উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনে ইসলাম by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

মিরাস বা উত্তরাধিকারের অর্থ হলো, একের অনুপস্থিতিতে অন্যের অধিকার। সে হিসেবে কারও মৃত্যুর পর অন্যের যে অধিকার জন্মায় তাকে উত্তরাধিকার বলে। একজনের জীবদ্দশায় কারও সম্পদে কখনও অন্যজনের অধিকার জন্মায় না।
ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান হচ্ছে উত্তরাধিকার সম্পদের সুষম বণ্টন। কাউকে কোনোভাবে তার প্রাপ্ত মিরাস থেকে বঞ্চিত করা কবিরা গোনাহ। ন্যায্যভাবে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন ফরজ কাজ। তবে এ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে আবার কেউ জেনে-বুঝে সম্পদের মোহে উত্তরাধিকার সম্পদ ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করে না। এমন মনোভাব স্পষ্ট গোনাহের কাজ। তওবা ছাড়া যার ক্ষমা নেই। অবশ্য কিছু সচেতন লোক রয়েছেন, যারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন করে থাকেন।
আমাদের সমাজে উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে বেশি বঞ্চিত হয় নারীরা। নারীদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য নানা অজুহাত ও উপায় দাঁড় করানো হয়। বিশেষত বিয়ের সময় প্রদেয় আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী প্রদানের কারণে কিংবা ভাইয়েরা বোনদের বিভিন্ন উপলক্ষে নানা উপহার প্রদানের অজুহাতে নারীদের মিরাস দেওয়া হয় না। এরপরও বোনরা মিরাস দাবি করলে কিংবা মিরাসের হিস্যা নিয়ে গেলে তাদের জন্য বাপের বাড়ির দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা হয়; ভাইবোনের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরনের আচরণ চরম অন্যায়, অমানবিক ও কঠিন গোনাহের কাজ। মনে রাখতে হবে, বিয়েতে বা বিয়ের পরে বোন বা কন্যাকে যত সম্পদই প্রদান করা হোক, তা উপহাররূপে গণ্য। যাকে আত্মীয়তার হক বলা যেতে পারে। মিরাসের হিস্যার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে কোনোভাবেই মিরাসের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। তাদের মিরাসি হক আদায় না করা পর্যন্ত তাদের অধিকার কখনও শেষ হবে না। এ বিষয়ে সবার সচেতনতা জরুরি।
এ তো গেল সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার একটি প্রক্রিয়া। এ ছাড়াও আরও অনেক প্রক্রিয়া রয়েছে মিরাস থেকে বঞ্চিত করার। যেমন, জীবিত অবস্থায় কেউ কেউ কোনো ওয়ারিশকে বঞ্চিত করার মানসে তার সম্পদ নির্দিষ্ট লোকদের লিখে দিয়ে যায়। ফলে বৈধ উত্তরাধিকারীদের অনেকেই বঞ্চিত হয়। এটাও স্পষ্টভাবে আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী কাজ। আল্লাহতায়ালা মিরাস বণ্টনের নিয়ম-কানুন বর্ণনা শেষে বলেন, 'এসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা। আর কেউ আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্য হলে এবং তার নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন করলে তিনি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন।' -সূরা নিসা : ১৩-১৪
অনেকে মৃত্যুর পূর্বে অসিয়তের মাধ্যমে অন্যের বৈধ অধিকার নষ্ট করে, এটাও অন্যায়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'কোনো পুরুষ ও স্ত্রী ষাট বছরব্যাপী আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য করে অতঃপর মৃত্যুর সম্মুখীন হয় এবং অসিয়তের মাধ্যমে অন্যের ক্ষতিসাধন করে। এর ফলে জাহান্নাম তার জন্য অনিবার্য হয়ে যায়।' -তিরমিযি ও আবু দাউদ
কেউ আবার দানের কথা বলে কোনো সন্তানকে বঞ্চিত করেন। এটাও ইসলাম স্বীকৃত নয়। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, হজরত নোমান বিন বশির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'তার পিতা তাকে নিয়ে হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে যান এবং বলেন, আমি আমার এই ছেলেকে কিছু দান করেছি। তখন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি কি তোমার প্রত্যেক ছেলেকে এরূপ দান করেছ? তিনি জবাবে বলেন, না। তখন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তা প্রত্যাহার কর।' -বুখারি ও মুসলিম
বর্ণিত হাদিসের আলোকে বলা যায়, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দানের ক্ষেত্রে সন্তানদের কাউকে অগ্রাধিকার দেওয়া কিংবা কাউকে বঞ্চিত করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এবং এমন কাজের পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেন। এমন কাজের জন্য অবশ্যই আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। উলেল্গখ্য, আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি নানাভাবে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন। যেমন দান, উইল, বিক্রয় ইত্যাদি। মুসলিম আইনে উইলের দ্বারা প্রদেয় সম্পদ ভোগের অধিকার উইলকারীর মৃত্যুর পর কার্যকর হবে। উইলের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই এক-তৃতীয়াংশের বেশি সম্পত্তি দেওয়া যাবে না।
আরেকটি কথা, বিভিন্ন কারণে অনেকেই নিজ সন্তানকে ত্যাজ্য ঘোষণা করে তাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণা দেন। আমাদের দেশে এ রকম ঘটনার কথা প্রায়ই শোনা যায়। মুসলিম আইন অনুযায়ী, জন্মসূত্রে কোনো সন্তান তার পরিবারের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার অর্জন করে এবং এই অধিকার কোনোভাবেই খর্বযোগ্য নয়। সাধারণত দেখা যায়, বাবা যদি কোনো সন্তানকে ত্যাজ্য করেন, তবে তার মৃত্যুর পর অন্যান্য উত্তরাধিকার সেই সন্তানকে আর সম্পত্তির অংশ দিতে চান না। এটাও ইসলাম স্বীকৃত বিষয় নয়। ত্যাজ্য একটি ভুল বিষয় এবং এটা কোনোভাবেই আইনে স্বীকৃত নয়। মুসলিম আইন উত্তরাধিকার স্বত্বের অধিকারকে চিরন্তন সত্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.