চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-টুইডেলগাম, টুইডেলগী by যতীন সরকার
দেখতে দেখতে চার দশকেরও বেশি সময়
অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এই দীর্ঘদিনেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিতে কাঙ্ক্ষিত
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো না কেন? এ প্রশ্ন সবারই। অথচ এর সর্বজনগ্রাহ্য
উত্তর এত দিনেও পাওয়া গেল না।
বরং প্রশ্নটির অনেক অনেক
ডালপালারই বিস্তার ঘটে চলেছে কেবল। ওই সব ডালপালায় বিচরণ করে প্রশ্নটির আসল
উত্তর কিছুতেই পাওয়া যাবে না। সে রকম উত্তর পাওয়ার জন্যই প্রয়োজন
প্রশ্নটির একেবারে মূলে দৃষ্টিপাত করা। অর্থাৎ 'গণতন্ত্র' বলতে আসলে কী
বোঝায়, সে বিষয়টিই আগে বুঝে নেওয়া।
এ রকম কথা ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তো অনেকের মুখ থেকে ফস্ করে বেরিয়ে আসবে আব্রাহাম লিংকনের সেই বিখ্যাত উক্তি- 'জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার।' অথচ এতেই যে প্রশ্নটির নিঃসংশয় উত্তর মিলে যাবে, তা কিন্তু নয়। তখন 'জনগণ' কারা এবং কোন জনগণের সরকার- এই প্রশ্ন উঠে আসবে। উঠে আসবে ইতিহাসের প্রসঙ্গও। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে কোন জনগণের কী ধরনের অবস্থান ছিল, রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে গণতন্ত্রের মতো কোনো ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল কি না, থাকলে কখন কোথায় কেমনভাবে ছিল- মূল প্রশ্নটির মূলে এ রকম অনেক কিছুই চোখে পড়বে।
প্রাচীন গ্রিসই যে ছিল ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের সূতিকাগার এবং 'ডেমোক্রেসি' শব্দটির উদ্ভবও যে সেখানেই- এ তথ্য আজ সর্বজনজ্ঞাত। কিন্তু সেই গ্রিক গণতন্ত্রের স্বরূপ-প্রকৃতি বুঝে নিলে সেই গণতন্ত্রের ভেতরকার ফাঁক ও ফাঁকিও ধরা পড়ে যাবে। এমনকি অদ্যাবধি প্রচলিত সব গণতন্ত্রই যে ফাঁক ও ফাঁকিতে ভরা, তাও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
প্রাচীন গ্রিক সমাজের ভিত্তিটি ছিল ক্রীতদাসতান্ত্রিক। অর্থাৎ গরু-ছাগলের মতো মানুষেরও সেখানে কেনাবেচা চলত। যারা কিনে আনত আর যাদের কিনে আনা হতো এই দুই জাতের মানুষের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চয়ই এ রকম ছিল না, থাকতেও পারে না। প্রথমজনেরা মালিক আর দ্বিতীয়জনেরা দাস। দাসদের অবস্থাও যে গরু-ছাগলদের থেকে অন্য রকম হতে পারেনি- সে কথা তো না বললেও চলে। গরু-ছাগলের বাচ্চাদের মতোই দাসদের ছেলেমেয়েরাও মালিকের সম্পত্তি। এই ক্রীতদাসরাই পরিশ্রম করে যা উৎপাদন করত, তার সবই হতো মালিকের। মালিকদের অন্ন, বস্ত্র, আবাস ও আরাম-আয়েশের জোগান দিত যারা, খেয়েদেয়ে কোনো মতো ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার চেয়ে বেশি কিছুই তারা পেত না। সেই দাসমালিক ও অন্য 'স্বাধীন' মানুষদের সংখ্যা ছিল একেবারেই মুষ্টিমেয় আর ক্রীতদাসরা অপরিমেয় সংখ্যক। সেই দেশে ও সমাজে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে রাষ্ট্রে অবশ্যই 'সরকার'ও ছিল। সেই সরকার গঠনে, নির্বাচনে ও পরিচালনায় ক্রীতদাসদের কোনো অধিকার ছিল না। অথচ মুষ্টিমেয় পরশ্রমভোগী মানুষের সেই সরকারই নাকি যথার্থ গণতান্ত্রিক সরকার।
কিন্তু কী করে তা হয়? প্রকৃত 'গণ' যেখানে বঞ্চিত এবং বঞ্চকরাই সর্বেসর্বা, তেমন সরকারকে কী করে গণতন্ত্রের মডেল বিবেচনা করা যায়? সেই গণহীন গণতন্ত্রের মহিমা প্রচারে আজও কেন ডঙ্কা বাজানো হচ্ছে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তৎপর কেন সেই গণতন্ত্রে ফাঁক ও ফাঁকিগুলোকে আড়াল করে রাখতে?
সরাসরি এমনসব বেয়াড়া প্রশ্ন কোনো ঝানু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে কেউ কোনো দিন করেছিলেন কি না এবং করে থাকলে কী জবাব পেয়েছিলেন, আমার জানা নেই। তবে অনুমান করতে পারি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মহোদয় অনেক ভারী ভারী কিতাবের নাম করে প্রশ্নকর্তাকে ভড়কে দিতে চেয়েছিলেন। গ্রিক গণতন্ত্রে কিছু ফাঁক ও ফাঁকি থাকলেও হয়তো থাকতে পারে। সেসবকে বড় করে দেখা তো আসল সত্যকে না দেখে কেবলই ছিদ্রান্বেষণ করা। গ্রিসীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীরূপে আজকের গণতন্ত্র যে সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন এমন কথাও হয়তো সেই গুরুগম্ভীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল এবং ছিদ্রান্বেষণ প্রবৃত্তি পরিহার করতে প্রশ্নকর্তাকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন।
আজকে যে পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে ত্রুটিহীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই বলে সেখানকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ঢক্কানিনাদে প্রচার করছেন। বিরামহীনভাবে বলে চলছেন- এই গণতন্ত্রই সারা পৃথিবীর সব দেশের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। এই গণতন্ত্রে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক সমান মর্যাদার অধিকারী, প্রত্যেকেরই একটি করে ভোট। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ভোটেই তো সরকার নির্বাচিত হয়। তাই সেটি অবশ্যই জনগণের সরকার। নির্বাচিত হতে চাইলে ভোটভিখারি হয়ে জনগণের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিতে হয়। নির্বাচিত হয়ে ভোটার তথা জনগণের কল্যাণের জন্য কী কী করবেন তা জানিয়ে ভোটপ্রার্থীদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয়, সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে পরবর্তী নির্বাচনে ভোটাররাই ব্যালটের মাধ্যমে তাঁদের গদিচ্যুত করেন। ভোটার তথা জনগণই যে গণতন্ত্রে এমন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, সে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু বলাই তো গণবিরোধিতা। এ রকম বিরোধিতা যারা করে, তারা বুলেটের পূজারি, ব্যালটের নয়। গণতন্ত্রে বুলেটের বদলে ব্যালটেরই জয় ঘোষিত।
এমন ধরনের বক্তব্য ধনিক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রতিনিয়ত প্রচারিত হলেও কবি-শিল্পীরা কিন্তু এতে প্রতারিত হন না। কারণ কবি-শিল্পীরা অন্য ধাতুতে গড়া, তাঁদের অনুভব ও অনুভূতি আকাশস্পর্শী ও ভূতলভেদী। বুদ্ধিমানের বুদ্ধি যেখানে অনধিগম্য, শিল্পীর চৈতন্য সেখানে অনায়াসে প্রবেশ করে। শৈল্পিক অনুভবের অধিকারী কবিচিত্তে গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপটিরও প্রতিফলন ঘটে সে কারণেই। তাই কবি-শিল্পী অন্নদাশঙ্কর রায় নিজে দেখেন ও আমাদের দেখান-
জোর যার মুলুক তার
মুলুক যার ভোট তার।
ভোট যার গদি তার
গদি যার ভোট তার।
এই কথাটি জেনো সার
বুলেট যার ব্যালট তার।
বুলেটধারীরাই তো সব রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল শক্তি। ব্যালটেরও তারাই নিয়ন্ত্রক। বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত থাকলেও গোড়ায় তারা এক ও অভিন্ন। তাদেরই একগোষ্ঠী ভোটপ্রার্থী হয়ে জানায়-
শুনহে ভোটার ভাই,
সবার উপরে আমিই সত্য
আমার উপরে নাই।
আমাকেই যদি ভোট দাও আর
আমি যদি হই রাজা
তোমার ভাগ্যে নিত্যভোগ্য
মৎস্য মাংস খাজা।
শুনবে আমার নাম?
আমি টুইডেলগাম।
তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভোটপ্রার্থী এসে বলে-
আমাকেই যদি ভোট দাও আর
আমি যদি হই রাজা
সাতখুন আমি মাফ করে দেব
তোমার হবে না সাজা।
নামটি আমার কী?
আমি টুইডেলগী।
অন্নদাশঙ্কর কথিত এই 'টুইডেলগাম' আর 'টুইডেলগী'রাই
বিভিন্ন নামে বিভিন্ন পার্টি বানায়, তাদের হাতেই থাকে রাজদণ্ড। 'জনগণ' নামে যারা পরিচিত, তারা কেবল ভোটেরই অধিকারী, রাজদণ্ডের নয়। একালীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটাররা শুধু ভোটই দিতে পারে, রাজত্বে অধিকার বিস্তারের সুযোগ বা ক্ষমতা তাদের নেই। যদি কখনো জনগণ কেবল ভোটদানের অধিকারে সন্তুষ্ট না থেকে রাজত্বের দিকে হাত বাড়ায়, তবে সে হাত ভেঙে দিতে টুইডেলগাম আর টুইডেলগীরা একাট্টা হয়, গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে ফেলে, জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, 'বুলেট যার ব্যালট তার'- এই সত্যই অনাবৃত করে দেয়।
এই গণতন্ত্রে সবাই সমান বলে প্রচারিত হলেও দুর্মুখেরা বলে, সমানদের মধ্যেও কেউ কেউ একটু 'বেশি সমান'। ধনবৈষম্যের কারণেই তাদের এই বেশি সমানত্ব। প্রাচীন গ্রিসে যেমন ক্রীতদাসরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, একালেও যারা সংখ্যাগুরু, তাদের বলা যায় 'বেতনদাস'। সংখ্যালঘু ধনিকরাই মূলত এই বেতনদাসদের মালিক। ক্রীতদাস মালিকদের মতো বেতনদাসের মালিকরা মোটেই হৃদয়হীন নন, জোর করে তাঁরা কাউকে দাসত্বে আবদ্ধ করেন না। 'সহৃদয়' এই মালিকরা বেতনদাসদের জন্য কাজের সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন; সেই নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে তারা দাস নয়, সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিবেকের স্বাধীনতারও তারা অধিকারী। দেশের সরকার গঠনেও তাদের অধিকার স্বীকৃত। ভোটের অধিকারের বিচারে তারা তো মালিকদেরই সমান। আহা, কী অসাধারণ গণতন্ত্র!
তবু কী দুঃখ, কতগুলো দুর্মুখ ছিদ্রান্বেষী কি না এই গণতন্ত্রেও ফাঁক ও ফাঁকি দেখতে পায়। তারা সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে ধনের মালিকানার অধিকারীদেরই কবজায় এই গণতন্ত্র আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ। একেবারে নির্ধন বা খুবই সামান্য ধন যাদের, তারা কেবল ভোট দিতেই পারে, ভোট পেতে পারে না। হ্যাঁ, ভোট প্রাপ্তির অধিকারও তাদের জন্য স্বীকৃত বটে। কিন্তু আসলে তাদের সে অধিকার এমনই ফাঁকিতে ভরা যে ভোটপ্রাপ্তি দূরে থাক, ভোটপ্রার্থী হওয়ারও ক্ষমতা তাদের নেই। অর্থের ভাণ্ডার পূর্ণ নয় যাদের, তাদের সব অধিকারই অর্থহীন। এমন গণতন্ত্রকে গণ-অধিকারহীন ধনিক গণতন্ত্র আখ্যা দেয় যারা, সেই দুর্মুখদের মুখ বন্ধ করবে কে বা কারা?
এতক্ষণ ধরে অনেক অনেক কথা বলে প্রচলিত গণতন্ত্রের স্বরূপ প্রকৃতি বিশ্লেষণের চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর-অন্বেষায় আলোচনাটি শুরু করেছিলাম, বাংলাদেশে সেই কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তো কিছুই বলা হলো না। বারান্তরে বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজকে এখানেই ইতি টানছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ
এ রকম কথা ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তো অনেকের মুখ থেকে ফস্ করে বেরিয়ে আসবে আব্রাহাম লিংকনের সেই বিখ্যাত উক্তি- 'জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের সরকার।' অথচ এতেই যে প্রশ্নটির নিঃসংশয় উত্তর মিলে যাবে, তা কিন্তু নয়। তখন 'জনগণ' কারা এবং কোন জনগণের সরকার- এই প্রশ্ন উঠে আসবে। উঠে আসবে ইতিহাসের প্রসঙ্গও। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে কোন জনগণের কী ধরনের অবস্থান ছিল, রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে গণতন্ত্রের মতো কোনো ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল কি না, থাকলে কখন কোথায় কেমনভাবে ছিল- মূল প্রশ্নটির মূলে এ রকম অনেক কিছুই চোখে পড়বে।
প্রাচীন গ্রিসই যে ছিল ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের সূতিকাগার এবং 'ডেমোক্রেসি' শব্দটির উদ্ভবও যে সেখানেই- এ তথ্য আজ সর্বজনজ্ঞাত। কিন্তু সেই গ্রিক গণতন্ত্রের স্বরূপ-প্রকৃতি বুঝে নিলে সেই গণতন্ত্রের ভেতরকার ফাঁক ও ফাঁকিও ধরা পড়ে যাবে। এমনকি অদ্যাবধি প্রচলিত সব গণতন্ত্রই যে ফাঁক ও ফাঁকিতে ভরা, তাও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
প্রাচীন গ্রিক সমাজের ভিত্তিটি ছিল ক্রীতদাসতান্ত্রিক। অর্থাৎ গরু-ছাগলের মতো মানুষেরও সেখানে কেনাবেচা চলত। যারা কিনে আনত আর যাদের কিনে আনা হতো এই দুই জাতের মানুষের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চয়ই এ রকম ছিল না, থাকতেও পারে না। প্রথমজনেরা মালিক আর দ্বিতীয়জনেরা দাস। দাসদের অবস্থাও যে গরু-ছাগলদের থেকে অন্য রকম হতে পারেনি- সে কথা তো না বললেও চলে। গরু-ছাগলের বাচ্চাদের মতোই দাসদের ছেলেমেয়েরাও মালিকের সম্পত্তি। এই ক্রীতদাসরাই পরিশ্রম করে যা উৎপাদন করত, তার সবই হতো মালিকের। মালিকদের অন্ন, বস্ত্র, আবাস ও আরাম-আয়েশের জোগান দিত যারা, খেয়েদেয়ে কোনো মতো ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার চেয়ে বেশি কিছুই তারা পেত না। সেই দাসমালিক ও অন্য 'স্বাধীন' মানুষদের সংখ্যা ছিল একেবারেই মুষ্টিমেয় আর ক্রীতদাসরা অপরিমেয় সংখ্যক। সেই দেশে ও সমাজে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে রাষ্ট্রে অবশ্যই 'সরকার'ও ছিল। সেই সরকার গঠনে, নির্বাচনে ও পরিচালনায় ক্রীতদাসদের কোনো অধিকার ছিল না। অথচ মুষ্টিমেয় পরশ্রমভোগী মানুষের সেই সরকারই নাকি যথার্থ গণতান্ত্রিক সরকার।
কিন্তু কী করে তা হয়? প্রকৃত 'গণ' যেখানে বঞ্চিত এবং বঞ্চকরাই সর্বেসর্বা, তেমন সরকারকে কী করে গণতন্ত্রের মডেল বিবেচনা করা যায়? সেই গণহীন গণতন্ত্রের মহিমা প্রচারে আজও কেন ডঙ্কা বাজানো হচ্ছে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তৎপর কেন সেই গণতন্ত্রে ফাঁক ও ফাঁকিগুলোকে আড়াল করে রাখতে?
সরাসরি এমনসব বেয়াড়া প্রশ্ন কোনো ঝানু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে কেউ কোনো দিন করেছিলেন কি না এবং করে থাকলে কী জবাব পেয়েছিলেন, আমার জানা নেই। তবে অনুমান করতে পারি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মহোদয় অনেক ভারী ভারী কিতাবের নাম করে প্রশ্নকর্তাকে ভড়কে দিতে চেয়েছিলেন। গ্রিক গণতন্ত্রে কিছু ফাঁক ও ফাঁকি থাকলেও হয়তো থাকতে পারে। সেসবকে বড় করে দেখা তো আসল সত্যকে না দেখে কেবলই ছিদ্রান্বেষণ করা। গ্রিসীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীরূপে আজকের গণতন্ত্র যে সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন এমন কথাও হয়তো সেই গুরুগম্ভীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল এবং ছিদ্রান্বেষণ প্রবৃত্তি পরিহার করতে প্রশ্নকর্তাকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন।
আজকে যে পাশ্চাত্য ভূখণ্ডে ত্রুটিহীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই বলে সেখানকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ঢক্কানিনাদে প্রচার করছেন। বিরামহীনভাবে বলে চলছেন- এই গণতন্ত্রই সারা পৃথিবীর সব দেশের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। এই গণতন্ত্রে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক সমান মর্যাদার অধিকারী, প্রত্যেকেরই একটি করে ভোট। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ভোটেই তো সরকার নির্বাচিত হয়। তাই সেটি অবশ্যই জনগণের সরকার। নির্বাচিত হতে চাইলে ভোটভিখারি হয়ে জনগণের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিতে হয়। নির্বাচিত হয়ে ভোটার তথা জনগণের কল্যাণের জন্য কী কী করবেন তা জানিয়ে ভোটপ্রার্থীদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয়, সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে পরবর্তী নির্বাচনে ভোটাররাই ব্যালটের মাধ্যমে তাঁদের গদিচ্যুত করেন। ভোটার তথা জনগণই যে গণতন্ত্রে এমন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, সে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু বলাই তো গণবিরোধিতা। এ রকম বিরোধিতা যারা করে, তারা বুলেটের পূজারি, ব্যালটের নয়। গণতন্ত্রে বুলেটের বদলে ব্যালটেরই জয় ঘোষিত।
এমন ধরনের বক্তব্য ধনিক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রতিনিয়ত প্রচারিত হলেও কবি-শিল্পীরা কিন্তু এতে প্রতারিত হন না। কারণ কবি-শিল্পীরা অন্য ধাতুতে গড়া, তাঁদের অনুভব ও অনুভূতি আকাশস্পর্শী ও ভূতলভেদী। বুদ্ধিমানের বুদ্ধি যেখানে অনধিগম্য, শিল্পীর চৈতন্য সেখানে অনায়াসে প্রবেশ করে। শৈল্পিক অনুভবের অধিকারী কবিচিত্তে গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপটিরও প্রতিফলন ঘটে সে কারণেই। তাই কবি-শিল্পী অন্নদাশঙ্কর রায় নিজে দেখেন ও আমাদের দেখান-
জোর যার মুলুক তার
মুলুক যার ভোট তার।
ভোট যার গদি তার
গদি যার ভোট তার।
এই কথাটি জেনো সার
বুলেট যার ব্যালট তার।
বুলেটধারীরাই তো সব রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল শক্তি। ব্যালটেরও তারাই নিয়ন্ত্রক। বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত থাকলেও গোড়ায় তারা এক ও অভিন্ন। তাদেরই একগোষ্ঠী ভোটপ্রার্থী হয়ে জানায়-
শুনহে ভোটার ভাই,
সবার উপরে আমিই সত্য
আমার উপরে নাই।
আমাকেই যদি ভোট দাও আর
আমি যদি হই রাজা
তোমার ভাগ্যে নিত্যভোগ্য
মৎস্য মাংস খাজা।
শুনবে আমার নাম?
আমি টুইডেলগাম।
তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভোটপ্রার্থী এসে বলে-
আমাকেই যদি ভোট দাও আর
আমি যদি হই রাজা
সাতখুন আমি মাফ করে দেব
তোমার হবে না সাজা।
নামটি আমার কী?
আমি টুইডেলগী।
অন্নদাশঙ্কর কথিত এই 'টুইডেলগাম' আর 'টুইডেলগী'রাই
বিভিন্ন নামে বিভিন্ন পার্টি বানায়, তাদের হাতেই থাকে রাজদণ্ড। 'জনগণ' নামে যারা পরিচিত, তারা কেবল ভোটেরই অধিকারী, রাজদণ্ডের নয়। একালীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটাররা শুধু ভোটই দিতে পারে, রাজত্বে অধিকার বিস্তারের সুযোগ বা ক্ষমতা তাদের নেই। যদি কখনো জনগণ কেবল ভোটদানের অধিকারে সন্তুষ্ট না থেকে রাজত্বের দিকে হাত বাড়ায়, তবে সে হাত ভেঙে দিতে টুইডেলগাম আর টুইডেলগীরা একাট্টা হয়, গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে ফেলে, জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, 'বুলেট যার ব্যালট তার'- এই সত্যই অনাবৃত করে দেয়।
এই গণতন্ত্রে সবাই সমান বলে প্রচারিত হলেও দুর্মুখেরা বলে, সমানদের মধ্যেও কেউ কেউ একটু 'বেশি সমান'। ধনবৈষম্যের কারণেই তাদের এই বেশি সমানত্ব। প্রাচীন গ্রিসে যেমন ক্রীতদাসরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, একালেও যারা সংখ্যাগুরু, তাদের বলা যায় 'বেতনদাস'। সংখ্যালঘু ধনিকরাই মূলত এই বেতনদাসদের মালিক। ক্রীতদাস মালিকদের মতো বেতনদাসের মালিকরা মোটেই হৃদয়হীন নন, জোর করে তাঁরা কাউকে দাসত্বে আবদ্ধ করেন না। 'সহৃদয়' এই মালিকরা বেতনদাসদের জন্য কাজের সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন; সেই নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে তারা দাস নয়, সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিবেকের স্বাধীনতারও তারা অধিকারী। দেশের সরকার গঠনেও তাদের অধিকার স্বীকৃত। ভোটের অধিকারের বিচারে তারা তো মালিকদেরই সমান। আহা, কী অসাধারণ গণতন্ত্র!
তবু কী দুঃখ, কতগুলো দুর্মুখ ছিদ্রান্বেষী কি না এই গণতন্ত্রেও ফাঁক ও ফাঁকি দেখতে পায়। তারা সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে ধনের মালিকানার অধিকারীদেরই কবজায় এই গণতন্ত্র আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ। একেবারে নির্ধন বা খুবই সামান্য ধন যাদের, তারা কেবল ভোট দিতেই পারে, ভোট পেতে পারে না। হ্যাঁ, ভোট প্রাপ্তির অধিকারও তাদের জন্য স্বীকৃত বটে। কিন্তু আসলে তাদের সে অধিকার এমনই ফাঁকিতে ভরা যে ভোটপ্রাপ্তি দূরে থাক, ভোটপ্রার্থী হওয়ারও ক্ষমতা তাদের নেই। অর্থের ভাণ্ডার পূর্ণ নয় যাদের, তাদের সব অধিকারই অর্থহীন। এমন গণতন্ত্রকে গণ-অধিকারহীন ধনিক গণতন্ত্র আখ্যা দেয় যারা, সেই দুর্মুখদের মুখ বন্ধ করবে কে বা কারা?
এতক্ষণ ধরে অনেক অনেক কথা বলে প্রচলিত গণতন্ত্রের স্বরূপ প্রকৃতি বিশ্লেষণের চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর-অন্বেষায় আলোচনাটি শুরু করেছিলাম, বাংলাদেশে সেই কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তো কিছুই বলা হলো না। বারান্তরে বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজকে এখানেই ইতি টানছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments