ব্যক্তির অধিক এক জীবন by সঞ্জয় ঘোষ
টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে যতবারই তার
কণ্ঠ শুনতে পাই, এক অদ্ভুত সি্নগ্ধতায় যেন ভরে ওঠে মন। এবারও তার ব্যতিক্রম
ঘটল না। বেশ কিছুদিন বাদে সাক্ষাৎ প্রার্থনায় তিনি না করলেন না। বললেন,
'কখন আসতে চাও?'।
আষাঢ়ের এক সকালের একান্ত আলাপচারিতায়
নিতান্ত সামান্যই তার জীবনকে তুলে আনা গেল। সামান্য এ জন্য যে, সিরাজুল
ইসলাম চৌধুরী আমাদের সমাজ-সাহিত্য-মনন জগতের বিকাশে এক অসামান্য নাম।
আগামী ২৩ জুন এই মানুষটির ৭৮তম জন্মদিন।
কথার শুরুতেই জানতে চেয়েছিলাম, জীবনের এ প্রান্তে এসে কী মনে হয়_ জীবনটা কেমন গেল? বললেন, 'জীবনটা খারাপ গেছে_ এমন মনে হয় না। তবে এ জীবন ছিল ঘটনাবহুল। অনেক উত্থান-পতন আর আন্দোলন-সংগ্রাম দেখতে হয়েছে এই এক জীবনে।' চোখের সামনে দিয়ে একে একে সমাজ-রাজনীতির নানা পট পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলছিলেন, 'ছোটবেলায় কিছুদিন রাজশাহীতে ছিলাম। এর পর বাবার চাকরিসূত্রে আমরা কলকাতায় থেকেছি কিছুদিন। তারপর ১৯৪৭-এ দেশভাগ হয়ে যাওয়ায় আমরা ঢাকায় চলে এলাম। সেই বয়সে কলকাতা, রাজশাহী আর ঢাকায় যাদের সাথে পরিচয় ঘটেছিল, যাদের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাদেরকে হারাতে হলো এই দেশভাগের কারণে। সবকিছুই কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমরা দেখছি, ওই যে আমরা পাকিস্তানের আওয়াজ তুলেছিলাম; সেটা তো আর আমাদের কাজে আসছে না। উল্টো আমাদের রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারছে যে, বাঙালিরা তো এখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে যাচ্ছে। এর পর ১৯৫২ সালে আইএ পরীক্ষা দেওয়ার সময় ভাষা আন্দোলন দারুণভাবে নাড়া দিল। চুয়ান্নর নির্বাচন হলো। ততদিনে মওলানা ভাসানী জেল থেকে চলে এসেছেন। তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছি। দ্রুতই যেন শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেল। এমএ পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে গেলাম। তারপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান গেল। মুক্তিযুদ্ধের সময় নানান জায়গায় আত্মগোপনে থাকতে হলো।'
পাকিস্তানিরা বাঙালি যেসব মানুষকে হত্যা-তালিকা তৈরি করেছিল, সেখানে তার নামও ছিল। এ তথ্য গোয়েন্দা দফতরে কর্মরত এক আত্মীয়ের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বলছিলেন, 'তা ছাড়া যুদ্ধ করার জন্য যে বিপুল প্রাণশক্তি প্রয়োজন, তা আমার ছিল না।'
জীবনের স্বপ্ন এবং তা পূরণ হয়েছে কতখানি_ জানতে চাইলাম। বললেন, 'সাহিত্যই আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল। ইচ্ছা ছিল সাহিত্যিক হব। সারাজীবন সাহিত্যের সাথে যুক্তও ছিলাম। নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডে বরাবরই জড়িত থাকতাম। কিন্তু তেমনভাবে আমি কখনোই সামাজিক মানুষ ছিলাম না। গল্প-উপন্যাস লেখার মতো সমাজের অনেক গভীর অভিজ্ঞতাই আমার ছিল না। ছেলেবেলা থেকেই বই পড়া ছিল আমার প্রধান কাজ। সময় কাটানোর প্রিয় বিষয় ছিল সাহিত্য। আমি বই পড়তাম, ভাবতাম। লেখক হবো_ এটা কৈশোর থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল। আমার ধারণা ছিল, আমি ছোটগল্প লিখব বা কথাসাহিত্যিক হবো। কিন্তু আমার এই ইংরেজি সাহিত্যে পড়া এবং পড়ানোটা আমার জন্য একদিক থেকে ক্ষতিকর হয়েছে। আমি আমার সৃষ্টিশীল লেখার ধারাকে আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি। সৃষ্টিশীলতার জন্য যে একটা সংশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি দরকার, সেটা আর থাকল না। বিশ্লেষণধর্মী হয়ে গেলাম। তখন জিনিসগুলোকে আমি বিশ্লেষণ করতে পারি, নির্মাণ করতে পারি না। আবার অত কল্পনার জোরও নেই, অভিজ্ঞতাও নেই। আমার বিচরণক্ষেত্রটা ছিল ছোট। তেমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারিনি। আরেকটা সমস্যা হলো_ অসন্তোষ। যে সাহিত্য আমি পড়ি বা পড়াই, তার তুলনায় নিজের রচনাকে অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয়। এটা আমাকে প্রবন্ধের দিকেই ঠেলে দিল। আমার ছোটগল্পের একটাই বই বেরিয়েছিল_ 'ভালো মানুষের জগৎ'।
বলছিলেন, 'আমার ভেতরে বোধ হয় একটা সাংবাদিক বাস করত। সমাজের নানা বিষয়-আশয় নিয়ে বলতে চাওয়া, লিখতে চাওয়ার আগ্রহ আমাকে কলাম লেখার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সে সময় থেকেই কেন জানি আমার সম্পাদক হওয়ার মোহ তৈরি হয়েছিল। সেই সম্পাদক হওয়ার মোহ থেকেই দৈনিক কাগজে লেখার একটা ইচ্ছা তৈরি হয়। দৈনিকে বেনামে লেখায় একটা মজা পেয়ে গিয়েছিলাম। এভাবেই শুরু। কিন্তু দিনে দিনে আমার সে লেখার মোহ সমাজ-রাজনৈতিক অসন্তোষের বিরুদ্ধে বলার মোহতে পরিণত হয়ে গেল। আমার সে বলা এখনও শেষ হয়নি। সম্পাদনার আগ্রহটা এখনও জীবিত আছে।'
জানতে চেয়েছিলাম ব্যক্তিগত জীবনে কোনো দুঃখ-বেদনা আক্রান্ত করে কিনা? বললেন, 'তিনটি মৃত্যুর ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে বেদনা দিয়েছে। বাবা মারা যান আমি যখন লেস্টারে পড়তে গেলাম। মাত্র কয়েক মাস হয়েছে আমি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। বাবাকে আর শেষ দেখা দেখতে পারিনি। এ বেদনা আমাকে ভুগিয়েছে অনেকদিন। স্ত্রীর মৃত্যুতে আমি গভীর এক ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। আর দু'বছর আগে মা মারা গেলেন। আমি এখনও বেঁচেই আছি।'
সাহিত্যের শিক্ষকতা করেছেন জীবনের অনেকটা সময়। সাহিত্যপ্রাণ মানুষ হিসেবে একবাক্যে এই মানুষটির নাম উচ্চারণ করা যায়। সে বিষয়ে তার চিন্তার কিছুটা শুনতে চাইলে বললেন, 'আমি শুরু করেছিলাম গল্প দিয়ে। আমার সেই ছোটগল্পগুলোতে সচেতনভাবে মতাদর্শগত বিষয়টি থাকত না। সাহিত্যিক এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনের বেদনা থাকলেও সচেতন মতাদর্শ তৈরি হতো না সেখানে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাহিত্য সম্বন্ধে আমার ধারণা বদলে গেল। এবং ক্রমাগত সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে আমি এই উপলব্ধিতে পেঁৗছেছি যে, কোনো সাহিত্যই মহৎ সাহিত্য হবে না, যদি তার ভেতরে একটা দার্শনিক অঙ্গীকার না থাকে। সে অঙ্গীকার কারওটা দক্ষিণপন্থি বা কারওটা অন্য পন্থি হতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে একটা মতাদর্শগত উপাদান, একটা অঙ্গীকার থাকা জরুরি। আমাদের সেই সময়ে, পঞ্চাশের শেষদিকে সাহিত্য পাঠ ছিল বিশ্লেষণমূলক। উপমার বিশ্লেষণ, শব্দের ব্যবহার-ব্যাখ্যাকে বিশ্লেষণ করাই ছিল সাহিত্য পাঠের ধারা। তবে এই ধারা ক্রমাগত স্তিমিত হয়ে দেখেছি নতুন একটা ধারা তৈরি হচ্ছে। তা হলো সাহিত্যের সমাজতাত্তি্বক বিশ্লেষণ। যেখানে সাহিত্যের পেছনে কোন সমাজ, সময়টা ছিল; লেখক সমাজের কোন শ্রেণী থেকে এসেছেন ইত্যাদি বিচারে সাহিত্যটির বিশ্লেষণ করা শুরু হলো। আবার এই বিশ্লেষণের বাইরে সাহিত্যের সৌন্দর্যও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে লাগল। একটি সাহিত্য কোন মতাদর্শগত জায়গা থেকে কীভাবে তৈরি হয়েছে, কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে এবং কেন রূপ নিয়েছে? এই যে সাহিত্যের সমাজতাত্তি্বক পাঠ_ এ পাঠের ওপরে আমার ধারণা তৈরি হতে লাগল যে, সাহিত্যের একটা ভেতরগত বস্তু থাকতে হবে। আরেকটি বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল। সেটি হলো, যে কোনো রচনার একটি উপসংহার থাকা প্রয়োজন। আমরা অনেক কথা বলছি, কিন্তু উপসংহার দিতে পারছি না_ এমন উপসংহারহীনতার প্রতি আমার চরম একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে। একটা সমাধান কিংবা সমাধানের ইঙ্গিত রচনায় থাকতে হবে। তবে সেটা স্থূলভাবে নয়; সাহিত্যিকভাবেই।'
বলছিলেন, 'কবিতা ভালো লাগত শৈশব থেকেই। বড় হয়ে ওঠার পর লিখতে ইচ্ছেও করত। কিন্তু ঐ যে, সাহিত্যের শিক্ষকতা! এটা নানাভাবে বাধা দিয়েছে আমার সৃজনশীলতায়। সাহিত্যের অপেক্ষাকৃত সৃষ্টিশীল মাধ্যমগুলোতে আমাকে মনোযোগ বসাতে দেয়নি আমার গভীর সাহিত্য পাঠ এবং পড়ানো। তা ছাড়া আমার কাছে মনে হতো, কবিতা লেখা খুব কঠিন। এর প্রথম কারণ হলো_ আমার ধারণা, আমি ছন্দ মিলাতে পারব না। দ্বিতীয় কারণটি হলো, কবিতা লেখার জন্য যে একটা গভীরতা দরকার, একটা সাধনা দরকার; তা আমার নেই। কবিতা হলো অনেক বেশি ভাবনা-গভীর হয়ে কম লেখা। আমার তো বেশি লেখার প্রতি ঝোঁক। তবে আমি মনে করি, কবিতার মধ্যে যে সঙ্গীতময়তা আছে, তা গদ্যে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু কবিতা লেখার সাহসই করিনি।'
অপূর্ণতা কিছু থেকে গেল কি এই জীবনে! এমন প্রশের উত্তরে বললেন, 'শিক্ষকতায় না এলে আমি হয়তো সাংবাদিক হতাম। আরেকটা ব্যাপার হলো, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি বোধ হয় আরও বেশি প্রভাবশালী হতে পারতাম, যদি আমি কথাসাহিত্যিক হতাম। কিন্তু কথাসাহিত্যের জন্য প্রয়োজনীয় গভীর অভিনিবেশ আমি দিতে পারিনি।'
জীবনের এ অংশে দাঁড়িয়ে কখনও নিজেকে নিঃসঙ্গ লাগে কিনা জানতে চাইলাম। বললেন, 'এ সময়ে অনেক বাবা-মায়ের সন্তানেরা দূরে চলে যায়। আমার দুই মেয়ে। তারা আমার কাছাকাছিই থাকে। একজন এ ভবনের নিচতলায় আরেকজন আমার সাথেই। আর প্রায় সময় আমি পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকি। তাই নিঃসঙ্গতা আমাকে পায় না।'
তার নিজের সম্পর্কে জানতে এসে ব্যক্তিগত নানান বিষয়ে শুনতে চেয়ে যে উত্তরগুলো পাওয়া গেল তাতে এটা স্পষ্ট হয়, যে কোনো বিষয়কেই তিনি সমাজের এক যৌথ সম্ভাবনার আলোকে দেখতে চান। বিষয়টি স্বীকারও করলেন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। বললেন, 'নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোও আমার মননে গেঁথে থাকে সমষ্টিগত ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়েই।' আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন ব্যক্তি হয়েও ব্যক্তির অধিক এক জীবন। হ
কথার শুরুতেই জানতে চেয়েছিলাম, জীবনের এ প্রান্তে এসে কী মনে হয়_ জীবনটা কেমন গেল? বললেন, 'জীবনটা খারাপ গেছে_ এমন মনে হয় না। তবে এ জীবন ছিল ঘটনাবহুল। অনেক উত্থান-পতন আর আন্দোলন-সংগ্রাম দেখতে হয়েছে এই এক জীবনে।' চোখের সামনে দিয়ে একে একে সমাজ-রাজনীতির নানা পট পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলছিলেন, 'ছোটবেলায় কিছুদিন রাজশাহীতে ছিলাম। এর পর বাবার চাকরিসূত্রে আমরা কলকাতায় থেকেছি কিছুদিন। তারপর ১৯৪৭-এ দেশভাগ হয়ে যাওয়ায় আমরা ঢাকায় চলে এলাম। সেই বয়সে কলকাতা, রাজশাহী আর ঢাকায় যাদের সাথে পরিচয় ঘটেছিল, যাদের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাদেরকে হারাতে হলো এই দেশভাগের কারণে। সবকিছুই কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমরা দেখছি, ওই যে আমরা পাকিস্তানের আওয়াজ তুলেছিলাম; সেটা তো আর আমাদের কাজে আসছে না। উল্টো আমাদের রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারছে যে, বাঙালিরা তো এখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে যাচ্ছে। এর পর ১৯৫২ সালে আইএ পরীক্ষা দেওয়ার সময় ভাষা আন্দোলন দারুণভাবে নাড়া দিল। চুয়ান্নর নির্বাচন হলো। ততদিনে মওলানা ভাসানী জেল থেকে চলে এসেছেন। তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছি। দ্রুতই যেন শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেল। এমএ পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে গেলাম। তারপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান গেল। মুক্তিযুদ্ধের সময় নানান জায়গায় আত্মগোপনে থাকতে হলো।'
পাকিস্তানিরা বাঙালি যেসব মানুষকে হত্যা-তালিকা তৈরি করেছিল, সেখানে তার নামও ছিল। এ তথ্য গোয়েন্দা দফতরে কর্মরত এক আত্মীয়ের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বলছিলেন, 'তা ছাড়া যুদ্ধ করার জন্য যে বিপুল প্রাণশক্তি প্রয়োজন, তা আমার ছিল না।'
জীবনের স্বপ্ন এবং তা পূরণ হয়েছে কতখানি_ জানতে চাইলাম। বললেন, 'সাহিত্যই আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল। ইচ্ছা ছিল সাহিত্যিক হব। সারাজীবন সাহিত্যের সাথে যুক্তও ছিলাম। নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডে বরাবরই জড়িত থাকতাম। কিন্তু তেমনভাবে আমি কখনোই সামাজিক মানুষ ছিলাম না। গল্প-উপন্যাস লেখার মতো সমাজের অনেক গভীর অভিজ্ঞতাই আমার ছিল না। ছেলেবেলা থেকেই বই পড়া ছিল আমার প্রধান কাজ। সময় কাটানোর প্রিয় বিষয় ছিল সাহিত্য। আমি বই পড়তাম, ভাবতাম। লেখক হবো_ এটা কৈশোর থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল। আমার ধারণা ছিল, আমি ছোটগল্প লিখব বা কথাসাহিত্যিক হবো। কিন্তু আমার এই ইংরেজি সাহিত্যে পড়া এবং পড়ানোটা আমার জন্য একদিক থেকে ক্ষতিকর হয়েছে। আমি আমার সৃষ্টিশীল লেখার ধারাকে আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি। সৃষ্টিশীলতার জন্য যে একটা সংশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি দরকার, সেটা আর থাকল না। বিশ্লেষণধর্মী হয়ে গেলাম। তখন জিনিসগুলোকে আমি বিশ্লেষণ করতে পারি, নির্মাণ করতে পারি না। আবার অত কল্পনার জোরও নেই, অভিজ্ঞতাও নেই। আমার বিচরণক্ষেত্রটা ছিল ছোট। তেমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারিনি। আরেকটা সমস্যা হলো_ অসন্তোষ। যে সাহিত্য আমি পড়ি বা পড়াই, তার তুলনায় নিজের রচনাকে অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয়। এটা আমাকে প্রবন্ধের দিকেই ঠেলে দিল। আমার ছোটগল্পের একটাই বই বেরিয়েছিল_ 'ভালো মানুষের জগৎ'।
বলছিলেন, 'আমার ভেতরে বোধ হয় একটা সাংবাদিক বাস করত। সমাজের নানা বিষয়-আশয় নিয়ে বলতে চাওয়া, লিখতে চাওয়ার আগ্রহ আমাকে কলাম লেখার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সে সময় থেকেই কেন জানি আমার সম্পাদক হওয়ার মোহ তৈরি হয়েছিল। সেই সম্পাদক হওয়ার মোহ থেকেই দৈনিক কাগজে লেখার একটা ইচ্ছা তৈরি হয়। দৈনিকে বেনামে লেখায় একটা মজা পেয়ে গিয়েছিলাম। এভাবেই শুরু। কিন্তু দিনে দিনে আমার সে লেখার মোহ সমাজ-রাজনৈতিক অসন্তোষের বিরুদ্ধে বলার মোহতে পরিণত হয়ে গেল। আমার সে বলা এখনও শেষ হয়নি। সম্পাদনার আগ্রহটা এখনও জীবিত আছে।'
জানতে চেয়েছিলাম ব্যক্তিগত জীবনে কোনো দুঃখ-বেদনা আক্রান্ত করে কিনা? বললেন, 'তিনটি মৃত্যুর ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে বেদনা দিয়েছে। বাবা মারা যান আমি যখন লেস্টারে পড়তে গেলাম। মাত্র কয়েক মাস হয়েছে আমি সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। বাবাকে আর শেষ দেখা দেখতে পারিনি। এ বেদনা আমাকে ভুগিয়েছে অনেকদিন। স্ত্রীর মৃত্যুতে আমি গভীর এক ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। আর দু'বছর আগে মা মারা গেলেন। আমি এখনও বেঁচেই আছি।'
সাহিত্যের শিক্ষকতা করেছেন জীবনের অনেকটা সময়। সাহিত্যপ্রাণ মানুষ হিসেবে একবাক্যে এই মানুষটির নাম উচ্চারণ করা যায়। সে বিষয়ে তার চিন্তার কিছুটা শুনতে চাইলে বললেন, 'আমি শুরু করেছিলাম গল্প দিয়ে। আমার সেই ছোটগল্পগুলোতে সচেতনভাবে মতাদর্শগত বিষয়টি থাকত না। সাহিত্যিক এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনের বেদনা থাকলেও সচেতন মতাদর্শ তৈরি হতো না সেখানে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সাহিত্য সম্বন্ধে আমার ধারণা বদলে গেল। এবং ক্রমাগত সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে আমি এই উপলব্ধিতে পেঁৗছেছি যে, কোনো সাহিত্যই মহৎ সাহিত্য হবে না, যদি তার ভেতরে একটা দার্শনিক অঙ্গীকার না থাকে। সে অঙ্গীকার কারওটা দক্ষিণপন্থি বা কারওটা অন্য পন্থি হতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে একটা মতাদর্শগত উপাদান, একটা অঙ্গীকার থাকা জরুরি। আমাদের সেই সময়ে, পঞ্চাশের শেষদিকে সাহিত্য পাঠ ছিল বিশ্লেষণমূলক। উপমার বিশ্লেষণ, শব্দের ব্যবহার-ব্যাখ্যাকে বিশ্লেষণ করাই ছিল সাহিত্য পাঠের ধারা। তবে এই ধারা ক্রমাগত স্তিমিত হয়ে দেখেছি নতুন একটা ধারা তৈরি হচ্ছে। তা হলো সাহিত্যের সমাজতাত্তি্বক বিশ্লেষণ। যেখানে সাহিত্যের পেছনে কোন সমাজ, সময়টা ছিল; লেখক সমাজের কোন শ্রেণী থেকে এসেছেন ইত্যাদি বিচারে সাহিত্যটির বিশ্লেষণ করা শুরু হলো। আবার এই বিশ্লেষণের বাইরে সাহিত্যের সৌন্দর্যও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে লাগল। একটি সাহিত্য কোন মতাদর্শগত জায়গা থেকে কীভাবে তৈরি হয়েছে, কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে এবং কেন রূপ নিয়েছে? এই যে সাহিত্যের সমাজতাত্তি্বক পাঠ_ এ পাঠের ওপরে আমার ধারণা তৈরি হতে লাগল যে, সাহিত্যের একটা ভেতরগত বস্তু থাকতে হবে। আরেকটি বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল। সেটি হলো, যে কোনো রচনার একটি উপসংহার থাকা প্রয়োজন। আমরা অনেক কথা বলছি, কিন্তু উপসংহার দিতে পারছি না_ এমন উপসংহারহীনতার প্রতি আমার চরম একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে। একটা সমাধান কিংবা সমাধানের ইঙ্গিত রচনায় থাকতে হবে। তবে সেটা স্থূলভাবে নয়; সাহিত্যিকভাবেই।'
বলছিলেন, 'কবিতা ভালো লাগত শৈশব থেকেই। বড় হয়ে ওঠার পর লিখতে ইচ্ছেও করত। কিন্তু ঐ যে, সাহিত্যের শিক্ষকতা! এটা নানাভাবে বাধা দিয়েছে আমার সৃজনশীলতায়। সাহিত্যের অপেক্ষাকৃত সৃষ্টিশীল মাধ্যমগুলোতে আমাকে মনোযোগ বসাতে দেয়নি আমার গভীর সাহিত্য পাঠ এবং পড়ানো। তা ছাড়া আমার কাছে মনে হতো, কবিতা লেখা খুব কঠিন। এর প্রথম কারণ হলো_ আমার ধারণা, আমি ছন্দ মিলাতে পারব না। দ্বিতীয় কারণটি হলো, কবিতা লেখার জন্য যে একটা গভীরতা দরকার, একটা সাধনা দরকার; তা আমার নেই। কবিতা হলো অনেক বেশি ভাবনা-গভীর হয়ে কম লেখা। আমার তো বেশি লেখার প্রতি ঝোঁক। তবে আমি মনে করি, কবিতার মধ্যে যে সঙ্গীতময়তা আছে, তা গদ্যে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু কবিতা লেখার সাহসই করিনি।'
অপূর্ণতা কিছু থেকে গেল কি এই জীবনে! এমন প্রশের উত্তরে বললেন, 'শিক্ষকতায় না এলে আমি হয়তো সাংবাদিক হতাম। আরেকটা ব্যাপার হলো, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি বোধ হয় আরও বেশি প্রভাবশালী হতে পারতাম, যদি আমি কথাসাহিত্যিক হতাম। কিন্তু কথাসাহিত্যের জন্য প্রয়োজনীয় গভীর অভিনিবেশ আমি দিতে পারিনি।'
জীবনের এ অংশে দাঁড়িয়ে কখনও নিজেকে নিঃসঙ্গ লাগে কিনা জানতে চাইলাম। বললেন, 'এ সময়ে অনেক বাবা-মায়ের সন্তানেরা দূরে চলে যায়। আমার দুই মেয়ে। তারা আমার কাছাকাছিই থাকে। একজন এ ভবনের নিচতলায় আরেকজন আমার সাথেই। আর প্রায় সময় আমি পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকি। তাই নিঃসঙ্গতা আমাকে পায় না।'
তার নিজের সম্পর্কে জানতে এসে ব্যক্তিগত নানান বিষয়ে শুনতে চেয়ে যে উত্তরগুলো পাওয়া গেল তাতে এটা স্পষ্ট হয়, যে কোনো বিষয়কেই তিনি সমাজের এক যৌথ সম্ভাবনার আলোকে দেখতে চান। বিষয়টি স্বীকারও করলেন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। বললেন, 'নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোও আমার মননে গেঁথে থাকে সমষ্টিগত ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়েই।' আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন ব্যক্তি হয়েও ব্যক্তির অধিক এক জীবন। হ
No comments