এসএসসির ফলাফল-বৈষম্য দূর হোক by রাশেদা কে চৌধূরী
বাংলাদেশে শিক্ষার জন্য চাহিদা তৈরি হয়ে গেছে। সবাই শিক্ষিত হতে চায়। এ দেশের দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীও তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে চায়। বিপুল হারে ছাত্রছাত্রী ভর্তি হচ্ছে, বিশাল সংখ্যায় কৃতকার্যও হচ্ছে।
এ বছর এসএসসি পরীক্ষার ফল শিক্ষার প্রতি এ দেশের মানুষের চাহিদার প্রতিফলন বলে আমি মনে করি। এসএসসির এই ফলকে আমরা সাধুবাদ জানাই। এই ফল আমাদের জন্য যেমন অর্জনের, ঠিক তেমনি চ্যালেঞ্জেরও বটে। আমাদের দেশে এখনো প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সংখ্যা অনেক বেশি। সরকারি হিসাবেই মোট এক-চতুর্থাংশ ছাত্রছাত্রী প্রাথমিক স্তরে ঝরে পড়ে। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় ৩০ ভাগ। অর্থাৎ, আমরা প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তরে মোট ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে আনতে পারছি। এরা আসছে, টিকছে, ঝরে যাচ্ছে না।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ফল ভালো হওয়ার মূল কারণ হিসেবে আমি বলব সৃজনশীল প্রশ্নপত্র পদ্ধতি। সৃজনশীল প্রশ্নে ছাত্রছাত্রীরা ভালো করছে বলেই পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে। আগে শিক্ষার্থীরা ভীতির কারণেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে—গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ে খারাপ করত। সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নে এই বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ভীতি কমে এসেছে। শিক্ষকদের সৃজনশীল পদ্ধতির ব্যাপারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার কারণেও এসএসসিতে পাসের হার বেড়েছে।
এত ভালো ফলের মধ্যেও একটি ব্যাপারে কিন্তু আশঙ্কা থেকেই যায়। এখনো ফলাফলে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা এগিয়ে আছে। এসএসসি পরীক্ষার আগেই ঝরে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি এখনো বাবা-মায়েরা মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ে থাকেন। তাদের স্কুলে পাঠিয়ে স্বস্তিতে না থাকতে পারার কারণেই এসএসসি পর্যায়ে ঝরে পড়া মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি।
এর পাশাপাশি এসএসসি পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে পারিবারিকভাবে যে বিনিয়োগ দরকার হয়, তাতে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত পরিবার মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের পেছনেই ওই বিনিয়োগটা অধিক কার্যকর মনে করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্ন মাধ্যমিক শ্রেণীতে যেখানে ছেলেদের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি মেয়ে ভর্তি হয়, সেখানে দশম শ্রেণীতে উঠতে উঠতে মেয়েদের সংখ্যা কমে যায় সেই ১১ শতাংশই। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের ব্যাপার। এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে।
সামাজিক বিনিয়োগ বৈষম্যের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৈষম্য দূর করারও সময় এসে গেছে। ক্যাডেট কলেজ, সরকারি স্কুল ও সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত স্কুলে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় বেসরকারি স্কুলগুলোর তুলনায় তিন-চার গুণ বেশি। এই বিনিয়োগে বৈষম্য দূর হলে ফল আরও ভালো হবে বলে আমি মনে করি।
এই মুহূর্তে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশের বেশি ব্যয় করা হয় না, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নিম্নতম। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্যও প্রয়োজন মোট দেশজ উৎপাদনের চার শতাংশ।
বাংলাদেশে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। মাধ্যমিক স্তরে কিংবা এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে যারা ঝরে পড়ছে, তাদের সংখ্যা অনেক। কেবল এসএসসি পাস করতে না পারার ব্যর্থতা ও অক্ষমতার কারণে একটি মোটামুটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মেধা অপচয় হবে—সেটা হতে দেওয়া যায় না। সে কারণে সরকারি তরফ থেকে বৃত্তিমূলক, উপ-আনুষ্ঠানিক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো জরুরি। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে ছেলেমেয়েদের কী লাভ, তা আমরা এখনো জনসাধারণকে বোঝাতে পারিনি। বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেলে আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো যেত দারুণভাবে।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার দেখে অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের চিন্তার মূল বিষয় হলো, ভালো ফল করা বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। ৮২ হাজার ২১২ জন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে বেশির ভাগই ভর্তি হতে পারবে না সেই সব কলেজে, যেগুলোকে আমরা সত্যিকার অর্থেই ‘ভালো’ কলেজ হিসেবে জানি। সরকারি তরফ থেকে প্রতিটি কলেজের মান উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেই কিন্তু স্বল্প মেয়াদে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যায়। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এ ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের উদাহরণ দিতে চাই। থাইল্যান্ড সরকার প্রতিবছর তাদের পাবলিক পরীক্ষায় খারাপ ফল করা স্কুল-কলেজগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের মানোন্নয়নের উদ্যোগ নেয়। কোনো পাবলিক পরীক্ষায় কোনো স্কুল-কলেজের ৫০ শতাংশের বেশি যদি পাস করতে না পারে, তাহলে তাদের একটি প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। তাদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও যদি এই ধরনের উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
কিছু ‘ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে’র দিকে তাকিয়ে না থেকে সরকার যদি এ ধরনের ব্যবস্থা হাতে নেয়, তাহলে আর সংকট থাকবে না। আশার কথা, সরকার এ ধরনের ব্যবস্থা হাতে নিচ্ছে। তবে সেটা কেন্দ্রীভূতভাবে না নিয়ে কিছুটা বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
রাশেদা কে চৌধূরী: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় ফল ভালো হওয়ার মূল কারণ হিসেবে আমি বলব সৃজনশীল প্রশ্নপত্র পদ্ধতি। সৃজনশীল প্রশ্নে ছাত্রছাত্রীরা ভালো করছে বলেই পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে। আগে শিক্ষার্থীরা ভীতির কারণেই হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে—গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ে খারাপ করত। সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নে এই বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ভীতি কমে এসেছে। শিক্ষকদের সৃজনশীল পদ্ধতির ব্যাপারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার কারণেও এসএসসিতে পাসের হার বেড়েছে।
এত ভালো ফলের মধ্যেও একটি ব্যাপারে কিন্তু আশঙ্কা থেকেই যায়। এখনো ফলাফলে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা এগিয়ে আছে। এসএসসি পরীক্ষার আগেই ঝরে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি এখনো বাবা-মায়েরা মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ে থাকেন। তাদের স্কুলে পাঠিয়ে স্বস্তিতে না থাকতে পারার কারণেই এসএসসি পর্যায়ে ঝরে পড়া মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি।
এর পাশাপাশি এসএসসি পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে পারিবারিকভাবে যে বিনিয়োগ দরকার হয়, তাতে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত পরিবার মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের পেছনেই ওই বিনিয়োগটা অধিক কার্যকর মনে করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্ন মাধ্যমিক শ্রেণীতে যেখানে ছেলেদের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি মেয়ে ভর্তি হয়, সেখানে দশম শ্রেণীতে উঠতে উঠতে মেয়েদের সংখ্যা কমে যায় সেই ১১ শতাংশই। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের ব্যাপার। এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে।
সামাজিক বিনিয়োগ বৈষম্যের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৈষম্য দূর করারও সময় এসে গেছে। ক্যাডেট কলেজ, সরকারি স্কুল ও সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত স্কুলে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় বেসরকারি স্কুলগুলোর তুলনায় তিন-চার গুণ বেশি। এই বিনিয়োগে বৈষম্য দূর হলে ফল আরও ভালো হবে বলে আমি মনে করি।
এই মুহূর্তে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশের বেশি ব্যয় করা হয় না, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নিম্নতম। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্যও প্রয়োজন মোট দেশজ উৎপাদনের চার শতাংশ।
বাংলাদেশে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। মাধ্যমিক স্তরে কিংবা এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে যারা ঝরে পড়ছে, তাদের সংখ্যা অনেক। কেবল এসএসসি পাস করতে না পারার ব্যর্থতা ও অক্ষমতার কারণে একটি মোটামুটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মেধা অপচয় হবে—সেটা হতে দেওয়া যায় না। সে কারণে সরকারি তরফ থেকে বৃত্তিমূলক, উপ-আনুষ্ঠানিক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো জরুরি। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে ছেলেমেয়েদের কী লাভ, তা আমরা এখনো জনসাধারণকে বোঝাতে পারিনি। বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেলে আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো যেত দারুণভাবে।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার দেখে অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের চিন্তার মূল বিষয় হলো, ভালো ফল করা বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। ৮২ হাজার ২১২ জন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে বেশির ভাগই ভর্তি হতে পারবে না সেই সব কলেজে, যেগুলোকে আমরা সত্যিকার অর্থেই ‘ভালো’ কলেজ হিসেবে জানি। সরকারি তরফ থেকে প্রতিটি কলেজের মান উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেই কিন্তু স্বল্প মেয়াদে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যায়। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এ ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের উদাহরণ দিতে চাই। থাইল্যান্ড সরকার প্রতিবছর তাদের পাবলিক পরীক্ষায় খারাপ ফল করা স্কুল-কলেজগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের মানোন্নয়নের উদ্যোগ নেয়। কোনো পাবলিক পরীক্ষায় কোনো স্কুল-কলেজের ৫০ শতাংশের বেশি যদি পাস করতে না পারে, তাহলে তাদের একটি প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। তাদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও যদি এই ধরনের উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
কিছু ‘ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে’র দিকে তাকিয়ে না থেকে সরকার যদি এ ধরনের ব্যবস্থা হাতে নেয়, তাহলে আর সংকট থাকবে না। আশার কথা, সরকার এ ধরনের ব্যবস্থা হাতে নিচ্ছে। তবে সেটা কেন্দ্রীভূতভাবে না নিয়ে কিছুটা বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
রাশেদা কে চৌধূরী: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।
No comments