নিখোঁজদের সন্ধান মেলে না বাড়ছে বেওয়ারিশ লাশ by পারভেজ খান
বিভিন্ন হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও পুলিশের তথ্য মতে, গত বছরের শুরু থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত সারা দেশে ২৭০ জন নিখোঁজ হয়েছে, যাদের এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। হিসাবে আরো এক বছর পিছিয়ে গেলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৪০০।
আর এর সবই যে গুপ্তহত্যা, গুম বা অপহরণ, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও এটা সত্য যে তারা এখনো নিখোঁজ। অন্যদিকে একের পর এক বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন নদীসহ দেশের নানা এলাকায়। এগুলোরও বেশির ভাগেরই পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। গত এক বছরে সারা দেশে ৭৪ জনের লাশ পাওয়া গেছে, যাদের পরিচয় আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি বেওয়ারিশ লাশ পাওয়ার হার বেড়ে গেছে। এসব কারণে সারা দেশে গুপ্তহত্যা আর গুম বলে যে আওয়াজ উঠেছে সেটাও দিন দিন আরো জোরালো হচ্ছে। এর কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না পুলিশ। বলা চলে, তারা অনেকটা ব্যর্থ। আর এর ফলে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। গতকাল ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূতরা এক সংবাদ সম্মেলনেও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের বিশ্ব অর্থবাজারেও এর প্রভাব পড়ছে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
এ ব্যাপারে পুলিশের ব্যর্থতার অভিযোগ অস্বীকার করে আইজিপি খন্দকার হাসান মাহমুদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনায় অপহৃত বা নিখোঁজ ব্যক্তিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলেই যে পুলিশ ব্যর্থ তা নয়। গুম বলে আসলে আইনের ভাষায় কিছু নেই। এটি হচ্ছে অপহরণ করে কাউকে আটকে রাখা। অপরাধ ঘটতেই পারে। তবে এসব ঘটনায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি হচ্ছে না সেটা নির্ভর করে আসলে ঘটনাটিগুলো কিভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তার ওপর।
আইজিপি বলেন, পুলিশ তার মতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেক অপহৃত ব্যক্তিকেই পুলিশ উদ্ধার করেছে। 'আমরা কখনো চাই না এ ধরনের অপরাধ ঘটুক। এটি অনভিপ্রেত। পুলিশ ও র্যাব যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে', বলেন তিনি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, যেকোনো নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সরকারের। সরকার এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। নাগরিকদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ ধরনের ঘটনাকে কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। সরকারের উচিত, অন্তত একটি ঘটনা হলেও সেটার সঠিক তদন্ত করে প্রকৃত রহস্য খুঁজে বের করা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র থেকে জানা যায়, তাদের একাধিক বৈঠকেও এ বিষয়গুলো নিয়ে অনেকবার আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় অনেকেই বলেছেন, একটি বিশেষ মহল দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য এসব অপহরণ আর হত্যা করে লাশ গুম করার ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি আলোচনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এসব নিয়ে সরকারি দল আর বিরোধী দল পরস্পরকে দোষারোপ করে একে অপরকে দায়ী করেছে। বলা হচ্ছে, এসবের পেছনে কাজ করছে একটি বিশেষ চক্র। কিন্তু পুলিশ, র্যাব বা কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কোনো তদন্তেই আজ পর্যন্ত বের হয়ে আসেনি এই 'একটি চক্র' কারা। এই অবস্থায় দেশের ভাবমূর্তির সর্বনাশ ক্রমশ ঘটেই চলেছে।
কর্মকর্তারা বলেন, এই গুম ঘটনা আজ নতুন নয়। ২০০৩ সালে বিএনপি নেতা শিল্পপতি জামাল উদ্দিন চৌধুরীকে গুম করা হলে তিন বছর পর মানিকছড়ির কাঞ্চননগর থেকে তাঁর কংকাল উদ্ধার করা হয়। ২০০৬ সালে সিলেট থেকে হাবিবুর রহমান নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি নিখোঁজ হন। আজও তাঁর সন্ধান মেলেনি। ২০০৭ সালে বরিশাল থেকে ছাত্রলীগ নেতা সফিকুল্লাহ নিখোঁজ হন। এখনো তিনি নিখোঁজ। নিখোঁজ আছেন এমন আলোচিতদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, যুবলীগ নেতা লিয়াকত হোসেন, আগারগাঁওয়ের বিএনপি নেতা ও শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ আর তাঁর জামাতা মান্নান, সিলেটের দুই যুবদল নেতা দিনার ও জুনেদ। সম্প্রতি নিখোঁজ হয়েছেন বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক। গত ৪ এপ্রিল আশুলিয়া থেকে নিখোঁজ হওয়ার একদিন পর টাঙ্গাইল থেকে উদ্ধার করা হয় শ্রমিক নেতা আমিনুলের লাশ। তবে ইলিয়াস আলী বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এবং আমিনুল ইসলাম শ্রমিক নেতা হওয়ার কারণে তাঁদের বিষয়গুলো দেশি-বিদেশি প্রচারমাধ্যমে জোরালোভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক আইজিপি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্ব পরিচিতিতে অনেক আগে বাংলাদেশকে বলা হতো জাদুর দেশ। আধুনিকতা আর শিক্ষার হার বেড়ে যাওয়ায় সে অপবাদ আজ আর নেই। বাংলাদেশকে একসময় বলা হতো দুর্ভিক্ষের দেশ। সেই অপবাদও সরকারের মোকাবিলায় কেটে গেছে। এরপর বলা হলো বাংলাদেশ জঙ্গিদের নিরাপদ আবাসভূমি। সরকারের কঠোর আর জোরালো তৎপরতায় আজ জঙ্গিরা এদেশে কোণঠাসা ও দুর্বল। বরং সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। আজ আবার নতুন করে বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুপ্তহত্যা আর গুমের দেশ।
সাবেক আইজিপি আরো বলেন, 'এসব সমস্যা সমাধানে সরকার আর বিরোধী দল কখনো আলোচনায় বসেনি। তারা ভাবেনি এখান থেকে কিভাবে বের হয়ে আসা যায়। বরং তারা এই গুমকে ইস্যু বানিয়ে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। নিজেরা সমাধানে যাচ্ছে না। বলা যায়, হয়তো তারা সমাধানে যেতেও চাচ্ছে না। অথচ বাইরের দেশ থেকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথিরা এলে তাঁদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে এসব কাহিনী। এ দেশের রাজনীতিবিদরা ভালো করেই জানেন, আলোচিত এসব সমস্যা জাতিসংঘ, ভারত বা আমেরিকা অথবা অন্য কোনো দেশের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। বরং তারা বাংলাদেশের এই দুর্বলতাকে তাদের সহায়ক কোনো কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু এসব জেনেও তারা 'পরের কাছে ঘরের বউয়ের অপবাদ' করার মতো কেচ্ছা গাইছে। এতে করে শুধুই যে দুর্নাম বা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে তা নয়, দুর্বল হচ্ছে এ দেশের ভিত বা ভিত্তি। দুর্বল হচ্ছে সার্বিক কাঠামো। বলা যায়, দুর্বল হচ্ছে নিরাপত্তাব্যবস্থাও।
গত ১৯ এপ্রিল ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ইলিয়াস আলীসহ নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন সময়ে গুম বা নিখোঁজ হওয়ার কথা বিএনপি নেতারা তুলে ধরেন। ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি অভিযোগ আকারে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রকেও জানানো হয়।
গত ১৮ এপ্রিল নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে মহাসচিব বান কি মুন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বরাবর পৃথকভাবে চিঠিও পৌঁছে দেওয়া হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। এ ছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মানবাধিকার লঙ্ঘন, জনগণের নিরাপত্তার অভাবসহ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অপশাসনের অভিযোগ এনে বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব সমপ্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সুইডেন, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত, যুক্তরাজ্যের উপ-হাইকমিশনার, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পলিটিক্যাল কাউন্সিলর, কানাডা, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, ভ্যাটিক্যান সিটি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। বিএনপি নেতাদের মধ্যে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, দলের ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদ।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন। তাঁর কাছেও রাজনীতিবিদরা তুলে ধরেছেন এসব সমস্যার কথা। গত ৪ এপ্রিল সংঘটিত বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সাভার-আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আমিনুল ইসলাম খুনের ঘটনার ওপর হিলারি বিশেষ জোর দেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এই খুনের ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়, এর জের ধরে আবারও শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে দেশের বাইরে অনেক আলোচনা হয়েছে। ঘটনাটি বাংলাদেশে প্রায় চাপা পড়ে থাকলেও গত শনিবার হিলারি ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন।
আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প ও শ্রমিকদের মধ্যে ফের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে গত ৯ এপ্রিল দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। 'কিলিং অব বাংলাদেশি লেবার অরগানাইজার সিগন্যালস অ্যান এস্কেলেশন ইন ভায়োলেন্স' শীর্ষক এ প্রতিবেদনের সূত্রে অন্যান্য বিদেশি গণমাধ্যমেও এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এরপর ওয়াশিংটনের শ্রমিকদের একটি সংগঠন এ ঘটনা তদন্তের জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ও বহুজাতিক কম্পানির প্রতি আহ্বান জানায়। আর এসব ঘটনার কারণেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে জোরালোভাবে। আর শুধু সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়া নয়, এতে করে বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থবাজারেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
দেশে এবং দেশের বাইরের বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওগুলোও এসব গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সংগঠনগুলো তাদের প্রতিবেদনেও এসব তুলে ধরছে। এ বছরের শুরুতে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে সাংবাদিকদের বলেন, গুপ্তহত্যা নতুন এক অপরাধপ্রবণতা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতন বন্ধে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সুলতানা কামাল ওই দিন বলেন, যারা এসব ঘটাচ্ছে তাদের বিচারের আওতায় এনে রাষ্ট্র তার জবাব দিতে পারত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত তাদের আগের ট্রেন্ড বজায় রেখে শক্তিমান কিংবা প্রভাবশালীদের বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। এ থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারছে না।
গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে মানবাধিকার সংস্থা 'অধিকার' আয়োজিত অনুষ্ঠানে ২০১১ সালের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রসফায়ারের নামে দেশে হত্যাকাণ্ডের পরিবর্তে বর্তমানে গুমের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রাষ্ট্রই এই 'কৌশল' বেছে নিয়েছে।
No comments