বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ-বাঘের কবলে মানুষের মৃত্যু, আমাদের দায় by খসরু চৌধুরী
সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণের বড় অন্তরায় সুন্দরবনে বাঘের কবলে মানুষের মৃত্যু। বাংলাদেশ সুন্দরবনে প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০ জন বনচারী (সরকারি হিসাবে ২০ থেকে ২২ জন) বনের ভেতর বাঘের আক্রমণে মারা যায়। এ ছাড়া চিকিৎসার অভাবেও বাঘ-আক্রান্ত মানুষ মারা পড়ে গ্রামে ফিরে।
ফলে উপদ্রুত এলাকাগুলোর পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের মানুষ ভয়ঙ্কর বাঘবিরোধী। প্রকৃতপক্ষে কৈখালী থেকে বেদকাশী এলাকার গ্রামাঞ্চলগুলোর এমন বাড়ি খুব কমই আছে যে বাড়ির কেউ না কেউ বাঘের আক্রমণে মারা পড়েনি।
বাঘের আক্রমণে মানুষ মারা যাওয়ার পর গ্রামবাসীর বাঘের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠাটা অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপার। মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হলো বাঘ মানুষ মারে এবং মৃত মানুষের মৃতদেহ খেয়েও ফেলে। এই খেয়ে ফেলাটা মানুষ কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারে না। সুন্দরবন-সংশ্লিষ্ট গ্রামাঞ্চলে বাঘের আক্রমণে যত মানুষ মারা পড়ে তার চেয়ে তিন গুণ বেশি মানুষ মারা যায় সাপের কামড়ে। অথচ মানুষ সাপের ব্যাপারে উদাসীন। প্রসঙ্গত, প্রাক বর্ষা, বর্ষা ও উত্তর বর্ষায় সারা দেশে গড়ে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ সাপের দংশনে মারা যায়।
এবার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে আসছি। সুন্দরবনের লোকালয়গুলোর বিরাট সংখ্যক মানুষ জীবিকার জন্য বনে ঢোকে। ইদানীং, বিশেষ করে এ বছর আইলাবিধ্বস্ত মানুষজন সুন্দরবনে বেশি ঢুকছে। এদের বেশির ভাগই বেপাশী—বন বিভাগের রাজস্ব না দিয়ে, অনুমতি না নিয়েই বনে ঢুকছে নিতান্তই পেটের দায়ে।
বাঘের মানুষ মারার প্রধান কারণ স্বাভাবিক শিকারের ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। একটি স্বাভাবিক বাঘের যেটা নিয়ন্ত্রণ এলাকা, সেটাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে নেয় মানুষমারা বাঘ। স্থানিক বাঘের সঙ্গে তার সংঘাত হয় না, কারণ স্বাভাবিক বাঘ যেখানে দিনের বেলা বিশ্রামে কাটায়, মানুষমারা বাঘ সেখানে মানুষের কর্ম এলাকার খোঁজে বের হয় দিনের বেলায়।
আমি দুটি মানুষমারা বাঘের মানুষ মারা শুরু হতে বাঘগুলো মারা যাওয়া পর্যন্ত সময়কালের খোঁজ রেখেছিলাম। এদের মধ্যে চাঁদপাই রেঞ্জের মরা পশরের বাঘটির মানুষ খাওয়ার ক্যারিয়ার ছিল আড়াই বছরের। এটির মানুষ মারার কর্ম এলাকা বিস্তৃত ছিল বাংলাদেশ সুন্দরবনের প্রায় ১৬ ভাগের এক ভাগ এলাকা। এটি শিকারির হাতে মারা পড়ে ২৯ জন মানুষ মারার পর। অন্য বাঘটিও চাঁদপাই এলাকার, এর কর্ম এলাকা ছিল সুন্দরবনের এক-অষ্টমাংশ এলাকা। চার বছরে এক বাওয়ালির কুঠারের আঘাতে বাঘটির মৃত্যু হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ মেরেছিল ৫৪ জন।
বর্তমান সময়ে সাতক্ষীরা রেঞ্জের কলগাছিয়া এলাকায় গত বছরের মধ্য অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত আটজন মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা গেছে। তিনজন কোনো রকমে বেঁচে এসেছে। এ বছর ওই সব এলাকায় গোল ও গরানের ঘের পড়েছে। ওখানে কয়টি বাঘ মানুষ মেরেছে তা ঠিক জানি না। বাঘ ওখানে মানুষ মারা শুরু করেছিল গত বছরের শেষের দিকে। নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে কুয়াশার আবডালে বাঘ প্রধানত গরান গোলের কুপে হানা দিত। কুয়াশা সরে যাওয়ায় এখন অন্যান্য বনচারীর ওপর হামলে পড়ছে।
কোনো এলাকায় একটি বাঘ যখন মানুষখেকো হয়ে পড়ে, তখন বাঘটি যতটা ক্ষতি করে, তার চেয়ে আতঙ্ক ছড়ায় এর কয়েক গুণ। উপদ্রুত এলাকার মানুষ নিজের ছায়াকেও ভয় পেতে শুরু করে।
সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চল সম্পূর্ণ সরকারের অধীনে। বন বিভাগ এর দেখভালের দায়িত্বে আছে। এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে যখন কোনো মানুষ রাজস্ব দিয়ে, অনুমতি নিয়ে বনে প্রবেশ করে তখন তার নিরাপত্তার দায় সরকার তথা বন বিভাগের ওপর। দুর্ঘটনা ঘটে গেলে দুর্গত পরিবারটিকে আর্থিক সাহায্য করাও নীতিগতভাবে বন বিভাগের ওপর বর্তায়। অথচ লজ্জাকর এবং দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য বন বিভাগের হাতে কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। রাজস্ব দিয়ে বাঘের হাতে মারা পড়া মানুষের সাধারণ দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয় বন কর্মচারীদের সহায়তায়।
লাশ বন অফিসে এনে মৃত্যুর সার্টিফিকেট নিতে হয় বন অফিস থেকে। আমি দেখেছি, সাহায্য করতে না পারা অসহায় বন কর্মীরা অনেক সময় নিজেদের পকেটের সামান্য অর্থ দিয়ে সাহায্য করে দুর্গত পরিবারগুলোকে, যাতে অন্তত দেহাবশিষ্টের কবর দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। বাঘের কবলে মানুষ মারা পড়ার বিষয়টি হেলথ হ্যাজার্ডের অংশ। পৃথিবীর কোনো সভ্য, বন-সংরক্ষণকামী বননীতি এটা হতে পারে না। সরকারকে ব্যাপারটি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। এলাকার লোকজন খ্যাপিয়ে বাঘ রক্ষা হবে না। এলাকাবাসীর জন্য অন্তত সান্ত্বনার হাত বাড়ানো দরকার এখনই।
খসরু চৌধুরী: বন বিশেষজ্ঞ।
বাঘের আক্রমণে মানুষ মারা যাওয়ার পর গ্রামবাসীর বাঘের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠাটা অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপার। মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হলো বাঘ মানুষ মারে এবং মৃত মানুষের মৃতদেহ খেয়েও ফেলে। এই খেয়ে ফেলাটা মানুষ কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারে না। সুন্দরবন-সংশ্লিষ্ট গ্রামাঞ্চলে বাঘের আক্রমণে যত মানুষ মারা পড়ে তার চেয়ে তিন গুণ বেশি মানুষ মারা যায় সাপের কামড়ে। অথচ মানুষ সাপের ব্যাপারে উদাসীন। প্রসঙ্গত, প্রাক বর্ষা, বর্ষা ও উত্তর বর্ষায় সারা দেশে গড়ে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ সাপের দংশনে মারা যায়।
এবার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে আসছি। সুন্দরবনের লোকালয়গুলোর বিরাট সংখ্যক মানুষ জীবিকার জন্য বনে ঢোকে। ইদানীং, বিশেষ করে এ বছর আইলাবিধ্বস্ত মানুষজন সুন্দরবনে বেশি ঢুকছে। এদের বেশির ভাগই বেপাশী—বন বিভাগের রাজস্ব না দিয়ে, অনুমতি না নিয়েই বনে ঢুকছে নিতান্তই পেটের দায়ে।
বাঘের মানুষ মারার প্রধান কারণ স্বাভাবিক শিকারের ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। একটি স্বাভাবিক বাঘের যেটা নিয়ন্ত্রণ এলাকা, সেটাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে নেয় মানুষমারা বাঘ। স্থানিক বাঘের সঙ্গে তার সংঘাত হয় না, কারণ স্বাভাবিক বাঘ যেখানে দিনের বেলা বিশ্রামে কাটায়, মানুষমারা বাঘ সেখানে মানুষের কর্ম এলাকার খোঁজে বের হয় দিনের বেলায়।
আমি দুটি মানুষমারা বাঘের মানুষ মারা শুরু হতে বাঘগুলো মারা যাওয়া পর্যন্ত সময়কালের খোঁজ রেখেছিলাম। এদের মধ্যে চাঁদপাই রেঞ্জের মরা পশরের বাঘটির মানুষ খাওয়ার ক্যারিয়ার ছিল আড়াই বছরের। এটির মানুষ মারার কর্ম এলাকা বিস্তৃত ছিল বাংলাদেশ সুন্দরবনের প্রায় ১৬ ভাগের এক ভাগ এলাকা। এটি শিকারির হাতে মারা পড়ে ২৯ জন মানুষ মারার পর। অন্য বাঘটিও চাঁদপাই এলাকার, এর কর্ম এলাকা ছিল সুন্দরবনের এক-অষ্টমাংশ এলাকা। চার বছরে এক বাওয়ালির কুঠারের আঘাতে বাঘটির মৃত্যু হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ মেরেছিল ৫৪ জন।
বর্তমান সময়ে সাতক্ষীরা রেঞ্জের কলগাছিয়া এলাকায় গত বছরের মধ্য অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত আটজন মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা গেছে। তিনজন কোনো রকমে বেঁচে এসেছে। এ বছর ওই সব এলাকায় গোল ও গরানের ঘের পড়েছে। ওখানে কয়টি বাঘ মানুষ মেরেছে তা ঠিক জানি না। বাঘ ওখানে মানুষ মারা শুরু করেছিল গত বছরের শেষের দিকে। নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে কুয়াশার আবডালে বাঘ প্রধানত গরান গোলের কুপে হানা দিত। কুয়াশা সরে যাওয়ায় এখন অন্যান্য বনচারীর ওপর হামলে পড়ছে।
কোনো এলাকায় একটি বাঘ যখন মানুষখেকো হয়ে পড়ে, তখন বাঘটি যতটা ক্ষতি করে, তার চেয়ে আতঙ্ক ছড়ায় এর কয়েক গুণ। উপদ্রুত এলাকার মানুষ নিজের ছায়াকেও ভয় পেতে শুরু করে।
সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চল সম্পূর্ণ সরকারের অধীনে। বন বিভাগ এর দেখভালের দায়িত্বে আছে। এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে যখন কোনো মানুষ রাজস্ব দিয়ে, অনুমতি নিয়ে বনে প্রবেশ করে তখন তার নিরাপত্তার দায় সরকার তথা বন বিভাগের ওপর। দুর্ঘটনা ঘটে গেলে দুর্গত পরিবারটিকে আর্থিক সাহায্য করাও নীতিগতভাবে বন বিভাগের ওপর বর্তায়। অথচ লজ্জাকর এবং দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য বন বিভাগের হাতে কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। রাজস্ব দিয়ে বাঘের হাতে মারা পড়া মানুষের সাধারণ দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয় বন কর্মচারীদের সহায়তায়।
লাশ বন অফিসে এনে মৃত্যুর সার্টিফিকেট নিতে হয় বন অফিস থেকে। আমি দেখেছি, সাহায্য করতে না পারা অসহায় বন কর্মীরা অনেক সময় নিজেদের পকেটের সামান্য অর্থ দিয়ে সাহায্য করে দুর্গত পরিবারগুলোকে, যাতে অন্তত দেহাবশিষ্টের কবর দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। বাঘের কবলে মানুষ মারা পড়ার বিষয়টি হেলথ হ্যাজার্ডের অংশ। পৃথিবীর কোনো সভ্য, বন-সংরক্ষণকামী বননীতি এটা হতে পারে না। সরকারকে ব্যাপারটি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। এলাকার লোকজন খ্যাপিয়ে বাঘ রক্ষা হবে না। এলাকাবাসীর জন্য অন্তত সান্ত্বনার হাত বাড়ানো দরকার এখনই।
খসরু চৌধুরী: বন বিশেষজ্ঞ।
No comments