সিরিয়ার ছবিটা বদলাবে এবার? by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
দুই বছরের বেশি সময় ধরে সিরিয়ার
গৃহযুদ্ধের অবসানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নেতাদের চেষ্টার বিরাম নেই। এ নিয়ে
কতবার যে দফায় দফায় আলোচনা আর বৈঠক হয়েছে, তারও যেন লেখাজোকা নেই। ফলাফল
বরাবরই শূন্য।
প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উৎখাতে
বিদ্রোহীদের লড়াই চলছেই। বাশারের সেনারাও চালাচ্ছে পাল্টা অভিযান। মাঝখানে
পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ।
আবারও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আলোচনার মাধ্যমে সিরিয়া-সমস্যার সমাধান করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় শিগগিরই এ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সরাসরি অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করার কথা ঘোষণা করে চমক জাগিয়েছে। ওবামা সরকার এ নিয়ে এতদিন ‘গড়িমসি’ করে যাচ্ছিল। এবার সিরিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতির ভারসাম্য চূড়ান্তভাবে বিদ্রোহীদের পক্ষে যাবে কি না তা নিয়েই পর্যবেক্ষক মহলে হিসাব-নিকাশ চলছে এখন।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সংগত কারণেই সিরিয়ার মিত্ররা (হাতে গোনা হলেও) খুশি নয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র দেওয়া মানে ‘নরখাদকদের’ সহযোগিতা করা। কিছুদিন আগে ইন্টারনেটে ছাড়া একটি ভিডিওচিত্রে কথিত নরমাংস খাওয়ার দৃশ্য প্রচারিত হয়। এতে আভাস দেওয়া হয়, সিরিয়ার বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত এক সেনাকে হত্যা করে তার হূৎপিণ্ড ভক্ষণ করেছে। পুতিন তাঁর বক্তব্যে ওই ঘটনার প্রতিই ইঙ্গিত করেন।
যুক্তরাজ্যের উত্তর আয়ারল্যান্ডে সদ্যসমাপ্ত এবারের জি-৮ শীর্ষ সম্মেলনেও মূল আলোচনা ছিল সংঘাতময় সিরিয়া নিয়ে। এতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর ওই জোটের নেতারা দেশটির রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসানে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। দৃশ্যত, এ সম্মেলনে এক পক্ষে ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তাঁর পশ্চিমা মিত্ররা। আরেক পক্ষে একাই এক শ হয়ে দাপটের সঙ্গে টক্কর দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। আলোচনায় উভয় পক্ষের অভিন্ন লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের শান্তিপূর্ণ অবসান। এ ক্ষেত্রে ওবামা ও তাঁর পশ্চিমা মিত্ররা চেয়েছেন সমঝোতার মাধ্যমে বাশারের বিদায়। পুতিন ছিলেন বাশারের পক্ষে অনড়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দুই পক্ষের মধ্যে এক সমঝোতা হয়। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ঘোষণা করেন, জি-৮ নেতারা মূল বিষয়গুলোতে মতভেদ কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের অবসানে যত দ্রুত সম্ভব জেনেভায় তাঁরা বৈঠকে বসবেন। তবে সে বৈঠক কখন কীভাবে হবে, ভবিষ্যতে বাশারের ভূমিকাই বা কী হতে পারে, এ বিষয়ে কোনো আভাস দেননি তিনি। নেতাদের ঐকমত্যের বিষয়টি যে নথিতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে, এতে রয়েছে সাতটি শর্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তটি হচ্ছে, সিরিয়ায় ভবিষ্যৎ অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে।
এ তো গেল ভবিষ্যতের বিষয়। এবার বর্তমানে ফেরা যাক। গৃহযুদ্ধ অবসানে আলোচনায় আর কাজ না হলে বিদ্রোহীদের অস্ত্র দেওয়ার মার্কিন ঘোষণা বাস্তবে পরিণত হতে পারে। সিরিয়ায় বলবৎ হতে পারে লিবিয়ার মতো ‘উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা’ বা ‘নো-ফ্লাই জোন’।
ওবামা বলেছেন, সিরীয় বাহিনীর নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের হাতে সরাসরি অস্ত্র দেবে। হোয়াইট হাউসের এ সংক্রান্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাশার সরকার কিছু রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে ‘সীমানা লঙ্ঘন’ করেছে।
তবে অনেকে বলছেন, ওবামার ওই ঘোষণা আসলে গোপন একটি বিষয় প্রকাশ্যে নিয়ে আসারই নামান্তর। সিরিয়ার যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে বিদ্রোহীদের হাতে শুরু থেকেই অস্ত্র দিয়ে আসছে। তাদের পক্ষে মিত্র হিসেবে কাজ করছে তুরস্ক। মধ্যপ্রাচ্যে বাশারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিদ্রোহীদের নানাভাবে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরব আর কাতার। সম্প্রতি সৌদি কর্তৃপক্ষও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সরাসরি সহযোগিতা করার কথা ঘোষণা করেছে।
বাইরের শক্তিরা বিদ্রোহীদের হাতে ব্যাপক হারে অস্ত্র দিলে সিরিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা যে সুবিধা পেয়েছে, সিরিয়ায় তা নেই। সিরিয়ার সঙ্গে এখনো পরাশক্তি রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তো আছেই, একই সঙ্গে ইরানও সিরিয়ার ওপর দিন দিন সমর্থন জোরদার করছে। বাশারের সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করেছে ইরান সমর্থিত হেজবুল্লাহর যোদ্ধারা।
এসব বিষয় মার্কিন সমর বিশেষজ্ঞরা অবশ্যই বিবেচনা করবেন। সে ক্ষেত্রে লিবিয়ার মতো ‘হুট করে’ আগে বাড়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। কিছুসংখ্যক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, সিরিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকা পালন করছে, তা অনেকটা পিচ্ছিল ঢালে অবস্থান নেওয়ার মতো। সিরিয়ার বিষয়ে ওবামা প্রশাসনের অবস্থানের ব্যাপারে ব্যাপক জনসমর্থনও নেই। এসব বিষয় বিবেচনা করেই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের উপ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেন রোডস নির্দিষ্ট করে বলেননি যে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কী ধরনের মার্কিন সহায়তা পেতে পারে। বেন রোডস বলেছেন, ‘আমরা সিরিয়ায় উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা ধাঁচের কোনো অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা এখনো মনে করি, বিরোধী পক্ষকে স্থলযুদ্ধে সহায়তা করলেই পরিস্থিতির পরিবর্তনে ভালো ভূমিকা রাখা যাবে।’
বেন রোডসের মতে, সিরিয়ায় ‘উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা’ ঘোষণা করলে তা লিবিয়ার মতো ইতিবাচক কোনো ফল বয়ে আনবে না। বরং পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকার অর্থ হচ্ছে সিরীয় সরকারের বিমান দেশটির ওই এলাকার আকাশে উড়তে পারবে না। মার্কিন/ আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা তা নিশ্চিত করবে। এতে করে বিদ্রোহীদের ওপর হামলা চালানোর ক্ষেত্রে বাশার বাহিনীর সক্ষমতা কমে যাবে।
সিরিয়া নিয়ে বিশ্লেষণ করে আলোচিত হয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা মোনা ইয়াকাউবিয়ান। তিনি এখন ওয়াশিংটনে স্টিমসন সেন্টারে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর মতে, ছোটখাটো অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহারে সিরিয়া-যুদ্ধে কোনো পরিবর্তন আসবে না। তবে বিদ্রোহীরা ভারী অস্ত্র পেলে সামরিক ভারসাম্যে তারতম্য ঘটতে পারে। কিন্তু বিদ্রোহীরা সে সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
মোনা ইয়াকাউবিয়ানের মতে, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে বাশারের সেনাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালালে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসতে পারে। কিন্তু সিরিয়ায় এখন রাশিয়ার তৈরি বিমান হামলা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই জোরদার করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা যে কতটা শক্তিশালী, ১৯৯৯ সালের কসোভো যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ভালো করেই টের পেয়েছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে (খুব সম্ভবত) রাশিয়ার এস-৩০০ বিমান হামলা প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র। গত মাসে টিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাশার আল-আসাদ নিজেই বলেছেন, বিমান বিধ্বংসী এই ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম চালানটি দামেস্কে পৌঁছেছে। চুক্তি অবশ্য বেশ আগের। ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য এই ক্ষেপণাস্ত্র যেকোনো যুদ্ধবিমানের হামলা ঠেকাতে যথেষ্ট কার্যকর। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রাডার ফাঁকি দেওয়া বি টু স্টেল্থ যুদ্ধবিমান ও টোমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে এই বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কতটা কাজ দেবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ও প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে জর্ডানের সামরিক ঘাঁটিতে। একই সঙ্গে চার হাজার সেনাও পাঠিয়েছে তারা। আরব সাগরে মোতায়েন রয়েছে দুটি বিমানবাহী রণতরী। নিয়মিত সামরিক মহড়ার জন্যই এ আয়োজন বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তা প্রয়োজনে সিরিয়ার বিরুদ্ধে যে প্রয়োগ হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
অনেকের আশঙ্কা, সিরিয়ার যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তার ঘোষণামতো সরাসরি যোগ দিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। ক্রমে তা আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমনকি এ যুদ্ধের সূত্র ধরে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার চাপা দ্বৈরথ প্রকাশ্যে রূপ নেওয়াও বিচিত্র কিছু নয়।
আবারও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আলোচনার মাধ্যমে সিরিয়া-সমস্যার সমাধান করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় শিগগিরই এ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সরাসরি অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করার কথা ঘোষণা করে চমক জাগিয়েছে। ওবামা সরকার এ নিয়ে এতদিন ‘গড়িমসি’ করে যাচ্ছিল। এবার সিরিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতির ভারসাম্য চূড়ান্তভাবে বিদ্রোহীদের পক্ষে যাবে কি না তা নিয়েই পর্যবেক্ষক মহলে হিসাব-নিকাশ চলছে এখন।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সংগত কারণেই সিরিয়ার মিত্ররা (হাতে গোনা হলেও) খুশি নয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অস্ত্র দেওয়া মানে ‘নরখাদকদের’ সহযোগিতা করা। কিছুদিন আগে ইন্টারনেটে ছাড়া একটি ভিডিওচিত্রে কথিত নরমাংস খাওয়ার দৃশ্য প্রচারিত হয়। এতে আভাস দেওয়া হয়, সিরিয়ার বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত এক সেনাকে হত্যা করে তার হূৎপিণ্ড ভক্ষণ করেছে। পুতিন তাঁর বক্তব্যে ওই ঘটনার প্রতিই ইঙ্গিত করেন।
যুক্তরাজ্যের উত্তর আয়ারল্যান্ডে সদ্যসমাপ্ত এবারের জি-৮ শীর্ষ সম্মেলনেও মূল আলোচনা ছিল সংঘাতময় সিরিয়া নিয়ে। এতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর ওই জোটের নেতারা দেশটির রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসানে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। দৃশ্যত, এ সম্মেলনে এক পক্ষে ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তাঁর পশ্চিমা মিত্ররা। আরেক পক্ষে একাই এক শ হয়ে দাপটের সঙ্গে টক্কর দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। আলোচনায় উভয় পক্ষের অভিন্ন লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের শান্তিপূর্ণ অবসান। এ ক্ষেত্রে ওবামা ও তাঁর পশ্চিমা মিত্ররা চেয়েছেন সমঝোতার মাধ্যমে বাশারের বিদায়। পুতিন ছিলেন বাশারের পক্ষে অনড়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দুই পক্ষের মধ্যে এক সমঝোতা হয়। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ঘোষণা করেন, জি-৮ নেতারা মূল বিষয়গুলোতে মতভেদ কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের অবসানে যত দ্রুত সম্ভব জেনেভায় তাঁরা বৈঠকে বসবেন। তবে সে বৈঠক কখন কীভাবে হবে, ভবিষ্যতে বাশারের ভূমিকাই বা কী হতে পারে, এ বিষয়ে কোনো আভাস দেননি তিনি। নেতাদের ঐকমত্যের বিষয়টি যে নথিতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে, এতে রয়েছে সাতটি শর্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তটি হচ্ছে, সিরিয়ায় ভবিষ্যৎ অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে।
এ তো গেল ভবিষ্যতের বিষয়। এবার বর্তমানে ফেরা যাক। গৃহযুদ্ধ অবসানে আলোচনায় আর কাজ না হলে বিদ্রোহীদের অস্ত্র দেওয়ার মার্কিন ঘোষণা বাস্তবে পরিণত হতে পারে। সিরিয়ায় বলবৎ হতে পারে লিবিয়ার মতো ‘উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা’ বা ‘নো-ফ্লাই জোন’।
ওবামা বলেছেন, সিরীয় বাহিনীর নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের হাতে সরাসরি অস্ত্র দেবে। হোয়াইট হাউসের এ সংক্রান্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাশার সরকার কিছু রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে ‘সীমানা লঙ্ঘন’ করেছে।
তবে অনেকে বলছেন, ওবামার ওই ঘোষণা আসলে গোপন একটি বিষয় প্রকাশ্যে নিয়ে আসারই নামান্তর। সিরিয়ার যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে বিদ্রোহীদের হাতে শুরু থেকেই অস্ত্র দিয়ে আসছে। তাদের পক্ষে মিত্র হিসেবে কাজ করছে তুরস্ক। মধ্যপ্রাচ্যে বাশারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিদ্রোহীদের নানাভাবে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরব আর কাতার। সম্প্রতি সৌদি কর্তৃপক্ষও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সরাসরি সহযোগিতা করার কথা ঘোষণা করেছে।
বাইরের শক্তিরা বিদ্রোহীদের হাতে ব্যাপক হারে অস্ত্র দিলে সিরিয়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্ররা যে সুবিধা পেয়েছে, সিরিয়ায় তা নেই। সিরিয়ার সঙ্গে এখনো পরাশক্তি রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তো আছেই, একই সঙ্গে ইরানও সিরিয়ার ওপর দিন দিন সমর্থন জোরদার করছে। বাশারের সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করেছে ইরান সমর্থিত হেজবুল্লাহর যোদ্ধারা।
এসব বিষয় মার্কিন সমর বিশেষজ্ঞরা অবশ্যই বিবেচনা করবেন। সে ক্ষেত্রে লিবিয়ার মতো ‘হুট করে’ আগে বাড়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। কিছুসংখ্যক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, সিরিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকা পালন করছে, তা অনেকটা পিচ্ছিল ঢালে অবস্থান নেওয়ার মতো। সিরিয়ার বিষয়ে ওবামা প্রশাসনের অবস্থানের ব্যাপারে ব্যাপক জনসমর্থনও নেই। এসব বিষয় বিবেচনা করেই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের উপ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেন রোডস নির্দিষ্ট করে বলেননি যে সিরিয়ার বিদ্রোহীরা কী ধরনের মার্কিন সহায়তা পেতে পারে। বেন রোডস বলেছেন, ‘আমরা সিরিয়ায় উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা ধাঁচের কোনো অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা এখনো মনে করি, বিরোধী পক্ষকে স্থলযুদ্ধে সহায়তা করলেই পরিস্থিতির পরিবর্তনে ভালো ভূমিকা রাখা যাবে।’
বেন রোডসের মতে, সিরিয়ায় ‘উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা’ ঘোষণা করলে তা লিবিয়ার মতো ইতিবাচক কোনো ফল বয়ে আনবে না। বরং পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকার অর্থ হচ্ছে সিরীয় সরকারের বিমান দেশটির ওই এলাকার আকাশে উড়তে পারবে না। মার্কিন/ আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা তা নিশ্চিত করবে। এতে করে বিদ্রোহীদের ওপর হামলা চালানোর ক্ষেত্রে বাশার বাহিনীর সক্ষমতা কমে যাবে।
সিরিয়া নিয়ে বিশ্লেষণ করে আলোচিত হয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা মোনা ইয়াকাউবিয়ান। তিনি এখন ওয়াশিংটনে স্টিমসন সেন্টারে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর মতে, ছোটখাটো অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহারে সিরিয়া-যুদ্ধে কোনো পরিবর্তন আসবে না। তবে বিদ্রোহীরা ভারী অস্ত্র পেলে সামরিক ভারসাম্যে তারতম্য ঘটতে পারে। কিন্তু বিদ্রোহীরা সে সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
মোনা ইয়াকাউবিয়ানের মতে, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে বাশারের সেনাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালালে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসতে পারে। কিন্তু সিরিয়ায় এখন রাশিয়ার তৈরি বিমান হামলা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই জোরদার করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা যে কতটা শক্তিশালী, ১৯৯৯ সালের কসোভো যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ভালো করেই টের পেয়েছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছে (খুব সম্ভবত) রাশিয়ার এস-৩০০ বিমান হামলা প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র। গত মাসে টিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাশার আল-আসাদ নিজেই বলেছেন, বিমান বিধ্বংসী এই ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম চালানটি দামেস্কে পৌঁছেছে। চুক্তি অবশ্য বেশ আগের। ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য এই ক্ষেপণাস্ত্র যেকোনো যুদ্ধবিমানের হামলা ঠেকাতে যথেষ্ট কার্যকর। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রাডার ফাঁকি দেওয়া বি টু স্টেল্থ যুদ্ধবিমান ও টোমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে এই বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কতটা কাজ দেবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ও প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে জর্ডানের সামরিক ঘাঁটিতে। একই সঙ্গে চার হাজার সেনাও পাঠিয়েছে তারা। আরব সাগরে মোতায়েন রয়েছে দুটি বিমানবাহী রণতরী। নিয়মিত সামরিক মহড়ার জন্যই এ আয়োজন বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তা প্রয়োজনে সিরিয়ার বিরুদ্ধে যে প্রয়োগ হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
অনেকের আশঙ্কা, সিরিয়ার যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তার ঘোষণামতো সরাসরি যোগ দিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। ক্রমে তা আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমনকি এ যুদ্ধের সূত্র ধরে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার চাপা দ্বৈরথ প্রকাশ্যে রূপ নেওয়াও বিচিত্র কিছু নয়।
No comments