চার সিটি নির্বাচন আগামী দিনের সতর্কসংকেত by এম সাখাওয়াত হোসেন
জাতীয় নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস আগে, ১৫
জুন চার সিটি করপোরেশন—রাজশাহী, খুলনা, সিলেট আর বরিশালে মেয়রসহ পরিষদের
নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ফলাফল ছিল
অনেকটা অপ্রত্যাশিত।
কারণ, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয়
জোট-সমর্থিত প্রার্থীদের চার সিটি করপোরেশনের মেয়র পদসহ ১১৬টি সাধারণ
কাউন্সিলর পদের মধ্যে ১৮-দলীয় জোট ৭৫টি পদ পেয়েও চমক সৃষ্টি করেছে। অপর
দিকে ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ-সমর্থিত শুধু চারজন
মেয়র প্রার্থীর পরাজয়ই দেখতে হয়নি, দেখতে হয়েছে প্রতিটি সিটি
করপোরেশনে কাউন্সিলর পদে বিরোধী দল-সমর্থিত প্রার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা।
এমন চিত্র সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরদের বেলায়ও দৃশ্যমান। এমনকি জামায়াতে
ইসলামীও প্রতিটি সিটি করপোরেশনের পরিষদে ন্যূনতম পক্ষে একজন এবং সিলেটে
সর্বোচ্চ তিনজন মোট আটজন নারীসহ কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়েছেন। অথচ মহাজোটের
শরিক দল জাতীয় পার্টি সাকল্যে মাত্র একটি কাউন্সিলর পদে জয়ী হয়েছে বলে
তথ্যে প্রকাশ (প্রথম আলো, জুন ১৭, ২০১৩)
এ ধরনের ফলাফল শাসক জোট যেমন আশা করেনি, তেমনি বিরোধী জোটও প্রত্যাশা করেনি। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা ছিল ৫০: ৫০-এ ফলাফল নির্ধারিত হতে পারে। এর কারণ চার সিটির মধ্যে রাজশাহী ও বরিশালের সদ্য বিদায়ী মেয়ররা তাঁদের নিজ নিজ শহরের উন্নয়ন করেছেন। শহরের বাসিন্দাদের কাছে এই দুই শহরের মেয়ররা অন্য দুই শহর থেকে যথেষ্ট সমাদৃত ছিলেন। অবশ্য ২০০৮ সালে বিএনপি প্রকাশ্য কোনো প্রার্থীকে সমর্থন না দিলেও নবনির্বাচিত চারজনের মধ্যে তিনজন নিজ বলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তবে বরিশালে বিদায়ী মেয়র শওকত হোসেন মাত্র ৫৮৮ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সময়েও বিএনপি তাদের প্রার্থীদের সমর্থন দিলে অন্তত দুটি করপোরেশনে জয়ী করাতে পারত বলে অনেকের ধারণা।
যা হোক, শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং এর ফলাফল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আমি আমার বিশ্লেষণে ১৮-দলীয় জোটের তিন এবং ১৪ দলের মহাজোটের একজন সমর্থক জিতবেন বলে ধারণা করেছিলাম। তবে সে ধারণা পাল্টাতে শুরু করে ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে বরিশাল থেকে আমার নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে বরিশালের মহাজোটের শরিকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের আভাস পেয়ে।
নির্বাচনের ফলাফল বিরোধী জোটকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে সন্দেহ নেই। গড়পড়তা প্রদেয় ভোটের ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে ১৮-দলীয় জোটের সমর্থক প্রার্থীদের পক্ষে। ভোটের এই পরিসংখ্যান ২০০৮ থেকে অনেক বেশি। ২০০৮ সালে একমাত্র সিলেটে সদ্য বিদায়ী মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান প্রতিপক্ষকে বিপুল ভোটে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন এক লাখ ১৫ হাজার ৪৩৬ ভোট আর তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আ ফ ম কামাল পেয়েছিলেন ৩২ হাজার ৯৭ ভোট। অপর দিকে বরিশালে শওকত হোসেন নির্বাচিত হয়েছিলেন ৪৬ হাজার ৭৯৬ ভোট পেয়ে আর তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সরদার সরফুদ্দিন আহমেদ পেয়েছিলেন ৪৬ হাজার ২০৮ ভোট।
আমি ওপরের প্রসঙ্গ এ জন্য টানলাম যে ২০১৩ সালের এই নির্বাচনে ১৮-দলীয় জোটের তথাকথিত ভোটব্যাংকের বাইরেও বিপুলসংখ্যক ভোটার বিজয়ীদের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ভোটের এই অঙ্ক তাৎপর্যপূর্ণ। এ ব্যবধানের পেছনে স্থানীয় বিষয়ের বিবেচনার বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিবেচনায় এবার সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে জাতীয় রাজনৈতিক বিষয়গুলো। এর মধ্যে রয়েছে বিগত সাড়ে চার বছরে ক্ষমতাসীন জোটের সুশাসনের অভাব। ১৮ দল-সমর্থিত প্রার্থীদের বাক্সে জমা হয়েছে শাসকজোটের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ভোট। অবশ্য এর আগেও চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লায় শাসকদের সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হননি। এ পর্যন্ত আটটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মাত্র দুটিতে শাসক দল-সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জে যিনি জয়ী হয়েছেন, তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী। রংপুরে বিরোধী জোট অংশ নেয়নি।
শাসকদের ভরাডুবির কারণ এক কথায় বলা যায় অর্জন ম্লান করার মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে আমি কয়েকটি উপাদান যোগ করতে চাই। কিছু কিছু মন্ত্রীর অতিকথন, অশোভন বাক্যবাণ ও আচরণ অনেকাংশে দায়ী। অতিকথন এবং কিছু কিছু কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে, অথচ এ ধরনের অতিকথনের এবং কিছু কিছু কর্মকাণ্ডে সরকারপ্রধানও বিব্রতবোধ করেছেন, এমনকি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করেছেন। তবে এত দিনে যে ক্ষতি হওয়ার তা হয়েছে। অন্যান্য বিষয় থাকুক, পদ্মা সেতু এবং এর না হওয়ার পেছনের কারণগুলো নিয়ে হতাশ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ। যদিও সেতুর দাবি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আগে মুখ্য ছিল না। পদ্মা সেতুকে ঘিরে যে দুর্নীতির অভিযোগ, একই সঙ্গে অতিকথনের মাত্রায় জনমনে এই সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে গভীর শঙ্কা রয়েছে। অন্তত বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে এ সেতুর বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তা নিশ্চিত।
আমার বিশ্লেষণে এহেন ভরাডুবির মোটা দাগের কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে দলীয় মোড়ক দিয়ে স্থানীয় উন্নয়ন এবং সমস্যা নিয়ে প্রচার-প্রচারণা বাদে জাতীয় পর্যায়ে দলীয় ভাবধারা ও এজেন্ডা নিয়ে অধিক মাত্রায় প্রচার, প্রচারণা। স্বাধীনতার চার দশক পর এখন যে প্রজন্ম সিংহভাগ বাংলাদেশি ভোটার, তাদের বিবেচনায় স্বাধীনতার পক্ষের আর বিপক্ষের শক্তির বয়ান ঠিক নয়। কারণ, এ প্রজন্ম স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম। প্রায় ৪২ বছর পর সিংহভাগ দলনিরপেক্ষ ভোটারকে আকৃষ্ট করে না। এ কথাও মনে রাখতে হবে যে ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহরের লিবারেল প্রজন্মই বাংলাদেশের প্রজন্ম নয়—এর বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংখ্যাধিক নতুন প্রজন্ম রয়েছে, যাদের চিন্তা আর ধ্যানধারণা পরিবর্তনের ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারেনি এই লিবারেল সমাজপতিরা। এর উদাহরণ হেফাজতে এবং ছাত্রশিবিরের তরুণ প্রজন্মের আধিক্য। এই প্রজন্মকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমনকি আলোচিত চারটি সিটি করপোরেশনেও ভোটার হিসেবে ভোট দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রব উঠেছে ‘আস্তিক’ আর ‘নাস্তিকের’ বিভাজনে।
আলোচিত চার সিটি করপোরেশনে এবার যেভাবে জাতীয় পর্যায়ের বিভাজনের রাজনীতির আঙ্গিক ছাড়াও ধর্মীয় অনুভূতির অপ্রতিরোধ্য ব্যবহার হয়েছে, তা রোধ করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। হেফাজতে ইসলামের উত্থান কোনোভাবেই রাজনীতির বাইরে ছিল না। ‘হেফাজতে ইসলাম’ নিজেদের অরাজনৈতিক দাবি করলেও সরকারি এবং বিরোধী জোট উভয়েই স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়ে এই সংগঠনকে বিপদে ঠেলে দিয়েছে। ৫ ও ৬ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে যেভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে, তাকে ঘিরে যে গুজব বা অতিরঞ্জন সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রতিকার করতে সরকারযন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকে দিতে বেগ পেতে হয়নি। এ দেশের মানুষ ধর্মান্ধ না হলেও ধর্মের প্রতি অত্যন্ত দুর্বল। সব ধর্মাবলম্বী হাজার বছর ধরে এমনই ছিল এবং আছে। ধর্মীয় আচরণ এতদঞ্চলের সমাজের এবং সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। তা ছাড়া ধর্মকে আক্ষরিক অর্থে রাজনীতি থেকে অতীতেও দূরে রাখা যায়নি, ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে না। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের বহু উন্নত এবং তথাকথিত সেক্যুলার দেশেও তেমনই প্রতীয়মান। কাজেই এই স্পর্শকাতর বিষয়টি যে আগামী নির্বাচনে অবশ্যই প্রভাব ফেলবে—তার প্রতিফলন এই চারটি সিটি করপোরেশনে প্রতিফলিত হয়েছে মাত্র। এখানেও নির্বাচন কমিশনের আইন ও বিধির ব্যত্যয় হয়েছে, যেমন হয়েছে নির্দলীয় নির্বাচনকে দলীয় মোড়কে ঢেকে ফেলা।
দুই
প্রবন্ধে যেসব কারণে সরকারি দলের বিপর্যয় হয়েছে বলে মনে হয়, তার মধ্যে দুর্নীতিও যোগ হয়েছে। দুর্নীতি শুধু বেআইনিভাবে অর্থ আর সম্পদ অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, দুর্নীতির বহু রূপ রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ অর্জনও এ পর্যায়ে পড়ে। আলোচিত চার সিটি করপোরেশনের বিদায়ী মেয়রদের বাধ্যতামূলক তথ্যবিবরণীতে সম্পদ-স্ফীতির যে বিবরণ পাওয়া গিয়েছিল, তার বিশ্লেষণ জনমনে, বিশেষ করে ওই শহরের ভোটারদের মনে প্রশ্নবোধক চিহ্নের জন্ম দিয়েছিল। সম্পদ অর্জন বৈধ উপায়ে হলেও গত পাঁচ বছরে যেভাবে স্ফীত হয়েছে, তা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এরই প্রতিফলন হয়েছে ভোটারদের রায়ে। হয়তো ভবিষ্যতেও সংসদ নির্বাচনের আগে এমনই দেখা যেতে পারে অনেক প্রার্থীর বিবরণ থেকে।
তিন
এই নির্বাচন এবং ফলাফল নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে উভয় পক্ষে। নির্বাচনের ফলাফলে উভয় পক্ষের যত বক্তব্যই থাকুক না কেন, সরকারি জোটকে এ সতর্কবাণী বা আমার মতে ৭ নম্বর বিপৎসংকেতকে আমলে নিয়ে, আত্মবিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। অপরদিকে বিরোধী জোটকেও অনুধাবন করতে হবে যে সব ভোটই তাদের আবেদনে দেওয়া হয়নি। এ ভোটের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে সরকারের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডগুলো যেভাবে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ভেতরে চাপা পড়ে গেছে, আর তাতে জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, তার ফলে এই ভোটের বন্যা। তাই আত্মতৃপ্তির সুযোগ কম। অবশ্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারব্যবস্থা নিয়ে জনমনে যে উৎকণ্ঠা রয়েছে, তার প্রতিফলন রয়েছে এই নির্বাচনগুলোর ফলাফলে।
উপসংহারে বলতে চাই যে বিগত এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা বেড়েছে, তা সব রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদকে অনুধাবন করতে হবে। ভোট কেনাবেচা ক্রমেই অতীত হয়ে যাচ্ছে। এটি খুবই ইতিবাচক দিক।
পরিশেষে পুনরাবৃত্তি করছি যে এ নির্বাচন সরকারি এবং বিরোধী জোট উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। এর গভীর বিশ্লেষণ অবশ্যই প্রয়োজন।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com
এ ধরনের ফলাফল শাসক জোট যেমন আশা করেনি, তেমনি বিরোধী জোটও প্রত্যাশা করেনি। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা ছিল ৫০: ৫০-এ ফলাফল নির্ধারিত হতে পারে। এর কারণ চার সিটির মধ্যে রাজশাহী ও বরিশালের সদ্য বিদায়ী মেয়ররা তাঁদের নিজ নিজ শহরের উন্নয়ন করেছেন। শহরের বাসিন্দাদের কাছে এই দুই শহরের মেয়ররা অন্য দুই শহর থেকে যথেষ্ট সমাদৃত ছিলেন। অবশ্য ২০০৮ সালে বিএনপি প্রকাশ্য কোনো প্রার্থীকে সমর্থন না দিলেও নবনির্বাচিত চারজনের মধ্যে তিনজন নিজ বলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তবে বরিশালে বিদায়ী মেয়র শওকত হোসেন মাত্র ৫৮৮ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সময়েও বিএনপি তাদের প্রার্থীদের সমর্থন দিলে অন্তত দুটি করপোরেশনে জয়ী করাতে পারত বলে অনেকের ধারণা।
যা হোক, শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং এর ফলাফল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আমি আমার বিশ্লেষণে ১৮-দলীয় জোটের তিন এবং ১৪ দলের মহাজোটের একজন সমর্থক জিতবেন বলে ধারণা করেছিলাম। তবে সে ধারণা পাল্টাতে শুরু করে ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে বরিশাল থেকে আমার নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে বরিশালের মহাজোটের শরিকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের আভাস পেয়ে।
নির্বাচনের ফলাফল বিরোধী জোটকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে সন্দেহ নেই। গড়পড়তা প্রদেয় ভোটের ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে ১৮-দলীয় জোটের সমর্থক প্রার্থীদের পক্ষে। ভোটের এই পরিসংখ্যান ২০০৮ থেকে অনেক বেশি। ২০০৮ সালে একমাত্র সিলেটে সদ্য বিদায়ী মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান প্রতিপক্ষকে বিপুল ভোটে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন এক লাখ ১৫ হাজার ৪৩৬ ভোট আর তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আ ফ ম কামাল পেয়েছিলেন ৩২ হাজার ৯৭ ভোট। অপর দিকে বরিশালে শওকত হোসেন নির্বাচিত হয়েছিলেন ৪৬ হাজার ৭৯৬ ভোট পেয়ে আর তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সরদার সরফুদ্দিন আহমেদ পেয়েছিলেন ৪৬ হাজার ২০৮ ভোট।
আমি ওপরের প্রসঙ্গ এ জন্য টানলাম যে ২০১৩ সালের এই নির্বাচনে ১৮-দলীয় জোটের তথাকথিত ভোটব্যাংকের বাইরেও বিপুলসংখ্যক ভোটার বিজয়ীদের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ভোটের এই অঙ্ক তাৎপর্যপূর্ণ। এ ব্যবধানের পেছনে স্থানীয় বিষয়ের বিবেচনার বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিবেচনায় এবার সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে জাতীয় রাজনৈতিক বিষয়গুলো। এর মধ্যে রয়েছে বিগত সাড়ে চার বছরে ক্ষমতাসীন জোটের সুশাসনের অভাব। ১৮ দল-সমর্থিত প্রার্থীদের বাক্সে জমা হয়েছে শাসকজোটের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ভোট। অবশ্য এর আগেও চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লায় শাসকদের সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হননি। এ পর্যন্ত আটটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মাত্র দুটিতে শাসক দল-সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জে যিনি জয়ী হয়েছেন, তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী। রংপুরে বিরোধী জোট অংশ নেয়নি।
শাসকদের ভরাডুবির কারণ এক কথায় বলা যায় অর্জন ম্লান করার মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে আমি কয়েকটি উপাদান যোগ করতে চাই। কিছু কিছু মন্ত্রীর অতিকথন, অশোভন বাক্যবাণ ও আচরণ অনেকাংশে দায়ী। অতিকথন এবং কিছু কিছু কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে, অথচ এ ধরনের অতিকথনের এবং কিছু কিছু কর্মকাণ্ডে সরকারপ্রধানও বিব্রতবোধ করেছেন, এমনকি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করেছেন। তবে এত দিনে যে ক্ষতি হওয়ার তা হয়েছে। অন্যান্য বিষয় থাকুক, পদ্মা সেতু এবং এর না হওয়ার পেছনের কারণগুলো নিয়ে হতাশ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ। যদিও সেতুর দাবি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আগে মুখ্য ছিল না। পদ্মা সেতুকে ঘিরে যে দুর্নীতির অভিযোগ, একই সঙ্গে অতিকথনের মাত্রায় জনমনে এই সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে গভীর শঙ্কা রয়েছে। অন্তত বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে এ সেতুর বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তা নিশ্চিত।
আমার বিশ্লেষণে এহেন ভরাডুবির মোটা দাগের কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে দলীয় মোড়ক দিয়ে স্থানীয় উন্নয়ন এবং সমস্যা নিয়ে প্রচার-প্রচারণা বাদে জাতীয় পর্যায়ে দলীয় ভাবধারা ও এজেন্ডা নিয়ে অধিক মাত্রায় প্রচার, প্রচারণা। স্বাধীনতার চার দশক পর এখন যে প্রজন্ম সিংহভাগ বাংলাদেশি ভোটার, তাদের বিবেচনায় স্বাধীনতার পক্ষের আর বিপক্ষের শক্তির বয়ান ঠিক নয়। কারণ, এ প্রজন্ম স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম। প্রায় ৪২ বছর পর সিংহভাগ দলনিরপেক্ষ ভোটারকে আকৃষ্ট করে না। এ কথাও মনে রাখতে হবে যে ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহরের লিবারেল প্রজন্মই বাংলাদেশের প্রজন্ম নয়—এর বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংখ্যাধিক নতুন প্রজন্ম রয়েছে, যাদের চিন্তা আর ধ্যানধারণা পরিবর্তনের ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারেনি এই লিবারেল সমাজপতিরা। এর উদাহরণ হেফাজতে এবং ছাত্রশিবিরের তরুণ প্রজন্মের আধিক্য। এই প্রজন্মকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমনকি আলোচিত চারটি সিটি করপোরেশনেও ভোটার হিসেবে ভোট দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রব উঠেছে ‘আস্তিক’ আর ‘নাস্তিকের’ বিভাজনে।
আলোচিত চার সিটি করপোরেশনে এবার যেভাবে জাতীয় পর্যায়ের বিভাজনের রাজনীতির আঙ্গিক ছাড়াও ধর্মীয় অনুভূতির অপ্রতিরোধ্য ব্যবহার হয়েছে, তা রোধ করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। হেফাজতে ইসলামের উত্থান কোনোভাবেই রাজনীতির বাইরে ছিল না। ‘হেফাজতে ইসলাম’ নিজেদের অরাজনৈতিক দাবি করলেও সরকারি এবং বিরোধী জোট উভয়েই স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়ে এই সংগঠনকে বিপদে ঠেলে দিয়েছে। ৫ ও ৬ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে যেভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে, তাকে ঘিরে যে গুজব বা অতিরঞ্জন সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রতিকার করতে সরকারযন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকে দিতে বেগ পেতে হয়নি। এ দেশের মানুষ ধর্মান্ধ না হলেও ধর্মের প্রতি অত্যন্ত দুর্বল। সব ধর্মাবলম্বী হাজার বছর ধরে এমনই ছিল এবং আছে। ধর্মীয় আচরণ এতদঞ্চলের সমাজের এবং সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। তা ছাড়া ধর্মকে আক্ষরিক অর্থে রাজনীতি থেকে অতীতেও দূরে রাখা যায়নি, ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে না। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের বহু উন্নত এবং তথাকথিত সেক্যুলার দেশেও তেমনই প্রতীয়মান। কাজেই এই স্পর্শকাতর বিষয়টি যে আগামী নির্বাচনে অবশ্যই প্রভাব ফেলবে—তার প্রতিফলন এই চারটি সিটি করপোরেশনে প্রতিফলিত হয়েছে মাত্র। এখানেও নির্বাচন কমিশনের আইন ও বিধির ব্যত্যয় হয়েছে, যেমন হয়েছে নির্দলীয় নির্বাচনকে দলীয় মোড়কে ঢেকে ফেলা।
দুই
প্রবন্ধে যেসব কারণে সরকারি দলের বিপর্যয় হয়েছে বলে মনে হয়, তার মধ্যে দুর্নীতিও যোগ হয়েছে। দুর্নীতি শুধু বেআইনিভাবে অর্থ আর সম্পদ অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, দুর্নীতির বহু রূপ রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ অর্জনও এ পর্যায়ে পড়ে। আলোচিত চার সিটি করপোরেশনের বিদায়ী মেয়রদের বাধ্যতামূলক তথ্যবিবরণীতে সম্পদ-স্ফীতির যে বিবরণ পাওয়া গিয়েছিল, তার বিশ্লেষণ জনমনে, বিশেষ করে ওই শহরের ভোটারদের মনে প্রশ্নবোধক চিহ্নের জন্ম দিয়েছিল। সম্পদ অর্জন বৈধ উপায়ে হলেও গত পাঁচ বছরে যেভাবে স্ফীত হয়েছে, তা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এরই প্রতিফলন হয়েছে ভোটারদের রায়ে। হয়তো ভবিষ্যতেও সংসদ নির্বাচনের আগে এমনই দেখা যেতে পারে অনেক প্রার্থীর বিবরণ থেকে।
তিন
এই নির্বাচন এবং ফলাফল নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে উভয় পক্ষে। নির্বাচনের ফলাফলে উভয় পক্ষের যত বক্তব্যই থাকুক না কেন, সরকারি জোটকে এ সতর্কবাণী বা আমার মতে ৭ নম্বর বিপৎসংকেতকে আমলে নিয়ে, আত্মবিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। অপরদিকে বিরোধী জোটকেও অনুধাবন করতে হবে যে সব ভোটই তাদের আবেদনে দেওয়া হয়নি। এ ভোটের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে সরকারের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডগুলো যেভাবে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ভেতরে চাপা পড়ে গেছে, আর তাতে জনমনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে, তার ফলে এই ভোটের বন্যা। তাই আত্মতৃপ্তির সুযোগ কম। অবশ্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারব্যবস্থা নিয়ে জনমনে যে উৎকণ্ঠা রয়েছে, তার প্রতিফলন রয়েছে এই নির্বাচনগুলোর ফলাফলে।
উপসংহারে বলতে চাই যে বিগত এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা বেড়েছে, তা সব রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদকে অনুধাবন করতে হবে। ভোট কেনাবেচা ক্রমেই অতীত হয়ে যাচ্ছে। এটি খুবই ইতিবাচক দিক।
পরিশেষে পুনরাবৃত্তি করছি যে এ নির্বাচন সরকারি এবং বিরোধী জোট উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। এর গভীর বিশ্লেষণ অবশ্যই প্রয়োজন।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com
No comments