সংসদ-একটি পার্লামেন্টারি বিতর্কের পুনর্পাঠ by জালাল ফিরোজ

একটি পুরনো বিতর্কের কথা আমরা বলব। সংসদের বাজেট অধিবেশন চলছে। নবম অধিবেশনে বিরোধী দল যোগ দিয়েছিল। সেখানে উল্লেখযোগ্য কোনো পার্লামেন্টারি বিতর্ক হয়নি। তবে অশোভন আচরণ ও অশ্লীল বাক্য বিনিময় হয়েছে।


বলা হয়, পার্লামেন্টের প্রাণ বিতর্ক। বিতর্কের জায়গাই পার্লামেন্ট। পার্লামেন্টের নির্যাস এর বিতর্ক। পার্লামেন্টারি বিতর্ক পার্লামেন্টের মানের পরিচায়ক। বিতর্ক তর্কযুদ্ধ নয়। বিতর্কের মাধ্যমে মূল্যবান তথ্য সংরক্ষিত হয়। এই তথ্য এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে পেঁৗছে। বাংলাদেশে পার্লামেন্ট আছে। পার্লামেন্টে বড় বড় 'ভাষণ' আছে কিন্তু বিতর্ক নেই। এর অর্থ দেহ আছে, দেহের মধ্যে প্রাণ নেই। তবে সবসময় পরিস্থিতি এমন ছিল না। বাংলাদেশের পার্লামেন্টারি ঐতিহ্যের কথা আমরা জানি। ব্রিটিশ-বাংলায় কিংবা পাকিস্তানি আমলেও পার্লামেন্টে অনেক সুন্দর বিতর্ক হয়েছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম পার্লামেন্টের শুরুটাও ছিল অসাধারণ। প্রথম সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠক বসে ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। সংসদের প্রথম দিন সাধারণত বিতর্ক হয় না। তবে ওইদিন বিতর্ক হয়েছিল।
নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন সাধারণত কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। নতুন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। সভাপতি প্যানেল নির্বাচিত হয়। সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময় করেন। বাংলাদেশের প্রথম সংসদের প্রথম দিনও এসব অনুষ্ঠান হয়। তিনটি বৈধতার প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। প্রথম ও তৃতীয় বৈধতার প্রশ্নটি তোলেন আতাউর রহমান খান এবং দ্বিতীয়টি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। আতাউর রহমান খানের প্রথম বৈধতার প্রশ্নটি ছিল প্রধানমন্ত্রীকে কেবল মন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করা যাবে কি-না বিষয়ে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদের শুরুতে পবিত্র কোরআন ও গীতার সঙ্গে বাইবেল পাঠেরও প্রস্তাব করেন। প্রতিটি বৈধতার প্রশ্ন নিয়ে সংসদে বিতর্ক হয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক হয় তৃতীয় বৈধতার প্রশ্নটি নিয়ে।
তৃতীয় প্রশ্নটি উত্থাপন করে আতাউর রহমান খান বলেন, সংবিধানের ৭৩ ধারা অনুসারে আজ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ থাকা উচিত ছিল। কিন্তু দিনের কার্যসূচিতে রাষ্ট্রপতির ভাষণের কোনো ঘোষণা আমরা পাইনি। এতে আমরা সংবিধানের বিধান লঙ্ঘন করতে যাচ্ছি। সংবিধান অনুসারে প্রথম অধিবেশনের 'সূচনায়' আজ রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, সংবিধান এমন ছোটখাটো বিধান যদি লঙ্ঘন করতে থাকি তবে ভবিষ্যতে আমরা আরও বড় ধরনের লঙ্ঘন করব।
আসাদুজ্জামান খান পদ্ধতিগত প্রশ্ন তুলে বলেন, সদস্যরা শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত সংসদ পূর্ণাঙ্গ হয় না_ স্পিকারের এই রুলিং আতাউর রহমান খান ইতিপূর্বে গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেবেন। আসাদুজ্জামান খান ব্রিটিশ পার্লামেন্টের রীতির উল্লেখ করে বলেন, সেখানে স্পিকার নির্বাচন, সদস্যদের শপথ গ্রহণের পর পার্লামেন্টে রানী ভাষণ দেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির ভাষণের আগে সংসদে আর কোনো কার্যসূচি সম্পাদন করা উচিত হবে না।
এরপর আতাউর রহমান খান জানতে চান শনিবারের এই অধিবেশন প্রথম অধিবেশন কি-না? যদি প্রথম অধিবেশন হয়ে থাকে তবে সংবিধানের ৭৩ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতির আজ (শনিবার) ভাষণ দেওয়া উচিত। নইলে এতে 'কিছুদূর গিয়া মর্দ রওয়ানা হইল' জাতীয় অবস্থা দাঁড়াবে।
মনোরঞ্জন ধর বলেন, সদস্যদের শপথ গ্রহণ ও স্পিকার নির্বাচনের মাধ্যমে এই মাত্র সংসদের কাজ শুরু হলো। ৭৩ ধারার সূচনা শব্দের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, 'সূচনা মানে এই মুহূর্ত নয়।' সংসদের এই মুহূর্তে কেবল অঙ্কুরোদ্গম হলো। তিনি সংসদের অধিবেশন শব্দের সংজ্ঞার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, সংসদের একাধিক বৈঠকের সমন্বয়ই হলো অধিবেশন। তিনি সংসদের শনিবারের কার্যসূচি সম্পাদন করার পক্ষে মত ব্যক্ত করতে গিয়ে সংবিধানের ৭৬ ধারার উলেল্গখ করেন। তিনি বলেন, সংসদের নীতি হলো, রাষ্ট্রপতির ভাষণে সরকারের নীতি প্রতিফলিত হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ১০ এপ্রিল সংসদে ভাষণ দেবেন। আজ শনিবার রাষ্ট্রপতির ভাষণ দিতে হলে তাকে সরকারের নীতি জানতে হবে। অল্প সময়ে তা সম্ভব নয়। মনোরঞ্জন ধর বলেন, ব্যবহারিক দিক, আইনগত দিক ও গণতন্ত্রের দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে, সংবিধানের কোনো বিধান লঙ্ঘন হয়নি।
এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, সংসদের প্রথম অধিবেশনের জন্য রাষ্ট্রপতির ভাষণ বাধ্যতামূলক। সংসদের সূচনা হবে রাষ্ট্রপতির ভাষণের মাধ্যমে।
বিতর্কে অংশ নিয়ে তাহের উদ্দিন ঠাকুর আতাউর রহমান খান ও আসাদুজ্জামান খানের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, সংবিধানে যে রাষ্ট্রপতির ভাষণদানের উলেল্গখ রয়েছে সেই রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের দ্বারা এখনও নির্বাচিত হননি। এরপর আসাদুজ্জামান খান আবার পদ্ধতিগত প্রশ্ন তুলে বলেন, রাষ্ট্রপতির ভাষণের আগে সংসদের অন্য কোনো কর্মসূচি সম্পাদন করা যেতে পারে না। তিনি ভারতীয় ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কথা উলেল্গখ করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর কামাল হোসেন বলেন, সংসদের বৈঠক ও অধিবেশনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তিনি বলেন, বিধান অনুসারে প্রথম বৈঠকে যেসব কাজ করার নির্দেশ রয়েছে তা আমাদের অবশ্যই সম্পাদন করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, প্রথম দিনের বৈঠককেই অধিবেশনের প্রথম বলা যায় না। গোড়ার দিকের যে কোনো বৈঠককেই সূচনা বলা যায়। তিনি রাষ্ট্রপতির ভাষণ সম্পর্কে বলেন, বছরের মাঝখানে অধিবেশন হলে রাষ্ট্রপতির ভাষণ দিতে পারেন, নাও পারেন। নতুন নির্বাচনের পর প্রত্যেক অধিবেশনের সূচনায় এবং প্রত্যেক বছরের প্রথম অধিবেশনে তিনি ভাষণ দেবেন। সদস্যদের বক্তব্য শোনার পর স্পিকার জানান যে এ বিষয়ে তিনি রুলিং দেবেন। এভাবে বিতর্কের অবসান ঘটে।
এই বিতর্ক থেকে কিছু বিষয় স্পষ্ট হচ্ছে এবং এগুলো থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায় সরকারি বা বিরোধী দলের কোনো সদস্য কোনো বিষয়ে বক্তব্য রাখলে বা একটি যুক্তি দিলে তার দলের সব সদস্য তাকে সমর্থন করেন। তার বক্তব্য ভুল হোক বা অযৌক্তিক হোক দলের কারণে সকলের 'পবিত্র দায়িত্ব' হয়ে পড়ে তাকে সমর্থন করা। অথচ ৭ এপ্রিল আমরা তা দেখিনি। নিজ দলের সদস্যের মতের বিরুদ্ধেও বক্তব্য রেখেছেন। এখন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের দাবি উঠেছে। এ দাবি যথার্থ এবং ৭০ অনুচ্ছেদ অবশ্যই বাতিল করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, ৭০ অনুচ্ছেদে সদস্যদের নিজ দলের অন্য সদস্যের মতের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না_ এ কথা বলা হয়নি। আর ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হলেই সব সদস্য স্বাধীনভাবে কথা বলা শুরু করে দেবেন তা-ও মনে করা যায় না। আমরা দলের ফোরামে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভিন্নমত উচ্চারিত হতে দেখি না। ভিন্নমত ধারণ ও প্রকাশের ক্ষমতা থাকা যেমন দরকার তেমনি দরকার ভিন্নমত গ্রহণের মত উদারতা। ভিন্নমত মানে বিরুদ্ধ মত নয়। ভিন্নমত বিতর্কের সুযোগ করে দেয়। বিতর্ক নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটায় ও নতুন পথের সন্ধান দেয়। বাংলাদেশের বড় দলগুলোর হাইকমান্ড ভিন্নমতকে উৎসাহিত করে না। আবার এটাও সত্য যে দলের মধ্যে যাদের ভিন্নমত বা উন্নত চিন্তা আছে তারা ধারাবাহিকভাবে 'মতাদর্শিক সংগ্রাম' চালান না বা সহজেই আত্মসমর্পণ করেন। ৭০ অনুছেদ সত্ত্বেও, দলের অবস্থানের বিরুদ্ধে গেলেও, একজন সদস্য সংসদে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেন। বিরোধী দলের কোনো সদস্য কি একটিও যৌক্তিক কথা বলেন না যা সরকারি দলের একজন সমর্থন করতে পারেন। অথবা সরকার কি একটিও ভালো কাজ করছে না যা বিরোধী দলের অন্তত একজন সদস্যও সমর্থন করতে পারেন না? আসলে দরকার মানসিকতার পরিবর্তন। সাহস এবং যুক্তি ও চিন্তার গভীরতা। পার্লামেন্টারি আলোচনা বা বিতর্কের সৌন্দর্য তখনই পরিস্ফুটিত হয় যখন শুভ ও উন্নততর বক্তব্য ও চিন্তা সমর্থিত হয় এবং জনস্বার্থবিরোধী, কূপমণ্ডূক, অশোভন কাজ, চিন্তা সমালোচিত ও বর্জিত হয়। দলের সদস্য যা বলেন কেবল তা-ই যদি সমর্থন করতে হয় তাহলে সংসদে চিন্তাশীল মানুষ না পাঠালেই ভালো হয়।

জালাল ফিরোজ :গবেষক
jfiroj2002@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.