দিল্লির চিঠি-ভারতের অতিক্রান্ত বিচারপতিরা by কুলদীপ নায়ার
ভারতে জ্যেষ্ঠ বিচারকদের পাশ কাটিয়ে বিচারক নিয়োগের ঘটনা আবারও ঘটল। কিছুদিন আগে দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরে যাওয়া বিচারপতি এ এন শাহ ছিলেন ভারতের সবচেয়ে ভালো বিচারকদের অন্যতম। জ্যেষ্ঠতার দিক থেকেও তাঁর অবস্থান ছিল সবার ওপরে। তবুও তাঁকে সুপ্রিম কোর্টে আসীন করা হয়নি।
শাহের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এস এইচ কাপাডিয়ার পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান তাঁর সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া ঠেকিয়ে দেয়। বিচারপতি কাপাডিয়া পাঁচ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত একটি পরিষদের সদস্য, যাঁরা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বাছাই করেন। আমার ধারণা, প্রধান বিচারপতিসহ বাকি চারজন বিচারক বিচারপতি শাহের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের কিছু করার ছিল না, কারণ একমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই এ ক্ষেত্রে রীতি।
১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতি জয়ন্তী মনিলাল শেলাত, কাউদুর সদানন্দ হেগড়ে ও অমর নাথ গ্রোভারকে পাশ কাটিয়ে তাঁদের কনিষ্ঠ অজিত নাথ রায়কে ভারতের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেন। অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীন এবং ইন্দিরার বিবেচনায় ‘প্রগতিশীল’ না হওয়াটাই এর পেছনে কাজ করেছে।
বিচারপতি শেলাতের অবসরে যেতে তখন মাত্র এক মাস বাকি ছিল। কিন্তু হেগডের তখনো দুই বছর বাকি ছিল। তাঁর আদালতে ইন্দিরার নির্বাচিত হওয়া বিষয়ে একটি আবেদন বিচারাধীন ছিল। ইন্দিরার দেওয়া হলফনামায় তিনি সত্যের বরখেলাপ দেখতে পান। তিনি আসলে ইন্দিরাকে সাহায্যই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইন্দিরার উপদেষ্টারা ভাবলেন উল্টো। আর বিচারপতি অজিত নাথ রায়ের থেকে জ্যেষ্ঠ হওয়ার কারণে বিচারপতি গ্রোভার তখন পদত্যাগ করেন। এটি ছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতাকে পদদলিত করা এবং সুপ্রিম কোর্টের সম্মান ও মর্যাদা অবমাননার এক স্পষ্ট ও নির্লজ্জ প্রচেষ্টা। রাজনৈতিক চাপের কাছে বিচার বিভাগকে পদানত এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রভাবের ওপর নির্ভরশীল করতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা।
তবে বিচারপতি শাহকে পাশ কাটানোর ক্ষেত্রে এই বিষয়টি কাজ করেনি। এ ক্ষেত্রে কারও বিপক্ষে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তাঁর সাহসটাই কাল হয়েছে। কয়েক বছর আগে তিনি ও বিচারপতি কাপাডিয়া যখন মুম্বাই হাইকোর্ট বেঞ্চে ছিলেন, তখন তিনি কাপাডিয়ার মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছিলেন। প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিচারক নিয়োগ পরিষদের যে সভায় ব্যাপক হট্টগোল হয়েছিল, সেখানে বিচারপতি শাহের নিয়োগ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়। চার বিচারক একপক্ষে আর কাপাডিয়া অন্য পক্ষে। বলা হয়েছে, আলোচনার শেষ হয়েছে বিচারপতি কাপাডিয়ার এমন মন্তব্যে যে, তাঁর মৃতদেহের ওপরই শাহের নিযুক্তি হতে পারে—এর আগে নয়।
অন্য চার বিচারকের বিপরীতে বিচারপতি কাপাডিয়ার অবস্থানটিই কেমন করে জয়ী হলো, তা এখনো এক ধাঁধা। মনে হয়, বাকিরা বিচারপতি শাহের পক্ষে শক্ত লড়াই চালাননি। সত্যি যাই হোক, বিচারপতি কাপাডিয়া তাঁর ভেটো প্রয়োগ করেছিলেন। জেষ্ঠ্য বিচারপতিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আরও একটি দৃষ্টান্ত আমার মনে পড়ছে। তখনকার মধ্যপ্রদেশের প্রধান বিচারপতি বিচারপতি এ কে পত্মায়েকের নিয়োগ অজানা কারণে প্রায় দেড় বছর আগে আটকে দিয়েছিলেন বিচারপতি অরজিত পাসায়াত। পত্নায়েক বিচারক হিসেবে অসাধারণ; তিনি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সব সময়। নর্মদা বাঁধের কারণে উত্খাত হওয়া জনগণকে পুনর্বাসন না করা পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার পর বাঁধ নির্মাণ বন্ধ রাখতে হবে—তাঁর এ রায়ের কথা মানবাধিকার কর্মীরা সন্তুষ্টচিত্তে স্মরণ করেন। উচ্চ আদালতের বিচারক বাছাই পরিষদের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের আরেকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। ঝাড়খন্ড বেঞ্চের নারী প্রধান বিচারপতি জ্ঞান মিশ্রের অবস্থান জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে ওপরের দিকে ছিল। তাঁকে অগ্রাহ্য করা হলে, পুনর্বিবেচনার জন্য প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ে সুপ্রিম কোর্টে নথি ফেরত পাঠান। নির্বাহী বিভাগের এই পদক্ষেপের পেছনে সম্ভবত কারণ ছিল এই যে, সুপ্রিম কোর্টে গত চার-পাঁচ বছরে কোনো নারী বিচারক ছিলেন না। তবুও বিচারক বাছাই পরিষদ জ্ঞান মিশ্রকে পাশ কাটিয়ে সি কে প্রসাদকে নিযুক্ত করেন। একজন নারী বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টে জায়গা করে নিতে পারেননি।
এসব উদাহরণ থেকে পরিষ্কার যে বিচারক বাছাই পরিষদ একটি গোপন সংস্থা; এটি অস্বচ্ছ ও উদ্ভট পথে বাছাই কাজটি করে। বিচারপতি শাহ অবসরে যাওয়ার পর গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেন, সুপ্রিম কোর্টে যেতে না পারার জন্য যে ‘আহত না হওয়ার ভান’ তিনি করতে পারেননি। তিনি কেন তার মনোকষ্ট প্রকাশ করেছিলেন তা অনুধাবনযোগ্য। এ পেশার অধিকাংশই সর্বোচ্চ পদে যেতে আগ্রহী থাকেন। সর্বোচ্চ পদে যেতে না পারার জন্য বিচারপতি শাহের ক্ষোভ স্বাভাবিক। বিচারপতি কাপাডিয়া ও বিচারপতি পাসায়াত যথাক্রমে বিচারপতি শাহ ও বিচারপতি পাটনায়েকের নিয়োগ কেন আটকে দিলেন, তাঁর কারণ তাঁদের অবশ্যই জানাতে হবে। তাঁদের মর্জিমাফিক সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিত নয়। যুক্তির সমর্থন থাকতে হবে। বিচারক বাছাই পরিষদের কোন বিচারকের পক্ষপাতিত্বের ওপর তা ছেড়ে দেওয়া যায় না।
সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন জ্যেষ্ঠতম বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এই পরিষদ সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ করেন। হাইকোর্টের তিন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ সেশন জজসহ নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগ দেন। এ সিদ্ধান্তগুলো কী সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নেওয়া উচিত নয়? মতৈক্যে পৌঁছার চেষ্টা থাকা উচিত। কিন্তু সেটা অসম্ভব হয়ে পড়লে একজনের কথাই চূড়ান্ত কেন হবে?
ভারত সরকার বিচারপতি শাহকে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কিছুটা হলেও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে পারে। কিন্তু আইনমন্ত্রী বীরাপ্পা মইলি এ কাজে অনিচ্ছুক। বিচারপতি কাপাডিয়া সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারতি হওয়ার ক্ষেত্রে অপেক্ষমাণ তালিকায় প্রথমে আছেন। তিনি যাতে আহত না বোধ করেন বীরাপ্পা তাই চান। সরকারের পুরো আওতার মধ্যে একটি পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারপতি কাপাডিয়ার ইচ্ছাকে মইলি অযথা বিবেচনায় আনছেন। সুপ্রিম কোর্টের তো এ ব্যাপারে কিছু করার নেই।
স্বীকার করতেই হবে, পাকিস্তানের আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীকে পুনর্বহাল করার লড়াইয়ে জিতে দেশটির বিচার বিভাগের সাধুতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি স্বেচ্ছাচারীভাবে বিচারপতি সাকিব নিসারকে লাহোর হাইকোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং বিচারপতি খাজাকে সুপ্রিম কোর্টে উন্নীত করেছিলেন। জারদারি এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীর সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। এতে বিচারপতিদ্বয় শপথ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাঁরা চান তাঁদের নিয়োগ প্রধান বিচারপতি কর্তৃক অনুমোদিত হোক। সারা দেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধানের পেছনে দাঁড়িয়েছে; দেশকে সাংবিধানিক সংকটে ঠেলে দেওয়ার জন্য জারদারিকে দায়ী করেছে। বিরোধী নেতা নওয়াজ শরিফ এই নিয়োগকে আখ্যায়িত করেছেন ‘গণতন্ত্র হত্যা’ বলে। আইনজীবীরা আবার ধর্মঘটের হুমকি দিচ্ছেন।
পাকিস্তানের বিচার বিভাগ থেকে ভারতের বিচার বিভাগ যা শিখতে পারে তা হলো, যথাযথ বিধি মেনে বিচারক না নিযুক্ত হলে তারা শপথ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। বিশেষত সুপ্রিম কোর্টের এই বিষয়টি মনোযোগে আনা প্রয়োজন। যেভাবে বিচারপতি শাহকে পাশ কাটানো হয়েছে, তা একদমই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে জনগণের কিছু করার নেই। এ বিষয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা হওয়া উচিত। বিশেষ করে, কথা হওয়া উচিত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ পরিষদের বিচারকদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বলি হওয়া কেমন করে ঠেকানো যায়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।।
১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতি জয়ন্তী মনিলাল শেলাত, কাউদুর সদানন্দ হেগড়ে ও অমর নাথ গ্রোভারকে পাশ কাটিয়ে তাঁদের কনিষ্ঠ অজিত নাথ রায়কে ভারতের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেন। অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীন এবং ইন্দিরার বিবেচনায় ‘প্রগতিশীল’ না হওয়াটাই এর পেছনে কাজ করেছে।
বিচারপতি শেলাতের অবসরে যেতে তখন মাত্র এক মাস বাকি ছিল। কিন্তু হেগডের তখনো দুই বছর বাকি ছিল। তাঁর আদালতে ইন্দিরার নির্বাচিত হওয়া বিষয়ে একটি আবেদন বিচারাধীন ছিল। ইন্দিরার দেওয়া হলফনামায় তিনি সত্যের বরখেলাপ দেখতে পান। তিনি আসলে ইন্দিরাকে সাহায্যই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ইন্দিরার উপদেষ্টারা ভাবলেন উল্টো। আর বিচারপতি অজিত নাথ রায়ের থেকে জ্যেষ্ঠ হওয়ার কারণে বিচারপতি গ্রোভার তখন পদত্যাগ করেন। এটি ছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতাকে পদদলিত করা এবং সুপ্রিম কোর্টের সম্মান ও মর্যাদা অবমাননার এক স্পষ্ট ও নির্লজ্জ প্রচেষ্টা। রাজনৈতিক চাপের কাছে বিচার বিভাগকে পদানত এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রভাবের ওপর নির্ভরশীল করতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা।
তবে বিচারপতি শাহকে পাশ কাটানোর ক্ষেত্রে এই বিষয়টি কাজ করেনি। এ ক্ষেত্রে কারও বিপক্ষে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তাঁর সাহসটাই কাল হয়েছে। কয়েক বছর আগে তিনি ও বিচারপতি কাপাডিয়া যখন মুম্বাই হাইকোর্ট বেঞ্চে ছিলেন, তখন তিনি কাপাডিয়ার মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছিলেন। প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিচারক নিয়োগ পরিষদের যে সভায় ব্যাপক হট্টগোল হয়েছিল, সেখানে বিচারপতি শাহের নিয়োগ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়। চার বিচারক একপক্ষে আর কাপাডিয়া অন্য পক্ষে। বলা হয়েছে, আলোচনার শেষ হয়েছে বিচারপতি কাপাডিয়ার এমন মন্তব্যে যে, তাঁর মৃতদেহের ওপরই শাহের নিযুক্তি হতে পারে—এর আগে নয়।
অন্য চার বিচারকের বিপরীতে বিচারপতি কাপাডিয়ার অবস্থানটিই কেমন করে জয়ী হলো, তা এখনো এক ধাঁধা। মনে হয়, বাকিরা বিচারপতি শাহের পক্ষে শক্ত লড়াই চালাননি। সত্যি যাই হোক, বিচারপতি কাপাডিয়া তাঁর ভেটো প্রয়োগ করেছিলেন। জেষ্ঠ্য বিচারপতিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আরও একটি দৃষ্টান্ত আমার মনে পড়ছে। তখনকার মধ্যপ্রদেশের প্রধান বিচারপতি বিচারপতি এ কে পত্মায়েকের নিয়োগ অজানা কারণে প্রায় দেড় বছর আগে আটকে দিয়েছিলেন বিচারপতি অরজিত পাসায়াত। পত্নায়েক বিচারক হিসেবে অসাধারণ; তিনি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সব সময়। নর্মদা বাঁধের কারণে উত্খাত হওয়া জনগণকে পুনর্বাসন না করা পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার পর বাঁধ নির্মাণ বন্ধ রাখতে হবে—তাঁর এ রায়ের কথা মানবাধিকার কর্মীরা সন্তুষ্টচিত্তে স্মরণ করেন। উচ্চ আদালতের বিচারক বাছাই পরিষদের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের আরেকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। ঝাড়খন্ড বেঞ্চের নারী প্রধান বিচারপতি জ্ঞান মিশ্রের অবস্থান জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে ওপরের দিকে ছিল। তাঁকে অগ্রাহ্য করা হলে, পুনর্বিবেচনার জন্য প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ে সুপ্রিম কোর্টে নথি ফেরত পাঠান। নির্বাহী বিভাগের এই পদক্ষেপের পেছনে সম্ভবত কারণ ছিল এই যে, সুপ্রিম কোর্টে গত চার-পাঁচ বছরে কোনো নারী বিচারক ছিলেন না। তবুও বিচারক বাছাই পরিষদ জ্ঞান মিশ্রকে পাশ কাটিয়ে সি কে প্রসাদকে নিযুক্ত করেন। একজন নারী বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টে জায়গা করে নিতে পারেননি।
এসব উদাহরণ থেকে পরিষ্কার যে বিচারক বাছাই পরিষদ একটি গোপন সংস্থা; এটি অস্বচ্ছ ও উদ্ভট পথে বাছাই কাজটি করে। বিচারপতি শাহ অবসরে যাওয়ার পর গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেন, সুপ্রিম কোর্টে যেতে না পারার জন্য যে ‘আহত না হওয়ার ভান’ তিনি করতে পারেননি। তিনি কেন তার মনোকষ্ট প্রকাশ করেছিলেন তা অনুধাবনযোগ্য। এ পেশার অধিকাংশই সর্বোচ্চ পদে যেতে আগ্রহী থাকেন। সর্বোচ্চ পদে যেতে না পারার জন্য বিচারপতি শাহের ক্ষোভ স্বাভাবিক। বিচারপতি কাপাডিয়া ও বিচারপতি পাসায়াত যথাক্রমে বিচারপতি শাহ ও বিচারপতি পাটনায়েকের নিয়োগ কেন আটকে দিলেন, তাঁর কারণ তাঁদের অবশ্যই জানাতে হবে। তাঁদের মর্জিমাফিক সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিত নয়। যুক্তির সমর্থন থাকতে হবে। বিচারক বাছাই পরিষদের কোন বিচারকের পক্ষপাতিত্বের ওপর তা ছেড়ে দেওয়া যায় না।
সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন জ্যেষ্ঠতম বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এই পরিষদ সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ করেন। হাইকোর্টের তিন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ সেশন জজসহ নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগ দেন। এ সিদ্ধান্তগুলো কী সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নেওয়া উচিত নয়? মতৈক্যে পৌঁছার চেষ্টা থাকা উচিত। কিন্তু সেটা অসম্ভব হয়ে পড়লে একজনের কথাই চূড়ান্ত কেন হবে?
ভারত সরকার বিচারপতি শাহকে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়ে কিছুটা হলেও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে পারে। কিন্তু আইনমন্ত্রী বীরাপ্পা মইলি এ কাজে অনিচ্ছুক। বিচারপতি কাপাডিয়া সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারতি হওয়ার ক্ষেত্রে অপেক্ষমাণ তালিকায় প্রথমে আছেন। তিনি যাতে আহত না বোধ করেন বীরাপ্পা তাই চান। সরকারের পুরো আওতার মধ্যে একটি পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারপতি কাপাডিয়ার ইচ্ছাকে মইলি অযথা বিবেচনায় আনছেন। সুপ্রিম কোর্টের তো এ ব্যাপারে কিছু করার নেই।
স্বীকার করতেই হবে, পাকিস্তানের আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীকে পুনর্বহাল করার লড়াইয়ে জিতে দেশটির বিচার বিভাগের সাধুতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি স্বেচ্ছাচারীভাবে বিচারপতি সাকিব নিসারকে লাহোর হাইকোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং বিচারপতি খাজাকে সুপ্রিম কোর্টে উন্নীত করেছিলেন। জারদারি এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীর সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। এতে বিচারপতিদ্বয় শপথ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাঁরা চান তাঁদের নিয়োগ প্রধান বিচারপতি কর্তৃক অনুমোদিত হোক। সারা দেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধানের পেছনে দাঁড়িয়েছে; দেশকে সাংবিধানিক সংকটে ঠেলে দেওয়ার জন্য জারদারিকে দায়ী করেছে। বিরোধী নেতা নওয়াজ শরিফ এই নিয়োগকে আখ্যায়িত করেছেন ‘গণতন্ত্র হত্যা’ বলে। আইনজীবীরা আবার ধর্মঘটের হুমকি দিচ্ছেন।
পাকিস্তানের বিচার বিভাগ থেকে ভারতের বিচার বিভাগ যা শিখতে পারে তা হলো, যথাযথ বিধি মেনে বিচারক না নিযুক্ত হলে তারা শপথ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। বিশেষত সুপ্রিম কোর্টের এই বিষয়টি মনোযোগে আনা প্রয়োজন। যেভাবে বিচারপতি শাহকে পাশ কাটানো হয়েছে, তা একদমই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে জনগণের কিছু করার নেই। এ বিষয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা হওয়া উচিত। বিশেষ করে, কথা হওয়া উচিত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ পরিষদের বিচারকদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বলি হওয়া কেমন করে ঠেকানো যায়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।।
No comments