অন্তরীণ সু চি-ভাওতাবাজির বিচার প্রক্রিয়া by এন্ড্রো হেইন

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আমরা জানতে পারলাম, পরদিন সকালে মিয়ানমারের হাইকোর্ট অং সান সু চির আপিলের রায় ঘোষণা করবেন। মিয়ানমার এবং বিশেষত দেশটির গণতন্ত্র আন্দোলনের নেত্রী অং সান সু চিকে নিয়ে বিশ্ববাসীর আগ্রহের ফলে পরদিন সকালে ইয়াঙ্গুনে ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা প্রত্যাশিত ছিল।


আপিলটি সমুন্নত রাখা হলে তার অর্থ হতো গভীর তাত্পর্যপূর্ণ। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দিনটি যেমন করে সে দেশের জনগণ স্মরণ করে, তেমনি সু চির মুক্তি পাওয়ার দিনটিও এ দেশের জনগণ মনে রাখত।
তবে বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। পথেঘাটে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ছিল। চায়ের দোকান ঘিরে কোনো বাড়তি শোরগোল ছিল না। ব্রিটিশ দূতাবাসের স্থানীয় কর্মীরাও সাড়া জাগানো কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে—এমন আভাস দেননি। শুনানির আগে যাঁদের সঙ্গেই আমি কথা বলেছি, তাঁরা সবাই জানত ফল কী হবে। তাই কোনো উত্তেজনা ছিল না, কেবল ছিল হাল ছেড়ে দেওয়ার ভাব।
রায় প্রদানের জন্য নির্ধারিত আদালতকক্ষের ভেতর আগের অধিবেশনগুলোর মতো উভয়পক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের ডেস্কে স্তূপ করে রাখা আইনের বই ও কাগজপত্র। পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী কূটনীতিকদের উপস্থিতিও বেশ ভালো ছিল। এটা এই শুনানি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে গভীর আগ্রহের প্রতিফলনও বটে। কিন্তু সবাই জানতেন, তাঁরা একটি ভাওতাবাজির প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করছেন। এই শুনানির ফল আগেরগুলো থেকে ভিন্ন হবে না। গত মে মাসে সু চির বিরুদ্ধে বানোয়াট অভিযোগ উত্থাপনের সময়ই এটা বোঝা গেছে। আর সু চির থেকে তা ভালো করে কে জানবে? তিনি সেদিন আদালতে ছিলেন না, তাঁকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত তাঁকে গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। মনে করা হয়, এর ফলে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে তাঁকে বিরত রাখা সম্ভব হবে।
আদালতের কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে। পাঁচ মিনিট পর শেষ। আপিল খারিজ করে দেওয়া হয়। বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের উত্থাপিত ১৯৭৪ সালের সংবিধান-সংশ্লিষ্ট প্রধান যুক্তিটি অপ্রাসঙ্গিক—এই যুক্তিতে আপিলটি খারিজ করে দেওয়া হয়। এটুকুই ঘটনা। আদালতকক্ষের বাইরে সু চির পক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলার পর আমি আমার দপ্তরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। বেশ কয়েকজন বিশেষ পুলিশের আলোকচিত্রী আমার ছবি তোলেন। মিয়ানমারে আসার পর থেকে তাঁরা যেসব ছবি তুলেছেন তা দিয়ে তাঁরা কী করবেন ওপরওয়ালাই জানেন। আদালতের বাইরে অল্পসংখ্যক স্থানীয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকের একটি দলকে পাশ কাটিয়ে ইয়াঙ্গুনের কর্মব্যস্ত পথে নেমে আসি। এবারও অবস্থাটা আগের মতোই। যেন তাত্পর্যপূর্ণ কিছু ঘটেনি, এমন অবস্থা বিরাজ করছে। সবাই যেন জানত কী রায় হবে। হয়েছেও তাই। কিন্তু বিস্তৃত পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে দেখা যাবে, এই ঘটনাটি তাত্পর্যপূর্ণ। আরও একটি কালো দিন, আরও একটি পশ্চাত্মুখী পদক্ষেপ।
এখান থেকে আমাদের এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্র আন্দোলনের যাত্রা কোন দিকে হবে? আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে এর উত্তর হলো, জান্তার ওপর ক্ষান্তিহীনভাবে চাপ প্রয়োগ জারি রাখতে হবে। এ বছর মিয়ানমারে নির্বাচন হবে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বিচারের মাপকাঠিটি হবে বেশ সোজাসাপ্টা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মানদণ্ডটি হবে, যে দুই হাজার ১০০ রাজনৈতিক বন্দী তাঁদের চিন্তা, লেখা ও বক্তব্যের জন্য আটক আছেন তাঁদেরকে কি নির্বাচনে মত জানানোর সুযোগ দেওয়া হবে? পত্রিকা ও টেলিভিশনে শাসকদের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি তাঁদেরও মতপ্রকাশের জন্য জায়গা দেওয়া হবে কি না। মিয়ানমারের ভবিষ্যত্ প্রশ্নে দেশটির সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে সংলাপে নিয়ে আসা হবে কি না। আর নির্বাচনের দিনে জনগণকে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে দেওয়া হবে কি না এবং গণনার কাজটি সঠিকভাবে সম্পাদন করা হবে কি না।
ইত্যবসরে, আইনি মামলার লড়াই চলবে। সু চির আইনজীবীদের সামনে এখন তথাকথিত ‘বিশেষ আদালতে’ যাওয়ার সুযোগ আছে। তাঁরা বলতে পারেন, এখন পর্যন্ত আইন ও ঘটনা-সংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যথাযথ বিবেচনায় আনা হয়নি। আইনজীবীরা আমাকে জানিয়েছেন, তাঁরা মাসখানেকের মধ্যে তাঁদের যুক্তি উত্থাপন করতে চান। আদালত যদি মনে করেন এ মামলা গ্রহণ করা যায়, তবে তিন বিচারকের বিশেষ একটি প্যানেল যুক্তিগুলো বিবেচনা করবেন। যদি এমন হয়, তবে তা ঘটবে রাজধানী নেপিদতে। বড় ধরনের কোনো লোকালয় থেকে মোটরযানযোগে এই রাজধানীটি চার ঘণ্টার পথ। সেক্ষেত্রে জায়গার পরিবর্তনটাই হবে একমাত্র পরিবর্তন। ঘটনাস্থল ভিন্ন হলেও ফলাফল প্রায় নিশ্চিতভাবেই একই হবে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব।
এন্ড্রো হেইন: ব্রিটিশ কূটনীতিক। মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত।

No comments

Powered by Blogger.