার মেজ বোন নাজমা সিদ্দিকী পরিবারসহ পাঁচ বছর পর বিদেশ থেকে ফেরার পর আম্মাকে ‘দখল’ করে নিলেন।
ইতিমধ্যে আমরা ঢাকায় একটা ছোটখাটো বাড়ি তৈরি করেছি—ওপরে তিনটা কামরা, নিজেদের, মেয়ের আর মায়ের জন্য বরাদ্দ। মায়ের সঙ্গে এক দিন গল্পচ্ছলে বলেছিলাম, আম্মা যদি মাঝেমধ্যে আমার এখানে এসে থাকতেন তাহলে আমার মেয়ে হুমানা দাদি-নানি দুজনেরই সঙ্গ পেত। কথাটা যথারীতি ভুলেও গেছি। কিন্তু মা ইতিমধ্যেই পারিবারিক কূটনৈতিক তত্পরতা শুরু করে দিলেন। আম্মাকে বোঝাতে প্রায়ই নাজমার বাসায় যাওয়া-আসা, আর আমাকে বললেন—এ বাড়িতে একটা ঘর আমার আর একটা ‘আম্মা’র আর হুমানা দাদি-নানির ঘরে ইচ্ছামতো থাকতে পারবে। মেয়ের বাসায় থাকার চেয়ে মেয়ের শাশুড়ির সঙ্গে থাকতেই আম্মার দ্বিধা ছিল। সবশেষে সাময়িকভাবে আম্মা আসতে রাজি হলেন এবং আমৃত্যু আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। সেই সময়টা আমাদের পরিবারের জন্য সবচেয়ে আনন্দদায়ক সময় ছিল—দুই তরফের দুই মুরব্বিকে ঘিরে আমাদের বাড়ি ‘পানসী’ হয়ে উঠেছিল একটা প্রাণের মিলনকেন্দ্র। দুই মায়ের কাছ থেকে পাওয়া মূল্যবোধ ও আদর্শ আমার জীবনকে সমৃদ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছে, যার জন্য আমি দুজনের কাছেই কৃতজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.