অর্থনীতি-ভোক্তার দৃষ্টিতে বাজেট-২০১৩-১৪ by এমএম আকাশ

২০০৯ সালে আমাদের দেশে 'ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন' গৃহীত হয়। এই আইনে ভোক্তার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে নিম্নরূপ :
সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করেন বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য অথবা সেবা
ক্রয় করেন; আংশিক মূল্য পরিশোধ করেন বা আংশিক বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন; কিস্তিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন (উৎস :কনজুমারস ফোরাম প্রকাশিত ভোক্তা অধিকার, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, মার্চ ২০১৩)।
এই সংজ্ঞার সহজ তাৎপর্য হচ্ছে 'ভোক্তা' হচ্ছে পণ্যের (বস্তু ও সেবা) ক্রেতা। পণ্য সমাজে বা বাজারভিত্তিক সমাজে সব ভোগ্যপণ্যই আমাদের বাজার থেকে কিনতে হয়। আর ওই পণ্য কেনার জন্য পকেটে টাকা থাকতে হয়। ওই টাকা পেতে হলে আয়-উপার্জন করতে হয়। সে জন্য আবার কোনো না কোনো উৎপাদন উপকরণের সেবা (জমির সেবা বা পুঁজির সেবা বা শ্রমশক্তি) বিক্রি করতে হয়, যার বিনিময়ে আমরা খাজনা, মুনাফা ও মজুরি-বেতন উপার্জন করে থাকি।
উপরোক্ত বিশ্লেষণের আলোকে দেখলে সমাজের সবাইকে 'ভোক্তা' গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। একমাত্র যারা বাজার সমাজের বাইরে বাস করেন বা যারা আয় ও ভোগ উভয়ই অপরের কাছ থেকে দান হিসেবে গ্রহণ করেন এবং যে দান টাকার রূপ পরিগ্রহ করে না তারাই 'অ-ভোক্তা' হিসেবে বিবেচিত হবেন। এ রকম লোক আমাদের দেশে একদম নেই, তা নয়। বৃদ্ধ বা শিশু যাদের সবকিছু অন্যদের বস্তুগত দান ও সেবার ওপর নির্ভরশীল তারা সরাসরি ভোক্তা বলে এই আইনে বিবেচিত হবেন না, যদিও তাদের 'ভোগ' করতে হয়। একইভাবে 'নিঝুম দ্বীপে' বা 'পার্বত্য চট্টগ্রামের' গহিন জঙ্গলে বসবাসকারী 'বার্টার' প্রথায় জীবন নির্বাহকারীরা অথবা ব্যক্তিগত মালিকানাবিহীন গোষ্ঠীগুলোও এই আইনের আওতার বাইরে অবস্থিত থাকবে। বাদবাকি বিপুল জনগণ ও ধনিক শ্রেণী অবশ্যই ভোক্তা এবং তাদের দৃষ্টিতে ২০১৩-র বাজেট হচ্ছে আজকের প্রতিপাদ্য বিষয়।
ভোক্তাদের স্বার্থ ও অধিকার :ভোক্তাদের প্রধান স্বার্থ দ্বিবিধ_ তারা চাইবেন তাদের আয় যাতে বৃদ্ধি পায় এবং ওই আয় ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যগুলো যাতে সুলভে পাওয়া যায়। আয় বৃদ্ধি ও ভোগ বৃদ্ধি হচ্ছে তাদের দুটি 'মৌলিক স্বার্থ'। তাই আজকের বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে : ক. এই বাজেট কি আয়-বর্ধক হবে? খ. এই বাজেট কি ভোগ বৃদ্ধি করে ভোক্তাদের জীবনযাত্রা মানের উন্নয়নে সহায়ক হবে? ভোক্তা অধিকার আইন আরেকটু অগ্রসর হয়ে ভোক্তার ভোগের মান রক্ষার ইস্যুটি নিয়ে কিছু অধিকারের প্রস্তাবনা করেছে। সেগুলো হচ্ছে : ক. পণ্যের (বস্তু ও সেবা) নির্ধারিত মূল্যে এবং ন্যায্য দামে বিক্রির ব্যবস্থা করা; খ. পণ্যের উপাদান, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ইত্যাদি তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; গ. কোনো পণ্য ও সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে (ভেজালের) ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা; ঘ. পণ্য ক্রয়ে প্রতারিত হলে অর্থাৎ বিক্রেতা তার দিকের শর্তগুলো পূরণ না করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে অভিযোগের অধিকার নিশ্চিত করা।
এগুলো করতে হলে সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে (যেমন : টিসিবি, ভেজাল নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ, চৎড়পঁৎবসবহঃ অঁঃযড়ৎরঃু, চৎরপব ঈড়সসরংংরড়হ ইত্যাদি) আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করে গড়ে তুলতে হবে। বস্তুত আমাদের দেশের ভোক্তারা এসব অধিকারের কথা এখন পর্যন্ত সম্যক অবগত নন। তাই ভোক্তা আন্দোলনটি এখন পর্যন্ত প্রচার ও সচেতনতা সৃষ্টির আন্দোলনের পর্যায়ই অতিক্রম করতে পারেনি।
বাজেট ২০১৩-১৪ ও ভোক্তা স্বার্থ :বর্তমান বাজেটে ভোক্তাদের অনুকূলে অর্থাৎ তাদের আয় বর্ধনের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং সেসবের পরিপ্রেক্ষিতে এর সবলতা ও দুর্বলতাগুলো তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। আমি সংক্ষেপে এর প্রধান দিকগুলো নিচে তুলে ধরছি।
সবলতা-দুর্বলতা
এই বাজেট, অতীত বাজেটগুলোর ধারাবাহিকতায় প্রণীত। বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে প্রণীত চারটি বাজেট শেষে এটি হচ্ছে তার শেষ এবং পঞ্চম বাজেট। সাধারণভাবে বিশ্ব মানদণ্ডে বলা যায় যে, এ সময় জাতীয় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যেহেতু ৬ শতাংশ হারে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে গেছে, সেহেতু এ সময় ভোক্তাদের মাথাপিছু গড় আয় প্রতিবছর কমপক্ষে ৪.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। সরকারের 'ম্যাজিক ফিগার' ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির টার্গেটে কখনোই এই সরকারের আমলে পেঁৗছানো সম্ভব হয়নি। যদিও দাবি করা হচ্ছে যে, ২০০৫-এর পর আয়বৈষম্যের গিনি সূচক ০ .৪৬ থেকে খুবই সামান্য বেড়ে ২০১০-এ ০.৪৭ হয়েছে এবং এ থেকে বোঝা যায় যে, এ সময় সব শ্রেণীরই আয় সমান হারে বেড়েছে, যার ফলে দারিদ্র্য হ্রাসের হারও ত্বরান্বিত হয়েছে। কিন্তু এই দাবি সাদা চোখে আমরা চতুর্দিকে যে বৈষম্য দেখি তা দ্বারা সমর্থিত হয় না। এ ছাড়া আমাদের বিআইডিএস গবেষক ড. রুশিদান ইসলামের সাম্প্রতিক প্রকাশিত গ্রন্থ 'বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন : স্বাধীনতার পর ৪০ বছর'-এর পৃষ্ঠা ১৭৯-এ উদ্ধৃত তালিকাটির দিকে তাকালে আমাদের এই সন্দেহ ঘনীভূত হয় যে, উচ্চতর প্রবৃদ্ধি সর্বদা সমান অনুপাতে আমাদের দেশে দারিদ্র্যের হার কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। এক কথায় 'প্রবৃদ্ধির হারের' সঙ্গে 'দারিদ্র্যের হারের' সম্পর্কটি আমাদের দেশে যথেষ্ট দুর্বল। [প্রয়োজনীয় তালিকাটি পরিশিষ্ট ১-এ দেওয়া হলো]
সুতরাং নিছক উচ্চ প্রবৃদ্ধির ষ্ট্র্যাটেজি দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোক্তা, বিশেষ করে দরিদ্র ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করা যাচ্ছে না। এ জন্য প্রয়োজন ছিল ধনী ও উচ্চবিত্ত লোকদের কাছ থেকে প্রচুর কর আদায় করে দরিদ্র অভিমুখী সরকারি ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি করে যাওয়া। এ ধরনের পুনর্বণ্টনমূলক পদক্ষেপ কি গত বাজেটগুলোতে এবং এই বাজেটে আছে? এ প্রসঙ্গে আমরা অবশ্যই বলব যে, এ ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। এনবিআরের সংগৃহীত করে ২০০৯-১০ সালে মুনাফা ও আয়ের ওপর আরোপিত প্রত্যক্ষ করের (এগুলো ধনীদের ওপরই আরোপিত কর বটে) অংশ ছিল মাত্র ২৭.১৭ শতাংশ। গত ২০১২-১৩ সালে সংশোধিত হিসাবানুসারে এটার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১.৪৫ শতাংশ এবং এবারের প্রস্তাবিত টার্গেট হচ্ছে ৩৫.৪৯ শতাংশ। একে অবশ্যই প্রশংসনীয় অগ্রগতি বলব। এ ছাড়া এ বাজেটে সম্পত্তির ওপর নতুন কর এবং উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির ওপরও নতুন সারচার্জের বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারি আয় সংগ্রহের ক্ষেত্রে অপ্রত্যক্ষ কর থেকে সরে গিয়ে প্রত্যক্ষ করের দিকে ঝোঁকার এই প্রবণতাটি যত দেরিতেই এবং যত দুর্বলই হোক না কেন, তাকে অবশ্যই প্রশংসনীয় বলতে হবে। কিন্তু এর পাশাপাশি আমরা দুটি প্রতিকূল প্রবণতাও দেখি। প্রথমত, প্রকৃতই যাদের কাছে প্রচুর পুঁজি আছে এবং যারা তার উৎপাদনশীল দেশীয় ব্যবহার করছেন না, বাইরে পাচার করে দিচ্ছেন অথবা যারা ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণ শোধ না করে বছরের পর বছর বহাল তবিয়তে রাজনৈতিক প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছেন, তাদের উপযুক্ত কর জালের অধীনে আনতে সরকার পারছে না। শুধু তাই নয় গত ৪২ বছরে ১৮ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ থেকে বাস্তবে সাদা হয়েছে মাত্র ১২৯৯৬ কোটি টাকা। আর সরকার রাজস্ব পেয়েছে মাত্র ১৩৬৮ কোটি টাকা। [ উৎস : 'বাজেট প্রতিক্রিয়া_ সমুন্নয়, ৯ জুন, ২০১৩] অথচ এই বাজেটেও জমি-ফ্ল্যাট-প্লট যারা কিনবেন তাদের টাকার উৎস জিজ্ঞেস না করে মাত্র ১০ শতাংশ করের মাধ্যমে ওই টাকাকে জায়েজ করা হবে। এর আগে শেয়ারবাজারকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বার্থে এ ধরনের ছাড় দেওয়াতে উল্লেখযোগ্য টাকা বিনিয়োগ হয়েছিল। কিন্তু দুষ্ট লোক বলে যে যারা টাকা শেয়ারবাজার থেকে লুট করে উঠিয়ে নিয়েছিলেন, তারাই আবার তা ফেরত দিয়ে এই আইনের সুবিধাটুকু ভোগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুতরাং সামগ্রিকভাবে যে দুর্বলতাটি সরকার অতিক্রম করতে পারছে না এবং এবারো পারেনি তা হচ্ছে অবৈধ পন্থায় উপার্জনকারীদের অর্থ ও সম্পত্তিকে আঘাত করে সেখান থেকে কর সংগ্রহ করা। এমনকি সে টাকার বিদেশে বহির্গমনও আটকানো সম্ভব হচ্ছে না। পক্ষান্তরে বিনিয়োগের নামে তাদের এখন যে সুযোগগুলো দেওয়া হচ্ছে, তাতে মধ্যবিত্ত ও এমনকি উচ্চমধ্যবিত্তরাও আর বাড়ি-প্লট-জমির বাজারে প্রবেশাধিকার পাবেন না। কারণ কালো টাকা যদি সত্যিই এখানে আসে, তাহলে এই বাজারে সবকিছুর অগি্নমূল্য তৈরি হবে।
এ কথা ঠিক যে, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার উপলব্ধি করেছে যে সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকে কর আদায়ের অতীত চেষ্টাটা আত্মঘাতী হয়েছে এবং এবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বৃদ্ধি করা হয়েছে ও করের হারও হ্রাস করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটা শুভ পরিবর্তন। কিন্তু সরকারকে প্রকৃত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করতে হলে সঞ্চয়পত্রের 'সাইজ' নানারকম করতে হবে। যাতে একজন ক্ষুদ্র আয়ের অধিকারীও সঞ্চয়ে উৎসাহী হন, তার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। এখন অবশ্য প্রধানত ডিপিএসের মাধ্যমে এটা পরিচালিত হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল থেকে প্রমাণিত হয়েছে, গ্রামের দরিদ্র মহিলারাও হাজার হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়ে সক্ষম। এ অব্যবহৃত উৎসটি নিয়ে নতুন পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। সরকার ভারতের মতো এনজিও মডেলের বদলে 'স্ব-সাহায্যকারী' গ্রুপের সঞ্চয় ও পরিপূরক সরকারি অনুদান (গধঃপযরহম মৎধহঃ) প্রথা প্রবর্তন করলে দরিদ্র ভোক্তারা উপকৃত হতেন এবং দারিদ্র্য আরও দ্রুত হ্রাস পেত।
আয় বৃদ্ধির জন্য দরকার বিনিয়োগ। এই বাজেট কি বিনিয়োগবান্ধব হয়েছে? এ কথা ঠিক যে, কাঁচামাল ও পুঁজি দ্রব্যের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে (অবশ্য সব ক্ষেত্রে নয়, এটা সঙ্গত কারণেই করা হয়েছে ঝবষবপঃরাবষু), যাতে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ উৎসাহিত হয়। কিন্তু ভৌত অবকাঠামোর সংকট ও সুশাসনের সংকট বজায় থাকলে আর এর সঙ্গে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা যুক্ত হলে এসব ঋরহধহপরধষ ওহপবহঃরাব কতটুকু কার্যকরী হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।
আলোচনা না বাড়িয়ে আর একটি বিষয় নিয়ে এখানে বক্তব্য রেখে বাজেট-২০১৩ প্রসঙ্গটি শেষ করব। 'মুদ্রাস্টম্ফীতি' তথা 'অস্থিতিশীলতা' ভোক্তাদের আঘাত করে তীব্রভাবে। যেহেতু আর্থিক আয় স্থির রেখে মুদ্রাস্টম্ফীতি হলে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, সে জন্য বিশেষভাবে অ-বিক্রেতা ভোক্তারা মুদ্রাস্টম্ফীতির অসহায় শিকারে পরিণত হন। সব স্থির বেতন ও মজুরিভোগী ভোক্তারা এর প্রধান শিকার। সাধারণভাবে বলা যায়, এই সরকারের মাঝামাঝি সময় মুদ্রাস্টম্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যমূল্যের স্টম্ফীতি খুবই তীব্র আকার ধারণ করেছিল। কিছু বাজার নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে তা আবার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে টিসিবি শক্তিশালী করা ও নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চৎরপব ঈড়সসরংরড়হ গঠন করতে হবে। এই বাজেটে স্থায়ী পে-কমিশনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে_ এর ফলে বেতনভোগী সরকারি কর্মচারীরা কিছুটা আশ্বস্ত হবেন। কিন্তু এখন ব্যক্তি খাতের বেতনভোগীদের ক্ষেত্রে সেই পরিবর্তনের প্রভাব কী হবে তা দেখতে হবে। তবে সাধারণভাবে ব্যক্তি খাতে কাজের চাপ ও দক্ষতা বেশি আদায় করার কারণে সেখানে এমনিতেই বেতন কাঠামো একটু উঁচুতে রয়েছে। কিন্তু সেখানে আবার চাকরি নিরাপত্তা ও দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ-সুবিধাগুলো কম। সবচেয়ে অসুবিধা হয়েছে মজুরি শ্রমিকদের ও নিম্ন আয়ের কর্মচারীদের। এখন পর্যন্ত স্থায়ী মজুরি বোর্ড গঠন করে আর্থিক মজুরির নিয়মিত সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা হয়নি। এই মজুরি শ্রমিকরা ব্যক্তি খাত বা সরকারি খাত যেখানেই থাকুন না কেন তাদের ওপর চাপের মাত্রাও বেশি, আয়ও কম এবং ভোগও কম। এখানে কিছু দুর্নীতিও আছে। মাস্তানি বা লুম্পেনিজমও আছে। কিন্তু আমাদের সমাজ পুঁটি মাছের দুর্নীতি ও মাস্তানি নিয়ে যত লম্ফঝম্ফ দেখায়, রাঘববোয়ালদের ক্ষেত্রে ঠিক ততটুকুই নীরব এবং নরম থাকে। এ জন্য ঠাট্টা করে বলা হয়, এ দেশের ছোট দুর্নীতিবাজরা 'বক সিগারেট' খেলেও সেটা 'বেনসনের' প্যাকেটে থাকে বলে তা নিয়ে বেশি হৈচৈ হয়। পক্ষান্তরে বৃহৎ দুর্নীতিবাজরা 'বেনসন' খেলেও সেটা লুকিয়ে রাখেন 'বক সিগারেটের' প্যাকেটে। ফলে হৈচৈ হয় কম। তবে মিডিয়ার কল্যাণে এই দুর্বলতা বর্তমানে কিছুটা কাটতে শুরু করেছে। তবে মিডিয়াকেও সচেতন হতে হবে, যাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য দুর্নীতির খবর প্রকাশের চেয়ে বৃহৎ দুর্নীতির খবর বেশি প্রকাশিত হয় এবং তার পেছনে জোঁকের মতো লেগেও থাকতে হবে দীর্ঘদিন।
কতিপয় দৃষ্টি আকর্ষণকারী বিষয় :এবার আমি বাংলাদেশের অর্থনীতির কতিপয় ইতিবাচক কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব :
বাংলাদেশে ১৯৯৫-এর পর যে বর্ধিত প্রবৃদ্ধির হার দেখা যায় তার মূল চালিকাশক্তি চারটি_ ক. কৃষি; খ. গ্রামীণ ও শহুরে খাতে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান (বস্তুগত দ্রব্য ও সেবা খাত উভয়ের সমন্বয়ে গঠিত); গ. পোশাকশিল্পের প্রবৃদ্ধি এবং ঘ. রেমিট্যান্সের দ্রুত প্রবৃদ্ধি।
বাংলাদেশের জনসংখ্যায় একটি 'জনমিতিক লভ্যাংশের' (উবসড়মৎধঢ়যরপ উরারফবহফ) সূচনা হয়েছে। অর্থাৎ একজন কর্মক্ষম লোকের ওপর নির্ভরশীল লোকের সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ আগামী দিনের এশিয়ার প্রবৃদ্ধির অগ্রনায়ক ভারত ও চীনের সঙ্গে সঠিক পরিপূরক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে তার প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা আরও বাড়বে। বাংলাদেশের শ্রম বাহিনীতে বিপুল পরিমাণে নারীদের আগমন ঘটছে।
বাংলাদেশের কতিপয় সামাজিক ইন্ডিকেটরগুলোর (শিক্ষা ও স্বাস্থ্য) অগ্রগতির হার দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকার পরে অবস্থিত এবং ভারতের গড় হারের চেয়ে বেশি।
কিন্তু এসব সম্ভাবনার বিপরীতে প্রধান নেতিবাচক প্রবণতাটি হচ্ছে :বাংলাদেশে আয়বৈষম্য অনেক উঁচুতে। সম্পদবৈষম্য অনেক উঁচুতে। আয় পুনর্বণ্টনের পদক্ষেপগুলোতে তথাকথিত 'সিস্টেম লস' অবিশ্বাস্য মাত্রায় বেশি। রাজনীতি রয়ে গেছে অনুৎপাদনশীল ধনিক শ্রেণীর হাতে এখনও কুক্ষিগত।
উপসংহার :অবশেষে বলব, বর্তমান প্রস্তাবিত বাজেটে সবকিছুই ভোক্তাদের স্বার্থবিরোধী বা সবকিছুই ভোক্তাদের স্বার্থানুকূল_ এমন কথা বলা ঠিক হবে না। এর সবলতা ও দুর্বলতা দুটি দিকই রয়েছে। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্বলতাগুলো ক্রমে কমিয়ে সবল দিকগুলোকে আরও বৃদ্ধি করা। আর সেটা করতে পারলেই শেষে এসে আমি যে অপার সম্ভাবনার দিকগুলো উল্লেখ করেছি তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
কিন্তু সে জন্য অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় গণমুখী, উন্নয়ন ধারাকে প্রতিষ্ঠা করা। জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দানকারী, ব্যক্তিস্বার্থের বদলে সমষ্টির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দানকারী, গ্রামমুখী, বৈষম্যবিরোধী, দক্ষ ও বিচক্ষণ একটি সরকার ছাড়া তা করা সম্ভব হবে না।


অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.