ক্ষমতার লালন আর বিরোধীর দমনে দুদক by আশরাফ-উল-আলম
আইনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সম্পূর্ণ
স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে এবং
সুনির্দিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনার লক্ষ্যে একটি স্বাধীন
দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠায় ২০০৪ সালে 'দুর্নীতি দমন কমিশন আইন' প্রণীত
হয়।
কিন্তু এখন পর্যন্ত দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান
হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। উল্টো এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই
পক্ষপাতিত্বসহ দুর্নীতির তদন্ত পরিচালনায় নানা রকম দুর্বলতার অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষমতাসীনদের নানা রকম প্রভাব ও চাপের কারণে
বয়স বাড়লেও সঠিকভাবে হাঁটাচলা শিখে উঠতে পারেনি দুদক।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সংকল্প থেকে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠার পর থেকে সব সরকারই এটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। সরকার যেভাবে নাচায়, দুদকও সেভাবে নাচে বলে অভিযোগ রয়েছে; যদিও দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কখনো কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেনি দুদক। নিরপেক্ষতার সঙ্গেই দুর্নীতির তদন্ত করা হয়।' তবে তাঁর এ মন্তব্যের সঙ্গে আগের দিনের বক্তব্যের কিছু অমিল লক্ষ করা যায়। গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্যে দুদকের অসহায়ত্বের বিষয়টিই যেন নানাভাবে ফুটে ওঠে। সেখানে তিনি বলেন, নিজের মেয়াদকালে দুর্নীতির অভিযোগে যদি এক-দেড় শ ব্যক্তির সাজা খাটা দেখতেন, তাহলে তিনি খুশি হতেন। তাঁর কথায় প্রচ্ছন্নভাবে এমন ইঙ্গিত মিলেছে যে তিনি তাঁর পক্ষে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো যথেষ্ট সংখ্যক দুর্নীতির শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেননি। তিনি আরো বলেন, আইন সংশোধন না হলে দুদক নখ-দন্তহীন বাঘই থেকে যাবে।
কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর দুদকের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কেউ কেউ পরিহাস করে বলেন, দুদক স্বাধীন, শুধু এর রিমোট কন্ট্রোলটি থাকে ক্ষমতাসীনদের হাতে।
দুদক আইন যখন প্রণীত হয় তখন বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু ওই সরকারের আমলে সরকারি দলের কারো বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হয়নি। মূলত ওই সময়ে দুদক ছিল কেবলই নামসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠান। প্রকৃতপক্ষে তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না তাদের। এ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার আগে দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করত দুর্নীতি দমন ব্যুরো। তখনো তাদের একই ধারায় কাজ করতে দেখা গেছে। বিএনপি সরকারের সময় আগের আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি বা ওই আমলের আমলাদের বিরুদ্ধে মামলা করা ছাড়া আর কোনো বিষয়ে ব্যুরোর সক্রিয়তা দেখা যায়নি। ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগের সময় বিএনপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ঘাঁটাঘাঁটি করে বেড়ানোই ছিল ব্যুরোর প্রধান কাজ। অর্থাৎ যখন যে সরকার, ব্যুরো থেকে শুরু করে দুদক পর্যন্ত সবাইকে তাদেরই পরোক্ষ আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হচ্ছে।
ব্যুরোকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তরের লক্ষ্যে দুদক গঠিত হয় জোট সরকারের আমলে। বাস্তবে শুরু থেকেই স্থবির প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেবল অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে এটি। ২০০৭ সালে এক-এগারোর সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দুদককে শক্তিশালী করা হয়। ওই বছর দুদক আইনও সংশোধন করা হয়। দুদককে দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাসহ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করা হয়। দুদক কয়েক শ মামলা করে ওই সময়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করা হয়। ওই সময় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির বিষয়ও দুদক নিয়মিতভাবে প্রচারযন্ত্রে প্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু তখনো দুদক সরকারের ইশারাতেই চলেছে বলে অভিযোগ ওঠে। রাজনীতিতে 'মাইনাস টু' ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতিয়ার হিসেবে দুদকও কাজ করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে। কারণ তখন যেসব রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন বা সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেনি দুদক। এমনকি তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা অনুসন্ধানও হয়নি। দু-একজনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তার তদন্ত এগোয়নি।
বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবে তার ছাপ পাওয়া যায়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে বর্তমানে বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত ও অনুসন্ধান অব্যাহত থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির যেসব অভিযোগ দুদকে ছিল, তার তদন্ত বা অনুসন্ধান থেমে যায়। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগ থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। দুদক থেকে বলা হয়, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ২০০১ সালে আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের প্রশ্নপত্র মুদ্রণে ৯৪ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলা থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও চার সরকারি কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয় গত ৫ জুন। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও চার সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্প ২০০১-এর (ওএমআর ফরম) প্রশ্নপত্র মুদ্রণে অনিয়মের অভিযোগে মামলাটি করে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ মামলায় আসামি আওয়ামী লীগের আগের আমলের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবেক সচিব ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক সৈয়দ তানভীর হোসেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাবেক যুগ্ম পরিচালক এস এম তাজুল ইসলাম, এলিট প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মহসিন আলী প্রামাণিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরসাদ আলী। তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়। অথচ বর্তমান সরকারের আমলে বিরোধী দলের নেতা মওদুদ আহমদ, জমির উদ্দিন সরকার, সাদেক হোসেন খোকা, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এহছানুল হক মিলনসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে শেয়ারবাজারে ধস, শেয়ারবাজারের অর্থপাচারের বিভিন্ন তথ্য উদ্ঘাটিত হয়। এ সময় সরকারদলীয় বা সরকার সমর্থক ব্যবসায়ীরা জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। দুদক বিষয়টি তদন্ত করবে বলেও বলা হয়। কিন্তু প্রভাবশালী সরকারদলীয় ব্যক্তিরা শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার কারণে বিষয়টি নিয়ে দুদক আর বেশি অগ্রসর হয়নি- এমন অভিযোগ রয়েছে। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের ঘটনায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম এলেও এ-সংক্রান্ত মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, সরকারে প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন বলে তিনি রেহাই পেয়ে গেছেন। এমনকি এ নিয়ে মামলার তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই।
সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর এপিএস ওমর ফারুকের ৭০ লাখ টাকাসহ আটক হওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনায় তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। এ ঘটনা তদন্ত করে দুদক। সুরঞ্জিতকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। তবে সুরঞ্জিত দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়ে যান।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হলমার্ক কর্তৃক দুর্নীতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়টি সম্প্রতি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। কিন্তু এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত সরকারদলীয় নেতাদের রক্ষায় এটির তদন্তেও এখন ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ডেসটিনি গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি বিষয়ে দুদক মামলা করলেও এসব ঘটনারও তদন্ত এগোচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, সরকারদলীয় প্রভাবশালী লোকজন তাদের সঙ্গে জড়িত থাকায় তদন্তে অগ্রগতি নেই।
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনো দলীয় দৃষ্টিকোণ দুদকের নেই। দুর্নীতির অভিযোগ পেলেই আমরা তদন্ত করেছি। কে বিএনপি, কে আওয়ামী লীগের লোক- এটা আমরা দেখি না।' তাহলে সরকারদলীয় নেতাদের মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়, বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়- এমন কেন হয়? এ প্রশ্নে গোলাম রহমান বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করে যা পান তা-ই তদন্ত প্রতিবেদনে স্থান পায়। প্রভাবিত হয়ে কিছু করে না দুদক।
বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, 'দুদকের ক্ষমতা সরকার কেড়ে নিচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তদন্ত হয়, অনুসন্ধান হয়। পরে অভিযোগপত্রও দাখিল হয়। কিন্তু সরকারদলীয় ব্যক্তিদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এখন দুদককে স্বাধীন বলবেন কিভাবে।'
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, দুদক স্বাধীন হতে পারেনি এখনো। এটিকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার জন্য আরো আইনি সংস্কার করা প্রয়োজন। তবে আইন যা আছে, সেখানে হস্তক্ষেপ না থাকলে দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। আর দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য এ প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন রাখা উচিত।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সংকল্প থেকে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠার পর থেকে সব সরকারই এটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। সরকার যেভাবে নাচায়, দুদকও সেভাবে নাচে বলে অভিযোগ রয়েছে; যদিও দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কখনো কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেনি দুদক। নিরপেক্ষতার সঙ্গেই দুর্নীতির তদন্ত করা হয়।' তবে তাঁর এ মন্তব্যের সঙ্গে আগের দিনের বক্তব্যের কিছু অমিল লক্ষ করা যায়। গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্যে দুদকের অসহায়ত্বের বিষয়টিই যেন নানাভাবে ফুটে ওঠে। সেখানে তিনি বলেন, নিজের মেয়াদকালে দুর্নীতির অভিযোগে যদি এক-দেড় শ ব্যক্তির সাজা খাটা দেখতেন, তাহলে তিনি খুশি হতেন। তাঁর কথায় প্রচ্ছন্নভাবে এমন ইঙ্গিত মিলেছে যে তিনি তাঁর পক্ষে সন্তুষ্ট হওয়ার মতো যথেষ্ট সংখ্যক দুর্নীতির শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেননি। তিনি আরো বলেন, আইন সংশোধন না হলে দুদক নখ-দন্তহীন বাঘই থেকে যাবে।
কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর দুদকের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কেউ কেউ পরিহাস করে বলেন, দুদক স্বাধীন, শুধু এর রিমোট কন্ট্রোলটি থাকে ক্ষমতাসীনদের হাতে।
দুদক আইন যখন প্রণীত হয় তখন বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু ওই সরকারের আমলে সরকারি দলের কারো বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত হয়নি। মূলত ওই সময়ে দুদক ছিল কেবলই নামসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠান। প্রকৃতপক্ষে তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না তাদের। এ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার আগে দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করত দুর্নীতি দমন ব্যুরো। তখনো তাদের একই ধারায় কাজ করতে দেখা গেছে। বিএনপি সরকারের সময় আগের আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি বা ওই আমলের আমলাদের বিরুদ্ধে মামলা করা ছাড়া আর কোনো বিষয়ে ব্যুরোর সক্রিয়তা দেখা যায়নি। ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগের সময় বিএনপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ঘাঁটাঘাঁটি করে বেড়ানোই ছিল ব্যুরোর প্রধান কাজ। অর্থাৎ যখন যে সরকার, ব্যুরো থেকে শুরু করে দুদক পর্যন্ত সবাইকে তাদেরই পরোক্ষ আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হচ্ছে।
ব্যুরোকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপান্তরের লক্ষ্যে দুদক গঠিত হয় জোট সরকারের আমলে। বাস্তবে শুরু থেকেই স্থবির প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেবল অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছে এটি। ২০০৭ সালে এক-এগারোর সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দুদককে শক্তিশালী করা হয়। ওই বছর দুদক আইনও সংশোধন করা হয়। দুদককে দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাসহ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করা হয়। দুদক কয়েক শ মামলা করে ওই সময়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করা হয়। ওই সময় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির বিষয়ও দুদক নিয়মিতভাবে প্রচারযন্ত্রে প্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু তখনো দুদক সরকারের ইশারাতেই চলেছে বলে অভিযোগ ওঠে। রাজনীতিতে 'মাইনাস টু' ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতিয়ার হিসেবে দুদকও কাজ করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে। কারণ তখন যেসব রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন বা সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেনি দুদক। এমনকি তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা অনুসন্ধানও হয়নি। দু-একজনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তার তদন্ত এগোয়নি।
বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবে তার ছাপ পাওয়া যায়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে বর্তমানে বিরোধী দলের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত ও অনুসন্ধান অব্যাহত থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির যেসব অভিযোগ দুদকে ছিল, তার তদন্ত বা অনুসন্ধান থেমে যায়। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগ থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। দুদক থেকে বলা হয়, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ২০০১ সালে আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের প্রশ্নপত্র মুদ্রণে ৯৪ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলা থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও চার সরকারি কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয় গত ৫ জুন। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও চার সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্প ২০০১-এর (ওএমআর ফরম) প্রশ্নপত্র মুদ্রণে অনিয়মের অভিযোগে মামলাটি করে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ মামলায় আসামি আওয়ামী লীগের আগের আমলের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবেক সচিব ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক সৈয়দ তানভীর হোসেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাবেক যুগ্ম পরিচালক এস এম তাজুল ইসলাম, এলিট প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মহসিন আলী প্রামাণিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরসাদ আলী। তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়। অথচ বর্তমান সরকারের আমলে বিরোধী দলের নেতা মওদুদ আহমদ, জমির উদ্দিন সরকার, সাদেক হোসেন খোকা, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এহছানুল হক মিলনসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বর্তমান সরকারের আমলে শেয়ারবাজারে ধস, শেয়ারবাজারের অর্থপাচারের বিভিন্ন তথ্য উদ্ঘাটিত হয়। এ সময় সরকারদলীয় বা সরকার সমর্থক ব্যবসায়ীরা জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। দুদক বিষয়টি তদন্ত করবে বলেও বলা হয়। কিন্তু প্রভাবশালী সরকারদলীয় ব্যক্তিরা শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার কারণে বিষয়টি নিয়ে দুদক আর বেশি অগ্রসর হয়নি- এমন অভিযোগ রয়েছে। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের ঘটনায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম এলেও এ-সংক্রান্ত মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, সরকারে প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন বলে তিনি রেহাই পেয়ে গেছেন। এমনকি এ নিয়ে মামলার তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই।
সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর এপিএস ওমর ফারুকের ৭০ লাখ টাকাসহ আটক হওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনায় তাঁকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। এ ঘটনা তদন্ত করে দুদক। সুরঞ্জিতকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। তবে সুরঞ্জিত দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়ে যান।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হলমার্ক কর্তৃক দুর্নীতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়টি সম্প্রতি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। কিন্তু এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত সরকারদলীয় নেতাদের রক্ষায় এটির তদন্তেও এখন ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ডেসটিনি গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি বিষয়ে দুদক মামলা করলেও এসব ঘটনারও তদন্ত এগোচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, সরকারদলীয় প্রভাবশালী লোকজন তাদের সঙ্গে জড়িত থাকায় তদন্তে অগ্রগতি নেই।
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনো দলীয় দৃষ্টিকোণ দুদকের নেই। দুর্নীতির অভিযোগ পেলেই আমরা তদন্ত করেছি। কে বিএনপি, কে আওয়ামী লীগের লোক- এটা আমরা দেখি না।' তাহলে সরকারদলীয় নেতাদের মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়, বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়- এমন কেন হয়? এ প্রশ্নে গোলাম রহমান বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করে যা পান তা-ই তদন্ত প্রতিবেদনে স্থান পায়। প্রভাবিত হয়ে কিছু করে না দুদক।
বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, 'দুদকের ক্ষমতা সরকার কেড়ে নিচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তদন্ত হয়, অনুসন্ধান হয়। পরে অভিযোগপত্রও দাখিল হয়। কিন্তু সরকারদলীয় ব্যক্তিদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এখন দুদককে স্বাধীন বলবেন কিভাবে।'
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, দুদক স্বাধীন হতে পারেনি এখনো। এটিকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার জন্য আরো আইনি সংস্কার করা প্রয়োজন। তবে আইন যা আছে, সেখানে হস্তক্ষেপ না থাকলে দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। আর দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য এ প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন রাখা উচিত।
No comments