ধর্ম-পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর আদর্শ ও অনুপম শিক্ষা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
আরবি বর্ষপঞ্জির ১২ রবিউল আউয়াল মানবজাতির ইতিহাসে সর্বগুণে গুণান্বিত ও শ্রেষ্ঠত্বের আলোকোজ্জ্বল প্রতিভা, নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.){৫৭০-৬৩২ খ্রি.}এ ধরাধামে আগমন করেন এবং এদিনই তিরোধান লাভ করেন। তাই বিশ্ব মুসলিমের কাছে এ মহান দিবসটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও তাত্পর্যময়।
আল্লাহ তাআলা এ বিশ্বচরাচরকে তাঁরই প্রিয় ও প্রকৃষ্ট সৃষ্টিসূত্রের আধার নূরে মুহাম্মদী দ্বারা আলোকিত, আলোড়িত এবং আন্দোলিত করেছেন। তিনি সৃষ্টির আদিকাল থেকেই প্রশংসিত মহামানব। তাঁর মাতা প্রদত্ত নাম ‘আহমাদ’ বা সর্বাধিক প্রশংসাকারী, আর দাদা প্রদত্ত নাম ‘মুহাম্মদ’ বা সর্বাধিক প্রশংসিত। পবিত্র কোরআনে ‘মুহাম্মদ’ নামটি চারবার এবং ‘আহমাদ’ নামটি একবার ব্যবহূত হয়েছে। অন্যদিকে নবী করিম (সা.)-এর ২৯টি গুণবাচক নাম ২২৪ বার সম্মানসূচক অভিধায় ব্যবহার হয়েছে। গোটা মানবজাতির জন্য এমনকি সারা দুনিয়ার জন্য রহমত ও আশীর্বাদ হিসেবে তিনি আবির্ভূত হন। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর নিশ্চয়ই আমি তোমাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)
ইসলামের সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মোত্সবকে বলা হয় পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। পৃথিবীর বুকে তাঁর শুভাগমন উপলক্ষে মুসলিম উম্মাহর তথা সৃষ্টিকুলের জন্য সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ উত্সব। সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে সিরাতুন্নবী (সা.) মাহফিলের মাধ্যমে রবিউল আউয়াল মাসটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে উদযাপন করে থাকেন। ‘মিলাদুন্নবী’ আরবি দুটি শব্দে গঠিত একটি যুক্ত শব্দ, যার অর্থ নবী করিম (সা.)-এর জন্ম। ‘সিরাতুন্নবী’ শব্দটিও দুটি শব্দের সামষ্টিক রূপ, যার অর্থ দাঁড়ায় রাসুলে করিম (সা.)-এর সামগ্রিক জীবনপ্রবাহ। মিলাদুন্নবী হচ্ছে নবী করিম (সা.)-এর জন্মবিষয়ক আলোচনা যথা— কখন, কোথায়, কীভাবে, কেমন পরিবেশ পরিস্থিতিতে জন্মগ্রহণ করেছেন, আর তাঁর যাপিত জীবনে উদ্ভাসিত জীবনাদর্শগুলো হচ্ছে সিরাতুন্নবীর সারকথা। নৈতিক মূল্যবোধ-বিশ্বাস, কথাবার্তা, চলাফেরা, লেনদেন, বিয়ে-শাদি, আচার-ব্যবহার, ধর্মীয় রীতিনীতি প্রভৃতিসহ মানবজীবনের সার্বিক বিষয়ে তাঁর অনুপম শিক্ষা ও আদর্শ সিরাতুন্নবী শব্দের বিশেষণে ব্যাখ্যা হয়েছে।
বিশ্বমানবতার ভীষণ বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পৃথিবীতে শুভাগমন ঘটে। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এ পবিত্র দিনে অসত্য, অনাচার ও পাপাচারের অবসান ঘটাতে তাঁর জন্মলগ্নে সংঘটিত অলৌকিক ঘটনায় হাজার বছর ধরে প্রজ্বলিত পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নিভে যায়, রোম সম্রাটের প্রাসাদে ফাটল ধরে এবং ১২টি শীর্ষচূড়া ধসে পড়ে, কাবাগৃহের প্রতিমাগুলো কেঁপে ওঠে এবং বাহিরা হ্রদের পানি শুকিয়ে যায়। আল্লাহর পেয়ারা হাবিব সারা বিশ্বের জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার, অবিচার, ফেতনা-ফাসাদ, অন্যায়ভাবে মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের মূলোত্পাটন ঘটিয়ে সত্য-ন্যায়ের শিক্ষা ও আদর্শ স্থাপন করে জাগতিক শান্তি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্চয়তা বিধান করেন এবং বিশ্বমানবতার কল্যাণ, মুক্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ (সূরা আল-সাবা, আয়াত-২৮)
বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত, অবিসংবাদিত মহাপুরুষ বিশ্বনবী (সা.) অতুলনীয় শিক্ষার এক চিরন্তন আদর্শ। আল্লাহর একত্ববাদ তথা তাওহিদ ও রিসালাতের ক্রমধারায় শুধু জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনাই তাঁর জীবনপথের একমাত্র কর্তব্য ছিল না। তাঁকে প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল মানবগোষ্ঠীকে এ পৃথিবীতে অত্যাচার-দুর্নীতিসহ সব ধরনের জুলুম, নির্যাতন ও অন্যায় থেকে মুক্তিদানে সুখ-শান্তি ও সত্পথে পরিচালন এবং মৃত্যুর পরপারে জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের মাধ্যমে চিরসুখময় জান্নাতের যোগ্য করে গড়া। এভাবে মহানবী (সা.) দুনিয়াতে ইসলাম ধর্মের মিশন শান্তির মর্মবাণী নিয়ে আসেন। মানবজাতির সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাধিক সম্মানিত এবং সব নবী-রাসুলের নেতা পরিশেষে আগমন করেন। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কোনো একটি বিশেষ দল বা সম্প্রদায়ভুক্ত নবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য বিশ্বনবী। তাঁর পরে দুনিয়াতে আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘অন্য নবীগণ তাঁদের স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, আর আমি বিশ্বের সমগ্র মানবের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ তিনি আরও সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘আমি শেষ নবী, আমার পরে আর কোনো নবী নেই।’
তাওহিদ-রিসালাতে বিশ্বাসের ভিত্তিতে সত্কর্মের একটি সুসমন্বিত ইবাদত ও আখলাকে মানবচরিত্রকে পরিশীলিত করা মহানবী (সা.)-এর ধর্ম-দর্শন, শিক্ষা-আদর্শ আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাঁর অর্থনৈতিক দর্শন হলো সম্পদের সামাজিক মালিকানা সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহভীরু মানুষের জীবনকে নির্লোভ ও নিরাপদ করা। দারিদ্র্য বিমোচনে তাঁর যাকাত দর্শন পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হতদরিদ্রকে আটটি ভাগে শ্রেণীকরণ করে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ৬৩ বছরের সুমহান জীবনচরিতের বর্ণাঢ্য আলেখ্য হলো তাঁর রাষ্ট্র চিন্তা। আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি, সামাজিক ঐক্য, মানবিক সাম্যের অঙ্গীকারে মদীনা সনদের ভিত্তিতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং জনকল্যাণের জন্য তিনি বিভিন্ন দপ্তর বণ্টন করে বিশিষ্ট সাহাবিদের দায়িত্ব প্রদান করে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন। তাঁর প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় ধনী-গরিব, ইতর-ভদ্র সবাই আইনের দৃষ্টিতে সমান ছিল। আল্লাহ তাআলা ফরমান, ‘রাসুল তোমাদের যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাকো।’ (সূরা আল-হাশর, আয়াত-৭)
স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) ২৭টি প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং সাহাবিদের অধিনায়কত্বে ৫৭টি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। এসব যুদ্ধে তীর, তরবারি, বল্লম, ঢাল-বর্মের অস্ত্রও ব্যবহূত হয়েছে, কিন্তু এগুলো কখনোই গায়ের জোরে বা মানুষকে ভয় দেখিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নয়; বরং যখন ইসলামের শত্রুদের কুটিল চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও শক্তির বলে মুসলমানদের দেশান্তর, পরাস্ত ও নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস, তখনই কেবল আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের ময়দানে সত্য ও ন্যায়ের জন্য প্রতিরোধ সংগ্রাম করতে হয়েছে। বিশ্বায়ন তথা আন্তর্জাতিকতায় মহানবী (সা.)-এর পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হলো বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মুসলিম জাতীয় চেতনা, বিশ্বব্যাপী শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচার এবং সৃষ্টির সেবা ও জনকল্যাণ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শাবলি অনুসরণ ও তাঁর শিক্ষা মেনে চলার জন্য আল্লাহ তাআলা নির্দেশ প্রদান করেছেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসুলের মধ্যে সুন্দরতম আদর্শ।’ (সূরা আল-আহযাব, আয়াত-২১)
পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, প্রতিবেশী সবার অকৃত্রিম শিক্ষণীয় আদর্শ ও প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি একাধারে সমাজ সংস্কারক, ন্যায় বিচারক, সাহসী যোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক এবং সফল ধর্মপ্রচারক। কেননা কল্যাণকর প্রতিটি কাজে তিনিই সর্বোত্তম আদর্শ। বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যার অনুসরণ করলে তোমরা বিভ্রান্ত হবে না, তা হচ্ছে- “আল্লাহর কিতাব” এবং “তাঁর রাসুলের সুন্নাহ” (আমার জীবনাদর্শ)।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রবিউল আউয়াল মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনীত শিক্ষা-দীক্ষা ও তাঁর জনহিতকর আদর্শাবলিকে স্বীয় জীবনে অনুসরণের জন্য প্রয়াসী হওয়া প্রকৃত আশেকে রাসুলের নমুনা। তাই নবী করিম (সা.)-এর সিরাত তথা জীবনচরিত আলোচনা, মিলাদ মাহফিল, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, হাদিস অধ্যয়ন, সালাত-সালাম, দোয়া-দরুদ ও তাঁর সুমহান জীবনের বিভিন্ন শিক্ষণীয় দিকের ওপর গভীর আলোকপাত করে মানব জীবনে তা বাস্তবায়ন করার প্রত্যয়দীপ্ত শপথ নিতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com
ইসলামের সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মোত্সবকে বলা হয় পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। পৃথিবীর বুকে তাঁর শুভাগমন উপলক্ষে মুসলিম উম্মাহর তথা সৃষ্টিকুলের জন্য সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দ উত্সব। সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে সিরাতুন্নবী (সা.) মাহফিলের মাধ্যমে রবিউল আউয়াল মাসটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে উদযাপন করে থাকেন। ‘মিলাদুন্নবী’ আরবি দুটি শব্দে গঠিত একটি যুক্ত শব্দ, যার অর্থ নবী করিম (সা.)-এর জন্ম। ‘সিরাতুন্নবী’ শব্দটিও দুটি শব্দের সামষ্টিক রূপ, যার অর্থ দাঁড়ায় রাসুলে করিম (সা.)-এর সামগ্রিক জীবনপ্রবাহ। মিলাদুন্নবী হচ্ছে নবী করিম (সা.)-এর জন্মবিষয়ক আলোচনা যথা— কখন, কোথায়, কীভাবে, কেমন পরিবেশ পরিস্থিতিতে জন্মগ্রহণ করেছেন, আর তাঁর যাপিত জীবনে উদ্ভাসিত জীবনাদর্শগুলো হচ্ছে সিরাতুন্নবীর সারকথা। নৈতিক মূল্যবোধ-বিশ্বাস, কথাবার্তা, চলাফেরা, লেনদেন, বিয়ে-শাদি, আচার-ব্যবহার, ধর্মীয় রীতিনীতি প্রভৃতিসহ মানবজীবনের সার্বিক বিষয়ে তাঁর অনুপম শিক্ষা ও আদর্শ সিরাতুন্নবী শব্দের বিশেষণে ব্যাখ্যা হয়েছে।
বিশ্বমানবতার ভীষণ বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পৃথিবীতে শুভাগমন ঘটে। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এ পবিত্র দিনে অসত্য, অনাচার ও পাপাচারের অবসান ঘটাতে তাঁর জন্মলগ্নে সংঘটিত অলৌকিক ঘটনায় হাজার বছর ধরে প্রজ্বলিত পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নিভে যায়, রোম সম্রাটের প্রাসাদে ফাটল ধরে এবং ১২টি শীর্ষচূড়া ধসে পড়ে, কাবাগৃহের প্রতিমাগুলো কেঁপে ওঠে এবং বাহিরা হ্রদের পানি শুকিয়ে যায়। আল্লাহর পেয়ারা হাবিব সারা বিশ্বের জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার, অবিচার, ফেতনা-ফাসাদ, অন্যায়ভাবে মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের মূলোত্পাটন ঘটিয়ে সত্য-ন্যায়ের শিক্ষা ও আদর্শ স্থাপন করে জাগতিক শান্তি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্চয়তা বিধান করেন এবং বিশ্বমানবতার কল্যাণ, মুক্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’ (সূরা আল-সাবা, আয়াত-২৮)
বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত, অবিসংবাদিত মহাপুরুষ বিশ্বনবী (সা.) অতুলনীয় শিক্ষার এক চিরন্তন আদর্শ। আল্লাহর একত্ববাদ তথা তাওহিদ ও রিসালাতের ক্রমধারায় শুধু জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনাই তাঁর জীবনপথের একমাত্র কর্তব্য ছিল না। তাঁকে প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল মানবগোষ্ঠীকে এ পৃথিবীতে অত্যাচার-দুর্নীতিসহ সব ধরনের জুলুম, নির্যাতন ও অন্যায় থেকে মুক্তিদানে সুখ-শান্তি ও সত্পথে পরিচালন এবং মৃত্যুর পরপারে জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের মাধ্যমে চিরসুখময় জান্নাতের যোগ্য করে গড়া। এভাবে মহানবী (সা.) দুনিয়াতে ইসলাম ধর্মের মিশন শান্তির মর্মবাণী নিয়ে আসেন। মানবজাতির সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাধিক সম্মানিত এবং সব নবী-রাসুলের নেতা পরিশেষে আগমন করেন। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কোনো একটি বিশেষ দল বা সম্প্রদায়ভুক্ত নবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য বিশ্বনবী। তাঁর পরে দুনিয়াতে আর কোনো নবীর আবির্ভাব হবে না। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘অন্য নবীগণ তাঁদের স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, আর আমি বিশ্বের সমগ্র মানবের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ তিনি আরও সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, ‘আমি শেষ নবী, আমার পরে আর কোনো নবী নেই।’
তাওহিদ-রিসালাতে বিশ্বাসের ভিত্তিতে সত্কর্মের একটি সুসমন্বিত ইবাদত ও আখলাকে মানবচরিত্রকে পরিশীলিত করা মহানবী (সা.)-এর ধর্ম-দর্শন, শিক্ষা-আদর্শ আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাঁর অর্থনৈতিক দর্শন হলো সম্পদের সামাজিক মালিকানা সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহভীরু মানুষের জীবনকে নির্লোভ ও নিরাপদ করা। দারিদ্র্য বিমোচনে তাঁর যাকাত দর্শন পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হতদরিদ্রকে আটটি ভাগে শ্রেণীকরণ করে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ৬৩ বছরের সুমহান জীবনচরিতের বর্ণাঢ্য আলেখ্য হলো তাঁর রাষ্ট্র চিন্তা। আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি, সামাজিক ঐক্য, মানবিক সাম্যের অঙ্গীকারে মদীনা সনদের ভিত্তিতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব এবং জনকল্যাণের জন্য তিনি বিভিন্ন দপ্তর বণ্টন করে বিশিষ্ট সাহাবিদের দায়িত্ব প্রদান করে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন। তাঁর প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় ধনী-গরিব, ইতর-ভদ্র সবাই আইনের দৃষ্টিতে সমান ছিল। আল্লাহ তাআলা ফরমান, ‘রাসুল তোমাদের যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাকো।’ (সূরা আল-হাশর, আয়াত-৭)
স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) ২৭টি প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং সাহাবিদের অধিনায়কত্বে ৫৭টি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। এসব যুদ্ধে তীর, তরবারি, বল্লম, ঢাল-বর্মের অস্ত্রও ব্যবহূত হয়েছে, কিন্তু এগুলো কখনোই গায়ের জোরে বা মানুষকে ভয় দেখিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নয়; বরং যখন ইসলামের শত্রুদের কুটিল চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও শক্তির বলে মুসলমানদের দেশান্তর, পরাস্ত ও নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস, তখনই কেবল আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের ময়দানে সত্য ও ন্যায়ের জন্য প্রতিরোধ সংগ্রাম করতে হয়েছে। বিশ্বায়ন তথা আন্তর্জাতিকতায় মহানবী (সা.)-এর পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হলো বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মুসলিম জাতীয় চেতনা, বিশ্বব্যাপী শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচার এবং সৃষ্টির সেবা ও জনকল্যাণ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শাবলি অনুসরণ ও তাঁর শিক্ষা মেনে চলার জন্য আল্লাহ তাআলা নির্দেশ প্রদান করেছেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসুলের মধ্যে সুন্দরতম আদর্শ।’ (সূরা আল-আহযাব, আয়াত-২১)
পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, প্রতিবেশী সবার অকৃত্রিম শিক্ষণীয় আদর্শ ও প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি একাধারে সমাজ সংস্কারক, ন্যায় বিচারক, সাহসী যোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক এবং সফল ধর্মপ্রচারক। কেননা কল্যাণকর প্রতিটি কাজে তিনিই সর্বোত্তম আদর্শ। বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যার অনুসরণ করলে তোমরা বিভ্রান্ত হবে না, তা হচ্ছে- “আল্লাহর কিতাব” এবং “তাঁর রাসুলের সুন্নাহ” (আমার জীবনাদর্শ)।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রবিউল আউয়াল মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনীত শিক্ষা-দীক্ষা ও তাঁর জনহিতকর আদর্শাবলিকে স্বীয় জীবনে অনুসরণের জন্য প্রয়াসী হওয়া প্রকৃত আশেকে রাসুলের নমুনা। তাই নবী করিম (সা.)-এর সিরাত তথা জীবনচরিত আলোচনা, মিলাদ মাহফিল, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, হাদিস অধ্যয়ন, সালাত-সালাম, দোয়া-দরুদ ও তাঁর সুমহান জীবনের বিভিন্ন শিক্ষণীয় দিকের ওপর গভীর আলোকপাত করে মানব জীবনে তা বাস্তবায়ন করার প্রত্যয়দীপ্ত শপথ নিতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments